Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৪১
———————————————–
সবার মাঝে বসে হাসি মুখে কথা বললেও ভিতরে কুল কুল করে ঘামছিলাম। কারন সবাই আমাদের চারপাশে বসেছে। লিও মাথা না ঘামালেও আমার মাথায় ঝড় বইয়ে দিচ্ছিলো। সবাই তীক্ষ্ণ নজরে লিও আর আমার আচরন কে অনুবীক্ষণ দৃষ্টির মত খতিয়ে খতিয়ে দেখছে।
বেশ খানিকটা সময় লাগলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে। আর আমিও খানিক টা হাফ ছেড়ে বাচঁলাম। হাতের মুটোয় থাকা ওয়াটার বোতল টা নিয়ে পুরোটা নিজের পেটে চালান করে দিলাম।
ক্যান্টিন থেকে বিশাল সাইজের পিৎজা আনা হয়েছে। তাই হয়ত সবার নজর আমার উপর থেকে উঠে পিৎজা তে গিয়ে থেমেছে। পেটুক সব!
হৈ হুল্লোর ও বেড়ে গিয়েছে। ক্লাসের ফ্রি সময় হওয়ায় আরো কয়েকজন এসে জুটলো।
আমি পিৎজার একটা টুকরো নিয়ে লিওর দিকে তাকাচ্ছি। সে তার পিৎজা তে মুরগীর মত ঠোকর মেরে পিয়াজের ছোট ছোট টুকরা গুলো তুলে ফেলছে। হয়ত পেঁয়াজ তার পছন্দ না। সবাই চেঁচামেচি করছে। লিও খেতে খেতে তাদের সাথে তাল মিলাচ্ছে। তার হাসির ঠমকে লুকিয়ে রাখা ক্রুশ লকেট টা বেড়িয়ে এলো। কোন অজানা কারনে আমার নজর সে দিকে পড়ে গেলো। মনে মনে অনেক কিছুই ভাবছি। এই লকেট টা আমাকে বার বার মনে করিয়ে দেয় লিও খ্রিষ্টান। তার প্রতি আমার এগিয়ে যাওয়া এক রকম বাড়াবাড়ি। যেখানে সবকিছু প্রতিকূলে সেখানে আমরা দুজন অনুকূলে হলেও কোন লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিষিদ্ধ সম্পর্ক কে টিকিয়ে রাখার নিকৃষ্ট প্রয়াস। দেখেও না দেখার ভান করা, বুঝেও না বোঝার ভান করা।
আমি হতাশ। টিনার কথা মনে পড়ছে। আমি কি জেনেও না জানার ভান করছি! নাকি করেও না করার ভান করছি?
“মিইইরা!”
লিওর ডাকে একটু হকচকিয়ে গেলাম।
“কি দেখছো তুমি?”
“কিছু না!”
লকেট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। এক দৃষ্টিতে এতক্ষন তাকিয়ে ছিলাম। কি ভাববে লিও? কিন্তু লিওর দৃষ্টি এড়ালো না। সে সুকৌশলে সেটাকে আবারো শার্টের ভিতর লুকিয়ে ফেললো। যেন কিছুই হয়নি।
“কি ভাবছো?”
“হাহ! নাহ্ কিছু না!”
পিৎজার শেষ টুকরা টা তাড়াতাড়ি মুখে পুরে নিলাম। যাতে আর কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে না হয়। লিও কি বুঝলো আমি জানিনা। তবে বলল
“আর তাকাবে না আমার লকেটের দিকে!”
ধরে পড়ে যাওয়ায় ভিতরে ভিতরে খানিকটা চমকে গেলাম। মুখে খাবার থাকায় কোন কিছু বলতে পারলাম না। ফোলা মুখ নিয়ে শুধু এদিক ওদিক মাথা নাড়ালাম। নাহ্ আর কখনো তাকাবোনা।
.
পড়ন্ত বিকেলে মার্থা হাউজে দুপুরের অসহ্য অসস্থি কেটে গিয়ে এক রকম ভালো লাগায় ছেয়ে থাকে। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হয়েছিল এখানে মানিয়ে নিতে। কিন্তু এখন তেমন কষ্ট হয় না। আর আমার প্রিয় মুহুর্ত টা হলো এই পড়ন্ত বিকেলে। যেখানে সূর্য ডুবু ডুবু করছে। ম্যাপল গাছগুলোর আড়ালে আবডালে সন্ধা লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। কখন সূর্য ডুববে আর সে ঝপ করে সারা শহরে ঝাপিয়ে পড়বে। যেন সূর্যের সাথে পেরে না উঠে সূর্যের অনুপস্থিতিতে সবকিছু তে ঝাকিয়ে বসা।
হাউজের একপাশে এত রকম গাছের ভিড়ে একটা মাত্র ইউক্যালিপটাস গাছ আছে। সেখানে কালকে কলির মত কিছু একটা দেখেছিলাম। আজ সেখানে ফুল দেখেছি। বাল নাকুটি টা এমন ভাবে সেই ফুলের পাশে বসেছিল আর চারপাশে তাকাচ্ছিল যেন সে উইনিপেগের সম্রাট আর উইনিপেগ তার রাজ্য।
মার্থা হাউজে ফুরফুরে মেজাজে কাজ করে চলেছি। মেজাজ ফুরফুরে হওয়ার কারন হলো আজ নিজ হাতে আলুর ভর্তা বানিয়েছিলাম। লাল মরিচ কে ভালো তাওয়ায় রেখে মচমচে করে টেলে নিয়ে তার সাথে পেয়াজ কুচি, লবন, তাজা ধনে পাতা কে বেশি করে সরিষার তেল দিয়ে ভালো চটকে নিলাম। এরপর সিদ্ধ আলু কে চটকে নিয়ে সবগুলো একসাথে মিশিয়ে নিলাম। মিশানোর পূর্বে এক চিমটি স্বাদ লবন ও দিলাম। সেখান থেকে অল্প অল্প আলু ভর্তা নিয়ে হাতের তালুতে রেখে ছোট ছোট স্প্রিং বলের মত বানিয়ে একটু চ্যাপ্টা করে ডিমের মিশ্রনে ডুবিয়ে ময়দা মেখে অল্প তেলে বাদামী করে ভেজে নিলাম। এরপর একটা প্লেটে সস সহ সাজিয়ে মিস মার্থা কে দিলে তিনি এটার দারুন প্রশংসা করলেন। মার্থা হাউজের সবাই কে একটা একটা করে দেয়া হল। তারাও পছন্দ করলেন আলুর তৈরি খাবার টা। মিস মার্থা ঘোষনা দিলেন যে এটা তার মেনু কার্ডের অন্যতম একটা পদ হতে যাচ্ছে। প্রথম বার এত প্রশংসা পেয়ে আমার লাফাতে ইচ্ছা করলো। বার বার ধন্যবাদ জানালাম মিস মার্থা কে।
অবশ্য আমার জন্য একটা লাভ হল। আধ সিদ্ধ খাবার থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় পেলাম।
কাউন্টারের পাশে কফি মেকার থেকে কফি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখন আমার ফ্রকে হালকা টান পড়লো। কেউ যেন নিচ থেকে টেনে ধরে রেখেছে। তাকিয়ে দেখলাম কালো চুলের ছোট একটা ছেলে। বয়স কত হবে? বড়জোর পাঁচ নয়তো ছয়। পুরো মুখ, জামা আর হাতে লাল লাল জেলি লাগানো। কিছুক্ষন পর পর হাতের মধ্যে লাগানো জেলি টুকু চাটছে। ভারী মিষ্টি ছেলে।
এখানে এরকম ঘন কালো চুলের মানুষ খুব কম দেখেছি। উবু হয়ে পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে বসলাম। একটু হেসে বললাম
“হ্যালো ডিয়ার!”
জবাবে ছেলেটি জেলী মাখানো দাঁত দেখিয়ে একটা হাসি দেখালো।
“তোমার কি চাই!”
দাঁত দেখিয়ে ছেলেটি জবাব দিল
“জে-জেইয়িই!”
“জেলী!”
“হুম!”
মাথা টা উপর নিচ করে জবাব দিল।
“ওকে। তুমি তোমার টেবিলে যাও আমি জেলি পাঠিয়ে দিচ্ছি!”
আবারো একই হাসি।
ছেলেটির জন্য জেলি নিতে কিচেনে গেলে ফ্রান্সিস আমাকে ডাকলো। কিচেনের বাইরে দাড়িয়ে খানিকটা চিৎকার করে বললো
“টামিনা তোমার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে!”
কে এসেছে জিজ্ঞেস করবো তার আগে ফ্রান্সিস উধাও। জেলি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে কাউকে দেখলাম না। না দেখে ফ্রান্সিস কে ইশারা করলাম কোথায়! সে আঙ্গুলের ইশারায় বাইরের দাড় করানো কার দেখিয়ে দিল। ইশারা বরাবার তাকিয়ে একটা কালো কার ছাড়া আর কিছু দেখলাম। মার্থা হাউজের বাইরে বেড়িয়ে এলাম। কার টার পাশে এসে কাচে নক করলাম। কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে খুট করে পাশের দরজা খুলে কেউ একজন বেড়িয়ে এলো। হুট করে বেরোতে দেখে আমি একটু চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু টিনা কে বেরোতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। এ এখানে কেন? আমার কাছে কি চাই।
কার থেকে বেড়িয়ে টিনা আমার দিকে তাকিয়ে এক রহস্যময়ী হাসি দিল। জবাবে আমি হাসতে চাইলেও হাসতে পারলাম না। বেশ একটু অস্বস্থি হতে লাগলো। টিনা আমার কাছে এসে বলল
“হ্যালো টামিনা!”
“হা-হাই টিনা!”
“কেমন আছো?”
“ভা-ভালো!”
আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। বার বার আঙ্গুল মটকাচ্ছি। টিনার সামনে খুব দূর্বল অনুভব করছি। কেন এমন মনে হচ্ছে? কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে?
“ভালো তো থাকবেই। এখন তো তোমার ভালো থাকার সময়। তাই নয় কি?”
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম
“বুঝলাম না!”
“কাম অন টামিনা! এতটা অবুঝ তো তুমি না! যে এত কান্ড ঘটাতে পারে সে আর যায় হোক অবুঝ হতে পারে না। আচ্ছা ছাড়ো। এরকম রাস্তায় দাড়িয়ে কথা বলতে তোমার সমস্যা না হতে পারে। কিন্তু একজন ওয়েটারের সাথে পারসোনাল ডিসকাসে আমার সময় ও রেপুটেশন দুটোই নষ্ট হচ্ছে।”
ভ্রু কুচকে তাকালাম।
“বলো কি বলতে চাও!”
“এড কে তুমি ভালোবাসো?”
আচমকা আক্রমনের মত প্রশ্ন শুনে আমি হা করে কয়েক সেকেন্ড টিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিনার অন্তর্বেদি দৃষ্টির সামনে নিজেকে বেশ দূর্বল মনে হল। আমতা আমতা করে বললাম
“কি-কি বলতে চাচ্ছো?”
“যেটা জিজ্ঞেস করেছি সরাসরি উত্তর দাও। আমার সাথে এরকম ঘোর প্যাচে কথা বলবে না।”
কড়া গলায় খানিকটা ধমকে উঠলো। আমি মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম
“আমি… আমি…
“বলো!”
টিনার চোখের দিকে তাকালাম
“আ-আমি লিও কে ভালোবাসি।”
কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নিরবতায় কাটলো। কিন্তু এরপর ঠাসসসস করে একটা শব্দ হলো। আর আমার বাম গাল চিন চিন করতে লাগলো। বুঝতে পারলাম কি হয়েছে। কিন্তু এ মুহুর্তে চিন চিন ব্যাথার চেয়ে রাস্তার মাঝখানে এত লোকের সামনে দাড়িয়ে থাপ্পড় খাওয়া মোটেই সুখকর মনে হলো না। বাঁকা দৃষ্টিতে অনেকে আমার দিকে তাকাতে লাগলো। কেউ কেউ করুনার দৃষ্টিতে।
আমি চড় খেয়ে টিনার দিকে তাকালাম। তার চোখ দুটো স্বাভাবিকের বড় বড় হয়ে আছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাসে বুকটা উঠা নামা করছে। রাগে ফুসছে। ফুসতে ফুসতে বলল
“তুমি কি জানো আমি তার বাগদত্তা?”
চড় খেয়ে আমার তখন অবস্থা টালমাটাল। ইচ্ছা হচ্ছিলো টিনার চুল গুলো সব টেনে ছিড়ে ফেলি। কল্লাটা টেনে শরীর থেকে আলাদা করে দিই। কিন্তু মাঝ রাস্তায় এসব করতে আমার একদম ইচ্ছা হলো না। তার ওপর এরকম কিছুর অভিযোগ পেলে ভার্সিটি থেকে বহিষ্কৃত হতে বেশি সময় লাগবেনা। তাই জবাবে বললাম
“জানি!”
“তারপরও এতটা নিচ কিভাবে হতে পারো? নিজ দেশে উপোস পড়ে থাকতে! আর এখানে এই দেশে ফ্রি সুযোগে এসে তোমার চোখ বড় হয়ে গেছে তাই না। নিজে কালো চামড়ার হয়ে ফর্সা চামড়ার ছেলে দেখে নিজেকে সামলাতে পারলে না। তার উপর এত ধনী ছেলে। থার্ড ওয়ার্ল্ডের মেয়ে থার্ড ক্লাস হতে পারে সেটা তোমাকে দেখে বুঝলাম।”
কথা গুলো শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। ইচ্ছে করছিল তাকে মার্থা হাউজের কড়াইয়ের গরম তেলে ডুবাই। কিন্তু এ মুহুর্তে আমার এসব করা একদম চলবে না। একটা ভুল পদক্ষেপ আমাকে অনেক ভোগাবে। তাই খুব কষ্টে কথা গুলো হজম করে নিজেকে সামলালাম। বললাম
“আমি লিও কে ভালোবাসি আর লিও ও আমাকে ভালোবাসে। এখানে থার্ড ক্লাস কেন আসছে?”
টিনা আরো একদম এগিয়ে এল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল
“লিসেন বিচ! এড তোমাকে ভালোবাসে না। একটু ভালো করে কথা বলায় তুমি গলে গেলে? তবে শুনে রাখো। এড তোমাকে ভালোবাসে না। সাধারন ফ্যান্টাসি তে আছে সে। আর এ ফ্যান্টাসি কেটে গেলে তখন দেখবে সে তোমাকে কোথায় ছুড়ে ফেলে?”
আমার চোখ টা ঝাপসা হওয়ার উপক্রম হলো। নাকটা একটু ঝাঝালো লাগলো। বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম
“মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।”
টিনা এবার আরেকটু এগিয়ে এসে ফিস ফিস গলায় বলল
“তুমি জানো না আমি কি করতে পারি! তবে এরপর থেকে যদি লিওর সাথে দেখি তাহলে একদম ভালো হবে না। মনে রেখ আমি টিনা এন্ডার সন!”
আমি হা করে টিনার দিকে তাকিয়ে রইলাম এমন তীক্ষ্ণ ছুরির মত কিন্তু ভয়ঙ্কর গলার হুমকি শুনে।
টিনা আর দাড়ালো না। হুট করে পিছন ফিরে কারে ঢুকে সাই সাই করে বাতাস উড়িয়ে বেড়িয়ে গেল। আর আমি দাড়িয়ে রইলাম। আবারো টুকরো হওয়া হৃদয় নিয়ে। যেখানে সান্ধ্যকালীন আকাশে সাদা মেঘ বার বার উকি মেরে যাচ্ছে। ঝালক বাতিরা যার যার জায়গায় জ্বলে উঠছে। পাখিরা নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। ইউক্যালিপটাসের ফুল টা সন্ধার ছোয়ায় আরো প্রান বন্ত হওয়ার বদলে নেতিয়ে পড়েছে। বিষন্ন বাতাস কানে কানে এসে নাকি সুরে কান্না করছে। মাটিতে ঝড়ে পড়ছে তারা ফুলের পাপড়ি গুলো। অনেক টা আমার টুকরো হওয়া হৃদয়ের মত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে।
.
(চলবে)