যদি তুমি জানতে’পর্ব-৮

0
1501

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_8
(আগের পর্ব গুলোর লিংক কমেন্টে দেওয়া আছে)
আজানেন শব্দ কানে আসলেই তাড়াহুড়া করে বাসার দিকে পা বাড়ায় তুরান। রুপা ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
-‘তুমি এখনো বাসায় যাচ্ছো না কেন? তোমার আম্মু এই সময় তোমায় রুমে না দেখলে বকবে না? সারা রাত ঘুমাও নি,আমায়ও সজাগ রাখলে।’
-‘সজাগ থাকলে আমার প্রবলেম হয় না। আপনি যান।’
আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যায় রুপা। আস্তে আস্তে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে । আবছা আলো দেখা যাচ্ছে।
তুরান সতর্ক পায়ে রুমের দিকে যাচ্ছে । তুরানের মা-বাবা নিয়মিত নামাজ পড়ে। এখন নিশ্চয়ই নামাজ পড়তে উঠেছে। তুরানকে যদি এখন বিছানায় না দেখে!
তুরান রুমে ঢুকতেই গম্ভীর কন্ঠে তুরানের মা বলে,
-‘কোথায় ছিলি তুই?’
হতাশ হয়ে যায় তুরান । যা ভেবেছিলো তাই ঘটলো। মেয়েরা দ্রুত ইনিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারে,ছেলেরা এত দ্রুত মিথ্যা বলতে পারে না। মাথা চুলকাতে চুলকাতে আমতা আমতা করে তুরান বলে,
-‘রাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো তাই ছাদে গিয়েছিলাম।’
তুরানের বাবা মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছে। মা বিষয়টা সহজে বিশ্বাস করেছে কিন্তু বাবা থাকলে এত সহজে বিশ্বাস করতো না। যথেষ্ট বয়স হয়েছে তুরানে, এ বয়সে ছেলে-মেয়েরা স্বাভাবিক ভাবে বাবা-মায়ের কাছে এত জবাবদিহিতা করতে ইচ্ছুক না। ইচ্ছা, পছন্দ রুচি ভিত্তিতে নিজ স্বাধীনতায় চলতেই পছন্দ করে। কিন্তু তুরানের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বাবা-মায়ের যথেষ্ট বাধ্য সে। বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক টাও দারুন। সন্তান যখন নিজের খরচ নিজে বহন করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তখন বাবা-মায়ের সাথে সু-সম্পর্ক থাকে না। তবে এটা সবার ক্ষেত্রে না ।
-‘নামাজ টা পড়লে কি ক্ষতি হয় বল তো?’
তুরান হেসে বলল,
-‘নামাজ পড়লে আবার কি ক্ষতি হবে? নামাজ পড়ে কোথায় গিয়েছিলে? এই শহরের কিছু চিনো তুমি? হারিয়ে গেলেই হবে।’
চেয়ায় টেনে তুরানের পাশে বসলো তুরানের বাবা।
-‘নামাজ পড়ে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আজকে সকালে আবহাওয়াটা দারুন। আমি আর কোথায় হারাবো। কথা ঘুরাস না,নামাজ পড়িস না কেন?’
-‘আহা বাবা পড়ি তো ফ্রাইডে তে।’
-‘জিলাপির জন্য জুম্মার নামাজ পড়তে যাস?’
উচ্চস্বরে হেসে দিলো তুরান।
-‘বাবা আমি কি পিচ্ছি জিলাপির জন্য মসজিদে যাবো?’
তুরানের বাবা হেসে বলে,
-‘ছোট বেলা তো তাই করতি। যেদিন জিলাপি না আসতো সেদিন মসজিদে যেতিস না।’
লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে তুরান বলে,
-‘ধুর! ছোট বেলায় তো মানুষ কত কি করত।’
পকেট থেকে টাকা বের করে বাবার হাতে দিলো তুরান।
-‘অনেক দিন মায়ের হাতের রান্না খাই নি। বেশী করে বাজার করে অনো। ইলিশ মাছ এনো কিন্তু ।আমার আজ ভার্সিটি তে যেতে হবে নয়ত আমিই করতাম বাজার।’
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তুরানের বাবা বলে,
-‘টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোই দায়। তার উপর সংসার টানিস।কষ্ট করতে হয় তোর খুব তাই না?’
অম্লান হাসি দিলো তুরান। বাবা কে কষ্ট বুঝতে না দেওয়ার হাসি।
-‘আরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে তোমার। টিউশনির অভাব আছে? মাস শেষে অনেক টাকা আসে। চলে যায় সব কিছু ভালো ভাবেই।’
তাড়াহুড়া করে রওয়ানা হয়ে টিউশনির উদ্দেশ্য বের হলো তুরান। টিউশনি করে ভার্সিটি তে যেতে হবে বাসে বাদুরের মত ঝুলে ঝুলে। একদম বোরিং হয়ে যায় সারা দিনে। চোখ বেশ জ্বলছে। রাতে রুপার জন্য ঘুম হয় নি। এত কথা কিভাবে বলে মেয়েটা? কথা গুলো শুনতেও বেশ!
-‘ভার্সিটি তে যাচ্ছেন ভ্যাবলাকান্ত মশাই?’
বেলকুনির দিকে তাকায় তুরান। রুপা দাঁড়িয়ে আছে।
-‘হ্যাঁ যাচ্ছি।’
-‘আমার জন্য একটা আইসক্রীম নিয়ে আসবেন কিন্তু! আম্মু আমায় আইসক্রীম খেতে দেয় না। টনসিলে প্রবলেম বলে। এত ডাক্তারি নিয়ম -কানুন মানতে কার ভালো লাগে বলুন?’
কি অদ্ভুধ আবদার! ভিতরে কোন সংকোচ নেই। এক নিঃশ্বাসে সব কথা বলল। তুরান কি যেন ভেবে বলল,
-‘আচ্ছা আনবো।’
ঠোঁটে চিলতে হাসি ফুঁটে রুপার।
-‘আনবেন কিন্তু ভুল হয়ে ভালো হবে না। আমার ফেবারিট আইসক্রীম কোন টা মনে আছে তো?’
জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকালো তুরান ।
-‘এত ভুলোমন কেন আপনার? কালকেই তো বললাম ভ্যানিলা ফ্লেভার।’
লেট হয়ে যাচ্ছে তুরানের। কথা বাড়ানো না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো।
বেশ বড় একখানা লিস্ট নিয়ে বাজারে উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো তুরানের বাবা । তুরানের পছন্দের খাবার রান্না করা হবে,তাই এত লম্বা লিস্ট তৈরি করলো তুরানের মা।
-‘আমি এখন একা বাসায় থাকবো?’
ব্যঙ্গ সুরে তুরানের বাবা বলে,
-‘তো কি আমার সাথে বাজারে যাবে?’
-‘আমি কি তা বলছি? এখানের কাউকে চিনি না । তুরান আগে যেখানে থাকত ওখানের সবাইকে চিনতাম।’
-‘বাচ্চা মানুষের মত কথা বলছো কেন? তুরান এখানে আসলো দেড় মাস হলো, আর আমরা এখানে এই প্রথম আসলাম। আস্তে আস্তে সবার সাথে পরিচিত হয়ে যাবা।’
কোন কথা বলে না তুরানের মা। আগের বাসায় তুরান প্রায় আড়াই বছর ছিলো। ছেলের সুবাদে বাসার আশে পাশের সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। তুরানের আচরন-ব্যবহার বিশেষ করে চুপ-চাপ স্বভাব সবার আকর্ষন কাড়ে।
সাহেলা বেগম হসপিটালে চলে গেলো। রুমে একা একা বসে কার্টুন দেখছে রুপা। হঠাৎ অন্য মনস্ক হয়ে জানালার দিকে তাকালো রুপা। তুরানের রুমের সামনে একজন বয়স্ক লোক। হাতে বাজারের ব্যাগ। কে লোকটা? অনেকক্ষন পর মনে পরলো কালকে রাতে যে দুইজন কে দেখেছিলো তাঁরা বোধ হয়। তুরানের বাবা । চেহেরায় কিছু টা মিল রয়েছে। রুপা টিভি অফ করে তুরানের বাসার দিকে গেলো।
-‘এত তাড়াতাড়ি বাজার করা শেষ?’
হাতের ঘড়িটা খুলে টেবিলের উপর রেখে তুরানের বাবা বলে,
-‘তোমার নাকি একা বাসায় ভালো লাগে না তাই চলে আসলাম।’
হেসে দিলো তুরানের মা।
-‘এই হাসির কিছু নেই। গাড়িতে গিয়েছি,গাড়িয়ে এসেছি। আর বাজারের লিস্ট করা ছিলো তাই কম সময় লেগেছে।’
মুখ ফ্যাকাশে করে তুরানের মা বলল,
-‘আমি জানতে চেয়েছি এসব?’
দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ালো রুপা। আড়াল থেকে তুরানের বাবা-মায়ের কথা শুনছে। লোক দুইজন তো বেশ মজার! ভালোই জমবে তাহলে।
রুপার দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে বলে,
-‘আসবো।’
রুপার কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকায় তুরানের মা।
-‘এসো।’
মুচকি হেসে রুমে ঢুকলো রুপা। একটা চেয়ার টেনে তুরানের বাবার পাশে বসলো। তুরানের মা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হতবাক হয়ে রুপার কান্ড দেখছে। বাজার থেকে পত্রিকা এনে গভীর মনযোগে পড়ছে তুরানের বাবা। একজন মানুষ এসে যে তাঁর পাশে বসলো সে খেয়ালও নেই।
-‘বাবা কি পড়ছো?’
হতবম্ব হয়ে রুপার দিকে তাকায় তুরানের বাবা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। মেয়েটা কে? তুরান কি তাঁদের না জানিয়ে বিয়ে করলো? তুরানের মা এসে তুরানের বাবার পাশে দাঁড়ালো। দুইজনই হতবম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল রুপার দিতে।
বিস্ময় কাটিয়ে তুরানের মা বলে,
-‘কে তুমি?’
-‘সাহেলা বেগম কে চিনেন না এবাসার মালিক? আমি উনার মেয়ে।’
-‘ও। বাবা মানে?’
হেসে দিলো রুপা,
-‘বাবা মানে বুঝেন না?’
নড়েচড়ে বসে তুরানের বাবা বলে,
-‘আমায় বাবা ডাকলে কেন সেটা বলো।’
মুখ ফ্যাকাশে করে রুপা বলে,
-‘তো বাবার বয়সী মানুষকে কি ডাকে?’
-‘বাবার বয়সী মানুষ কে বাবা ডাকে এটা তোমায় কে শিখিয়েছে?’
মাথা নিচু করে ফেলল রুপা। তুরানের মা শক্ত গলায় বলে,
-‘তুরানের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক আছে?’
-‘সম্পর্ক আবার কি?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তুরানের বাবা। মেয়েটা কে দেখতে তো যথেষ্ট ম্যাচুরেট মনে হয়ে ,কিন্তু কথা গুলো অদ্ভুধ ।
-‘আরে আমার বাবা আজিজ চৌধুরীরও আপনার মত গোঁফ,চুল তাই আপনায় বাবা ডাকলাম।’
তুরানের বাবা-মা নিজেদের সামলে নেয়। তুরান আসলে সবটা জানা যাবে। তুরান আর যা হোক মিথ্যা বলবে না। সে ভরসা তুরানের উপর আছে।
রুপা আবার বলে,
-‘আম্মু তো ডাক্তার, সে হসপিটালে । আব্বু ইঞ্জিনিয়ার মানুষ সে তাঁর কাজে। আমি একা রুমে কার্টুন দেখছিলাম। ইঠাৎ আপনাদের দেখলে পেলাম তাই আড্ডা দিতে আসলাম।’
তুরানের বাবা বলে,
-‘কিসে পড়ো তুমি?’
-‘মা বলেছে আমি মেডিকেলে পড়ি।’
ফিক করে হেসে দেয় তুরানের বাবা । মাথায় গন্ডগোল বোধ হয়!
তুরানের বাবার সাথে এক নাগাড়ে কথা বলেই যাচ্ছে রুপা। তুরানের মা রান্না ঘরে। বেশ ভালো খাতির জমে উঠছে। রুপার কথা গুলো বেশ ভালোই লাগছে তুরানের বাবার কাছে।
রান্না ঘর থেকে রুমে এসে তুরানের মা বলে,
-‘বেশ ভালোই তো আড্ডা চলছে।’
রুপা বলে,
-‘মা আসো তুমিও আড্ডা দেও।’
মা ডাক শুনে চমকে যায় তুরানের মা। তুরানের বাবা হেসে বলে,
-‘আরে এত চমকানোর কিছু নেই। রুপার মায়েরও বোধ হয় তোমার মত গোঁফ,চুল আছে তাই তোমায় মা ডাকছে।তাই না রুপা?’
রুপা অট্টহেসে বলে,
-‘হ্যাঁ তাই।’
রাগান্বিত কন্ঠে তুরানের মা বলে,
-‘আমার গোঁফ,চুল আছে তাই না?’
-‘কি তোমার চুল নেই?’
-‘রাখো তোমার ফাজলামি।’
তুরানের মায়ের পিছনে পিছনে রান্না ঘরে যায় রুপা।
তুরানের মা মাংস রান্না করছে।
রুপা কিছুক্ষন উঁকিঝুকি মেরে বলে,
-‘আমি মাংস রান্না শিখবো।’
রুপার কথা এখন আর সিরিয়াস হচ্ছে না তুরানের মা। মেয়েটার হয়ত মাথায় প্রবলেম রয়েছে।
তুরানের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে নানান রকমের গল্প জুড়ে দিলো রুপা। রুপার কথা শুনে মাঝে মাঝে অট্টহাসিতে ফেটে পরে তুরানের মা।
রান্নায় সাহায্য করছে রুপা। তুরানের মা বেশ অবাক হয়ে গেলো। এত অল্প সময়ে একটা মানুষ কিভাবে অপরিচিত কারো সাথে মিশতে পারে? মেয়েটা বেশ মিশুক!
সারা দুপুর তুরানের মায়ের সাথে রান্না ঘরে কাটিয়ে দিলো রুপা ।
-‘আরে মেয়ে তোমার হাতে আগুনের আঁচ লাগবে তো।’
-‘না,না কিছু হবে না আমার।’
রুপা নাছোড়বান্দা। রান্না শেষ হওয়া অবধি রান্না ঘরেই ছিলো।
-‘আম্মু এখনো আসছে না,একা বাসায় আমার ভালো লাগে না একদম।’
রান্না শেষে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তুরানের মা। ক্লান্ত স্বরে বলে,
-‘দুপুরে না খেয়ে বাসায় যেতে পারবে না।’
-‘না,না গো। আম্মু মারবে।’
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেয় তুরানের বাবা। তুরান বাসায় ফিরিছে। চোখে মুখে ক্লান্তির চিহ্ন।
তুরান কে দেখেই উৎকন্ঠিত গলায় রুপা বলে,
-‘আমার আইসক্রীম কোথায়?’
রুপা কে বাসায় দেখে অবাক হয়ে যায় তুরান। বাবা-মা কি ভেবেছে কে জানে?
হাতের ইশারায় রুপা কে চুপ থাকতে বলে তুরান। চাপা কন্ঠে বলে,
-‘চুপ একদম।’
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here