যদি তুমি জানতে’পর্ব-৪০

0
1144

#যদি_তুমি_জানতে
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_40
হাতে সাদা শাঁখা আর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া মানুষ টা রুপার মা হয় কিভাবে? তুরান কিছুই বুঝতে পারছে না। চেয়ারে না বসে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুপা রহস্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
রুপার মা পুনরায় বললো,
-‘কি হয়েছে বসছো না কেন? এনি প্রবলেম?’
তুরান নিজেকে সামলে চেয়ারে বসলো। সাহেলা বেগম চুপচাপ বসে রইলো ,কোন কথা বলছে না। তিনজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। তিন জনই উদাস হয়ে বসে রইলো খানিকক্ষণ। নিরবতা ভেঙে রুপার মা বললো,
-‘প্রথমেই আমি সরি সাহেলার আচরণের জন্য। তোমাদের বাসা থেকে বের করে দেওয়া বা গেটের ভিতরে ঢুকতে না দেওয়া এভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।’
তুরান কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। কেমন নির্বাক , হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে বললো,
-‘আপনি রুপার মা?’
পূজা রায় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
-‘হ্যাঁ। খুব হতভম্ব হয়ে গেলে আমায় দেখে? তুমি হয়ত জানতে না রুপা হিন্দু তাই তো? আমিও এমনটা ভেবেছিলাম। আরো অনেক কিছু আছে তা তুমি জানো না। সবটা তোমায় জানিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। তাই তোমায় ডেকেছি।’
তুরানের চোখের কোণে জল জমছে। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করতে লাগলো। কি হচ্ছে এগুলো তু্রান হিসাব মিলাতে পারছে না। মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন, এক্ষুনি স্বপ্ন টা ভেঙে যাবে।
পূজা রায় বুঝতে পারলো তুরানের অবস্থা। তিনি আবার বললো,
-‘আচ্ছা তুমি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারে পড়ো? কত মেধাবী ছেলে তুমি! কিন্তু এরকম বোকার মত কাজ কিভাবে করলে?’
তুরান কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-‘কি করেছি?’
পূজা রায় ফিকে হেসে বললো,
-‘এই যে একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করলে তাঁর কাছে কি একবারও জিজ্ঞেস করো নি তাঁর অতীত? তাঁর লেখাপড়া? তাঁর ধর্ম?’
তুরান পূজা রায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না যেন ভিতর থেকে আটকে আসছে। অনেকক্ষণ পর তুরান বললো,
-‘ জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু রুপা এড়িয়ে গেছে।’
-‘ এড়িয়ে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না। শতরুপা তো নিজেই এসব প্রশ্নের জবাব জানে না। কারন ব্রেনে আঘাতের কারণে নিজের অতীত ভুলে যাওয়া মানুষ টা কিভাবে এসব জানবে বলো? একজন সাইকিয়াট্রিস্টের বাসায় ট্রিটমেন্টের জন্য থাকা একটা মেয়ের সাথে তোমার মত একটা মিউচুয়াল ছেলে কিভাবে সম্পর্কে জড়ালে?’
তুরানের মাথায় আবার যেন বাজ পড়লো। অস্ফুট স্বরে বললো,
-‘কি বলছেন এসব?’
-‘এটাই সত্যি। এসব শুনার জন্য নিশ্চয় কোন রকম প্রস্তুত ছিলেনা? আর ধর্মের বিষয়টা না জানা আমি দোষের মনে করছি না ,কারন রুপা একটা মুসলিম ফ্যামিলি তে থাকতো। তুমি ভেবেছিলে রুপাও মুসলিম। রুপা হিন্দু সম্প্রদায়ের হতে পারে এটা হয়ত ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারো নি? সাহেলা আমার ফ্রেন্ড, বোনের চেয়েও বেশি।’
এতক্ষণ এই প্রশ্ন টাই তুরানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু নির্বাক হয়ে কথা বলতে পারছিলো না। তুরানের কি বলা উচিত? কি করা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছে না। পৃথিবীটা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে তুরানের।
পূজা রায় আবার বললো,
-‘ তোমাকে কিছু কথা বললো এখন মন দিয়ে শুনো।’
তুরান পূজা রায়ের দিকে তাকায়। তুরানের চোখে পানি টলটল করছে। এমন দুইজন মানুষের সামনে কিছুতেই চোখের জল ফেলতে চাচ্ছে না তুরান। খুব জোর করে আটকে রেখেছে। তুরান ক্ষীণ গলায় বললো,
-‘বলুন!’
পূজা রায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
-‘ আমার এক মেয়ে এক ছেলে। আমার ছেলের নাম অন্তিম। ছেলেটা ছোট। আর মেয়ে শতরুপা।
শতরুপা তুখোড় মেধাবী। শতরুপার স্বপ্ন ডাক্তার হবে, মেডিকেলেও চান্স পায়। তুমি যে মেয়েটার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে সে মেয়েটা ছিলো অসাধারণ মেধাবী একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে শান্তির সংসার আমার, কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। টাকা-পয়সা আছে বেহিসেবি।
তারপর একদিন রাতে কি হয় জানো? যে রাতটা একজন মায়ের কাছে মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রণাময় সে রাতের কথা বলছি। সে রাতে আমার মেয়েটা ধর্ষণ হয়।’
তুরান আঁতকে উঠে। পুরো শরীর কাঁপছে তুরানের। রুপার মা তুরানের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
-‘নিজেকে সামলাও। গল্প বাকি আছে তো।’
পূজা রায় আবার বলতে শুরু করলো,
-‘ আমার মেয়েটা ধর্ষণ হয়। অনুভব করতে পারো তুমি এর কষ্ট?এর থেকে বড় কষ্ট এক জন মায়ের জন্য আর কি হতে পারে? ধর্ষণকারী কাউকেই চিনতে পারেনি শতরুপা। আমরা কথিত সমাজের ভদ্র মানুষ। মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে লোকে জানলে কি লজ্জা! মেয়েটাও এই সমাজে আর মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারবে না! এই বিশ্রী সমাজ ব্যবস্থার কাছে হেরে গিয়েছিলাম আমরা। সমাজের মানুষের বিশ্রী দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাবের কারণে সেই রাত নিয়ে আর আইনের শরনাপন্ন হয়নি। লোকে জানাজানি হয়ে গেলে আমার মেয়েটা যে আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না!
ভুলে থাকতে চেষ্টা করলাম আমরা! কিন্তু শতরুপা ভুলতে পারেনি কিছুতেই। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ব্রেনে আঘাত খায়। নিজের অতীত ভুলে যায়, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এত উঁচু বংশের মানুষ আমরা মেয়েকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করানো কি শোভা পায়? অসহ্য পাগলামি করতো শতরুপা! বাসায় আগুন লাগিয়ে দিতো, রুমের সব জিনিসপত্র ভেঙে ফেলতো। মানুষ কে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করতো! কাউকেই চিনতো না ও! মাঝে মাঝে ওর পাগলামি তে অসহ্য হয়ে একটু রাগ দিতাম । তাই আমাদের সহ্য করতে পারতো না ও। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। শেষে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাই। সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেলা বেগম! সাহেলা আমার বাসায় গিয়ে গিয়ে শতরুপার চিকিৎসা করতো, একটা সময়ে শতরুপা সাহেলার দারুন ভক্ত হয়ে যায়। সাহেলা ছাড়া আর কাউকে সহ্য করতে পারত না। সেই থেকে সাহেলার বাসায় থাকতো ও।’
পূজা রায় একটুকু বলে থেমে যায়। বার বার চোখ মুছতে লাগলো। তুরানের দিকে তাকায় ! তুরানের চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পূজা রায় কিছুক্ষণ তুরানের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
-‘আরে একটা বিষয় বলা দরকার তোমায়। সাহেলা বলেছিলো রুপা বিবাহিতা। আসলে বিষয়টা একদমও মিথ্যা না। একটা ছেলের সাথে রুপার চার বছরের সম্পর্ক ছিলো। পারিবারিক ভাবে ওঁদের আশীর্বাদও হয়েছে। আশীর্বাদের পর ছেলেটা দেশের বাইরে যায় লেখাপড়ার জন্য। শতরুপা কে ভীষণ ভালোবাসে! শতরুপা ধর্ষণ হয়েছে জেনেও বিন্দু মাত্র দ্বিধায় পড়ে নি শতরুপাকে ভালোবাসতে। কতটা ভালোবাসলে এটা সম্ভব বলতে পারো? শতরুপার এ অবস্থা শুনে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে।ঠিক যতটা কষ্ট আমরা পেয়েছি ঠিক ততটা কষ্ট প্রনয় পেয়েছে। দেশে আসার জন্য কত চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রবলেমের কারণে আসতে পারেনি। কয়েকদিন বাদে আসবে, শতরুপা কে দেশের বাইরে নিয়ে যাবে ট্রিটমেন্টের জন্য।’
তুরান কথা বলা ভুলে গেছে যেন। হুঁশ , জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বোধ হয়! এর থেকে বিস্মিত পৃথিবীতে কে হয়েছে কবে? এমন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কার হয়েছে? এত আঘাত! এত নিদারুণ অসহায়ত্ব, যন্ত্রণা, কষ্ট, মূর্ছনা কিভাবে সহ্য করা যায়?
তুরানের শরীর কাঁপছে, ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। এত বাধা পেরিয়ে কিভাবে পাবে রুপা কে? কত বাধা,কত বিপত্তি, কত শত দেয়াল! যে রুপা কে সারাদিন চোখের সামনে দেখেছি, যে রুপার পাগলামি যে মুগ্ধ হয়েছে হাজার বার, যে রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজে পেয়েছে সহস্র বছরের ভালোবাসা! সে রুপা কে ছাড়া কিভাবে সম্ভব? ছোট এই জীবনে এত পূর্ণতা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব?
রুপা হিন্দু, রুপা ধর্ষিতা, রুপার আশীর্বাদ হয়েছে, রুপার অতীত, রুপার ভালোবাসার মানুষ! আর কত শত রহস্য রুপা তে? হোক রুপা ধর্ষিতা! তাতে কি ভালোবাসা থেমে থাকবে? কিন্তু আর সবকিছু?
অঝোর ধারায় কাঁদছে তুরান।ভুলে গেছে ওর সামনে দুই জন মানুষ বসে আছে।
এত কান্না,এত যন্ত্রণা, এত ব্যাথা সহ্য করার মতো না। কি নির্মম বাস্তব, কি পরিহাস!
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here