Story – আমার ভিনদেশি তারা
Writer – Nirjara Neera
পর্ব নং – ৫৫
———————————————–
উইনিপেগে নিয়মিত ফিল্ডে যেতাম তাই অভ্যাস বশত একই সময়ে ঘুম ভাঙত। বাংলাদেশে এসেও নিয়মের ব্যতিক্রম হলো না। যদিও বা সময়ের বিশাল হের ফের আছে। যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন কাক ডাকা ভোর। বন্ধ জানালার ছোট ছোট ফাক গলে একটু একটু আবছা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। আরেকটু ঘুমাতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। উসখুস করতে করতে উঠে গেলাম। বেশ ঠাণ্ডা পড়ছে চারদিকে। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময় এখন। ভোরে ভোরে এখনো কুয়াশা পড়ে। সূর্য উঠতেই বেশ কড়া রোদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। মাফলার টা গলায় জড়িয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। বাইরে বেশ আবছা অন্ধকার। সুনসান নিরবতা। খোয়াড়ের ভিতর থেকে মোরগ টা ডাকছে। হয়ত ডেকে ডেকে বলছে ভোর হয়েছে, এবার আমাকে বেরুতে দাও। ফযরের আযান দিয়েছিল বেশ কিছুক্ষন আগে। এই আলো আধারে আমার কিছুই ভালো লাগছেনা। তাই পুকুর ঘাটে চলে গেলাম। সেখানেও কুয়াশার একছত্র আধিপত্য। হালকা ধোয়া উঠছে পানি থেকে। যেন পুকুরের নিচ থেকে কেউ পুকুরের পানি কে জ্বাল দিচ্ছে।
আমি পুকুরে নেমে পানি একটু করে স্পর্শ করলাম। ওহ্ মা! আর্তনাদ করে সাথে সাথেই আবার পা তুলে ফেললাম। পানি বরফের চাইতেও ঠাণ্ডা হয়ে আছে। এ ঠাণ্ডা পানিতে অযু করবো কিভাবে? খানিকটা ইতস্থত করে হাত পানিতে ডুবিয়ে দিলাম। পুরো শরীর শিউরে উঠছে। যেন পুকুর থেকে ভোল্টেজের উপর ভোল্টেজ কারেন্ট সাপ্লাই করছে শরীরে। অযু করার সময় দাঁতে দাঁত চেপে রইলাম।
নামাজ শেষ করে বেড়ুতেই আলো অনেক খানি ফুটে উঠেছে। কচি লাউয়ের ডগা গুলো তে শিশির বিন্দু মুক্তার মত জ্বলজ্বল করছে। কুয়াশা ভেজা খড়ের গাদা কে মনে হচ্ছে পানিতে ভিজে চুপসে যাওয়া কোনো মুরগী। উঠানের কোণে জাম গাছের ডালে দু জোড়া শালিক নিজেদের মধ্যে বেশ ঝগড়া লাগিয়েছে। শরীফা খালা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। মা মুরগী টা সগর্বে বুক ফুলিয়ে এক পাল ছানা পোনা নিয়ে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তৈয়ব চাচু পুকুর ঘাট থেকে অযু করে মসজিদের দিকে এগুচ্ছে। উসমান চাচা গায়ে চাদর পেঁচিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভোলা ও ঝিমুতে ঝিমুতে দাওয়ায় উঠে বসেছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে বাংলার এ রূপ টাকে দেখছিলাম। কানাডা যতই পরিচ্ছন্ন দেশ হোক না কেন, যতই মুগ্ধ কর হোক না কেন, বাংলার এ প্রাঞ্জল রুপের সাথে আর কোনো দেশের তুলনা হয় না। দেখে আমার মনে মনে বলতে ইচ্ছা করছে
“সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি!”
আমি ভোলার দিকে এগিয়ে গেলাম। হালকা করে ধাক্কা দিয়ে বললাম
“আমার সাথে দৌড়াবি?”
ভোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালো। বলল
“কি কন মীরাপা?”
“উঠ!”
“মীরাপা?”
“উঠতে বলছি তোরে।”
ভোলা বাধ্য ছেলের মত উঠে দাড়ালো। গলায় পুরোনো উলের মাফলার। মাথার রোদে পোড়া চুল গুলো লালচে বর্ণ ধারন করেছে। গলায় হাজার বছরের পুরোনো তাবিজ ঝুলানো।
“আমার সাথে যাবি। চল?
“কই মীরাপা?”
“যেখানে নিয়ে যাব।”
.
বাড়িতে পৌছতেই আব্বার মুখোমুখি পড়লাম। ভীষণ হাঁপাচ্ছি দৌড়ের কারণে। আর আব্বা ও সামনে পড়েছে। কি যে করি? আব্বা থম থম মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হল সকাল সকাল পুরো গ্রাম দৌড়ে আসা ব্যাপার টা তিনি হজম করতে পারছেন না। অস্বস্থি টা কাটাতে আমি সালাম দিলাম
“আসসালামু আলাইকুম আব্বা।”
আব্বার সাথে প্রথম মুখোমুখি দেখা হল। দাড়ি চুল কিছুটা সাদা হয়েছে। সেখানে মেহেদি লাগিয়ে লাল করা হয়েছে। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর টুপি মাথায় আব্বাকে ফেরেশতা বলেই মনে হচ্ছে। কাল রাতেও দেখা হয় নি। আমি ইচ্ছা করেই যাই নি ক্লান্ত ছিলাম বলে। আব্বার অসুস্থতার কথা শুনে দৌড়ে এসেছিলাম। কিন্তু হাটা চলা দেখে মনে হল উনি সুস্থ। শুধু আমার মা টা অসুস্থ।
আমার সালাম শুনে কটমটে গলায় জবাব দিল
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
এরপর আর কোনো না বলে গটগট করে বেড়িয়ে পড়লেন। আমি শুধু কোমড়ে হাত দিয়ে দেখতে লাগলাম। ইতোমধ্যে ভোলাও আমার পিছু পিছু দৌড়াতে হাজির হয়েছে। সেও হাপিয়ে উঠেছে। তার শ্যামলা গাল টা আরো রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছে দৌড়ের কারনে।
.
সকাল টা এক রকম রুমের মধ্যে কাটলো। কেউ আমাকে বেরুতে দিচ্ছে না। এদিকে পাড়া প্রতিবেশি এসে আমাদের ঘরে উঁকি ঝুকি দিচ্ছে। কেউ কেউ শরীফা খালার সাথে বসে কথার ছলে আমার কথা জানতে চাইছে। কেউ তো সরাসরি আমাকে দেখার নাম ঘরে ঢুকে পড়ছে। আমার হয়েছে জ্বালা। সকাল থেকে আম্মা কেও দেখছিনা। ফোন টা কোথায় গায়েব হল খুজেই পাচ্ছি না। পুরো পাগল হওয়ার মত অবস্থা। চাচী এসে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলো
“কি খুজছো তাহমিনা?”
“আমার ফোন! ওটা খুজে পাচ্ছি না।”
“এদিক সেদিক আছে হয়ত। পাওয়া যাবে। তোমার কি কিছু লাগবে?”
“না চাচী। তবে মাকে দেখছিনা সকাল থেকে। মা কোথায়?”
“তোমার মা রান্না ঘরে। শরীফার সাথে রান্না করছে।”
“ওহ্ তাহলে আমি মার কাছেই যাই!”
“যেও না তাহমিনা। পাড়ার মহিলারা আসছে যাচ্ছে। সামনে না যাওয়ায় ভালো।”
মন খারাপ হয়ে গেল। ঘরে এক রকম বন্দী হয়ে আছি। কিছু প্রয়োজন হলে চাচী দিয়ে যাচ্ছেন।
দুপুর গড়িয়ে এলো। এখনো বাইরে বেড়ুতে পারছিনা। বিছানায় উপুর হয়ে অলস ভাবে পেপার ওয়েট টা ঘুরাচ্ছি। ভাবছি নিতান্তই কিছু আজগুবি কল্পনা।
“বাদরী!”
ডাক শুনে ঝট করে পিছনে ফিরলাম।
“মামা!”
লাফিয়ে উঠে মামা কে জড়িয়ে ধরলাম। মামা হাসতে লাগল।
“কি করিস? চেপে মেরে ফেলবি নাকি রে?”
“মামা!”
“কেমন আছিস?”
মামা কে ছেড়ে দিয়ে বললাম
“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো মামা?”
“এই ভালো আছি।”
“আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে। তাই না মামা?”
“কি যা তা বলছিস? তেমন কিছু হয় নি?”
“তাহলে আব্বা তোমাকে মারলো কেন?”
“ওসব মিথ্যা কথা। বিশ্বাস করিস না। এমনে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।”
“সত্যি তো?”
“আরে সত্যি বলছিরে পাগলী। আমি কি কখনো মিথ্যা বলি?”
মামার বলার ধরনে আমি হেসে দিলাম। বললাম
“ছোট মামী কোথায়?”
“আসছে। ওই দিকে তোর মার সাথে কথা বলছে।”
“হুম!”
“তা তোর গ্র্যাজুয়েশনের খবর কি?”
“পরীক্ষা তো দিয়ে আসলাম মামা। রেজাল্ট টাই জানতে পারি নি। তার আগেই বড় মামা ফোন করে বলল আব্বা অসুস্থ। তাই টিকিট কেটে চলে এসেছি।”
“বলিস কিরে?”
“হ্যা মামা!”
মামা একটু অন্যমনষ্ক হয়েই বলল
“ভাইজান আর দুলাভাইয়ের মাথায় চলছে কি?”
“কিছু বললে মামা?”
“নাহ্ কিছু না।”
ছোট মামা বিছানায় উঠে বসলো। আমি আবারো মামা কে ডাকলাম
“মামা!”
“হুম!”
“তুমি আর আমাকে ফোন কর নাই কেন? আমি কত চিন্তায় ছিলাম জানো?”
মামা সাথে সাথে জবাব দিলো না। তার মুখ টা কালো হয়ে গেল। মুখ কালো করে বলল
“তোর খুব টাকার সমস্যা হয়েছিল। তাই না রে?”
“কি যে বলনা মামা! টাকার অভাবের চাইতে তোমাদের চিন্তা বেশি হচ্ছিল। হুট করে সবাই যেভাবে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলে তাতে নিজেকে এতিম এতিম বলে লাগছিল।”
মামা হেসে দিল। বলল
“এখন এসে গেছিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
.
দুপুরে আম্মা কম করে হলে পনেরো থেকে বিশ পদের রান্না করেছে আমার জন্য। পুরো বাড়ি গম গম করছে। সব আত্মীয় স্বজন এসে ভীড় করছে। ভীষণ হাঁসফাস করছি। বড় মামা, মেজ মামা, ছোট মামা ও তিন মামী তাদের সন্তান রা, ফুপা-ফুপি, তৈয়ব চাচু আর চাচী সব মিলে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার।
খাওয়ার দাওয়ার পর রুমে একটু বসছিলাম। অমনি চাচী এসে বললেন আব্বার রুমে যেতে। আমাকে নাকি ডাকা হয়েছে। শুনে একটু ভয় ভয় লাগল। দুরুদুরু বুকে আব্বার রুমে গেলাম। সেখানে গিয়ে আমার ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা হল। সকলে সেখানে গোল ধরে বসে আছে। যেন অনেক গুরুত্ব পূর্ণ সালিশ শুরু হবে। বড় মামা আয়েশ করে পান চিবুচ্ছেন। আব্বা গম্ভীর মুখে কপাল কুচকে আছে। আম্মা চুপচাপ চাচীর সাথে বসে আছে। বাকি রা কোন চিন্তা ছাড়া। নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। শরীফা খালা ট্রে তে করে সবাই কে চা বিলাচ্ছে। চলছে টা কি?
আমাকে দেখে ফুপি ডাকলেন
“তাহমিনা এদিকে আসো।”
আমি গেলাম। উনি আমাকে পাশে বসালেন। মুখের এক কোনের পান খাওয়া ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন
“বসো এইখানে।”
আমি বসতেই উনি বললেন
“অনেক তো ঘুরাঘুরি করলা। এবার কি করবা ভাবছো?”
“ফুপি আমি…!
“থাক তোমার আর চিন্তা করা লাগবেনা। তুমি মাথা কে বিশ্রাম দাও। অনেক করছো। এবার আমাদের করতে দাও।”
কথার আগা মাথা বুঝলাম না। কিছু জিজ্ঞেস করব তার আগে বড় মামা গলা খাকড়ি দিয়ে উঠল। খাকড়ি দিয়ে শরীফা খালা কে ডাকলেন
“শরীফা?”
“জে ভাইজান?”
“তুমি একটু বাইরে যাও। আর কেউ যেন ভিতরে না আসে। দরজটা লাগায় যাবে।”
“জে ভাইজান।”
শরীফা খালা দরজা লাগিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেল। বড় মামা বলতে শুরু করলেন।
“তাহমিনা!”
“জি মামা!”
“তুমি হইলে আমার ভাগিনী। আমার জান।”
মামা একটু থামলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন
“তুমি তোমার বিয়ার দিন পালাই গেসিলে। ছেলে পক্ষ কে আমরা কোনো জবাব দিতে পারি নাই। হাত ধরে মাফ চাইসি। সবাই বলছে অন্য ছেলের সাথে তোমার লাইন আছে তাই পালাইছো। আমরা খুব কষ্ট পাইছিলাম।”
আমি মাথা নিচু করে ছিলাম। চোখ তুলে তাকানোর মত সাহস আমার ছিল না। ফুপি মাঝ খান থেকে বললেন
“মেয়ে রে এত বেশি পড়ান নাই। পড়াইলে পাখা গজায়। তারা উড়তে চাই। এই জন্য আবিদারে আমি মেট্টিকের বেশি পড়াই নাই। আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে আমার সুখে আছে।”
মামা ফুপি কে ধমক দিয়ে বললেন
“আয়েশা তুমি থামো। এখানে তোমার মেয়ের জন্য বসি নাই।”
ধমক খেয়ে ফুপি ফিরিয়ে বিড় বিড় করে কিছু একটা বললেন। পরিষ্কার শোনা গেল না সেটা। মামা আবার বলতে লাগল
“সমাজে আমাদের একটা মান ইজ্জত আছে। তার উপর তোমার বাবা এ গ্রামের জমিদার। তুমি পালাই যাওয়ার কারনে তোমার বাবা এবার ইলেকশনে খাড়াইতে পারে নাই। এটা কত বড় দুঃখ জনক কথা তুমি জানো?”
আমি চুপচাপ নির্বিকার। কোনো কথা বলার সাহস এ মুহুর্তে আমার নাই। মামা আবার বললেন
“তোমার বিয়ে আমরা কাজী বাড়ির ছেলের লগে ঠিক করছিলাম। ভালো ছেলে ছিল। তুমি পালাই যাওয়ার পড়েও একটা কথাও উচু গলায় বলে নাই। এমন সোনার টুকরা ছেলের জন্য সবাই মেয়ে নিয়ে বসে আছে।”
এত কথার মানে ঠিক কি হতে পারে আমি এখনো বুঝতেছিলাম না। শুধু হাতের মুটোয় হাত নিয়ে আঙ্গুল ফুটানোর চেষ্টা করছিলাম।
রুমের মধ্যে শো শো করে ফ্যানের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নাই। সবাই মনোযোগ দিয়ে বড় মামার কথা শুনছে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে বাচ্চাদের আওয়াজ আসছে। মামা বললেন
“তোমারে ভাগায় দিয়ে তোমার মা আর তোমার ছোট মামা অনেক খারাপ কাম করছে। এর জন্যও কম কাহিনী হয় নাই। তোমার মার সাথে তো আমি কথায় বলি না। নিজের মেয়ের সাথে কেউ এমন করে?”
বড় মামা একটু করে থামলেন। যেন প্রস্তুতি নিচ্ছেন পরবর্তী কি বলবেন।
“কানাডা গেছো, অনেক ঘুরছো, পড়ছো। এবার ফিরে আসছো। আর তো কোনো সমস্যা নাই। তাইলে এবার আর…”
দু বার খুক খুক করে মামা কাশলেন।তারপর গলা ঠিক করে বললেন
“আমাদের আর নাক কাটাইয়ো না। আমরা সকলে মিলে আবার তোমার বিয়ে ঠিক করছি। কাজী বাড়ির ছেলের সাথেই। ছেলে এখনো তোমাকে পছন্দ করে। তুমি কানাডা গেছো শুনে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। এখন তুমি আসছো বিয়েটাও সাইরা ফেলো।”
.
(চলবে)
.
:'(