একটুখানি পর্ব : ৬১

0
566

একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৬১
কুহুর কলেজে আজ ক্লাস ছিল তাই স্কুলে
যেতে পারবে না,ছুটি নিয়েছে সে। কিন্তু
শরীরটা ভালো না তাই মা কলেজে যেতে
দেয়নি। তাছাড়া মাও বড় খালার বাসায়
যাবে বাসা খালি তাই যেতে নিষেধ করলো।
পিহু,বাবা কেউ নেই। কুহু ভালোই করেছে না
যেয়ে। গেলেও মনে হয়না বেশি একটা সুবিধা
করতে পারতো। মাথায় প্রচন্ডরকমের যন্ত্রণা
হচ্ছে। দিনরাত শুধু কুহুর মাথায় একটাই প্রশ্ন
ঘুরে। কলরবকে সে পাবে তো? নাকি হারিয়ে
ফেলবে? বুকের মাঝে কেমন যেন একটা
অনুভূতি হয়। এই অনুভূতি কাউকে বুঝানো সম্ভব
না। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। খালি
কলরবকে নিয়ে ভয় হয়। কলরবকে দুএকবার
বলেছেও। কলরব প্রতিবারই কুহুর এরকম কথা
শুনে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে থাকে তারপর বলে,
– ফুলটুশী ফাজিল ছেলেটাকে এতো
ভালোবাসে? আমার তো বিশ্বাসই হয় না।
কুহু তখন ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দেয়,
– বিশ্বাস হয়না কেনো? আমি কি
ভালোবাসতে জানি না নাকি?
কলরব তখন হাসতে থাকে। কলরবের হাসির
শব্দে কুহু আর রেগে থাকতে পারে না। এই তো
সেদিন কুহু যে মেকি রাগ দেখিয়েছিল
কলরবের অবস্হা তাতে দারুণ খারাপ হয়েছিল।
আর তা দেখে কুহুর যা হাসি পেয়েছিল বলার
বাইরে। বহু কষ্টে একদিন পার করেছিল কলরব।
এরপর একের পর এক ইমোশনাল মেসেজিং।
” ফুলটুশীর সাথে কথা না বলতে পেরে ফাজিল
ছেলের দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে গাছ
গাছ মনে হচ্ছে আমার। উদ্ভিদ যেমন
কার্বনডাইঅক্সাইড ছাড়া বাঁচতে পারে না
তেমনি আমিও কুহু ছাড়া বাঁচতে পারি না”
কুহু এই মেসেজ পড়ে হাসতে হাসতে বাড়িঘর
মাথায় তুলেছিল। এমনকি পিহুও অনেক
হেসেছিল। দুইবোনের কি গড়াগড়ি। কুহ হাসি
থামতেই কল করেছিল কলরবকে। কলরব ফোন
ধরতেই বলেছিল,
– এই আপনি অক্সিজেনও তো বলতে পারতেন?
এতো ছাগল কেনো আপনি?
– আরে আমি ফরেস্ট্রিতে পড়েছি তো তাই
বনজঙ্গল এসবের প্রতি টান অনুভব করি। এজন্য
বললাম আরকি।
আর আসল কথা হলো কুহু ‘ক’ দিয়ে
কার্বনডাইঅক্সাইড ও ‘ক’ দিয়ে।
কুহু সেদিন একথা শুনে হাসিররাজ্যে তুমুল
বেগে ঝড় তুলেছিল। এখনও একথাগুলো
ভাবতেই কুহুর হাসি পেতে লাগলো। একা একা
বসেই কুহু হাসছে। এমন সময় মোবাইলের
স্ক্রিনে কলরবের নাম ভেসে উঠতেই কুহুর খুশি
দ্বিগুণ হয়ে গেল। কুহু অতিদ্রুত ফোন রিসিভ
করে কলরবের সাথে কথায় মেতে উঠলো।
ঘণ্টাখানেক ধরে দুজন কথা বলছে। কলিংবেল
এর শব্দ শুনতে পেয়ে কুহু বলল,
– কে যেন এসেছে পরে কথা বলছি।
– ঠিক আছে এখন রাখছি।
কুহু মোবাইল রেখে উঠে গেল কে এলো
দেখতে। দরজা খুলেই কুহু দেখলো কূজন
দাঁড়িয়ে আছে। কূজনকে দেখে কুহু সাথে
সাথে দরজা বন্ধ করে দিল। ভয়ে কুহুর হাত পা
কাঁপতে লাগলো। বাসায় কেউ নেই তাই কূজন
বাসা পর্যন্ত এসে পড়লো? ভয়ের চোটে রুমের
দিকে পা বাড়ালো কুহু। এখনি কলরবকে
জানাতে হবে। মোবাইলের জন্য রুমের দিকে
পা বাড়াতেই কুহু দরজা ধাক্কানোর শব্দ শুনতে
পেল। কূজন ব্যাকুল হয়ে বলছে,
– কুহু প্লিজ দরজাটা খুলো। আই এম রিয়ালি
সরি! আমি ঐসময় ইচ্ছে করে তোমার হাত
ধরিনি। তোমাকে থামাতে হঠাৎ করেই
ধরেছিলাম। আমার ঐরকম কোনো ইন্টেনশন
ছিল না। আমি সত্যি দুঃখিত। কুহু আর
কোনোদিন এমন কাজ হবে না।
কুহু শান্ত স্বরে জবাব দিল,
– তাহলে আমি হাত ছাড়তে বলার পরও কেনো
ছাড়েননি? একটা কথা বললেই হলো নাকি?
আপনি যে কেমন জানা হয়ে গেছে।
– ভালো যে বাসি তা কেনো জানতে চাও না,
কুহু?
কুহু কোনো উত্তর দিল না। দাঁতে দাঁতে চেপে
হনহন করে রুমে এলো। বুকশেলফের বইগুলো
একেকটা হাঁতড়ে খুঁজতে লাগলো। কূজনের
দেওয়া বইটা পেয়েই হাতে নিয়ে প্রায় দৌড়ে
গেল। দরজার নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে কূজনের
মুখোমুখি দাঁড়ালো। কুহুকে দেখতে পেয়েই
কূজন হাতে থাকা লাল গোলাপগুলো কুহুর
দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,
– কুহু সত্যি সরি।
কুহু কূজনের হাত থেকে গোলাপগুলো নিয়ে
বইটা কূজনের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলো। ডেল
কার্নেগির সমগ্র বেশ মোটা আর ভারি।
কূজনের চোখে লেগেছে,চশমাটাও খুলে পড়ে
গেছে। কপালে হাত দিয়ে কুহুর দিকে অবাক
চোখে তাকিয়ে আছে সে।
কুহু রক্তচক্ষু নিয়ে কঠিন গলায় শাসিয়ে বলল,
– আপনার কি বিবেক বলতে কিছু নেই? শুধু হৃদয়
আছে তাইনা? কুৎসিত আর অসুস্হ একটা হৃদয়।
আমি যে আপনাকে ভালোবাসি না তা কেনো
বুঝতে পারছেন না? আপনি যদি আজ আমাকে
সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতেন তাহলে আদৌ
এসব হেরেসমেন্ট করতেন না। আমাকে
শান্তিতে থাকতে দিন প্লিজ। আর এসব ফুল
নিয়ে যান এখান থেকে।
-:কুহু আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না।
কুহু আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলো না।
গোলাপগুলো ফেলে দিয়ে পা দিয়ে মাড়িয়ে
দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পর কলরব এর ফোন
আসতেই কুহু সবটা খুলে বলল। কলরব কিছুসময় চুপ
করে থেকে বলল,
– কি বলবো বুঝতে পারছি না। আসলে কূজন
এরকম শুরু করবে তাও বাসা পর্যন্ত এসে পড়বে
ভাবতে পারিনি। মাও ফোন করে কান্নাকাটি
করছে।
কুহু বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল,
– মা কান্না করছে মানে? মা কি জানে নাকি
এসব?
– নাহ্ তা জানে না তবে কূজনের কপাল ফুলে
গেছে, চোখ মুখ সব লাল হয়ে আছে। মাথা
ব্যাথায় ছটফট করছে তাই মা কান্নাকাটি শুরু
করেছে।
কুহুর কিছু ভালো লাগছে না। কি হচ্ছে কি
এসব? ওর জীবনটা তো কতো সহজ সুন্দর ছিল। বড়
কোনো এক্সপেকটেশনও ছিল না। ছোট ছোট
বিষয়ে সুখ খুঁজে পেত। হঠাৎ করে সব গুলিয়ে
যাচ্ছে কেনো? এ কোন চুরাবালিতে পা
আটকেছে তার? দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহু বলল,
– এখন রাখছি ভালো লাগছে না কথা বলতে।
কলরব আর কথা বাড়ালো না। ফোন রাখতেই
কুহুকে একরাশ অনুশোচনা ঘ্রাস করলো। কূজন
তো একটা পাগল তা কুহু বুঝেই নিয়েছে
তারপরো ওকে এভাবে হার্ট করা ঠিক হয়নি।
এভাবে এতো অভদ্র আচরণ কীভাবে করতে
পারলো কুহু নিজেই বুঝতে পারছে না। বইটা
নরমালি দিলেই পারতো। এভাবে মুখের উপর
ছুঁড়ে দেয়ায় কুহুর এখন খারাপ লাগছে। কলরব
বলল চোখ, মুখ, কপাল সব ফুলে গেছে।
অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো কুহুর। কূজন
খারাপ তাই বলে কি তারো খারাপ হতে হবে
নাকি? এসব ভাবতে ভাবতেই ইরিনকে কল
করলো কুহু।
– হ্যালো! ইরিন কেমন আছো?
– আরে ভাবি বলো না আর। কেমন আছি জানি
না। ভাইয়াও নেই তাই ভালো লাগে না।
তোমাদের বিয়েটা যে কবে হবে আল্লাহ্
মালুম! তার উপর মা বাসায় আবার কান্নাকাটি
শুরু করেছে। কোথায় এক্সাম শেষ হলো চিল
করবো তা না করে..
– কেনো মা কাঁদছে কেনো?
– কূজন ভাইয়া একটু আগে বাসা থেকে বেরুলো।
তারপর এখন বাসায় ফিরলো কপাল ফোলে
ফেঁপে অবস্হা খারাপ,চোখও লাল টকটকে হয়ে
আছে। চশমাটাও ছিল না সাথে। আমি তখন
বাইরে ছিলাম। দোকানে গিয়েছিলাম। আসার
সময় দেখি ভাইয়া আসছে মাঝ রাস্তায়
রিকশার নীচে পড়ছিল। কোনোরকম সামলেছে।
কুহু অস্হির হয়ে বলল,
– কিছু হয়নি তো?
– কনুইয়ের দিকটা না ছিঁলে গেছে। মা এটা
দেখেনি অবশ্য। এটা দেখলে তো আরো
কান্নাকাটি শুরু করবে। আমারি তো কান্না
পাচ্ছে আর মা তো কাঁদবেই।
ইরিনের কথাগুলো শুনে কুহুর নিজেকে মেরে
ফেলতে মন চাইছে। সে খুব ভালো করেই জানে
সামনে খুব বড়রকমের ঝামেলা হতে যাচ্ছে। এই
ঝামেলায় কলরবের কিছু হয়ে যাবে না তো?
আর কূজনই যদি নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে
তাহলে কুহু নিজেকে কোনোদিন ক্ষমা করতে
পারবে না। ইরিনকে সান্ত্বনার কয়েকটা কথা
শুনিয়ে কুহু কি যেন মনে করে বাসার সদর দরজা
খুললো। দরজা খুলে নীচে তাকাতেই দেখতে
পেল ফুলগুলো পড়ে আছে। চশমাটাও নীচেই
অবহেলায় পড়ে আছে কিন্তু বইটা নেই। কুহুর
মায়া হলো খুব। সে একজন আধা পাগল মানুষ এর
সাথে এমন ব্যবহার করলো। এতো রাগ যে সে
কোথা থেকে পেয়েছে বুঝে পায় না। কুহু
নীচে ঝুঁকে চশমাটা তুললো। কি ভেবে যেন
আবার ছুঁড়ে ফেলে দিল।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here