একটুখানি পর্ব : ৩৮

0
650

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী
পর্বঃ৩৮
কুহু থমথমে হয়ে বসে আছে। রুমের দরজা বন্ধ
করে পিহু কুহুকে ডায়েরিটা দিল। প্রথম কবিতাটা শুধু পিহুর
সামনে পড়লো। তারপর পিহুকে রুম থেকে চলে
যেতে বললো। পিহু উঠে যেতে যেতে
বললো,
– তুই একটা রাবিশ আপুণি।
কুহু পিহুর কথায় চোখ রাঙিয়ে তাকালো। পিহু
বোনের এই দৃষ্টি চিনে। এমনিতে কুহুকে সারাদিন
গালমন্দ করলেও কুহু পিহুকে বলে পিহুর মুখে বকা
শুনতেই নাকি ভালো লাগে তার। কিন্তু রেগে গেল
তখন পিহুর কপালে চড় থাপ্পর জুটে। তখন সাধারণ কথা
বললেও পিহুকে বকা শুনতে হয়। কুহু যে রেগে
গিয়েছে বুঝতে পেরে পিহু চলার গতি দ্রুত করে
রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। পিহু বের হতেই
কুহু দরজা বন্ধ করে ডায়েরি নিয়ে নীচে বসে
পড়লো। একে একে কূজনের লিখাগুলো পড়তে
লাগলো সে। একেকটা কবিতা পড়ে তার চোখে
মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়ছে। বুকের মধ্যে ছলাৎ
ছলাৎ শব্দ হতে লাগলো। তবে সে শব্দ অন্য
কেউ শুনতে পাবে না। ঠোঁটে হাসির রেখা বিস্তৃত
হতে লাগলো। পিহুর সামনে কুহুর এই অবস্হা হলে
পিহু ওকে জ্বালিয়ে মারতো। তার উপর ছোট
বোন। যতোই ফ্রি হোক তারপরো পিহু তো আর
বান্ধবী না তাই কুহু পিহুকে সরিয়ে দিল। এত ভালো
লাগছে কেনো কুহুর? হঠাৎ কুহুর চোখ গেল
খাটের নীচে। সেখানে কলরবের বাস্কেটবলটা
পড়ে আছে। যেটার জন্যই সেদিন কলরবের
কাছে দুই বোন ধরা পড়েছিল। কুহুর হাত থেকে
ডায়েরিটা পড়ে গেল। হাত পা কাঁপা শুরু করেছে তার।
দুম করে দুই চোখের পাতায় কান্নারা ঝেঁকে
বসলো। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো
সে। বুকের ভিতর সবকিছু কেমন যেন শূণ্য শূণ্য
লাগছে। কান্না বেড়েই চলছে। একসময় ফুপিয়ে
কাঁদতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ কাঁদার পর উঠে
দাঁড়ালো। ডায়েরিটা দরজার পাশে যেখানে কুহু
বসেছিল সেখানেই পরে রইলো। কুহু এগিয়ে
গেল ড্রেসিংটেবিলের দিকে। আয়নার সামনে
দাঁড়িয়ে নিজেকে একনজর দেখলো সে। বিশেষ
কিছু খুঁজে পেল না নিজের মধ্যে। ভাবতে লাগলো
কেনো দুইজন আমাকে পছন্দ করে?? আমার
মাঝে তো তেমন কিছুই নেই। কি দেখলো ওরা?
কিসে মুগ্ধ হয়েছে? এত ভেবেও কূল কিনারা
করতে পারলো না সে। হতাশ ভঙ্গিতে দরজার
কাছে ফিরে এসে ডায়েরিটা তুললো। তারপর
ডায়েরিটা সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখে
পিহুকে ডাকলো। পিহু বোনের ডাক শুনেই ঝড়ের
গতিতে এসে বোনের কাছে বসলো। কুহু
সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করলো,
– আমার জায়গায় তুই হলে কি করতিস পিহুন?
কুহু যে ওকে এরকম কোনো প্রশ্ন করবে এ
সম্পর্কে ওর বিন্দু মাত্র ধারনা ছিল না। তাই আচমকা এই
প্রশ্ন শোনেই সাথে সাথে কিছু বলতে পারলো
না। কুহু অস্হির হয়ে পিহুর হাত চেপে ধরে বললো,
– বল না পিহুন কি করতিস??
পিহু একটুখানি ভেবে বললো,
– জানি না।
কুহু হতাশ হয়ে পিহুর হাত ছেড়ে দিল। পিহুও চুপচাপ
বসে রইলো। কিছুক্ষণ বোনকে পর্যবেক্ষণ
করে পিহু চাপা স্বরে বললো,
– যদি পরিস্হিতি আগের মতন হতো তাহলে আমি
নির্দ্বিধায় কলরবের নাম বলতাম। কারণ আমি
ভেবেছিলাম কলরব তোকে ভালোবাসে কিন্তু
কূজন বাসে না। এখন যখন জানতে পেরেছি দুইজনই
ভালোবাসে তাই একমাত্র উপায় হলো তুই যাকে
ভালোবাসিস বা পছন্দ করিস তাকে বেছে নেয়া। কুহু
পিহুর দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
– এটাই জানি না। কূজনের সবকিছু আমার ভালো লাগে,
সবকিছু। একদম মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত।
আর কলর…
পিহু বোনকে থামিয়ে দিয়ে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে
বললো,
– তুই এত খেয়াল করে কবে দেখেছিস ঐ
ছেলেকে???
কুহু বোনের কথায় হেসে ফেললো। আস্তে
করে বোনের মাথায় টোকা দিয়ে বললো,
– বুদ্ধু আমি বলতে চেয়েছি যে কূজনের গান,
কবিতা, কথা বলা এগুলো ভালো লাগে।
– ওহ্ এত পেঁচিয়ে বলিস কেনো? সোজাসাপ্টা
বলতে পারিস না? এই জন্যই আমার তোদের মতন
মানুষদের বিরক্ত লাগে।
কুহু চোখ ঈষৎ ছোট করে বললো,
– কাদের মতন?
– এইতো যেমন ধর তুই তারপর কূজন।
কুহু কণ্ঠে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় কুড়িয়ে
এনে বললো,
– কিহ্?? কূজনকে ভালো লাগে না?? তুই মানুষ না অন্য
কিছু?
– তুই গাধী তাই এই ছাগলকে তোর পছন্দ হয়। কি বড়
বানোয়াট একটা কথাই না লিখলো সে।
– কি লিখেছে?
– ঐ যে তোর চুল বাতাসে উড়ছে, জানালার পাশে…
কুহু হুহু করে জোরে হেসে উঠলো। হাসতে
হাসতে পিহুর উপর গড়িয়ে পড়লো।
পিহু বিরক্ত হয়ে কুহুকে ধাক্কিয়ে সড়িয়ে দিল। কুহু
হাসতে হাসতেই বললো,
– ঐটা এমনি লিখেছে। কবিতা লিখার সময় মানুষ তো
এমন করেই।
– এই জন্যই তো এই সাহিত্যিক মার্কা লোকজন
দেখলে আমার গা জ্বলে যায়।
– তুই এসব বুঝবি না।
– বোঝার দরকারও নেই। তবে আমার একটা কথা মনে
রাখবি সবসময়। বিজ্ঞানী আর সাহিত্যিক এই দুই
শ্রেণীর মানুষ হয় ঢিলা ক্যারেকটারের।
কুহু এই কথা পিহুর মুখ থেকে হাজারবার শুনেছে। পিহুর
ধারনা বিজ্ঞানীরা সাধারণ একটা ফুল নিয়েও কিসব হাবিজাবি
জিনিস পরীক্ষা করে। নিষ্পাপ ফুলগুলোকেও
ক্যারেকটারল্যাস বলে চালিয়ে দেয়।
পরাগধানী,গর্ভমুন্ড, পুংকেশর, স্ত্রীকেশর এসব
নিয়ে ফুল জাতির মান সম্মান নিয়ে পর্যন্ত টানাটানি করে।
অপরদিকে যারা লেখক ওরা প্রতি গল্পেই প্রতিটি নায়ক
নায়িকার প্রেমে পড়ে যায়। একেকবার একেক
নারী পুরুষকে বর্ণনা করে। কীভাবে পারে
এসব?? ক্যারেকটার ঢিলা বলেই এগুলো করে ওরা।
আর কুহুও আজ দোটানায় ভুগছে কারণ মেডামের
দুইজনকেই ভালো লাগে।
কুহুর কাছে পিহুর কথাগুলো
আজ কেনো যেন কিছুটা সত্যি মনে হচ্ছে। আচ্ছা
নরেণ আর তপন এই দুজনকেই তো কুহুর পছন্দ।
আজো ভেবে বের করতে পারলো না
নরেণকে বেশি ভালো লাগে নাকি তপনকে?
ওগুলো না ভাবলেও চলবে তার। উপন্যাসের নায়ক
দুইজন কেনো হাজারজনকে পছন্দ হলেও সমস্যা
নেই। কিন্তু বাস্তবে এটা আদৌ সম্ভব না। কুহু
একইসঙ্গে দুইজনকে কখনোই ভালোবাসতে
পারে না। যেকোনো একজনকে ভালোবাসে
সে কিন্তু কাকে? কুহু প্রথম থেকে দুইজনের
সাথে দেখা হওয়া, কথা হওয়া সব মনে করলো। লাভ
হলো না। কুহু চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে সিদ্ধান্ত
নিল সে এই দুইজনের কাউকেই বিয়ে করবে না।
অন্য যেকোনো ছেলেকে সে বিয়ে
করবে কিন্তু এই দুইজনের একজনকেও সে বিয়ে
করবে না। মনে মনে দৃঢ় প্রতীজ্ঞা করলো সে।
তারপর পিহুর দিকে মুখ ফিরিয়ে দৃঢ় গলায় বললো,
– আমি পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম ছেলেকেও
বিয়ে করতে রাজি এমনকি সারাজীবন বিয়ে না করেও
থাকতে রাজি তবে এই কূজন কিংবা কলরব একজনকেও
আমি বিয়ে করবো না।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here