একটুখানি
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ৬২
কুহু জিদ ধরেছে কলরবকে ঢাকা থেকে আসতেই
হবে এবং হাতে একদিন সময় দিয়েছে। কলরব বারবার
বুঝানোর চেষ্টা করেছে আসা সম্ভব না। কিন্তু কুহু
মানতে নারাজ। কলরব হয় আসবে নয়তো এখানেই
সব শেষ। কুহু থেকে কি চাকুরী বেশি ইম্পর্টেন্ট
নাকি? এই এক কথার জবাবে কলরব প্রতিবার এক কথাই
বলেছে। “চাকুরীটাও ইম্পর্টেন্ট। সব কাজ
ধীরে সুস্হে করতে হয়। তাড়াহুড়া করে শুধু লস হয়
লাভের খাতা শূণ্য পড়ে থাকে। কলরবের জীবনে
তো শুধু কুহু না আরো কিছু মানুষ আছে। একজন
সন্তান একজন ভাই হিসেবেও তাঁর কর্তব্য কম কিছু নয়
বরং বেশি। সব ভেবে চিন্তে কাজ করতে হয়।”
কুহু যখন কলরবকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে,
– কূজনকে নিয়ে আপনার কি কিছুই বলার নেই?
কলরব ধীর গলায় জবাব দিয়েছে,
– কূজনের বয়স কম, বাস্তবতা কি জানে না। বাবার
ছায়াতলে মানুষ হওয়া একটা ছেলে। যে চাইলেই সব
কিছু পেয়ে এসেছে। কোনোদিন পায়নি এমন
কিছুই তার স্মৃতিতে নেই তাই মানতে কষ্ট হচ্ছে।
সময় দাও সব ঠিক হয়ে যাবে।
কুহু কাঁটা কাঁটা গলায় তখন বলে,
– কি সময় দিব ঐ পাগলকে? আমাকে জ্বালিয়ে
মারছে। সব পেয়ে গেছে মানে কি আমাকেও
পেয়ে যাবে নাকি? আমি কি এতোটাই স্বস্তা?
কূজনের বাবা কি আমায় কিনে নিতে পারবে নাকি?
– কুহু এভাবে রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি এমন
বলিনি শুধু বলতে চেয়েছি কূজন অবুঝ, জিদ
চেপেছে মনে।
– আমি কম বুঝিয়েছি আপনার ভাইকে? যথেষ্ট
ভালোভাবে উনাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি। আর
কি করতে পারি আমি? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে
মনে হয়না এতটাও করতো।
– কুহু জানি তো। তোমাকে আমার থেকে বেশি
আর কে চিনতে পারে বলো?
– দেখুন এসব শুনতে ভালো লাগছে না। আমি
জানতে চাই আপনি কূজনকে কিছু বলছেন না
কেনো? কোনো স্টেপ কি আদৌ নিয়েছেন?
– আমি কূজনকে বুঝিয়েছি।
– রাজপুত্তুর কি বলল?
– কিছুই বলেনি চুপ করেছিল।
– বাহ্ ভালো তো। দুই ভাই তো দেখছি নিজেদের
মাঝে ঠিকই আছে। মাঝখান থেকে আমি পিষে মরছি।
আমাকে কি মানুষ মনে হয় না? আপনাদের সাজানো
পুতুল আমি? এই আপনার ভালোবাসা? মুখে বড় বড় কথা
আর কাজের বেলায় পালিয়ে বেড়ানো।
– কুহু আমি কি ইচ্ছে করে করছি নাকি?
– কিসের ইচ্ছা অনিচ্ছা বুঝাতে চাচ্ছেন? বাংলাদেশে
কেনো পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই যা
টাকার বদলে করানো যায় না। অফিসের লোকদের
ম্যানেজ করা কি এতোটাই কঠিন?
– তা ঠিক বলেছো আমি দেখি কি করা যায়।
কলরবের কি করা যায় কথাটা কানে আসতেই কুহু
মোবাইল কান থেকে সরিয়ে ছুঁড়ে ফেলল।
দেয়ালের সঙ্গে লেগে মোবাইল দু টুকরো
হয়ে পড়ে রইলো মেঝেতে। রাগে নিজের
চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো কুহুর। কবরী শব্দ শুনে
পাশের রুম থেকে দৌড়ে মেয়ের রুমে এলেন।
মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– কি হলো কিসের শব্দ হলো?
– আম্মু দয়া করে তুমি এখান থেকে যাও।
– কি হয়েছে কুহু,এমন করছিস কেনো?
– আম্মু তুমি যাবে কিনা বলো।
– হুম যাচ্ছি।
কবরী যাওয়ার সময় ভাঙা মোবাইলটা দেখলেন। যা
বুঝার বুঝে নিয়েছেন তিনি। কবরী চলে যেতেই
কুহু উঠে ড্রেসিংটেবিল এর কাছে গেল।
কলরবের দেওয়া চুড়িগুলো খুব সুন্দর করে
সাজিয়ে রেখেছে। কুহ আলনা থেকে টেনে
নিজের একটা উড়না হাতে নিল। তারপর সবগুলো চুড়ি
উড়নায় নিয়ে বেঁধে রুম ছেড়ে বেরিয়ে
পড়লো। কুহু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল কলরব
না আসা অব্দি ছাদে পাও মাড়াবে না। কিন্তু সে কথা এক
সাইডে রেখে ছাদে উঠে এলো সে। ধীর
পায়ে এসে রেলিং এর পাশে দাঁড়ালো, যেদিকটায়
কলরবদের ছাদ সেদিকটায়। তারপর উড়নাটা সহ
চুড়িগুলো কলরবদের ছাদে ছুঁড়ে ফেলল। উড়নার
গিঁট দেওয়ার সময় রাগে কুহুর হাত পা কাঁপছিল তাই
ভালোভাবে গিঁট দিতে পারেনি। ছুঁড়ে ফেলতেই
চুড়িগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছাদের অনেকখানি
জায়গা দখল করলো। কুহু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা
দেখলো। অনেক অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আকাশের
দিকে তাকিয়ে রইলো। কুহুর দৃষ্টি আজ আকাশ পানে
হলেও চোখের জলগুলো চিবুক পেড়িয়ে টপটপ
করে নীচে পড়ছে। কষ্টের পায়রা বুকের
মাঝে বন্দি করে দূর আকাশের ডানামেলা পাখিদের
মতন হতে চাইতে মন ব্যাকুল হয়ে আছে। সূর্যটা
ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। কুহু তাকিয়ে
আছে, একদৃষ্টিতে। মাঝে মাঝে পলক ফেলছে
সাথে কষ্টের ফোয়ারাও নামছে। অনেকটা সময়
এভাবে কাটানোর পর কুহু মনে মনে বলল,
– আকাশের মতন এমন একটা ছাদ চেয়েছিলাম যেটার
নীচে তুমি আর আমি একসাথে থাকবো। একটাই
ঘর,একটাই ছাদ, দুজনের ছোট্ট সংসার। কিন্তু তুমি তা
হতে দিলে না।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুহু চোখের পানি মুছে
ফেলে তারপর বাসায় ফিরে আসে। বেডরুমের
দরজা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে সে।
মা, বাবা, পিহু বহুবার ডেকেছে। কুহু উত্তরও দিয়েছে
কিন্তু শুধু একটা কথাই বলেছে,
– আমাকে একা থাকতে দাও।
পিহু দরজা ধাক্কিয়ে জিজ্ঞাসাও করেছে কলরবের
সাথে কিছু হয়েছে কিনা। কুহু প্রতিত্তুরে জানান
দিয়েছে,
– কলরবকে যদি এ বাসার কেউ ফোন করে তাহলে
কুহুর মরামুখ দেখবে।
একথা শুনে বাসার কেউ ভয়ে আর কিছুই জানায়নি। কুহি
রাতে কিছুই খায়নি। সবাই অনেক ডেকেছে কিন্তু
কুহু নড়লোও না। ক্ষুধা নেই বলে চলে যেতে
বলল। কিন্তু কবরী গেলেন না। একনাগাড়ে কুহুকে
ডেকেই চললেন। তৈয়ব সাহেবও যোগ দিলেন।
শেষে না পেরে কুহু উঠে গিয়ে রাতের খাবার
খেয়ে নিল। বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে
খেলো,কথাও বলল। কেউ জিজ্ঞাসা না করার পরও
নিজ থেকে বলল কলরবের সাথে ঝগড়া হয়েছিল
এখন ঠিক হয়ে গেছে। তারপর নিজ থেকেই আবার
জিজ্ঞাসা করলো,”কেউ কলরবকে ফোন
দিয়েছে কিনা”। কেউ দেয়নি জানতে পেরে
আশ্বস্ত হলো। কুহু এর শেষটা দেখতে চায়।
কলরবকে কিছুতেই এভাবে ফ্যামিলি থেকে চাপ
দিয়ে আনবে না। কিন্তু কলরবেরর সাথে কোনো
কথাও বলবে না। বেশিই ভালোবেসে ফেলেছিল
সে। এতো ভালোবাসা ঠিক হয়নি। পিহুর মতন
ভালোবাসায় অবিশ্বাসীদের কখনোই এতো
যন্ত্রণা নেই যতোটা আছে কুহুর মতন
প্রেমেজর্জরিতদের। কুহু খুব স্বাভাবিক আচরণ
করছে যদিও ভিতরে ভিতরে কুহুর প্রতিটা শিরা উপশিরাও
কাঁদছে। খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষণ বই নিয়েও
বসেছে। কিছুটা পড়েছেও কিন্তু পুরোটা সময়
ধরে শুধু কলরবের অবহেলাগুলো মনে
পড়েছে আর ভিতরে ভিতরে পুড়ে মরেছে
সে। কুহু শুতে যেতেই পিহু মোবাইল নিয়ে এসে
বলল,
– কলরব ভাই ফোন করেছে তোর মোবাইলে
কল ঢুকছে না নাকি।
কুহু কথা বাড়ালো না মোবাইলটা হাতে নিয়ে কানে
ধরলো। পিহু চলে যেতেই কুহু লাইন না কেটেই
মোবাইল বালিশের পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
ইচ্ছে করেই ঘুমিয়ে পড়েছে যাতে কলরবের
সাথে কোনো কথা না বলতে হয়। কলরব কুহুর
কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে কল কেটে আবার
কল করলো। কিন্তু কল রিসিভ করা হচ্ছে না তাই নিরুপায়
হয়ে কুহুর মায়ের মোবাইলে কল করলো।
কবরী মোবাইল নিয়ে এসে দেখলেন কুহু
ঘুমোচ্ছে। কুহুকে ডাক দিতে নিলে কলরব নিষেধ
করে দেয়। ঘুমোচ্ছে ঘুমাক বলে ফোন
রেখে দেয়।
চলবে…