যদি তুমি জানতে’পর্ব-৩২

0
517

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_32
কয়েকদিন যাবৎ তুরান খুব ব্যস্ত। তুরানের বাবাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। তুরানের বেশি ভাগ সময়ই কাটে হসপিটালে। রুপার সাথে ব্যস্ততার জন্য কয়েকদিন যাবৎ তেমন কথা হয় নি। মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা হয়েছে। রুপা যে ভীষণ মন খারাপ করে আছে তা তুরান বুঝতে পারছে। হসপিটালে আসার সুবাদে তুরান এটাও জেনেছে যে সাহেলা বেগম একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। রুপার মেন্টাল প্রবলেম এটাও বুঝতে পেরেছে তুরান। রুপার এই প্রবলেম টার জন্যই রুপার প্রতি ইমপ্রেসড হয়েছে তুরান। তাই এটা নিয়ে তুরানের কোন প্রকার প্রবলেম নেই। উপরন্তু তুরানের মনে হয় যে রুপার এই পাগলামি গুলোর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট কেন? থাকুক না এমন পাগলামি সারা জীবন। কিন্তু এই পাগলামির শুরুর কারন আর কবে থেকে শুরু এটা অবশ্যই জানতে হবে তুরানের। কিন্তু হসপিটালে সারাদিন দৌড়াদৌড়ির উপর আছে তুরান। রুপা বলেছিল ওর আম্মু এসেছে। তুরানের সাথে দেখা হয় নি । তুরানের ইচ্ছা ছিল রুপার মা নামক মানুষ টা কে দেখা। আর তুরান জানে রুপা ওর মা-বাবা কে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু এবার বুঝি একটু চেঞ্জ হয়েছে রুপা। তাছাড়া রুপা আগের মত পাগলামিও করে না। রুপা এর আগেও অনেকবার বলেছে যে ওর আম্মু আসছিলো কিন্তু তুরানের সাথে কখনো দেখা হয় নি।
কালকে তুরানের বাবাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হবে। তুরানের বাবা এখন প্রায় সুস্থ। অন্যদিকে তুরানের টিউশনি, ভার্সিটি সব অফ। এ মাসে বেশ বন্ধ দিয়েছে টিউশনি। গার্ডিয়ানদের কথাও শুনতে হয়েছে, এখন আবার শুনতে হবে।
রুপার সাথে কবে যে আবার ভালোভাবে কথা হবে কে জানে? রুপা তো রাগের পাহাড় জমিয়ে রেখেছে। তাছাড়া রুপা কে নাকি এখন বেশ চোখে চোখে রাখে। তুরানের বাবা-মাও এখানে তাই কথা বলার সুযোগ হয়ে উঠেনা। তুরানের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
.
রুপার মা আজ চলে যাবে। রুপার ছোট ভাই আর ওর বাবাও এসেছে । রুপার মন এখন বিষন্নই থাকে। সব কিছু আগের মত হয়ে যায় না কেন? রুপা একটা বিষয় বুঝতে পারছে যে রুপার বাবা-মা,ভাই নামক মানুষ গুলোকে আজকাল তেমন অসহ্য লাগে না । রুপা বাবা-মা চাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য রুপা কে নিয়ে যেতে কিন্তু রুপা নারাজ। কিছুতেই এখান থেকে যাবে না। রুপার বাবা-মাও তেমন জোর করছে না। কারন তাঁরা চায় রুপা সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। তাই ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু না করাই ভালো।
রুপার ছোট ভাই অন্তিম বার বার কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে,
-‘ বাসায় চলো না দি। কতদিন তুমি বাসায় থাকো না। তোমায় অনেক বেশি মিস করি।’
বলতে বলতে চোখ গড়িয়ে পানি পরে অন্তিমের। রুপা শুধু অপরিচিত ভঙ্গিতে তাকায়। কি বলা উচিত বুঝে উঠে পারে না। যাওয়ার সময় রুপার বাবা-মা , অন্তিম সবাই কাঁদলো। এঁদের কান্না দেখে সাহেলা বেগমও না কান্না আটকিয়ে রাখতে পারলো না। রুপা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরব দর্শকের মত সব কান্ড দেখছে। এতসব কান্নাকাটির মানেই বুঝতে পারছে না আর কারনও খুঁজে পাচ্ছে না।
.
রুপার মা-বাবা চলে গেলো। রুপার মন কেন জানি বিষন্নতায় ভরে গেলো। খুব একাকিত্ব অনুভব করছে রুপা। তুরানও আগের মত সময় দিচ্ছে না। সবকিছু অসহ্য লাগছে রুপার, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। রুপা ড্রেসিং টেবিলের কাছে রাখা ফুলদানিটা ফ্লোরে আচরে ফেললো। বিকট শব্দ গিয়ে পৌঁছেলো সাহেলা বেগমের কানে। সাহেলা বেগম দৌড়ে রুপার রুমে আসলো।রুপা কে নানা ভাবে বুঝিয়ে শান্ত করলো।
কিন্তু রাতের বেলায় ভীষণ জ্বর আসলো রুপার গায়ে। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সাহেলা বেগম রুপার পাশে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। হঠাৎ এমন জ্বর আসার কারন খুঁজে পেলো না সাহেলা বেগম। রাত প্রায় বারোটা বেজে গেলো। রুপা ঘুমাচ্ছে না শুধু জ্বরে কাঁপছে। সাহেলা বেগম রুপার মাথার কাছে বসে রইলো। আজিজ চৌধুরীও অনেকক্ষণ সজাগ ছিলো। ধৈর্য হারা হয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়লো।
সাহেলা বেগম রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পরম আদরে। রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়লো রুপা। সাহেলা বেগম রুপার কপালে আলতো করে চুমু খেলো। রুপার পুরো রুমটা অগোছালো। সাহেলা বেগম দক্ষ হাতে নিঃশব্দে রুম গোছাচ্ছে।
হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের ফাঁকে একটা টিনের বক্স চোখে পড়ে। সাহেলা বেগম কৌতুহলী মনে বাক্সটা খুলে দেখলো। কতগুলো টুকরো টুকরো কাগজ। সাহেলা বেগম কাগজ গুলো খুলে দেখতে লাগলো। সাহেলা বেগমের মাথায় যেন বাজ পড়লো। বিস্ময়ে চোখমুখ কুঁচকে ঘামতে লাগলো। ধপ করে চেয়ারে বসে পরলো।
প্রথম যে কাগজটার ভাঁজ ভাঙলো সেটায় লেখা-
‘ ভার্সিটি যাচ্ছি আমি, তুমি খেয়ে নিয়ো কিন্তু, পাগলামি করো না কোন রকম।’
সাহেলা বেগম আবার একটা কাগজের ভাঁজ ভাঙলো! সেটায় লেখা-
‘ওই কালো শাড়ি টা আর নুপুর জোড়া পরে ছাদে এসো। কপালে ছোট্ট একটা টিপ দিয়ো।’
সাহেলা বেগম যেন হতবাক,নির্বুদ্ধি হয়ে যেতে লাগলো। আবার একটা কাগজের হাতে নিলো। সেটায় লেখা-
‘ মায়াময়ী আমি ভার্সিটি তে যাচ্ছি। লেট হয়ে যাচ্ছে আমার।’
সাহেলা বেগম হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরকমটা কখনো ভাবতেও পারিনি। সাহেলা বেগম ভিমড়ি খেয়ে বসে রইলো। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। রুপার বাবা-মা কে কি জবাব দিবে। তাঁরা এসব জানলে কি বলবে সাহেলা বেগম? এসব কখনো কি সম্ভব? ভুল পথে পা বাড়িয়েছে দুইজন। দুই জনের পথ এক হওয়া কখনোই সম্ভব না।
সাহেলা বেগম একে একে সবগুলো কাগজ পড়লো। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। আজিজ চৌধুরী ঘুমাচ্ছে। সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে ঘুম থেকে জাগালো। হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে থ মেরে বসে রইলো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম এক গ্লাস পানি এনে আজিজ চৌধুরীর হাতে দিলো চোখে দেওয়ার জন্য। সাহেলা বেগম কে খুব বেশি অস্থির দেখাচ্ছে।
আজিজ চৌধুরী চোখে পানি দিয়ে বললো,
-‘ কি ব্যাপার ? পাগল হয়ে গেছো নাকি? এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?’
সাহেলা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে আজিজ চৌধুরীর পাশে বসলো। তারপর নিচু গলায় বললো,
-‘ ঘুম গেছে তোমার? জরুরি কথা ছিল?’
-‘ এত রাতে কি জরুরী কথা যে এভাবে ঘুম থেকে উঠালে? সকালে বলা যেতো না?’
খানিকটা বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললো আজিজ চৌধুরী। সাহেলা বেগম চিন্তিত গলায় বললো,
-‘না এক্ষুনি বলতে হবে। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না। কি করা উচিত আমার?’
আজিজ চৌধুরী এবার বুঝতে পারলো নিশ্চয় সিরিয়ার কিছু হয়েছে। নয়ত সাহেলা বেগম এমন করতো না। আজিজ চৌধুরী নড়েচড়ে বসে বললো,
-‘ কি হয়েছে বলো? চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন তোমায়?’
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-‘ রুপার সম্পর্ক চলে তুরানের সাথে।’
আজিজ চৌধুরীর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। কনফিউজড হয়ে বললো,
-‘ তোমার কিছু ভুল হচ্ছে মনে হয়। তুরানের মত মিউচুয়াল ছেলে রুপার সাথে সম্পর্কে জড়াবে? আর ওদের সাথে সম্পর্ক সম্ভব নাকি? তুরান কি জানেনা রুপা হিন্দু? আর তুরান সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলে। কোন দিক থেকে ওদের সাথে যায়? তাছাড়া প্রনয়..।’
সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরী কে থামিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ উফ! চুপ করো তুমি। এসব যাওয়া না যাওয়ার হিসেব বাদ দেও। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত ছিলো।’
দুই জনই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। নিরবতা ভেঙে আজিজ চৌধুরী বললো,
-‘ এখন তুমি কি করতে চাচ্ছো?’
সাহেলা বেগম হতাশ হয়ে বললো,
-‘ এসব যদি পূজার কানে যায় আমি কি করবো বলো?’
আজিজ চৌধুরী কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-‘ওই ছোট লোকের বাচ্চায় আর মেয়ে খুঁজে পেলো না । ব্যাচেলর ছেলে ভাড়া দেই না। ছেলেটার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে দয়া করে ভাড়া দিয়েছি। কি কান্ড টা করলো! ওরে ডেকে আনো। এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে বলো সকাল হওয়ার আগে। রাতেই সব ঝামেলার মিটমিট হয়ে যাক। রুপা কিছু জানবে না।’
আজিজ চৌধুরীর আইডিয়া টা মন্দ না। সাহেলা বেগম বললো,
-‘ কিন্তু তুরান তো বাসায় না। ওর বাবার সাথে হসপিটালে। কালকের মধ্যে ওদেরকে বাসা থেকে বের করার ব্যবস্থা করো। আমি নয়ত ওরে পুলিশে দিবো। মানুষ সুযোগ সৎ ব্যবহার করবে এটাই স্বাভাবিক।’
তারপর দুই জন আবার চুপ করে রইলো। সাহেলা বেগমের এখনো এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। বিস্ময়ে ফেটে পড়ছে। রুপা কে কত চেষ্টা করে এই পর্যায়ে এনেছে। আবার এই আঘাত কি রুপা সহ্য করতে পারবে? এসব রোগীরা এমনিতেই খুব সেনসেটিভ হয়। রুপা আবার কি পাগলামি শুরু করবে? চিন্তায় মাথায় ধরে যাচ্ছে সাহেলা বেগমের।
সেদিন যদি তুরানকে বাসা ভাড়া না দিতো তাহলে এইদিন দেখতে হতো না। সাহেলা বেগম চিৎকার করে উঠে বললো,
-‘ হসপিটালে ফোন দেও। ওদের এলাকা ছাড়তে বলো। হসপিটাল থেকেই যেন চলে যায়। ওদের সব মালামাল ঘর থেকে ফেলে দিতে বলো। ওরা যেন এই বাসার কাছে আর না আস্তে পারে সেই ব্যবস্থা করো। দরকার হলে পুলিশের সহায়তায় নেও।’
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here