যদি তুমি জানতে’পর্ব-৭

0
638

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_7
তুরানের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যায় রুপা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিক।সেই বিকেলে ঘুমিয়েছে এখন রাত দেড়টা বাজে। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নেমে লাইট অন করে রুপা।
মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে আর ঘুম হয় না। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকায় রুপা। পূর্নিমা রাত বোধ হয়। অনেকক্ষন চেয়ারে বসে থেকে বোর হয়ে যায়।
আচমকা মনে পরে তুরানের কথা। উনি কি এখনও ফিরে নি বাসায়? রুপা এক মুহূর্ত দেরী না করে চলে যায় তুরানের রুমের কাছে। অদ্ভুধ, থমথমে পরিবেশ,চারদিকে কোন কোলহল নেই। দরজার সামনে এখন আর তালা ঝুলানো নেই। তার মানে তুরান বাসায় ফিরেছে। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে রুপার। কেউ যদি এখন সজাগ হয়ে যায় নিশ্চই চোর ভেবে গনদোলাই দিবে। তুরানের খাট’টা রুমের দেয়াল ঘেঁষে। খাট বরাবর দুটো জানালা রয়েছে। জানালা দুটো খোলা। রুমের ভিতর কিছুই দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারের জন্য! রুপা আবার রুমে গিয়ে টর্চ লাইট নিয়ে আসে। জানালা দিয়ে লাইটের আলো গিয়ে পরে তুরানের মুখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তুরান। রুপা লাইট মেরে পুরো রুমটা দেখতে লাগলো। দুটো খাট তুরানের রুমে। আরেক’টা খাটেও মানুষ ঘুমাচ্ছে। তুরান তো এখানে একা থাকে,তাহলে ওই খাটে কে? রুপা ভালো করে লাইট মেরে দেখলো দুইজন মানুষ ঘুমাচ্ছে অন্য খাটে। একটু বয়স্ক! তুরানের মা-বাবা বোধ হয়।
ওই দিকে আর মনযোগ দেয় না রুপা। জানালার ফাঁক দিয়ে তুরানের চুল টান দেয়। ঘুম ভাঙছে না তুরানের! লাইট’টা মারলো তুরানের চোখে দিকে ,যাতে আলো একদম চোখ বরাবর পরে। লাইটের আলো চোখ পরতেই চোখ,মুখ কুঁচকে ফেলে তুরান। রুপা বার বার লাইট মারছে। এবার জোরে চুল ধরে ঝাঁকি দেয়। হকচকিয়ে উঠে বসে তুরান। হঠাৎ ঘুম ভাঙার ফলে কিছুই বুঝতে পারছে না,তবে কি হচ্ছে ব্যাপার’টা বুঝার চেষ্টা করছে।
লাইট অফ করে জানালার কপাটের আড়ালে চুপ-চাপ চোরের মত দাঁড়িয়ে রইল রুপা। তুরানের মনে হলো কেউ জানালা দিয়ে চুল টান দিয়েছে।
কিন্তু না! জানালার কাছে তো কেউ নেই। স্বপ্নে দেখছিলো বোধ হয়। এই ভেবে আবার শুয়ে পরে তুরান ।
তুরান শুয়ে পরার সাথে সাথে রুপা কন্ঠটা একটু মোটা করে বলে,
-‘আমি ভুত!’
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেলে তুরান । ভুত-পেত্নিতে ভয় পাবে কেন? ভুত কি জানালা দিয়ে চুল টান দিবে! ভয় পাচ্ছে না তুরান! বরংচ বিরক্ত হচ্ছে। এত রাতে ঘুমে ডিস্টার্ব হচ্ছে তাই।
শোয়া থেকে উঠে লাইট অন করে তুরান। রুপা আবার যথারীতি কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে পরলো। তুরান ভয় পেয়েছে এই ভেবে খুশি হচ্ছে খুব।
তুরান দ্রুত পায়ে জানালার কাছে গেলো। প্রথমে নজরে এলো কারো পা। যে জানালার কপাটের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। তবে পা দুটো মেয়ে মানুষের তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে। মেয়ে মানুষ কি ভুত হয়? মেয়েরা তো পেত্নি হয়! তুরান বেশ অবাক হচ্ছে! এত রাতে কোন মেয়ে এভাবে চুল টেনে বাচ্চা দের মত ভুত বলে ভয় দেখাতে পারে জানা ছিলো না। রাত প্রায় দুইটা। কোন মেয়ে একটা ছেলের রুমের কাছে আসছে লুকোচুরি খেলতে? অবাক করা কান্ড!
তুরান এক পা দুই পা করে সামনে আগালো।হাঁটু অবধি চুলওয়ালা মেয়ে! ফেস না দেখা গেলেও চুল দেখা যাচ্ছে! তুরানের আর বুঝতে বাকী রইল না কে হতে পারে।
আজকে তুরানের বাবা-মা এসেছে গ্রাম থেকে। তাই বেশী চেঁচানো যাবো না। এত রাতে দুইজন ছেলে মেয়েকে এক সাথে দেখলে কিছু না ঘটলেও অনেক কিছু রটবে।
তুরান চাপা কন্ঠে বলল,
-‘রুপা এত রাতে এখানে তুমি?’
মোটা কন্ঠে রুপা বলল,
-‘আমি রুপা না….আমি ভুত!’
হাসি পাচ্ছে তুরানের। রুপাকে যত দেখছে ওর কর্মকান্ডে তত অবাক হচ্ছে।
-‘বুঝছি তুমি ভুত। সাহেলা আন্টি ভুত বশ করতে পারে। সাহেলা আন্টি কে ডাকবো নাকি আংকেল কে ডাকবো?’
লাফিয়ে জানালার আড়াল থেকে বের হয় রুপা। হাতে সেই লাইট’টা নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে তুরানের সামনে দাঁড়ায়।
-‘না,না কাউকে ডাকবেন না প্লীজ।’
খানিকক্ষন চুপ থেকে রাগী কন্ঠে তুরান বলল,
-‘এত রাতে তুমি এখানে কেন এসেছো? কেউ যদি দেখে ফেলে কি হবে সেটা তুমি জানো? আমার বাবা-মা আসছে আজকে। তাঁরা যদি সজাগ হয়ে যায়?’
একটু থেমে তুরান আবার বলল,
-‘এই মেয়ে এই…প্রবলেম কি তোমার? বলেছি না আমার রুমের কাছে আসবে না। মাথায় কি কমন সেন্স নেই?’
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। আবছা আলোতে বুঝা যাচ্ছে যে ওর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
ঠান্ডা গলায় রুপা বলল,
-‘সব আমার দোষ তাই না? বিকালে যদি আপনি আমার কাছে বলে যেতেন তাহলে কি আমি আপনায় খুঁজতে আসতাম এত রাতে?’
বিস্ময় ভরা কন্ঠে তুরান বলল,
-‘আচ্ছা,আচ্ছা! তুমি আমার কে এমন হও যে তোমায় বলে যেতে হবে? তোমার মতলব কি বলো তো? প্রেমে-ট্রেমে পরে গেলে নাকি আমার।’
ছলছল চোখে তুরানের দিকে তাকিয়ে রুপা বলল,
-‘প্রেম কি?’
ব্যঙ্গ কন্ঠে তুরান বলল,
-‘তুমি তো বাবু তাই না? ফিডার খাও? প্রেম বুঝো না!’
-‘রুপা বাবু আমি!’
অবাক হচ্ছে তুরান। এত খারাপ আচরন করছে অযচ রুপা কি সাবলীল ভাবে কথা বলছে। মনে হচ্ছে তুরানে বলা কোন কথাই গায়ে মাখছে না বা কেয়ার করছে না।
তুরান রুপার হাত খপ করে ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বলে,
-‘যাও এখান থেকে। নয়ত ভালো হবে না। তোমার জন্য আতঙ্কে থাকতে হয় আমার।তুমি কি আমায় বিপদে ফেলতে চাও নাকি?’
-‘না,না আমি আপনায় ডাস্টবিনে ফেলতে চাই।’
-‘মজা নিচ্ছো তুমি? ওকে,ওয়েট! তোমার আম্মুকে ডাকছি।’
-‘এত রাতে আম্মুকে ডেকে কোন লাভ নেই। আমি যাবো না এখান থেকে। আমি এখন আপনার বাবা-মা কে ঘুম থেকে ডেকে তুলবো এবং তাঁদের সাথে ভাব জমাবো।’
রুপার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে তুরান । কি আবল তাবল বকছে মেয়েটা? রুপার কথায় বিস্মিত হয়ে যাচ্ছে তুরান!
রুপা তুরান কে ঠেলে রুমে ঢুকতে চাইলো। তুরান হেঁচকা টান দিয়ে রুপা কে সরিয়ে নিলো।
মাঝরাতে এ কোন বিপদে পরলো? এর থেকে বিপদ আর কি হতে পারে। রুপা কে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় তুরান বলে,
-‘আচ্ছা তোমার কি চাই কেন এমন করো?’
রুপা বেশ ভাব নিয়ে বলল,
-‘মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে আমার আর ঘুম হয় না। আপনি যদি এখন আমার সাথে ছাদে বসে আড্ডা না দেন তাহলে আপনার বাবা-মা কে ডাকবো।’
রাগ চাপিয়ে তুরান বলে,
-‘তুমি এখান থেকে যাবে নাকি সাহেলা আন্টি কে ডাকবো?’
-‘ডাকেন ,ডাকেন।’
কয়েক পা হেঁটেও থেমে গেলো তুরান । এত রাতে ডাকতে যাবে? কেমন যেন বেমানান লাগছে ব্যাপার টা ।
রুপা কে রাগ দেখিয়ে লাভ হবে না তেমন! আপোষে কিছু করা যায় কিনা?
তুরান এবার ঠান্ডা গলায় রুপা কে বুঝিয়ে বলে,
-‘অনেক ভালো মেয়ে তুমি। পাগলামী করো না প্লীজ। এত রাতে তুমি যদি এমন করো মানুষ বাজে ভাব্বে। কালকে বিকালে তোমার সাথে ছাদে আড্ডা দিবো হুম ?’
রুপা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-‘উঁহু! এখন।’
-‘রুপা তুমি কি খেতে পছন্দ করো?’
-‘আইসক্রীম ভ্যানিলা ফ্লেভার।’
-‘আচ্ছা আমি তোমায় কালকে দুইটা আইসক্রীম খাওয়াবো। প্লীজ চলে যাও এখন । কোন সিন ক্রিয়েট করো না।’
রুপা ভেংচি কেটে বলে,
-‘আপনায় আমি চারটা খাওয়াবো আইসক্রীম । প্লীজ চলেন না আড্ডা দেই। আপনার সাথে অনেক অনেক কথা আছে। চলেন না প্লীজ।’
খুব জোরালো কন্ঠে অনুরোধ করছে তুরান । এই মেয়েটার কোয়ালিটিই বুঝতে পারছে না। রুপার এরকম কাজে খুব বেশী রাগ হয় তুরানের । আবার ওর বাচ্চামী কথা বার্তায় রাগ সব উবে যায়।
-‘আচ্ছা চলো।’
খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় রুপা। মনে হচ্ছে কোন কাঙ্ক্ষিত বা বিশেষ জিনিস পেয়েছে।
রুপা আগে আগে হাঁটছে। তুরান একটু পিছে।
-‘এই পিছন থেকে আবার পালিয়ে যাবেন না তো?’
হেসে দেয় তুরান। ছাদে দিয়ে তুরান রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। রুপা আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
এবার রুপা এসে তুরানের শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়। রুপার হাইট পাঁচ ফিট হতে পারে,কমও হতে পারে। তুরান ছয় ফিট উচ্চতার এক সুদর্শন পুরুষ। তুরান কিছু না বলে চুপ-চাপ দাঁড়িয়ে আছে। কি করতে চাচ্ছে রুপা তাই দেখছে।
একটু পর রুপা বলে,
-‘আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে আমার। আর সবাই কে অসহ্য লাগে।’
-‘এটাই তো আমার দুর্ভাগ্য।’
-‘কি বললেন?’
-‘না কিছু না।’
রুপা এবার খানিকটা দূরত্ব রেখে দাঁড়ায়। রুপার চুলের ঘ্রান নেশার মত মনে হচ্ছে তুরানের!
-‘রুপা চুলে কি পারফিউম ইউস করো?’
এই প্রথম রুপাকে আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলো তুরান।
-‘না ফেসওয়াশ ইউস করি।’
হেসে দিলো তুরান। রুপার চুল গুলো সত্যিই খুব সুন্দর।
রুপা একটার পর কথা বলেই যাচ্ছে । তুরান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে কথা শুনছে। বেশ মজা পাচ্ছে! রুপার কথার নেশায় পরে গেলো। এত রাতে ছাদে ডেকে এনে আড্ডা দিচ্ছে । কি অদ্ভুধ!
হঠাৎ আজানের শব্দ ভেসে আসলো তুরানের কানে। সকাল হয়ে গেছে!! কথার মাঝে ডুবে ছিলো একদম খেয়ালই ছিলো না।
চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here