একটুখানি
#লামিয়া_চৌঃ
পর্ব: ১৩
হাসানাদ সাহেব বের হতেই কূজন বেড ছেড়ে নামলো। অন্যদিন হলে রেডি হয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেত আজ মন ভালো নেই তাই বারান্দায় যেয়ে দোলনায় বসলো। চোখ বন্ধ করে ছন্দ মিলাতে চেষ্টা করছে। কূজনের মন ভালো থাকার সাক্ষী যেমন তার গিটার তেমনি মন খারাপের সঙ্গী হলো কবিতা। চোখ বন্ধ করে দুইলাইন ভেবেছে কূজন,
” মেঘের ভেজা ভেজা আবেগ,
সূর্যের তীব্র ভালোবাসা,
বিরহীদের কান্না নিয়ে,
ভোর হওয়ার শুরু।
ঝাপসা চোখের তারা,
সব আশায় গুড়ে বালি,
একটুখানি ভালোবাসার জন্যে,
একটু ভালো থাকার জন্যে।”
কূজন দোলনা ছেড়ে উঠে রুমে ফিরে এলো তারপর মোবাইল নিয়ে বেক ইয়ার্ডে গেল। ভোর হওয়ার কিছু সুন্দর ছবি তুলে ডাটা অন করলো পিক আপলোড দেওয়ার জন্য। এফবিতে যেয়েই একটু আগের ভাবা লাইনগুলো ক্যাপশন দিয়ে পিকগুলো আপলোড করলো। তারপর মেসেঞ্জারে মেসেজ চেক করতে করতে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে একটা মেসেজ পড়লো।
” ধন্যবাদ আপনাকে সাহায্য করার জন্য আর দুঃখিত না বলে চলে আসার জন্য”
কূজন সিঁড়িতেই থমকে দাঁড়ালো। একমিনিট সময় নিল বুঝার জন্য যে মেসেজটা কুহু পাঠিয়েছে। কিন্তু যখন বুঝলো এক দৌড়ে নিজের বেডরুমে চলে এলো তারপর মোবাইল নিয়ে কাউচে বসে পড়লো। শিউর হওয়ার জন্য কুহুর প্রোফাইলে ঢুকলো। নাম কুহু আরিজা দেখেই শিউর হলো যে এটা কুহুর মেসেজ। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় নাম না দেখেই মেসেজ পড়েছিলো।
কিন্তু কূজন বুঝতে পারছে না কুহু তার আইডি কীভাবে খুঁজে বের করলো। কূজন তো নিক নেইমে দেওয়া। কূজন এই চিন্তা বাদ দিয়ে কুহুকে মেসেজ করলো,
– আপনি কি কুহু বলছেন? আই মিন জানালার পাশের কুহু? আন্টি এখন কেমন আছেন?
তারপর ওয়েট করতে লাগলো রিপ্লাই পাওয়ার কিন্তু কোনো রিপ্লাই পেল না।
আধা ঘণ্টা পর মোবাইলে রিমাইন্ডার দেখে মনে হলো কূজনের তো এক জায়গায় গান গাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। কুহুর চিন্তা করতে করতে ভুলেই গিয়েছিল ভাগ্যিস রিমাইন্ডার দিয়ে রেখেছিল। মোবাইলে রেখেই ডেসিংরুমের দিকে গেল।
রেডি হয়েই ওয়ালেট বের করলো। মোবাইল, ওয়ালেট আর গিটার নিয়ে এগুলো মা বাবার ঘরের দিকে। কূজন রুমের দরজায় উঁকি দিয়েই বললো,
– মা আমি আসছি।
– এতো সকাল সকাল যে?
– প্রোগ্রাম আছে ফিরতে রাত হবে।
– খেয়ে যা।
– না মা বাইরে খেয়ে নিব নয়তো দেরি হয়ে যাবে। রাগ করো না কিন্তু মা।
– আমার লক্ষী ছেলের উপর কি রাগ করে থাকতে পারি?
কূজন দৌড়ে এসে মায়ের কপালে চুমো দিয়ে বললো,
– আসছি মা।
কূজন বাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভার রফিক ভাইকে বললো,
– রফিক ভাই ফেণী চলুন।
– কূজন ভাই ঐ হাসপাতালে?
– কোন হাসপাতালে?
– ঐ যে কালকে যে একটা আফারে নিয়ে গেলাম।
– না আমি এড্রেস বলবো সেখানে নিয়ে যাবেন, প্রোগ্রাম আছে।
– ওহ্।
– ভাই তাড়াতাড়ি।
– আচ্ছা কূজন ভাই একখান কথা কমু?
– অবশ্যই রফিক ভাই এভাবে প্রশ্ন করার প্রয়োজন নেই।
– আইচ্ছা আমনে সবসময় আমার লগের সিটে বসেন কেন? পিছনেও তো বসতে পারেন?
– আহা রফিক ভাই আপনি আমার ভাই না? ভাই সামনে একা বসবে আর আমি পিছনে বসবো এটা কোনো কথা?
– কূজন ভাই আমনে আসলেই অনেক ভালা। আমনের লগে গাড়িতে থাকলে নিজেরে ড্রাইভার ড্রাইভার লাগে না আমনের বন্ধু বন্ধু লাগে।
– আহা রফিও ভাই বন্ধু না বলুন ভাই।
রফিক কূজনের একথায় হেসে বললো,
– আমনে আসলেই অনেক ভালা।
– জানি তো কিন্তু অ্যাওয়ার্ড কোথায়?
– এই তো এহন আমনেরে ঝড়ের গতিতে উড়াইয়া ফেণী নিয়া যামু।
.
কূজন ফেনী আদর্শ মেমোরিয়াল স্কুলের সামনে যেতেই রফিককে গাড়ি থামাতে বললো।
গাড়ি থেকে নেমে পিছনে রাখা গিটার নিয়ে স্কুলের ভিতর গেল।
কথা ছিল সকাল আটটায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। কূজন পৌঁছুলো আটটা এগারোতে।
সব স্টুডেন্টরা তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কূজন সোজা স্টেজে যেয়ে উঠে গিটার নিয়ে বসলো। একজন ছাত্র এসে মাইক্রোফোন ঠিক করে দিয়ে গেল। কূজন হেসে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েই মাইক্রোফোনে বললো,
– হ্যালো! আমি রবিন ইবনে হাসানাদ। সবার কাছে প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এতোটা অপেক্ষা করানোর জন্য তবে প্রমিজ পুষিয়ে দিব।
কূজন কথা বলা শেষ করেই
গিটারে সুর তুলে চোখ বন্ধ করে গান ধরলো,
” হো এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা”
এতোটুকু গাওয়ার পরই কুহুর চেহারা ভেসে উঠলো আর কূজনের কিউট হাসিটা ধীরে ধীরে চওড়া হলো।
“যেসে খিলতা গোলাব
যেসে শায়েরকা খাব
যেসে উজলি কিরাণ
যেসে মানমে হিরাণ
যেসে চাঁন্দনী রাত
যেসে নারমি কি বাত যেসে
মান্দির মে হো ইক জালতা দিয়া
এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
যেসে সুবহোকা রুপ
যেসে সার্দিকি ধুপ
যেসে বিনাকি তান
যেসে কাঙ্গুকি জান
যেসে বালখায়ি বেল
যেসে লেহেরোকা খেল
যেসে খুশবো লিয়ে আয়ি
ঠান্ডি হাওয়া হো
এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
হো এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
এক লারকি কো দেখা তো এসা লাগা
যেসে নাচতা মোর
যেসে রেশমকি ডোর
যেসে পারীওকা রাগ
যেসে সামদালকি আগ
যেসে সোলা স্রিঙ্গার
যেসে রাসকি হোয়ার
যেসে আহিসতা আহিসতা
বাড়া নেশা”
কূজন গানটা শেষ করতেই সবার করতালিতে ক্যাম্পাস মুখরিত হয়। কূজন চোখ খুলেই নিজের বুকের বাম পাশে হাত রাখলো। হার্ট বিট বেড়ে গেছে কূজনের। কূজনের কলেজ লাইফ থেকেই সবচেয়ে প্রিয় গান এটা কতোশতো রাত যে কূজন এই গানটা গেয়ে পার করেছে তা তার গুণা নেই। কই কখনো তো এমন হয়নি। কাল রাতে মনেই ছিল না প্রোগ্রামের কথা তাই কোনো গান প্র্যাকটিস করেনি সে। আর তাই সবচেয়ে ভালো পারা গানটাই গাইলো কূজন
কিম্তু হঠাৎ কুহুর চেহারাটা ভেসে উঠলো কেনো? কুহুকে যখন সিট দেয়ার কথ বলা হয়েছিল তখন কুহু যে চিন্তার জগতে পড়ে গিয়েছিলো সেখান থেকে শুরু করে কুহর আইস্ক্রিম হাতে কূজনের পাশে এসে দাঁড়ানো, কুহুর সিটে বসতে দেওয়া,তারপর বই দেওয়া দেখে বোকা বনে যাওয়া,শালবনে কুহুর সাথে দেখা হওয়া, কুহুর কান্নারত দুটো লাল চোখ, সেই দৌড়ে চলে যাওয়া সব এক এক করে কূজনের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কূজন অবাক হয়ে গিটারটা রেখে দাঁড়ালো তারপর আবার শুরু করলো,
” লাইক আ স্মল বোউট
অন দি ওউশেন
সেনডিং বিগ ওয়েবস
ইন দা মোউশেন
লাইক হাউ অা সিঙ্গেল ওয়ার্ড
ক্যান মেইক অা হার্ট ওউপেন
বাট আই হেব অনলি ওয়ান ম্যাচ
বাট আই ক্যান মেইক আ এক্সপ্লোউশেন
এন্ড অল দোউজ থিঙ্গস
আই ডিডেন্ট সে
রেকিং বলস
ইনসাইড মাই ব্রেইন
আই ওয়াজ স্ক্রিমিং
ক্যান ইউ হিয়ার মাই বয়েজ
দিস টাইম
দিস ইজ মাই ফাইট সং
টেইক ব্যাক মাই লাইফ সং
অলরাইট সং
মাই পাওয়ারস টার্ন্ড অন
আলবি স্ট্রং আই প্লে মাি ফাইট সং”
কূজন গানটা শেষ করে নিজে বোকা বনে গেল কারণ সে অনেকগুলো ওয়ার্ড মিস করেছে, এমনকি শেষের দুই লাইন ভুলেও গেছে। কূজনের মনে হলো সবাই এখন তার উপর পচা ডিম ছুঁড়বে। কিন্তু কেউ এটা করলো না কারণ ইংলিশ গান সবাই তেমন একটা শুনে না তাই কূজন বেঁচে গেল উল্টো সবাই আরো জুড়ে হাততালি দিচ্ছি।
..
ইরিন সেই সকাল থেকে বসে আছে সুইটি ভিডিও সেন্ড করবে বলে। দূপুর বারোটা বেজে গেছে এখনও সুইটির ভিডিও পাঠানের কোনো নাম গন্ধ নেই। ইরিনের মনটাই খারাপ হয়ে গেল কাল কতো করে কলরবকে বললো কিন্তু কলরব নিল না। কাল যখন সুইটি থেকে স্কুলে কনসার্ট হবে জেনেছিলো তখনই সাথে সাথে কলরবকে ফোন করেছিল।
– ভাইয়া স্কুলে গান হবে আমাকে নিয়ে যাও প্লিজ।
– পায়ের এ অবস্হায় কখনো না।
– প্লিজ।
কলরব জবাব না দিয়েই ফোন কেটে দিল। সে জানে ইরিনের সাথে আর দুমিনিট কথা বললেই ইরিন কাজ আদায় করে নিবে। কিন্তু ইরিনের পা আগে ঠিক হতে হবে তারপর এসব আবদার পূরণ করা যাবে। ইরিন রাগে গজগজ করতে করতে তার বান্ধবী সুইটির কাছে আবার ফোন দিল,
– সুইটি আমি তো আসতে পারবো না প্লিজ তুই অনুষ্ঠানের পুরোটা ভিডিও করবি আর আমাকে পাঠাবি।
– ওকে ইরিন।
– না পাঠালে খেয়ে ফেলবো কিন্তু তোকে।
– আরে আরে পাঠাবো ল্যাংড়ি দাদী।
– একদম এসব বলবি না।
– ঠিক আছে ঠিক আছে।
– আচ্ছা যে ভাইয়াটা ঢাকা থেকে আসবেন গান করার জন্য নাম যেন কি?
– রবিন ইবনে হাসানাদ।
– প্রফেশনাল কেউ?
– না বোধহয় যতোটুকু শুনেছি শখের বসে টুকটাক গায়।
– ওহ্।
– আচ্ছা এখন রাখছি।
.
ইরিনের এখন ইচ্ছে হচ্ছে পা টেনে খুলে ফেলে দিতে। এমন পা ইরিনের দরকার নেই যার কারণে ইরিন গানের কনসার্টে যেতে পারলো না। ইরিনের যখন প্রায়য় কান্না এসে যাবে তখন সুইটি ভিডিও সেন্ড করলো। ইরিন খুশি মনে ভিডিও অন করতেই ইরিনের খুশি ধীরে ধীরে ঠোঁটে ফুটে উঠলো।
ইরিন অবাক দৃষ্টিতে কূজনের গানটা শুনলো। ইরিন পুরাই মণ্ত্রমুগ্ধ, অবাক, হতবাক। এটা কি সত্যি রবিন ইবনে হাসানাদ?
চলবে…