আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩২

0
1795

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩২
———————————————–
আমি অতি দ্রুত হাটতে লাগলাম। কোথায় বা কোন দিকে হাটছি সে দিকে আমার হুশ নেই। শুধু চলে যেতে হবে সেটায় জপছি। কানের মধ্যে একটানা ঝিঁ ঝিঁ শব্দ করছে। মাথা টা ভন ভন করছে।
হঠাৎ করে পিছন থেকে কেউ প্রচন্ড জোরে আমার হাত টেনে ধরলো। আমি ভীষন ব্যাথা পেলাম। তাকিয়ে দেখতেই লিও হাঁপাচ্ছে। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সে হড় বড় করে বলা শুরু করলো
“মি-মিইইরা যদি মজা করে এসব বলে থাকো তাহলে এটা খুব খারাপ জোকস মনে রাখো। আমাকে নিয়ে যদি তোমার কোনো সমস্যা থাকে বা কোনো দোষ করি আমাকে মারো, পুলিশে দাও কিন্তু প্লিজ এমন টা করো না। আমাকে রিজেক্ট করো না। আমি ক্রিশ্চিয়ান তুমি অন্য রিলিওজনের এরকম ফানি এক্সকিউজ আমাকে দিও না। আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো। কি সমস্যা আমাকে বল। আমি সব ঠিক করে দিব। কিন্তু এভাবে যেতে দিব না।”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। ঠিক এমন একটা কিছুর ভয় পাচ্ছিলাম।
ক্যামেলিয়া ফুল গুলো ছিন্ন ভিন্ন অবস্থায় পিছনে রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে। ঠিক যেমন টি লিওর কপালের চুল গুলো ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে।
আমি লিওর হাত ধরে আস্তে করে নিজেকে ছাড়ালাম। তারপর বললাম
“লি-লিও আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু। আর বন্ধুত্বের মধ্যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ কোনো বিষয় থাকে না। কিন্তু বিয়ে নামক বিষয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ অনেক কিছুই নির্ভর করে। অনেক কিছুই চেপে বসে।”
“কি বলতে চাইছো তুমি?”
“লিও আমি বলতে চাইছি যে আমাদের ধর্ম কখনো এ সম্পর্কে স্বীকৃত দিবে না। আর যে সম্পর্কে স্বীকৃত দিবে না সে সম্পর্কে জড়িয়ে লাভ কি? কষ্ট ছাড়া কি পাবো?”
“মিইইইরা এখানে অহরহ এরকম হচ্ছে। এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের মানুষের বিয়ে হচ্ছে। যেখানে হোমো সেক্সুয়ালিটি পর্যন্ত লিগ্যাল হয়ে যাচ্ছে সেখানে ধর্ম খুব ক্ষুদ্র বিষয়। এটা খুব লেইম এক্সকিউজ মিইইরা।”
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে লিওর দিকে তাকালাম। তারপর ধীরে ধীরে বললাম
“লিও এটা তোমার দেশ। কিন্তু আমার না। আমি কয়েক বছরের মেহমান মাত্র। এরপর আমার দেশে চলে যাবো। যেখানে হোমো সেক্সুয়ালিটি অনেক অনেক দূরের কথা। সামান্য ধনী গরিবের বিয়েও খুব ঝামেলার মধ্যে হয়!”
লিও নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আমার দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি আবারো বললাম
“লিও আ-আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। যেদিন পালিয়ে এসেছি সেদিন আমার বিয়ে ছিলো। বুঝতে পারো তুমি এটা? উচ্চশিক্ষা নেওয়া আমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার বাবার মর্জি ছিল না। যেখানে শিক্ষার মত বিষয় টুকু আমাকে পালিয়ে করতে হচ্ছে সেখানে আমার প্রেম কতটুকু গুরুত্ব পাবে লিও? তাও এক ক্রিশ্চিয়ান ছেলের সাথে? তারা কি মেনে নিবে?”
লিও ভাষা হারিয়ে ফেলল। অনেকক্ষণ পর আমার হাত আলতো করে স্পর্শ করে নরম গলায় বলল
“তুমি আর বাংলাদেশে ফিরে যেওনা। এখানে থেকে যাও। আমার সাথে। আমি সব ব্যবস্থা করবো। ছোট্ট করে ঘর বানাবো, তুমি আমি দুজনে জব করবো, আমাদের একটা ছোট্ট বেবি গার্ল হবে!”
লিওর চোখ চক চক করে উঠল। আমি কথা শুনে নিঃশব্দে হাসলাম। দুই দিকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রচন্ড ভাবে হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। শুধু ব্যাথা টা অনুভব হচ্ছে। লিওর হাতের উপর হাত রাখলাম। বললাম
“এমন টা তো হয় না লিও। কখনো হওয়ার না। আমাকে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে। যেখান থেকে এসেছি, সেখানেই ফিরে যেতে হবে।”
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক পা পিছু হটলাম। তারপর পিছু ফিরে হাটা শুরু করলাম। দু হাতে চোখে পানি গাল বেয়ে পড়ার আগে মুছে নিলাম। নাকটা জ্বলছে ভীষন। কেন যে বুকের মধ্যে এত ব্যাথা হচ্ছে বুঝতে পারছি না। নিঃশ্বাস নিতেও প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে আমার। কি যেন নেই, কি যেন হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি।
দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম সুক্ষ ব্যাথার অনুভুতি টা সহ্য করার জন্য। মনে হচ্ছে জাত-পাতপাত, ধর্ম-বর্ণ সব চুলায় ঢুকিয়ে দিয়ে আবার পিছন ফিরে লিও কে জড়িয়ে ধরি। বলি
“লিও তুমি কি জানো আমার কত কষ্ট হচ্ছে? প্রচন্ড জ্বলছে এখান টাতে! আমি কি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি? আমার কি হবে লিও! আমার কি হবে?”
.
এক টুকরো ভাঙা হৃদয় নিয়ে হোস্টেলে প্রবেশ করলাম। হোস্টেলে যে বিরাট একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল ছিলো না। শুধু নিজের টুকরো টুকরো হওয়া হৃদয় নিয়ে ধপাস করে বিছানায় পড়লাম। উঠলাম না সেখান থেকে। সবাই কানের কাছে এসে হড় বড় করে অনেক কিছুই বলল। কিন্তু কিছুই মাথায় ঢুকলো না। বিষন্নতা ঘিরে ধরলো আমাকে। এমন ভাবে অবশ হলাম যে সারাদিন শক্তি কুলালো না বিছানা থেকে উঠার। রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর চলে এলো। জ্বরের ঘোরে মনে হচ্ছিল আমি নিজের ঘরে নিজের বিছানায় আছি। হাতরিয়ে হাতরিয়ে শুধু আমার মা কে খুজেছি। সকালে জ্বর কিছুটা কমে এলো। কিন্তু উপোস থাকায় একদম দুর্বল ছিলাম। এডালিন, রিচা, লুনা আর রাঘব আমাকে দেখতে এসেছিল। কিন্তু মনে মনে আমি এদের মাঝে লিও কে খুজছিলাম। না পেয়ে হতাশ হলাম।
হোস্টেল পরিচারিকা মিসেস মারিয়া আমার জন্য ডাক্তার নিয়ে এলেন। বিভিন্ন চেক আপ শেষে উনি এক গাদা ঔষুধ দিলেন। আর বললেন বেড রেস্ট নিতে।
এমনিতেও আমি বেড থেকে নামি নি। যদি মিসেস মারিয়া আর ইভিলিন না থাকতো তাহলে কেউই জোর করে আমাকে কিছু খাওয়াতে পারতো না। ইভিলিন তার প্রয়োজনে বাইরে চলে গেলেও মিসেস মারিয়া আমার খেয়াল রাখতেন। এতটা যত্ন করতেন যে আমার মনেই হত না যে আমি হোস্টেলে আছি।
.
সুস্থ হলাম বেশ কয়েকদিন পর। তখন হোস্টেল হাঙ্গামার কথা শুনলাম লারার কাছে। সে বেশ ঘটা করেই বলল
“জানো টামিনা ওইদিন গার্ড দুইজন বলল তাদেরকে নাকি কালো মুখোশধারী কয়েকজন বেহুশ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল। অপর গার্ড দেখে ফেলায় তাকেও বেহুশ করা হয়। না হলে গার্ড রা বুঝতেই পারত না যে হোস্টেলে আততায়ী ঢুকছে। সিসি টিভি ক্যামেরা চেক করেও কিছু পাওয়া যায় নি। কারন ওটাও অফ ছিল। কি সাংঘাতিক ব্যাপার বলতে পারো টামিনা! গার্ডের চেঁচামেচিতে সকালে ফিল্ডে যাওয়া বাদ দিয়ে সবাই ওখানে গিয়েছিলো। পুলিশ কে ও খবর দেয়া হয়েছিল”
আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে কফি পান করছিলাম। লারার কথা শুনে কফি নাকে উঠে গেল। কোনোমতে সামলে জিজ্ঞেস করলাম
“তারপর?”
“তারপর আর কি! আমরা এখনো জানতেই পারিনি কি হয়েছে। হোস্টেল কতৃপক্ষের সাথে পুলিশের কথা বার্তা হয়েছে। এরপর সিকিউরিটি আরো বাড়ানো হয়েছে।”
“ওহ্!”
“তুমি মনে হয় ফিল্ডে চলে গিয়েছিলে তাই জানো না।”
“হ্যা চলে গিয়েছিলাম।”
মনে মনে মিথ্যা টুকু বলে জিবে কামড় খেলাম। লারা বলল
“একটা ব্যাপার আমার মাথায় আসছেনা।”
কফির মগে চুমুক দিয়ে বললাম
“কি?”
“যদি আততায়ী এসেও থাকে তাহলে কেন আসলো? কিছুই তো হয় নি শুধু গার্ড বেহুশ হওয়া ছাড়া? তাহলে কি তারা গার্ল হোস্টেল পরিভ্রমনে এসেছিল? নাকি কেউ তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে এসেছিল?”
আমি আতঙ্কিত চোখে লারার দিকে তাকালাম। তারপর ইতস্থত গলায় বললাম
“হতেও পারে!”
.
মোটামুটি খানিকটা সুস্থ হয়ে ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করলাম। সবার সাথে দেখা হলো। শুধু লিও ছাড়া। ক্লাস ও করছি ঠিক মত। কিন্তু পাশের সিট টা খালি। যে প্লাইউডের টেবিলের লিওর কাছে টিউশন নিতাম সেখানে টেবিল টা খা খা করছে। হতাশ হয়ে লিওর চেয়ার টাতে বসলাম। মিস করছি তাকে প্রচন্ড ভাবে মিস করছি। আশ পাশ ভীষন শূণ্য শূণ্য মনে হচ্ছে। কি যেন নেই। কোথায় যেন সব হারিয়ে ফেলেছি।
.
মার্থা হাউজে পৌছে কয়েকদিন গ্যাপ যাওয়ায় মিস মার্থা নামক জলন্ত অগ্নিকুণ্ডে জ্বলতে হল। অসুখ ছিল বলে কোনো মতে পার পেলাম। তবে শর্ত হল ডাক্তার প্রেসক্রিপশন দেখাতে হবে। না হলে কাল থেকে কাজে আসা বন্ধ। আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
অর্ডার নিতে গিয়ে অন্যমনষ্ক ভাবে হেটে আসছিলাম তখন আনার সাথে হালকা ধাক্কা লাগলো। ধাক্কাতে আমি স্যরি বললেও খানিক টা মনোমালিন্য হল। তাতে আনা আমাকে You f***ing b**ch বলে গালি দিয়ে বসলো। শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ঠাস করে আনা কে থাপ্পড় মেরে বসলাম। থাপ্পড় খেয়ে আনা ফ্লোরে পড়েছিল। আর ঝামেলা করে নি। কিন্তু মিস মার্থা কে আমার নামে বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে অভিযোগ করলো। ফলাফল মার্থা হাউজে আমার কাজ করা আরো কঠিন হয়ে পড়লো। প্রবাদ আছে অভাগা যেদিকে চায় সেদিকে সাগর জল শুকিয়ে যায়। আমার বেলায় তা হলো। দিনে দিনে চার পাশ টা আমার জন্য বেশ কষ্ট কর হতে লাগলো। যে দিকে যেতাম একটা না একটা অঘটন ঘটতে লাগলো। ক্লাসে অমনোযোগীতার কারনে তিরস্কৃত হতে হলো। আবার হোস্টেলে তুচ্ছ কারনে ইলি আমার সাথে দুর্ব্যবহার করলো।
আমার মনে হতে লাগলো যেন লিও ছেড়ে যেতেই অসৌভাগ্য সব আমাকে ঘিরে ধরলো। সেদিন রাতে ফেরার পর এক ছিনতাই কারীর কবলে পড়লাম। আমার কাছে এক মাসের স্যালারি ছাড়া কিছুই ছিল না। কিন্তু ছিনতাই কারী আমার সে সামান্য ডলার টুকুও নিয়ে গেল। সেদিন রাতে প্রচন্ড কান্না করলাম। ডলারের জন্য বিন্দু মাত্র আফসোস হচ্ছিল না। কিন্তু তারপরও বুক ফেটে কান্না বেড়িয়ে আসছিলো। লিওর কালো হুডি জ্যাকেট যেটা সে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিল সে জ্যাকেট টা বুকে চেপে ধরে নিজেকে সান্তনা দিচ্ছিলাম আর বলতে লাগলাম
“শান্ত হও! শান্ত হও! তুমি কিছুই ভুল করো নি। সব ঠিক আছে। শুধু একটু কষ্ট হচ্ছে। সেটা ঠিক হয়ে যাবে, ঠিক হয়ে যাবে।
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here