Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৩৬
———————————————–
ক্লাসে বইয়ের পাতায় গভীর মনযোগে দৃষ্টি বুলাচ্ছি। প্রফেসার গুরুত্বপূর্ণ টপিকে লেকচার দিচ্ছেন। বিষয় টা সবাই কে নিয়ে ল্যাবে হাতে কলমে পরিক্ষা করাবেন। কিন্তু টপিক টা আমি আগেই পড়েছি। লিওর কাছে। খুব সুন্দর করে সে আমাকে বিস্তারিত বলেছিল। সে সাথে নেট ঘেটে দুনিয়ার তাবৎ সব তথ্য সামনে এনে দিয়েছিল। তাই এখন বুঝতে বেশি কষ্ট হচ্ছে না।
সে আসলেই পাগল ছিল।
মনে মনে হাসছিলাম। যখন সে চেহারায় গাম্ভীর্য্য ফুটিয়ে আমাকে লেকচার দিত আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ও মনে করতো ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি। আসলে আমি ওর ডিম্পল দেখতাম। শুধু হাসার সময় না যখন সে এক নাগাড়ে কোন বিষয় নিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে লেকচার দিত তখন ওর সেই সুন্দর গিরি খাদ ময় ডিম্পল টা ভেসে উঠত। আর আমি মুগ্ধ নয়নে গিরিখাদের সৌন্দর্য্য অবলোকন করতাম বেহায়া দের মত।
“হা হা হা!”
ভীষন একটা মজার কথা মনে পড়লো। মনে পড়তেই হাসতে হাসতে চারদিকে তাকালাম। রিচা ছিল পাশে। সে আমাকে প্রচন্ড জোরে পায়ে পাড়া দিল। চিৎকার করতে গিয়েও পারলাম না। পুরো ক্লাসে পিনপতন নিরবতা। সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর। তাদের ক্লাস নষ্ট করায় চোখ দিয়ে সবাই আমাকে গিলে খাচ্ছিলো। আর প্রফেসারের কথা বলা বাহুল্য।
ফলাফল ক্লাস থেকে বহিষ্কার। ক্লাস থেকে যখন বের করে দেয়া হয়েছে তাহলে বাইরেই ঘুরি। ফোর্ড গ্যারি ক্যাম্পাস ইয়ার্ডে ইতস্থত করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। চোখে পড়লো হালকা আকাশী রংয়ের জেইড ভেইন ফ্লাওয়ার। একদম নীল আকাশের সাথে মিলে গেছে। এই ফুল টা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। তবে অনেকে বিদেশী ফুল শখ করে রোপন করে থাকে। মনে মনে চিন্তা করলাম বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার আগে এ ফুলের বীজ নিয়ে যাবো।
.
বাড়ি খেয়ে আলু হয়ে যাওয়া কপাল টা ভেজা টিস্যু দিয়ে কতক্ষণ পর পর চেপে ধরছিলাম। আমার ধারনা এতে ফোলা ভাব টা কিছুটা হলেও কমবে।
.
শুধু হাসার জন্য ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে এ কথা রিচা বেশ রসিয়ে রসিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে সবাই কে বোঝাচ্ছিল। প্রফেসার আমাকে কি কি বলছিল সব সে উগলে দিচ্ছে। উপস্থিত জনতা হা করে তার কথা গিলছে। তাদের ধারনা আমি প্রেমে পড়েছি।
.
কে হতে পারে আমার সম্ভাব্য প্রেমিক!
.
বিষয়ক সেমিনারে তারা আলোচনা পর্যালোচনা করছে। রাঘব, কার্লের মত প্রবীন ব্যক্তিরা তাদের গুরুত্ব পূর্ণ বক্তব্য পেশ করছে। এডালিন আমাকে কখন, কার সাথে, কিভাবে, কোন কোন ছেলের সাথে দেখা গিয়েছিল সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাচ্ছে। আর লুনা এ ব্যাপারে সায় জানাচ্ছে।
আমি গরম গরম প্যান কেক খেতে খেতে ওদের আলোচনা শুনছিলাম। নাহ্! লিওর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এতক্ষন হয়ে যাচ্ছে। কোথায় সে? আজ তো কোনো ম্যাচও নেই তাহলে?
লিও আসলো বেশ কিছুক্ষন পর হুড়মুড় করে। সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। লিওর হাত থেকে সবাই জমি দখলের মত আইসক্রিম কেড়ে নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিল। আমি ও নিলাম একটা। দারুন স্ট্রবেরি স্বাদের।
লিও চেয়ার টেনে বসে গেল। ও বসতেই এতক্ষনের যে বিশেষ সেমিনার চলছিল তার সার সংক্ষেপ তাকে শুনিয়ে দেয়া হল। এ ব্যাপারে তার মতামত কি জানতে চাওয়া হল।
লিও দমে গেল। ড্যাব ড্যাব করা চোখ নিয়ে একবার আমার দিকে একবার সবার দিকে তাকাচ্ছে।
আমি মাথা নিচু করে চুপচাপ আইসক্রিম খাচ্ছি।
কিছু বলতে না পেরে সে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বোকার মত হাসতে লাগল। তারপর বলল
“ইয়ে মা-মানে! কারো গোপনীয়তা বজায় থাকা কিছুটা দরকার আছে বৈকি। এটা নিয়ে এত তোলপাড় করার কোনো কারন দেখছিনা!”
সবাই এক যোগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লিওর দিকে তাকালো। এডালিন বেশ প্রতিবাদী হয়ে উঠল। সে টেবিল চাপড়ে বক্তৃতা শুরু করলো
“আমার বেলায় যে গোপনীয়তার সুযোগ আমি পাইনি তা আমি কারো বেলায় পেতে দেবো না, কিছুতেই না। টামিনা কে বলতে হবে তার হবু প্রেমিক কে? তাকে লুকিয়ে রাখার মানে কি? তাকে লুকিয়ে রাখার পিছনে কি রহস্য রয়েছে? বলতে হবে, মুখ খুলতেই হবে!”
রাঘব হাতে তালি দিয়ে বলল
“Exactly Edi! I agree with you!”
সমর্থনের আশায় গ্রুপের সবার দিকে তাকালো এডালিন। কিন্তু রাঘব ছাড়া আর কোনো সাপোর্ট কারি দেখলোনা। সবাই মনযোগে লিওর আইসক্রিম খাচ্ছে। আর আইসক্রিমের সাথে সমস্ত আলোচনা পেটে অবস্থান নিয়েছে।
.
যাক বাঁচা গেলো। লিওর দিকে তাকিয়ে বললাম
“এবার তাহলে আমি আসি!”
লিও মনোযোগ দিয়ে ফোনে কিছু দেখছিল। আমার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল
“কোথায় যাচ্ছো?”
“লিও আমার হোস্টেলে অল্প কাজ বাকি আছে!”
সবাই বলল
“এ আর নতুন কি? ওর তো প্রতিদিনই এ সময়ে অনেক কাজ!”
আমি একটু হেসে সবার কথার সমর্থন জানালাম। লিও আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। তারপরে উঠে দাড়িয়ে বলল
“আমিও যাচ্ছি!”
সবার সামনে কিছু না বললেও ইয়ার্ডে আসতেই বললাম
“লিও তোমার আসতে হবে না। আমি যেতে পারবো!”
লিও ভ্রু কুচকে বললো
“নো! এখন থেকে আমার সাথে চলা ফেরা করা তোমার দায়িত্ব! প্রতিদিন আমার সাথে আসবে, আমার সাথে যাবে। মাঝে মাঝে লাঞ্চ অথবা ডিনার করবে…!”
“থামো থামো! কি সব বলছো?”
“কি বলছি? বেশি কিছু তো না। শুধু মনে করিয়ে দিইচ্ছি কি কি দায়িত্ব এখন থেকে পালন করতে হবে।”
“বুলশীট!”
“আরেহ্ মিইইরা! বুলশীট বলছো কেন? এখন থেকে তিন বেলা আমার সাথে তোমার দেখা করতে হবে, ডিনার, লাঞ্চ…!”
আমি ঝট করে ওর দিকে তাকালাম
“তিন বেলা?”
“হুম! সকালে একবার, বিকেলে একবার, আর?”
“আর?”
“আর রাতে একবার! পাইপ বেয়ে হোস্টেলে! ইয়ু নো দ্যাট! হাউ মাচ আই এক্সপার্ট!”
“ননসেন্স!”
.
যদিও মুখে কপট রাগ প্রকাশ করছিলাম কিন্তু মনে মনে বেশ লজ্জা হচ্ছিল। তার চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছিলাম না। আমারো ইচ্ছা হচ্ছিল ওর সাথে ঘুরতে ফিরতে। কিন্তু আমি আমার কাজের কথা ওর কাছে প্রকাশ করতে চাইনা। আমি আমার অসহায়ত্ব ওর সামনে চলে আসুক সেটা চাই না। কারন আমাকে ওভাবে দেখলে হয়ত ওর মনে আমার জন্য করুনা সৃষ্টি হবে। আর সে চাইবে নানা ভাবে আমাকে সাহায্য করতে। বিষয় টা বেশ জটিল।
.
আমি লিওর দিকে তাকালাম। তারপর একটু করে হেসে বললাম
“লিও! এখনো অনেক সময় আছে। গল্প করার, কথা বলার, সব কিছু বুঝার। কিন্তু আমার যে দেরি হয়ে যাবে এখন না গেলে। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
আমি ওকে বলছিলাম অনেক সময় আছে। কিন্তু সময় টা যে কোথায় আছে সেটা আমার জানা নেই। হয়ত বুঝ দেওয়া। নিজেকে অথবা লিও কে।
“ঠিক আছে তাহলে তোমাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিই।”
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম।
“লাগবেনা। আমি যেতে পারবো লিও।”
“অসম্ভব! এটা কেমন কথা? আমি তোমাকে নামিয়েও দিতে পারবোনা?”
.
এটার জবাব আমার কাছে ছিল না। কি বলবো বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খুড়ছি। এমন ভাবে নিচু করে মাটি খুড়ছি যেন মাটিতে দুনিয়ার সব সৌন্দর্য্য মিশে আছে।
লিও আমার কাছে একটু এগিয়ে আসল। এতটা কাছে যে ওর শরীরের উষ্ণতা টুকু আমি অনুভব করতে পারছি। লিও দু আঙ্গুলে থুতনি ধরে আমার মাথা উপরে তুলল। আমি তাকালাম ওর দিকে। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ওর স্বচ্ছ ঘোলাটে চোখে আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি।
“মিইইরা!”
নিচের দিকে তাকিয়ে একটা হালকা নিঃশ্বাস নিলো সে। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো
“আমার কাছে কি গোপন করছো তুমি? দয়া করে সেটা গোপন করিও না। কি হয়েছে আমাকে বল! আমি তোমাকে সাহায্য করব। কোনো সমস্যা হলে তাও বল। কিন্তু এভাবে লুকোচুরি খেলিও না!”
.
আমি নিজের থুতনি হতে লিওর হাত সরিয়ে নিজের মুটোয় নিলাম। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিলাম। বললাম
.
“আমি তোমার কাছে কিছুই গোপন করছি না লিও। কোনো লুকোচুরি করছি না। যদি কখনো কোনো সমস্যা হয় আমি তোমার কাছেই আসবো। আর কার কাছে যাবো বল? কে আছে আর?”
.
মনে মনে মিথ্যা বলার জন্য তওবা করলাম। মুখে হাসি ফুটিয়ে যথা সম্ভব নিজেকে শক্ত রাখলাম।
লিও খুশি হয়ে গেল। এক গাল হেসে বলল
“তাও ঠিক।”
“তাহলে আমি যাই?”
“হুম!”
হাত ছেড়ে দিতেই সে বলে উঠল
“ওয়েট!”
“কি হল?”
লিও ইতস্থত করছে। তারপর হুট করে বলে ফেলল
“Can you give me one hug please? Just one! please please!”
আবদার শুনে আমি থমকে গেলাম। সে এবার আমার হাত দুটো মুটোয় পুরে নিল। তারপর ধীরে ধীরে বলল
“আ-আমি জানি আসলে এটা তোমার জন্য একটু অস্বস্তিকর। কিন্তু আমার দিক টা একটু বিবেচনা কর! বেশি কিছু না প্লিজ। জাস্ট ওয়ান হাগ”
চোখ দুটো বড় বড় করে করুন স্বর করে লিও মিন মিন করছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। মুহুর্তে যেন আমার প্রেশার হাই হয়ে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেল কপালে।
“মিইইরা!”
লিও হালকা ঝাকুনি দিল।
“হাহ!”
লিও এখনো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার মুখে যেন কথা আটকে গেছে। বেশ কিছুক্ষন পর অনেক চেষ্টা করে বলতে চাইলাম
“লি-লিও আ-আম-মি…!”
“মিইইরা শসসসহ! ইটস ওকে! আমি চাই নি তোমাকে আনকম্পরটেবল করাতে। আমি দুঃখিত।”
“লি-লিও…!”
“বললাম তো ইটস ওকে! আর চিন্তা করো না বলে দিয়েছিলাম। সমস্যা নেই। তুমি যাও। পরে দেখা হবে।”
আমি জবাব দিলাম না। হা করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পিছন ফিরে চলে যেতে লাগল। আমি ওর যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
মাথা কাজ করছেনা আমার। লিও কে আমি কেন বুঝতে পারছি না। কেন তাকে অচেনা লাগছে? কেন চারদিকে এত ঘোর প্যাচ মনে হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে এত কাছে তবুও ওকে স্পর্শ করতে পারছিনা? শুধুই কি আমার পরিচয়ের কারনে? নাকি দেশের কারনে? নাকি আমার পরিবারের সৃষ্ট অদৃশ্য বেড়া জালের কারনে?
.
(চলবে)