Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪০
———————————————–
লিওর গায়ে ভি নেকের সাদা ফুল হাতা গেঞ্জি। সাথে ব্লু ডেনিম জিন্স। চামড়ার হুডি জ্যাকেট টা হাতের মধ্যে ভাজ করে নেয়া। পায়ে ব্ল্যাক সু। হাতে কালো রোলাক্স ঘড়ি। মাথায় পরিপাটি করে আচড়ানো অগোছালো চুল। বার বার হাত বুলিয়ে অগোছালো চুল টাকে আরো অগোছালো করছে। শার্টের বুকের বোতামে ক্রুশ লকেট টা পেচিয়ে আছে। রোদের আলো পড়ায় সেটা চিক চিক করছে। ব্যাক প্যাক কাধে হেলমেট টা ধরে আছে। ঘোলাটে চোখের চেহারায় উজ্জল গিরিখাদ ময় হাসি। উইনিপেগের দূর্লভ সোনালী সকাল টার সৌন্দর্য্য কে হার মানিয়ে দিচ্ছে। আমার অর্ধেক জ্বর সেরে গেল ওর টেপা হাসি টা দেখে।
“শুভ সকাল লিও!”
জ্যাকেট টা সাইকেলের উপর রেখে হেলমেট হাতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। হেলমেট টা আমার মাথায় বেধে দিতে দিতে মিষ্টি হেসেই বলল
“শুভ সকাল মিইইরা! কেমন আছো?”
“ভালো! তুমি?”
“আই এ্যাম অলওয়েজ গুড!”
নিজের হেলমেট ঠিক করে জ্যাকেট টা আমার হাতে দিলো। আমি নিলাম। তারপর ওর পিছনে সাইকেলে উঠে বসলাম। শরীর টা তখনো দূর্বল ছিল। ঔষধে কেন এখনো কাজ হচ্ছে না! বার বার মনে হচ্ছে পড়ে যাবো। তাই শক্ত করে লিওর শার্ট আকড়ে ধরলাম।
.
ফোর্ড গ্যারি ক্যাম্পাসে ঢোকার সাথে সবার সাথে দেখা। এডালিন আর রাঘব কেও দেখতে পেলাম। শুনেছি তারা নাকি লিভিং টুগেদারে আছে। এডালিনের জন্য বিষয় টা স্বাভাবিক হলেও রাঘব কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে সেটা ভাববার বিষয়। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে মিট মিট করে হাসে, সর্বদা হাতে হাত রেখে চলে, এক কফি মগে একই স্থান থেকে দুজনে চুমুক দিয়ে পান করে, একে অপরের প্রশংসাই মুখে ফেনা তুলে ফেলা, সর্বদা ফ্লাইং কিস পাঠাতে থাকা, ওহ্ বেবি, ওহ্ সুইটহার্ট, ডার্লিং, হানি, ডিয়ার উফফ্! কত বিরক্তির শব্দ! কেমনে মানু্ষ সহ্য করে? ইদানিং আড়ালে আবডালে রাঘব এডালিন কে সুইট স্ট্রবেরি বলে ডাকে। কিন্তু সবার সামনে না। আসলেই সুইট স্ট্রবেরি! বেচারা স্ট্রবেরি কেও ছাড় দিলনা!
.
ক্লাসে ঢোকার আগ মুহুর্তে লিও আমাকে বাই জানালো। কিন্তু সে আমার চেহারা দেখে খানিক টা সন্দেহ করে বসলো। বললো
“মিইইরা! তুমি ঠিক আছো? কেমন অসুস্থ মনে হচ্ছে!”
“নো! আমি ঠিক আছি! দেখ!”
নিজেকে একটু হেসে দেখালাম। কিন্তু তাতে ওর সন্দেহ কমলো না।
“Are you sure?”
আবারো একটা হাসি দিয়ে বললাম
“Yeah!”
লিওর ভ্রু সোজা হলেও চোখ থেকে সন্দেহ গেল না। আমাকে বাই জানালো এক টুকরো ডিম্পল দেখিয়ে। আমার মনে মনে আফসোস জাগে কেন আমি সাবজেক্ট টা ছেড়ে আসলাম। কেন আমি অত পাগলামী করলাম ওই সময়? কি হত সাবজেক্ট চেইঞ্জ না করলে?
.
এডালিন আর রাঘব! তারা একে অপরকে বাই জানাবে বেশ বৈচিত্র্য ভাবে। ক্লাসে ঢুকবে সবার শেষে। তারপর চারপাশ টা একটু করে দেখে নিয়ে এডালিন ঝট করে রাঘবের গলা জড়িয়ে ধরে একে অপরের ঠোটে এমন ভাবে জড়াবে যেন হারিয়ে যাওয়া কোনো গুপ্তধন খুজতেছে! ছিইই! অপ্রস্তুত ভাবে দেখে ফেলায় আমার বেশ গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। কেমনে পারে এরা?
এদেরর কাছে যে শয়তান টা ঘুর ঘুর করে সেটা যেন আমাকে কাবু করতে না পারে সুরা ইখলাস বির বির করে পড়ে ক্লাসে ঢুকলাম।
.
বেশ অস্বস্তিকর ক্লাস। মাথা এলিয়ে রাখতে ইচ্ছা হল। কপাল ও ঘাড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেওয়ায় মনে হল জ্বর নেমে গেছে। টিস্যু দিয়ে মুছে ফেললাম। কিন্তু তারপরও অত্যন্ত দুর্বল লাগছে। সকালে মারিয়ার স্যুপ ছাড়া কিছু খাই নি। খিদে টা বেশ চাড়া দিচ্ছে পেটের মধ্যে।
তাই ক্লাস গ্যাপ দিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য ক্যান্টিনে গিয়ে চিকেন বার্গার বা রোল খাওয়া। সবজি খাওয়াও মন্দ হবে না।
একটা প্যাকেটের মধ্যে জুস, ভেজিটেবল রোল, বার্গার, ওয়াটার বোতল নিয়ে ইয়ার্ডে চলে এলাম। ইয়ার্ডের এক পাশে পাথরের বাধানো সিট। প্যাকেট টা কোলে নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। ক্লাস চলা কালীন সময় হলেও স্টুডেন্ট দের আনাগোনা কম না। চারদিকে ফুর ফুরে বাতাস বইছে। আমার পিছনে এক ঝাক রেইন ট্রি আর দেবদারু গাছ। সেখানে নাম না জানা কিছু পাখি কিচ মিচ করছে। শরীর দুর্বল হলেও এই খোলা পরিবেশে একটুও খারাপ লাগছে না।
খাওয়া শেষ করতে করতে আমার কানে কিছু শোরগোলের আওয়াজ এলো। একটা মেয়ের তীক্ষ্ণ চিল্লানোর শব্দ আসছে। ব্যাপার টা পাত্তা দিলাম না। এরকম কদাচিৎ হয়ে থাকে। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজেকে খাওয়ার দিকে মনোযোগী করতে পারলাম না। ক্রমশ মনোযোগ বিঘ্ন হচ্ছে। অনেক করে নিজেকে প্রবোধ দিলাম। হলো না। নিষিদ্ধ জিনিসে আকর্ষন বেশি। নিউটনের সূত্রের পর এইটা এমন একটা সূত্র যেটাতে কোনো ভুল নেই। এছাড়া অন্যান্য জাতির তুলনায় বাঙালি জাতি ঝগড়া বিবাদ বেশ আয়েশ করে দেখে, মজা নেয়। কিন্তু চালাক রা বিবাদে নিজেকে জড়ায় না। দূর থেকে তামাসা দেখে। আমার শরীরে ও সেই জাতির রক্ত বইছে। আমিও তার ব্যাতিক্রম নয়। নিজের কৌতূহল মেটাতে উঠে পড়লাম। কাছে যাবো না। দূর থেকে এক নজর দেখে নিজেকে চালাকের আসনে বসাবো।
.
একটু এগিয়ে সামনে গেলাম। একটা ছেলে আর মেয়ে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। দূর থেকে দেখে মনে হল নিজেদের মধ্যে কিছু ঝগড়া চলছে। আমি আরেকটু এগিয়ে মোটা ম্যাপল গাছ টার পিছনে দাড়ালাম। এখান থেকে বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি থমকে দাড়ালাম। কারন দুজনের একজন কে আমি বেশ ভালো ভাবে চিনেছি। আর সে একজন হচ্ছে লিও। কিন্তু মেয়েটা কে? আমার দিকে পিঠ করে থাকায় মেয়েটি কে চিনতে পারলাম না। এটা কি রিচা? আজকে তো রিচার সাথে দেখাও হয় নি। কিন্তু রিচার চুল তো এইরকম না। আর এই মেয়ে ব্লন্ডি। কে হতে পারে আর? কি নিয়ে এত ঝগড়া হচ্ছে? মনে মনে ভাবছি এগিয়ে যাবো কিনা? আমার এগিয়ে যাওয়া উচিত হবে কিনা?
পরে ভাবলাম না থাক। লিও হয়তো চাইবেনা আমি ওখানে যাই। তারচেয়ে বরং বোঝার চেষ্টা করছি কি নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে।
কয়েক মিনিট পর মেয়েটি ঝগড়ার এক পর্যায়ে ঝট করে আমার দিকে মুখ করে ফিরলো। আমার এক সেকেন্ডও লাগলো না চিনতে। টিনা! সে এখানে কি করছে? আর কেনই বা এত ঝগড়া?
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ঝগড়া টা আমাকে নিয়েই। আর থাকলাম না ওখানে। বিমর্ষ মুখে প্রিয় আধ খাওয়া বার্গারের কাছে চলে এলাম। কিছুক্ষন আগেও আমার মন খুব ভালো আর ফুরফুরে ছিল। কিন্তু এখন? বার্গারে কামড় দিয়ে পানি দিয়ে গিলছি শুধু। টিনা কেন এত সিরিয়াস! যেখানে লিও চাইছে না সেখানে কেন এত জোরাজুরি আর ঝগড়া ঝাটি? আমার মাথায় আসলো না।
.
ওই দিন আর ক্লাস করা হলো না। বসে রইলাম ওই খানে। ভাবছি আবোল তাবোল অনেক কিছু। মনে হচ্ছে সব ছেড়ে ছুড়ে বাংলাদেশ চলে যাই। আবার মনে হল বিনা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে বাংলাদেশে কিভাবে যাই?
আর যদি চলেও যাই তাহলে লিওর কি হবে? সে কি আমার কথা ভাববে? আমাকে কি তখন একটুও মনে পড়বে? নাকি টিনা কে বিয়ে করে ফেলবে?
না নাহ্! কি সব ভাবছি! নিজের মাথায় নিজে বাড়ি দিলাম।
.
“কি করছো এখানে তুমি?”
“হাহ!”
আমি চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখলাম সবাই এখানে চলে এসেছে। আমি পাক্কা শিউর লিও ওদের কে টেনে হিচড়ে নিয়ে এসেছে আমাকে খোঁজার জন্য।
“কিছু না! এমনিই বসে আছি!”
“তাহলে ক্যান্টিনে বসলে না কেন?”
এডালিন জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম
“আসলে একটু দুর্বল লাগছিল। ক্যান্টিনে ভালো লাগছিলো না তাই!”
লিও আমার পাশে হুট করে বসে গেল। বললো
“তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাহলে তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছিলে?”
“না নাহ্। তোমাকে মিথ্যা বলবো কেন? আসলে সকালে না খেয়ে আসছিলাম তাই…!”
লিও দরদে গলিত হয়ে বেশ কিছু বলছিলো। কিন্তু সেটা আমার কানে যাচ্ছে না। কারন সবাই হা করে লিওর কান্ড কারখানা দেখছে। যেন চোখ দিয়ে সবাই গিলে খাচ্ছে। কোন কিছু মিলানোর চেষ্টা করছে। আমার প্রতি অতি দরদ কেন দেখাচ্ছে সেটায় তাদের ভাববার বিষয়। মনে মনে দোয়া করলাম যেন তাদের কোন প্রশ্ন বানে পড়তে না হয়।
.
বেশ অস্বস্তিকর মুহুর্ত। তাড়াতাড়ি লিও কে বুঝিয়ে বললাম যে আমি ঠিক আছি। কিন্তু আমার দোয়া কবুল হলো না। প্রথমেই কথা বলে উঠলো রিচা। বেশ অভিজ্ঞ দের মত ভঙ্গি করে বলল
“Something is fishy!”
ওর সাথে তাল মিলিয়ে কার্ল মাথা নাড়ালো। বললো
“I think so!”
আমি ঢোক গিললাম। এডালিনও বাদ গেল না। বিজ্ঞ বিচারকের মত ভ্রু নাচিয়ে সে বলল
“I think I have to be sharlock homs! Nah tamina?”
এবার নিশ্চয় রাঘবের পালা। তাই কাতর চোখে রাঘব কে ইশারা করে মিনতি করলাম। তুমি তো বাদ যাও! এরা সবাই পশ্চিমা! কিন্তু তুমি তো আমার প্রতিবেশি! ঘরের মানুষ, আপন মানুষ! তুমি অন্তত ছাড় দাও। কিন্তু নাহ্! রাঘব এদের চাইতে আরো এক ধাপ এগিয়ে উপরের লেভেলে উঠলো। কড়া চোখে হাত দুটো বুকের কাছে মুড়ে রাঘব পরিষ্কার গলায় নিজের মাতৃভাষার সদ্ব্যবহার করে বলে উঠলো
“ডাল মে কুচ কালা হ্যা!”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। হিন্দি সিরিয়ালের বদৌলতে এই লাইন টার মানে আমি বেশ ভালো করে বুঝি।
.
(চলবে)