আমার ভিনদেশি তারা পর্ব -৩৫

0
1909

Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৫
———————————————–
লিও ওয়াশ রুম হতে বের হবার পূর্বেই নিচে আমার ডাক পড়লো। সবার সাথে ড্রয়িংরুমের সোফাতে বসতে হল। কোনো মেয়ে বন্ধু বাড়িতে আসা ব্যাপার টা সাধারন। তাই কেউ কিছু মনে করলো না। শুধু মাত্র কয়েক জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এর মধ্যে টিনা আর লিওর পিতা মি. উইলিয়াম ও আছে। বাকি দের তেমন চিনি না। কয়েক জনকে শুধু লিওর বার্থ ডে তে দেখেছিলাম।
সবার সাথে বসে নার্ভাসে আমার কপাল বেয়ে টপ টপ করে ঘাম ঝড়ছিল। টিনা যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছে কেউ যেন তাকে জোর করে চিরতার রস খাইয়ে দিয়েছে। আমি আরো নার্ভাস হয়ে যেতাম যদি রিচার্ড এসে পাশে না বসতো। সে তার স্থান ছেড়ে হুট করে আমার পাশে এসে বসলো। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পেলে বললাম
“গুড মর্ণিং রিচার্ড। কখন এলে?”
এই বলে সামনের স্পটিকের গ্লাসে পানি ঢেলে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম। রিচার্ড মুখে হালকা হাসি ঝুলিয়ে বলল
“গুড মর্ণিং টামিনা! এই তো কালই এলাম। আমি দুঃখিত গতবার যাওয়ার আগে বলে যেতে পারি নি। আর আমাদের ডিনার করাও হয় নি।”
“ইটস ওকে।”
“কেমন আছো?”
“এই তো ভালো আছি। তুমি?”
“আই এ্যাম গুড। তা আজ সকালে কি মনে করে?”
“এ-এমনি এসেছি। তেমন কিছু না!”
“এমনিই?”
“লি-লিওর সাথে ভার্সিটিতে যেতে এসেছি।”
“ওহ্!”
আমি মনে করলাম এই বুঝি রিচার্ডের প্রশ্ন বান বন্ধ হল। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণিত করে রিচার্ড আবার বলল
“বাই দ্যা ওয়ে ইয়ু লুকিং ভেরি বিউটিফুল।”
শুনে আমি যেন একটু চমকে উঠলাম। সেটা লুকিয়ে একটু ভদ্রতার হাসি হেসে বললাম
“থ্যাংকস!”
“আচ্ছা ওই কফি হাউজে এখনো চাকরি করো?”
“হ্যা করি!”
“ওই জব টা ছেড়ে দাও না কেন? সামান্য ওয়েটারের চাকরি কিভাবে করছো?”
আমি জবাব না দিয়ে একটু হাসলাম মাত্র। রিচার্ড বলল
“আমি তোমার জন্য আমাদের কোম্পানি তে চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি!”
আমি ভ্রু কুচকে রিচার্ডের দিকে তাকালাম
“আমার জন্যে?”
“হুম! ইন্টার্ন হিসেবে যোগ দিবে। পরে তোমার দক্ষতা অনুযায়ী পদোন্নতি হবে!”
আমি ভাবতে লাগলাম। হুট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। আগে দেখতে হবে। রিচার্ড বলল
“এত কি ভাবছো টামিনা?”
“হাহ! নাহ্ আমাকে একটু সময় দাও।”
“এত কি ভাবার আছে? আচ্ছা ঠিক আছে। দিলাম সময়!”
.
সবাই ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং টেবিলে বসলো। আমি নাস্তা করে এসেছিলাম তবুও অনুরোধে আবারো বসলাম। ঠিক সে সময় লিও নিচে নেমে এলো ফুল ড্রেস আপে। কালো শার্টের সাথে থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট। ফর্সা পায়ে ব্ল্যাক হোয়াইট মিক্স পাম্প সু। হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ভাজ করা চুলে কালো রোদ চশমা টা আটকে আছে। ক্রুশ চিহ্ন টা লিওর নাড়াচাড়ার চোটে হয়ত শার্টের বাইরে বেড়িয়ে এসেছে। কাঁধে ব্যাক প্যাক টা কোনো রকম ঝুলিয়ে হেডফোন কানে ফোন টিপতে টিপতে নিচে নেমে আসছে। একে তো এরা জাতি গত ফর্সা। তার উপর কালো শার্টে ওকে আরো ফর্সা লাগছে। সদ্য গোসল করে আসায় পানির বিন্দু বিন্দু ফোটায় শার্টের কিছু স্থান ভিজে আছে। নিশ্চয় সে তাড়াহুড়ো করেছে। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় লিও কে সত্যিকারের কোনো রাজকুমারের মতই মনে হচ্ছে। একদম ওয়েস্টার্ন রাজকুমার।
সে নিচে নেমেই সবাইকে গুড মর্ণিং উইশ করলো। জবাবে সবাইও তাকে উইশ করে নাস্তা করার জন্য বসতে বললো। ওকে দেখে হাসি তামাসা যেন একটু বেড়েই গেল। প্রথমে এত গেস্ট হয়ত সে লক্ষ করে নি। পরে চারদিকে এত মানুষ জন দেখে সে একটু থমকে গেল। হয়তো ভাবে নি ঘুম থেকে উঠে এত জনকে দেখবে। চারদিকে নজর বুলাতেই আমার দিকে চোখ পড়লো। আমি একটু করে হাসলাম। কিন্তু লিও হাসলো না। হেডফোন টা গলায় নামিয়ে তার মম কে ডাকলো
“মম আমার ক্ষুধা নেই। আমি যাচ্ছি ভার্সিটিতে!”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“মিইইরা চলো!”
লিওর মম চোখ কপালে তুলে ফেলল
“কেন এড? শরীর খারাপ করছে? খাবেনা কেন?”
লিওর পিতা ও একই কথা বলল। উত্তরে সে ভার্সিটিতে পড়ার চাপের কথা বলল। এবার টিনা কথা বলে উঠল
“কি ব্যাপার এড? এমন করছো কেন? কেউ কি এমন ফ্যামিলি গেট টুগেদার মিস করতে চায়? কি এমন পড়ার চাপ ভার্সিটিতে? যেখানে ফ্যামিলি কে একটু সময় দিতে পারো না? নাকি অন্য কিছু!”
“তুমি…!”
লিও কিছু বলতে চেয়েও চারদিকে গেস্ট দেখে দাঁতে দাঁত চেপে থেমে গেল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি এখনো বসে আছো?”
আমি একটু চমকে উঠলাম। সবে মাত্র গরম গরম প্যান কেকের একটা টুকরা মুখে দিয়েছিলাম। দারুন স্বাদ এটার। কিন্তু ওর কথায় এত শুধু প্যান কেক টা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।
.
লিও প্রায় সময় ভার্সিটিতে যাতায়াতে বাই সাইকেল টা ব্যবহার করে। এবারো ব্যাতিক্রম হল না। একটা হেলমেট আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে বলল
“পড়ো!”
আমি হেলমেট টার দিকে একটু তাকিয়ে মাথায় বেধে নিলাম। লিও নিজের হেলমেট বেধেই সাইকেলে উঠে বসলো। কোনো কথা বলছে না। অনেক টা চুপসে আছে। আমি ধরতে পারলাম না ঠিক কি কারনে হাস্যোজ্জল লিও হঠাৎ এরকম গোমড়ামুখো হয়ে গেল।
সাইকেলে বসে সে অপেক্ষা করতে লাগল। আমি প্রথমে বুঝলাম না। পরে পিন পতন নিরবতায় বুঝতে পারলাম সে আমার জন্যই অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। সাইকেলে চড়ার সময় আমাদের মধ্যে তেমন কথা হলো না। কিন্তু উইলিয়াম এভে পার করে ম্যাক ডারমোট এসেই সাইকেল থেমে গেল। আমরা একসাথেই হাটতে লাগলাম।
সকালটা রোদ্দুরে না হলে ও যথেষ্ট ফরসা ছিল চারদিক। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ আকাশে তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেক টা আমাদের দেশের শরতের আকাশের মত। বাতাস একেবারেই নেই বললে চলে। ওক গাছে বাল নাকুটি পাখি টা বার বার ডানা ঝাপটিয়ে উঠছে।
.
আমি একটু করে লিওর দিকে তাকালাম। সে হেডফোন কানে লাগিয়ে মাথা নিচু করে কিছু একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। নিশ্চয় কোন গান শুনছে। হাত দুটো পকেটে ঢুকানো। হাটতে হাটতে মাঝে মাঝে পায়ের কাছে ছোট কংকরের টুকরা পড়লে সেটা পা দিয়ে কিক করে দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পথ টুকু অতিক্রম করে আবার সেই কংকরের টুকরো সামনে পড়লে সেটাকে কিক করে আবার দূরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কিক খেয়ে খেয়ে বেচারা কংকরের অবস্থা শত টুকরা। শেষে কিক করার জন্য আর টুকরোই বেঁচে রইল না। এ যেন অদৃশ্য খেলা। আমি একটু গলা খাকড়ি দিয়ে লিও ডাকলাম
“লিও?”
তার চোখ মুখ টা এখনো অন্ধকার। হয়ত আমার ডাক শুনতে পাই নি। আমি আবার ডাকলাম
“লিও!”
এবারো শুনতে পেল না। তবে আমার দিকে একটু তাকাতেই বুঝতে পারলো আমি কিছু বলছি। মাথার উপর থেকে হেডফোন নামিয়ে ফেলল
“কিছু বললে?”
“হুম!’
“কি?”
“তুমি উপোস চলে এলে। কিছু খাবে না?”
“নাহ্! আমার ক্ষিধে নেই।”
“মিথ্যা বলছো কেন?”
লিও আমার দিকে তাকিয়ে একটু করে হাসলো। তারপর বলল
“ক্যান্টিন থেকে করে নিব!”
এই বলেই সে আমার হাত টা তার হাতের মুটোয় পুরে নিল। আমি একটু অবাক হলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। ক্যাম্পাসে ঢোকার আগে লকার থেকে দুজনেই কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিলাম। এরপর আমার আর লিওর ক্লাস আলাদা। তাই আমি চলে যেতে লাগলেই সে পিছন থেকে ডাক দিলো
“মিইইরা!”
আমি ওর দিকে ফিরে জবাব দিলাম
“হাহ!”
লিও লকারে এক কাঁধে হেলান দিয়ে দাড়ালো। ঠোটের কোনে অদৃশ্য ছোট্ট হাসি। ডিম্পল টা হালকা ভাবে ভেসে উঠছে। কিছু না বলে চুপ করে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“কি হলো? বলো!”
সে আস্তে করে বললো
“থ্যাংক ইয়ু!”
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে পলক বিহীন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা বুঝতে সময় লাগছিল যে ঠিক কি কারনে সে আমাকে থ্যাংকস বলছে।
লিও ঠোটের কোনের মিষ্টি হাসি টা ঝুলিয়ে রেখে আমার কাছে এগিয়ে আসলো। এসেই আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ও মাথায় হাত বুলাতেই আমি মনে মনে যেন শান্তি বোধ করলাম। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলাম। নিজেকে নিরাপদ মনে হল। এরপর সে আমার গালে হাত রেখে বলল
“ক্লাস শেষে আমাকে না বলে কোথাও যাবে না। হুম?”
আমি মাথা নেড়ে ওকে সায় জানালাম।
“ঠিক আছে।”
তারপর পিছু ফিরে আমি আমার ক্লাসের দিকে এগুতে লাগলাম। মনের মধ্যে সুখের প্রজাপ্রতিরা উড়াউড়ি করছে। চার পাশ টা কেমন যেন আনন্দময় মনে হচ্ছে। কিছুদুর গিয়েই আমি আবার একটু করে পিছনে তাকালাম। লিও এখনো সেখানে দাড়িয়ে আছে। বুকের মধ্যে হাত দুটো মুড়ে ডিম্পল ওয়ালা এক বিগত হাসি টা মুখে ঝুলিয়ে রেখেছে। আমি খানিক টা লজ্জা পেয়ে সামনে ফিরে গেলাম। হুট করে মনটা ভালো হয়ে গেল। আপনা আপনি হাসতে লাগলাম। যেন আকাশে হাওয়ার সাথে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। সারা শরীরে অদ্ভুদ শিহরন বয়ে যাচ্ছে। সব কিছু এত ভালো লাগছে কেন?
ধপ করে সামনের কিছু একটার সাথে কপালে আঘাত খেলাম।
“ওহ্! ইয়া আল্লাহ!”
বাড়ি খেয়েই ঝট করে স্বপ্নের আকাশ থেকে বাস্তবের মাটিতে পরে গেলাম। হাত থেকে সব কিছু পরে গেল। আঘাত খেয়ে আমার কপাল আর নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেলো। নাক ঢলতে ঢলতে তাকিয়ে দেখলাম ক্লাসের কাচের দরজাটা না খুলেই ভিতর প্রবেশ করতে গিয়েই অবস্থা। বসে সবকিছু গুছিয়ে নিলাম। তারপর উঠেই নিজের মাথায় নিজেই চাপড় দিলাম
“আন্ধি কোথাকার!”
.
(চলবে)
.
ছোট করে দেয়ার জন্য আমি দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here