চন্দ্রপুকুর’ পর্ব-৪৮

0
1916

#চন্দ্রপুকুর
||শেষপর্ব|| (২য় ভাগ)
– ঈপ্সিতা শিকদার
তার চিন্তা-ভাবনার মাঝে কাছাকাছি চলে আসে আরহান। চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এই যে! কোথায় হারালেন?”

ঘোর ভাঙে যামিনীর। অবিলম্বে ফাইলটি বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে শুধায়,

“আমিই বেগম শেরপুরের, নবাবের স্ত্রী বেগম চন্দ্রমল্লিকা।”

জিভে কামড় দেয় যুবক। যামিনীর কথা তার বিশ্বাস করতে একবিন্দু সন্দেহ হয় না। কারণ সে তো প্রকৃতপক্ষে বেগম চন্দ্রমল্লিকার চেহারা দেখেনি। দেখেছে আলখাল্লা, হিজাব, নিকাবের আড়াল হয়ে থাকা এক রমণীকে।

“আমি দুঃখিত বেগম। আমি আসলে জানতাম না।”

“ঠিক আছে। আপনি এই ফাইলটি পড়ে দেখুন। আপনার কাজের।” বলতে বলতেই এদিক-ওদিক তাকায় রমণী। ভীতিতে তার হাত-পা শীতল হয়ে যাচ্ছে।

ভ্রু কুঁচকে ফেলে যুবক। হাতে নিয়ে ফাইলের কয়েকটা কাগজে চোখ বুলাতেই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় তার।

“এতো বড়ো রহস্য! এটা খোলাসা করতে পারলে তো…! আপনি জানেন না আপনি কতো বড়ো সহায়তা করলেন চন্দ্রমল্লিকা। আমি যাচ্ছি। আর আপনি চিন্তা করবেন না, আপনার ক্রেডিটও আপনিই পেয়ে যাবেন।তাছাড়া আপনি এই কার্ডটি রাখুন, যে কোনো প্রয়োজনে আমায় কল দিতে পারবেন তাতে লিখা নম্বরে।”

পকেট হতে একটি কাগজ বের করে দিয়ে উত্তেজনায় কোনো দিকে না তাকিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করে। তার মুখশ্রীতে চওড়া হাসি প্রাপ্তির।

যামিনী এবার আরও একটু অধিক ভীতিগ্রস্ত হয়। অজান্তেই কোনো ভুল কদম নিয়ে ফেলেনি তো সে!

এই কাগজ-পত্রের ফাইলটি নিয়ে দুপুর গড়ানোর পূর্বেই শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে মিস্টার হকিংস তার দলবল নিয়ে।

___

একটু একটু করে আঁধার নেমেছে গগণের শুভ্র বক্ষে। শাহাজাদি জান্নাতুল আজ প্রচণ্ড রেগে আছেন। ক্রোধে রীতিমতো সর্পের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছেন তিনি।

যে মানুষটি তাঁর জীবন ধ্বংস করেছে তিনি তাঁর রক্তের জীবন নিয়েও ধ্বংসলীলায় মেতেছেন। বয়সটা যখন আঠারো তখন তাঁর বিবাহ হয় আমির হাওলাদারের সাথে। অথচ, কিশোরী অবস্থায় ভালো তিনি বেসেছিলেন মসজিদের ইমামকে।

যদিও মানুষটিকে কখনোই বলা হয়নি ‘ভালোবাসি’ শব্দটি। তবে রোজ নিয়ম করে যেতেন মসজিদে ফজরের ওয়াক্তে কোরআন তিলাওয়াত করার বাহানায় মানুষটির একদফা দর্শন পেতে।

কিন্তু মোর্শেদা খাতুন কোনো কালেই পছন্দ করতেন না শাহাজাদি জান্নাতুলকে। ঈর্ষা করতেন। হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তিনি এই ঘটনা। কান ভাঙানো শুরু করেন জমিদার নবাব আলিবর্দি শাহের। ছিলেন কি না জমিদারের পিতা-মাতা হীন প্রিয় ভাগ্নী, তাই তিনিও বিশ্বাস করতে দ্বিধা করেননি।

ভাগ্নীর পরামর্শ অনুযায়ী কাউকে জানানো ব্যতীত বিয়ে ঠিক করেন নেশাখোর ও বদমেজাজি আমির হাওলাদারের সাথে। সেই যে শাহাজাদি জান্নাতুনের আনন্দ ও সুখের সূর্য অস্ত গিয়েছিল, তারপর আর কখনও উদয় হয়নি এই ধরনীর বক্ষে।

কতো দফা আমির হাওলাদারের মানসিক অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে এ বাড়িতে ফিরেছেন। শারীরিক অত্যাচারিতও কম হয়নি। তবে স্থান পাননি, ভাগ্নীর কথা বিশ্বাস করে তাঁকেই দোষোরোপ করেছেন তাঁর আব্বা হুজুর। যদিও মৃত্যুর সময় বহুবার ক্ষমা চেয়েছিলেন, তবুও কি এই ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আর হবে বা সম্ভব কখনো?

কথাটা ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে যান মোর্শেদা খাতুনের কামরায়। চুলের মুঠি টেনে ধরেন।

“শাহাজাদি!”

আতঙ্কিত ভঙ্গিমায় চিৎকার করে উঠেন মোর্শেদা খাতুন। শাহাজাদি যেন আরও তেঁতে উঠেন।

“সর্বনাশী! অজ্ঞাত হওয়ার অভিনয় করছিস! চল আমার সাথে শয়তান নারী, তোর ফয়সাল আজ আমি করবোই।”

তাঁর চুলের মুঠি ধরেই তিনি এগিয়ে যান বেগম লুৎফুন্নেসার ব্যক্তিগত দরবারে। কারণ এই সময় তিনি সেখানে অন্দরমহলের অর্থনৈতিক সহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনায় বসেন আয়েশা খাতুনের সাথে।

___

বেগম লুৎফুন্নেসার দরবারে জরুরি তলবে এসেছে মেহমাদ শাহ।

“আমি শুনেছি তুমি দু’দিন পর যামিনীকে নিয়ে শেরপুরের বাহিরে যাচ্ছো।”

“যা শুনেছেন দাদীজান, সত্য শুনেছেন৷ যামিনীকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। তার চিকিৎসা প্রয়োজন।”

“আজকাল শাসক হতে অধিক প্রেমিক হয়ে ভাবছো। এই চিকিৎসার জন্য বহুদিন তোমার বাহিরে থাকতে হতে পারে, ততোদিন জমিদারি কে সামলাবে চিন্তা করেছো?”

“যেই আপনার জমিদারি, সবই তো কপটতা। আমাদের পূর্বপুরুষের তৈরি করা কপটতার জাল। যাতে এখনও ফেঁসে আছে শেরপুর বাসী।” তাচ্ছিল্যের সুর যুবকের।

“মেহমাদ! আজকাল বড্ড বেশিই বিদ্রোহী হয়েছো! আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা করেছে আমাদের জন্যই করেছে। নাহলে আজ জমিদারের মতো রাজত্ব না করে রাস্তায় থাকতে তুমি। আর শেরপুর বাসীকে মন্দ রেখেছি আমরা? হাসপাতাল, খাবার, পড়াশোনা, শান্তি, কোন দিক দিয়ে কমতি আছে?”

“না নেই। বিদ্যালয় ঠিকই তৈরি করেছেন। তবে সে বিদ্যালয়ে আমাদের পড়ানো হয়নি ক্যানো? কারণ আপনারাও জ্ঞাত শহরে আরও ভালো ব্যবস্থা আছে।”

এর মাঝেই ঝড়ের বেগে দ্বার খুলে প্রবেশ করেন শাহাজাদি জান্নাতুল মোর্শেদা খাতুনের চুলের মুঠি ধরে। বেগম লুৎফুন্নেসা ও মেহমাদ শাহ উভয়ের চক্ষুশূল এ দৃশ্য দেখে বাক্যহারা।

“আম্মাজান! ফুপিজান! এ কী অবস্থা! ফুপিজান আপনি আম্মাজানের সাথে এমন আচারণ করছেন ক্যানো?”

শাহাজাদি জান্নাতুল উত্তর প্রদান করেন না। আয়েশা খাতুনের দিকে দৃষ্টিপাত করেন তিনি।

“আয়েশা খাতুন, বেগম চন্দ্রমল্লিকা যেই অবস্থায় থাকুক না ক্যানো, তাকে এই মুহূর্তে আম্মিজানের কক্ষে নিয়ে আসুন।”

“যথা আজ্ঞা শাহাজাদি।”

আয়েশা খাতুন আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

“কী হয়েছে আমার জান? তুমি এতো উত্তেজিত ক্যানো?”

আরও যেন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেন মধ্যবয়স্ক শাহাজাদি। মেঝেতে ধাক্কা মারেন অপ্রিয় কলুষিত এই নারীটিকে।

“কী হয়েছে জিজ্ঞেস করছো? তোমার এই পুত্রবধূ তথা তোমার স্বামীর প্রিয় ভাগ্নির আমার আর আমার ভাইদের জীবন ধ্বংস করে স্বস্তি মিলেনি। এখন আমার অসহায় ভ্রাতুষ্পুত্রীর জীবনটা নিয়েও ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে!”

দ্বার খুলে যামিনী এ দৃশ্য দর্শন করে এবং এই উক্তি শুনে আশ্চর্যান্বিত হয়। তার আগমনের আভাস পেতেই ফুপিজান দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।

“আমার আদুরে কন্যা। আমার চন্দ্রিমা। আমাদের বংশের একমাত্র কন্যা।”

মেহমাদ শাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

“এসব কী বলছেন আপনি ফুপিজান? যামিনী এ বংশের কন্যা!”

“হ্যাঁ রে মেহমাদ। এটা তোর আরমান চাচাজানের একমাত্র কন্যা যামিনী। এ এক অপরিবর্তনীয় সত্য, যা এই নারীর জন্য এতোকাল আড়াল হয়েছিল। আমি আমার লোক দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি এ তথ্য।”

বেগম লুৎফুন্নেসা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়েন। পরক্ষণে বড়ো বড়ো পা ফেলে জড়িয়ে ধরে চুমু খান পৌত্রীর ললাটে।

“আমার আকসা, আমার আরমানের কন্যা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো দাদু। দাদীজান না বুঝে তোমার সাথে কতো অপরাধ করে ফেলেছি।”

যামিনী স্তম্ভিত হয়ে আছে। সে বোধগম্য করতে পারছে না এখানে কী হচ্ছে। আর একজনও তার দলে শামিল, সে হলো মেহমাদ শাহ।

“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না আপনারা কী বলছেন। চন্দ্রমল্লিকা কী করে আরমান শাহের কন্যা হয়? আর আম্মাজানই বা কী করে দোষী?”

“নাটের গুরু তিনিই আমার মেহমাদ। তুমি জানো না সে কতো বড়ো ছলনাময়ী। এতোকাল তোমার সম্মুখেও ভালো সাজার অভিনয় করেছে। এমন কী যে তোমার আব্বাজানের যে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর উদ্দেশ্যে তুমি নিজেকে ও সবাইকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে আসছো, তার মূল দোষীও এই নারী। এই হৃদয় বিদারক বিষয়ে নিয়ে কথা বলতে চাইতাম না আর আব্বাহুজুর ওয়াদা নিয়েছিলেন বলে এতো সময় সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করিনি আমরা। তবে এখন আর কোনো বাধা নেই।”

“আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না কী হচ্ছে এখানে!” মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করে যামিনী।

“এখন হতে প্রায় একুশ কী বাইশ বছর পূর্বের কথা। আমাদের সুখী পরিবার ছিল। আব্বাহুজুর তথা তোমাদের দাদাজান জমিদার নবাব আলিবর্দি শাহ কর্তৃত্ব খুব ভালোভাবেই চলছিল আমাদের ছয় সদস্যের সংসার।

তবে আব্বাহুজুর হতে আমি বা আমরা পিতার ভালোবাসা কখনও পুরোপুরি পাইনি। তার কারণ ছিল এই নারী, মোর্শেদা! আব্বা হুজুরের প্রিয় পরলোকগত বোন ও ভগিনীপতির একমাত্র কন্যার দিকে তাঁর মমত্ববোধটাই অধিকই ছিল সর্বদা।

আম্মিজানের নিকট এ দৃশ্য দৃষ্টিকটু লাগলেও আব্বা হুজুরের ভয়ে নীরব থাকতেন। মোর্শেদাকেও কম আদর করতেন না তিনি। আমি, আরমান ভাইজান, লোকমান ভাইজান ও আলিউল ভাইজান কখনও বাজে আচারণ করিনি তার সাথে। সবসময় আপন ভেবেই চলেছিল।

কিন্তু এই সর্বনাশী সদাই যেন ঈর্ষাই করে গিয়েছে আমাদের। আব্বা হুজুরের নিকট তো ক্ষণে ক্ষণে আমাদের নামে মিথ্যে অপবাদই দিতেন। তবে একজনকে তার একটু অধিকই পছন্দ ছিল, তিনি ছিলেন আরমান ভাইজান। আব্বাহুজুরকে ফুসলিয়ে রাজি করায় সে এই বিবাহের জন্য।

আরমান ভাইজান বারবার বলেছিলেন তিনি অন্যকাউকে ভালোবাসেন, এই বিয়ে করতে ইচ্ছুক নন। কিন্তু আব্বাহুজুর ভাগ্নীর মিষ্টি কথায় আর মায়ায় অন্ধ হয়ে একপ্রকার আম্মিজানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বিবাহ করায় দু’জনের।

এই বিবাহের পরও স্বামীর সুখ পায়নি মোর্শেদা। তিনি ভালোবাসতেন যামিনীর মাতাকে, অবৈধ সম্পর্কও গড়েছিলেন। গর্ভবতী হয়ে যান তিনি। যার মাশুলই দিতে হয়েছিল সবাইকে।”

“কী মাশুল ফুপিজান?”

“নবাব বংশের নিয়ম ছিল যে অবধি শাহাজাদাদের মাঝে যোগ্য নবাব না পাওয়া যাবে সে অবধি কোনো শাহাজাদা লোকচক্ষুর সম্মুখে আসবে না। আর যাকে যোগ্য মনে হবে একমাত্র সেই-ই একমাত্র শাহাজাদা স্বরূপ শেরপুরে থাকবে। বাকিরা শহুরে যেয়ে ব্যবসা সামলাবে। তবে আরমান ভাই যেহেতু সবার বড়ো ছিলেন, তাই তাঁরই হক ছিল বেশি। এই বিষয়টির জন্যই প্রিয় ছিলেন কি না তিনি এই মোর্শেদার নিকট কে জানে?

আরমান ভাইজান বড়ো হলেও তিনি এতোকাল রাজি না হওয়ায় লোকমান ভাইজান ও আলিউল ভাইজানেরও বিয়ে হয়েছিল তার আরও পূর্বে। তোমার বড়ো চাচীমা গুলবাহার খাতুন ছিল সন্তানহীনা, আর তোমার মাতা নূর বাহার বেগম তোমার জন্ম হলে তাকে বেশ তাচ্ছিল্য করতেন। গুলবাহার ভাবীজানও কখনও ছাড় দেননি।

তবে ভাইজানদের কাউকেই চিনতেন না গ্রামবাসী। যেহেতু শাহাজাদাদের পরিচয় করানো নিষেধ ছিল। তাঁরা সাধারণ ভাবে গ্রামে ঘুরে বেরাতেন, গ্রামবাসীদের কোথাও কোনো সমস্যা হতো কি না দেখতেন কৈশোর অবস্থা হতেই। আমাদের অজান্তেই কোনো এক কালে গ্রামে যেয়ে আরমান ভাইজান যামিনীর মাতাকে দেখে এক দর্শনে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। যামিনীর মাতাও ছিলেন কৃষ্ণকায়া রূপসী, মায়ার অরণ্য। এজন্যই হয়তো বিয়ের নাম শুনতেই গাইগুই করতেন আরমান ভাইজান।

যাকগে ভাইজান ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সবাইকে লুকিয়ে যামিনীর মাতার নিকট নিজের পরিচয় আড়াল রেখে এই অবৈধ সম্পর্ক চলমান রাখছিলেন। এই বিষয়টি জেনে যান মোর্শেদা খাতুন। তবে কীভাবে নবাবের সম্মুখে প্রমাণ করবেন বোধগম্য হচ্ছিলো না। কারণ তার মনে হতো যামিনীর মাতা তো কখনোই ভাইজানের জন্য অহিতকর সাক্ষী দিবেন না।

তোমার হাত ধরে এই সুযোগ পায় সে মেহমাদ। তুমি ও লোকমান ভাইজান একদিন সন্ধ্যাবেলা তাঁকে দেখে ফেলেছিল সকলের আড়ালে এক কন্যার সাথে মাটির এক ঘরে ঢুকতে। লোকমান ভাইজান এ বিষয়ে আরমান ভাইজানের নিকট জিজ্ঞেসাবাদ করলে তিনি আর লুকান না। সবই বলে দেন।

আমাদের সবার মাঝে লোকমান ভাইজান একটু অধিকই পরোপকারী ছিলেন, তাঁর ভালোবাসাটাও ছিল বেশি। তাই তিনি বিষয়টি জেনেও চেপে যান। আম্মিজান অবশ্য বেশ পূর্ব হতেই জানতেন তবে ছেলেকে ফিরাতে না পেরে পুত্র হারানোর ভয়ে তিনিও চুপ ছিলেন।

কিন্তু ভুলটা করো তুমি। অবুঝ তুমি না জেনে এ তথ্য জানিয়ে দাও এই মোর্শেদাকে। কারণ ছেলেবেলায় একমাত্র বংশেরবাতির খেয়াল রাখার দায়িত্ব আব্বাহুজুর এই বিষাক্ত নারীটিকেই দিয়েছিলেন। তুমি মানো তোমার আম্মিজান তোমাকে বলেছিলেন তোমার দেখা দৃশ্য তোমার দাদাজানকে জানাতে। তবে একবারও ভাবোনি তোমার আম্মিজানকে কে বলেছে তুমি কী দেখে এসেছো? অবশ্য তোমারও দোষ না, বয়সটাই বা কতো হবে তোমার তখন।

আমি বলছি, বলেছিলেন তোমার প্রিয় আম্মাজান। যামিনীর মাতাকে তোমার চাচাজান তন্দ্রাঘোরে সব তথ্য বলে ফেলেছিল, এমন কী নবাব বাড়ির গোপন রহস্য। তবে এ আর বলেননি যে এই সম্পর্কের কথা জানলে সকলের মৃত্যু হবে। এই পরিস্থিতিকে মুখ্যম সময় ভেবে ফায়দা তুলে মোর্শেদা। যামিনীর মাতাকে যেয়ে জানায় আরমান ভাইজান তাকে বিবাহ করেছেন এবং তাকে নিয়ে শহরে চলে যাচ্ছেন। অন্তঃসত্ত্বা তিনিও বোকার ন্যায় ভাইজানকে না জানিয়ে নিজের হক চাইতে এসে পড়েন নবাববাড়ির দরবারে।

আব্বাহুজুর প্রথমে বিশ্বাস করছিলেন না। সেই বিশ্বাস জয় করতে এই পরিকল্পনায় শামিল করে তোমার মাতা নূর বাহারকে। নূর বাহার ভাবীজানও ছিলেন ক্ষমতা লোভী, উত্তরাধিকার কমবে বুঝে তিনি এক পায়ে দাঁড়া হয়ে যায়। তোমার প্রিয় খাবারের লোভ দেখিয়ে তোমায় পাঠায় সত্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে। অবুঝ তুমিও… আব্বাহুজুরের তোমার কথা অবিশ্বাস করার সুযোগ ছিল না।

আরমান ভাইজান ও লোকমান ভাইজান সেই মুহূর্তে বাড়ি ছিলেন না। কাজে বাহিরে ছিলেন। সেখান হতে আব্বাহুজুরের লোকজন তাঁকে তুলে আনেন। আতঙ্কিত হয়ে আসেন লোকমান ভাইজানও। যামিনীর মাতা হুমকি দিচ্ছিলেন নবাববাড়ির রহস্য উন্মেচন করে দিবেন তাঁকে স্থান না দিলে। আব্বাহুজুর প্রচণ্ড রেগে যান, জীবন নিয়ে নিতে তৎপর।

দরবারে এসে পরিস্থিতি বিপরীতে দেখে লোকমান ভাইজান সকল দোষ নিজের কাঁধে তুলে নেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন আব্বাজান খুব বেশি হলে তাকে বহিষ্কার করবেন। আম্মিজান আঁতকে উঠলেও চুপ থাকেন, কারণ তার ভয় ছিল এই মুহূর্ত প্রকৃত সত্য জানলে জমিদার দুই পুত্রকেই হত্যা করবে। আর আব্বাহুজুর? তিনি স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাথে সাথে এক আঘাতে তাকে হত্যা করে ফেলেন।

পরিস্থিতির গম্ভীরতা এতোক্ষণে বোধ হয় যামিনীর মায়ের। আতঙ্কে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। এরপর আর একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। স্তব্ধ হয়ে পড়েন আরমান ভাইজানও। কেউই এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আশা করেনি। আম্মিজান, ভাইজান কেঁদে এগিয়ে যেতে নেয়। আব্বাহুজুর আটকে দেন তাদের।

বলেছিলেন, ‘এই অপরাধীর কলঙ্কিত দেহ স্পর্শ করবে না লুৎফুন্নেসা। তবে তোমাদেরও আমি কী অবস্থা করবো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ছেলে প্রেমে এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিল নিজের বংশ রক্ষা ভুলে গিয়েছিল। আমি অন্যদের মৃত্যু শাস্তি দেই পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্কে, সে কেন বাদ যাবে?’

আরমান ভাইজান অনুতপ্ত ছিলেন, ক্রুব্ধ ছিলেন। তিনি শাব্দিক বিরোধিতা করেন আব্বাহুজুরের। আব্বাহুজুর পুনরায় পুরো দমে রেগে যাচ্ছিলেন। আম্মিজানের আর একজন স্বজনের মৃত্যু দেখার ক্ষমতা ছিল না। তাই তিনিই কঠোর গলায় শাস্তি দিয়েছিলেন, ‘এতো দুঃসাহস তোমার! তোমাকে বহিষ্কার করলাম আমি এই শেরপুর হতে। তুমি আর কখনোই শেরপুরে আসতে পারবে না। আলিউল হবে নবাব, আর তুমি শহরে আমাদের কাজ সামলাবে’।

তাৎক্ষণাৎ আরমান ভাইজানকে শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর জীবন রক্ষা পায়। তবে তিনিও ভুল বুঝেন আম্মিজানকে, মিথ্যে দোষারোপ করেন আম্মিজান ও এ বাড়ির সকলকে। আর যামিনীর মাতাকে আব্বাহুজুর প্রচণ্ড ভয় দেখিয়ে বের করে দেন মহল হতে। পরিচিত বাসস্থানে আর তাঁর হদিস মিলেনি। অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলেই বোধহয় আব্বাহুজুর জানে মারেননি। সেদিন এই কলুষিত নারীর জন্য সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এবারও যামিনীর তথ্য লুকিয়ে রাখতে চেয়েছে সে, এতোটাই তার ঈর্ষা।”

এক টানা অতীত বলে মেহমাদ শাহ ও যামিনীর পানে তাকায় শাহাজাদি জান্নাতুল। উভয় মানুষই কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

“আম্মাজান, আপনি? আপনি এমনটা কী করতে পারেন?”

খিলখিল করে হেসে উঠেন মোর্শেদা খাতুন।

“হ্যাঁ, আমি সব করেছি। আর আমার এতে কোনো আফসোস নাই। আর তুমি মেহমাদ, তোমাকে তো আমি কখনও দুই চক্ষুতে দেখতেই পারিনি। সবটাই ছিল মামাজানের নিকট ভালো সেজে থাকার প্রচেষ্টা। আর আমি করবো না ক্যানো এসব? আমিও শাহাজাদি ছিলাম, এই জান্নাতুলও শাহাজাদি ছিল। তবুও সে সর্বদাই অধিক মূল্য পেতো সবকিছুতে। ক্যানো?

আরমানকে বিবাহ করে ভেবেছিলাম বেগমের মর্যাদা পাবো। না, সে অন্যের প্রেমে মেতে। এতো পরিকল্পনা করে সত্য ফাঁস করলাম যেন যামিনীর মাতার ফাঁসি হয়। অথচ, ঐ বলদ বুড়োটা নিজের পুত্রকে হত্যা করে আমায় আরও বেকায়দায় ফেললো। এমন কী আরমান যাওয়ার পর আমার পুত্র সন্তান প্রতিবন্ধী রূপে ভূমিষ্ঠ হলে তাকেও ত্যাগ করতে বাধ্য করলো আমায়!

একবারও ভাবেনি আমার মমতার কথা। এতোটা বছর ধরে দাসীর ন্যায় থেকেছি আমি শাহাজাদি হয়ে। এতো অপমান সহ্য করেছি দাঁতে দাঁত চেপে। শুধু এই প্রতিশোধের তাড়নায়। তবে আজ আমি সফল। আমি সফল। তোমাদের ধ্বংস শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কিছুটা সময় বাকি তারপর জমিদারি আর জমিদার কিছুই থাকবে না।

শাহাজাদি জান্নাতুল, যে ভ্রাতুষ্পুত্রীর জন্য আমায় এতো অপমান করলে সে নিজ হাতে তোমাদের জমিদারির ইমারতে আগুন লাগিয়েছে। এখন দাউদাউ করে জ্বলে ছারখার হওয়ার পালা। নবাববংশের অন্ধকারচ্ছন্ন অতীত চন্দ্রপুকুর ফাইল এখন মিস্টার আর.কে. হকিংসের হস্তে। চন্দ্রমল্লিকা নিজ হাতে তুলে দিয়েছে।”

বজ্রপাত হয় যেন সকলের মাথায়। যামিনীও তার ব্যতিক্রম নয়। ভাবে,

– চিঠিদাতা তবে মোর্শেদা খাতুন!

মোর্শেদা খাতুন ক্রোধে ও প্রতিশোধ নেওয়ার উত্তেজনায় খুলে বলে প্রতিটি ঘটনা। কীভাবে শুরু হতে চিঠিদাতা রূপে তো কখনও দিলরুবা, মোহিনীর সহায়তায় বিভ্রান্ত করেছে যামিনীকে।

আরও বলেন,

“আমি যখন হতে জানতে পেরেছি এই বেজন্মার সাথে মেহমাদের বিবাহের কথা তখনই পরিকল্পনা করে ফেলেছিলাম। যেই কন্যার মাতা ও পিতা আমার স্বপ্নে ধ্বংস নামিয়েছিল, তার দ্বারাই এই নবাব বংশকে ধ্বংস করবো আমি। এজন্যই তো দিলরুবাকে প্রেরণ করি তোমার নিকট, মেয়েটার আনুগত্যের অভিনয়ও লাজবাব!

মেহমাদ কাজের ব্যস্ততায় তাকে সময় দিতে পারছিল না। আবার ছিল পূর্বের মান-অভিমান। আমি জানতাম যামিনী তার মাতৃত্বের সত্য গোপন করেছে এ তথ্য পেলে মেহমাদ রাগবেই। এই যোগাযোগের অবনতির সূক্ষ্ম বিষয়টিরই ফায়দা নিয়েছি আমি। ধীরে ধীরে তার হৃদয়ে সন্দেহের দ্রবণ গাঢ় করেছি মেহমাদ আর মেহনূরকে নিয়ে। যাতে সে নিজেকে অবহেলিত, উপেক্ষিত বোধ করে। আর হয়ও তা। মেহমাদের উপর তার বিশ্বাস নড়বড়ে হতেই আমি শেষ চাল দেই চিঠিদাতা হয়ে।

আর আরমান শাহ? গুলবাহার? তাদের মতোন বোকা তো কেউ নেই। তাদের তোমরা সত্য কখনও পুরোপুরি বলোনি। তাই আমার সত্য-মিথ্যের মিশ্রণ এবং নিজের চোখের দর্শনই তারা বিশ্বাস করেছে। তারা ভেবেছে ঐ আলিবর্দি শাহের ইশারায় সব হয়েছে, নিজের বংশমর্যাদার দম্ভে সে এ কার্য করেছে। আর আপনারাও নিজেদের দাম্ভিকতায় প্রতিবাদ বা বাধাদান করেননি। আপনার নিজের পুত্রই এই ধ্বংস চালনা করার চালিকাশক্তি তথা অর্থ প্রদান করেছে আমায়।”

শাহাজাদি জান্নাতুল নিজেকে শক্ত রেখে প্রহরীদের আদেশ করেন,

“এই নারীকে বন্দীশালায় বন্দী করো। জলও যেন তার গলা দিয়ে না নামে।”

মোর্শেদা খাতুন যেতে যেতে শুধান,

“করো আমায় বন্দী। আমি মরবো, তবে তোমারাও বাঁচতে পারবি না। সবার প্রথমে ফাঁসবে তোমাদের প্রিয় জমিদার বাবু। সব ধ্বংস হয়ে যাবে, সব! আর যামিনী তোমার গর্ভবতী না হওয়ার পিছনের কারণটাও এই আমি! আমার নির্দেশেই দিলরুবা তোমায় খাবারের সাথে জন্মনিয়ন্ত্রণ ঔষধি আহার করাচ্ছিল।”

যামিনী নিঃস্তব্ধ। সে বোধ করতে পারছে না কী হচ্ছে বা কোন এমন প্রলয় ডেকে এনেছে সে। এ কেমন জটিলতর ধাঁধাময় পরিস্থিতি!

এদিকে এ সকল কথা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না বৃদ্ধার বয়স্ক হৃদয়। মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নেন বেগম লুৎফুন্নেসা। মেহমাদ শাহ দৌড়ে যেয়ে তাঁকে ধরে। যামিনীও এগিয়ে যায়।

“দাদীজান, নিজেকে শান্ত করুন! শান্ত করুন!”

যুবক তাঁর প্রিয় দাদীজানকে শিঘ্রই পালঙ্কে বসায়। যামিনী পানপাত্র এগিয়ে দেয়। গটগট করে পানি পান করে নেন বৃদ্ধা।

“তোমাকে বলেছিলাম মেহমাদ প্রেমে ডুবে মরো না। এই কন্যার আমাদের বংশের হলেও বেগম হওয়ার গুন তার মাঝে নেই। দেখো, আজ আমাদের এতোদিনের তৈরি সবকিছু এক মুহূর্তে ধ্বংস করে ফেললো পরের বুদ্ধিতে। তারও কী দোষ? বড়ো হয়েছে পরের আশ্রিতা হয়ে, নবাব বংশের মারপ্যাঁচ সে কী করে বোধগম্য করবে? কিন্তু তুমি কী করে এতোটা অসতর্ক হলে মেহমাদ?

ঐ কামরার চাবির উপর আমাদের ভাগ্য নির্ভর করে তুমি জানতে। তা অন্তরালে রাখার দায় তোমার ছিল। তাহলে চাবি কী করে যামিনীর হস্তে গেল? ঐ কামরায় সে কীভাবে প্রবেশ করলো? তুমি অসফল মেহমাদ, অসফল! এই অপরাধের জন্য ক্ষমা তুমি কখনোই পাবে না। কখনোই না! তোমাকে বিশ্বাস করাই আমাদের সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি ছিল।”

আহত হয় মেহমাদ শাহ। অনুতাপসূচক তার চাহনি।

“দাদীজান, অনুগ্রহ করে এভাবে বলবেন না। আমি সহ্য করতে পারছি না।”

তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠে দাদীজানের মুখশ্রীতে। প্রিয় পৌত্রের মুখশ্রীর দিকে তাকানও না তিনি।

“সহ্য করার অভ্যাস করে নেও আমার প্রিয় পৌত্র। আগামীকাল এ বংশের নাম ধুলোর মিশতে দর্শন করতে হবে। এই বৃদ্ধ বয়সে এ দিনও দেখতে হচ্ছে, মৃত্যু যেন আসে এই বিভীষিকাময় দৃশ্য দেখার পূর্বে। আয়েশা খাতুন, আমাকে আমার কামরায় নিয়ে চলো। প্রহর গুনতে থাকি সর্বনাশের অপেক্ষায়।”

আয়েশা খাতুন বেগম লুৎফুন্নেসাক নিয়ে বের হয়ে যান। যামিনী বেদনাদায়ক দৃষ্টিতে দেখে যায় সবটা নীরবে। এ কী কর্মকাণ্ড করলো সে! যাকে ভালোবাসলো তার চিতাও নিজে হস্তে সাজালো!

নিজের প্রিয় পুরুষটির দিকে তাকিয়ে কোনোরকম উচ্চারণ করে, “বাবু মশাই?”

মানুষটির দৃষ্টি মেঝেতে স্থির, মাথা নত। এই কঠোর পুরুষটি আজ কাঁদছে, মেঝেতে টপটপ কয়ে বেয়ে পড়ছে স্বচ্ছ নোনাজল।

তার দিকে না তাকিয়েই মেহমাদ শাহ বলে উঠে,

“দোষটা তোমার একার নয়, আমিই অধম এখনও তোমার বিশ্বাস পুরোপুরি অর্জন করে নিতে পারিনি। তবুও মনের মাঝে আর্তনাদ করে কেউ জিজ্ঞেস করে, আমাকে আর একটু বিশ্বাস করা যেতো না? তবে তুমি খুশি হও। লোকচক্ষুর নজরে তুমিই কাল বড়ো হতে চলেছো, সবাই জানবে তুমিই উন্মেচন করেছে শেরপুরের নবাববংশের এই কালো অতীত ও রহস্য। আর আমি হতে চলেছি সবার সম্মুখে নরকের কীট অপক্ষের অধম!”

রমণী কী বলবে ভেবে পায় না। তবুও কিছু বলতে নেয়, তবে না শুনেই ক্রোধে হনহন করে বের হয়ে যায় মেহমাদ শাহ।

স্থির থাকে শুধু যামিনী আর শাহাজাদি জান্নাতুল। যুবতী জমিদারনির আজ প্রকৃতপক্ষেই নিজেকে অযোগ্য মনে হচ্ছে ‘বেগম’ পদবীর।

শাহাজাদি জান্নাতুলের মায়ের হৃদয় বোধগম্য করতে পারি প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর হৃদয়ের অবস্থা। সান্ত্বনার ভঙ্গিমায় কাঁধে হাত রাখে।

আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না কন্যা। ঝরঝর করে কেঁদে দেয় নিজের ফুপিজানকে জড়িয়ে ধরে।

“ফুপিজান এমন কী কার্য সম্পাদন হয়েছে আমার দ্বারা যে সবাই এতো নারাজ? আমি কীভাবে নিজের বংশের নিজের স্বামীর উপর তাণ্ডবলীলা আনলাম? কী আছে ঐ কাগজ-পত্রে যা ঐ শহুরে বাবুদের হাতে পড়ায় পতন হতে চলেছে শেরপুরের নবাব বংশের?”

সুদীর্ঘ এক শ্বাস ফেলেন মধ্যবয়স্ক মানুষটি। ক্লান্তির ভঙ্গিমায় জানান,

“এই যে জমিদারি দেখছো তা কিছুই আসলে আমাদের থাকার ছিল না। ছলনা, মিথ্যে, গ্রামীন মানুষদের অক্লান্তকর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জমিদারি। এই ছলনা, মিথ্যের প্রমাণই ছিল ঐ ফাইলে। যা এখন গোটা দুনিয়া জেনে যাবে। যার জন্য গোটা দুনিয়ার নিকট আসামী হবো আমরা। পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে আমাদের। তবে নায়িকা হবে তুমি সকলের চোখে। সকলে জানবে মহৎ বলে তোমায় আমাদের রহস্য উন্মেচন করেছো জেনে। যাই হোক এ বিষয়ে আর ভেবে বা জেনে এ মুহূর্তে কোনো লাভ নেই।”

তিনিও দরবার ত্যাগ করেন। তবুও সম্পূর্ণ একাকি হয়ে যায় না যামিনী। আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা লোকমান শাহের বিধবা গুলবাহার খাতুনও ইতিমধ্যে মেঝেতে নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছেন।

___

আরমান শাহ অপেক্ষারত। অবশেষে তাঁর অপেক্ষার অবশান হয় টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনিতে। বিলম্ব না করে কলটি তুলেন তিনি

“এস.পি. খোঁজ নিয়েছো নীলকণ্ঠ দাসের আর চন্দ্রমল্লিকার? কী জানতে পেরেছো?”

এস.পি. সাহেবের মাঝে বিড়ম্বনা। যা সে জানতে পেরেছে তা শুনে মানুষটি ক্রোধান্বিত হবে কি না…

“কী হলো! কথা বলছো না ক্যানো এস.পি.?”

তাঁর ধমকে কম্পিত হয় পুরুষটি। ললাট হতে চিকন ঘাম বেয়ে পড়ছে।

“আসলে সাহেব, আমি অন্য একটি বিষয় জানতে পেরেছি। আমার তদন্ত মতে যামিনী আপনারই কন্যা। আপনি যেই নারীটির খোঁজ নিতে আমায় বলেছিলেন। নীলকণ্ঠ দাসকে উত্তম মাধ্যম দিয়ে জানতে পারি যামিনীর মাতা তিনিক। আর তাঁকে এতোকাল পাইনি কারণ তিনি মৃত।”

হাত হতে ধীরে ধীরে খসে পড়ে যায় টেলিফোনের হ্যান্ডসেট। আকস্মাৎ এ বজ্রপাত মেনে নিতে পারছেন না আরমান শাহ। শেষে কি না নিজের কন্যার জীবনটা নিয়েই প্রতিশোধের খেলায় মেতেছিলেন? নিজের কন্যার স্বামীকে ছিনিয়ে নেওয়ার জঘন্য পরিকল্পনা করছিলেন?

“ড্রাইভার! ড্রাইভার! গাড়ি বের করো! এখনই শেরপুর যাবো আমি।”

কোনোরকম চেঁচিয়ে কথাটা বলতে বলতে নিজের গায়ের চাদর নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। তবে এ যাওয়ায় কি কোনো লাভ আছে? ধ্বংসের সূচনা তো হয়েই গিয়েছে। রোধ করার আর উপয় কোথায়?

___

আকাশের বক্ষে গভীর রাত নেমেছে। বইছে ঝড়ো বাতাস। আছড়ে পড়ছে আকাশ হতে বজ্র, বর্ষণ হচ্ছে বৃষ্টির। প্রকৃতিও যেন জ্ঞাত আজকের রাত্রি কতোটা বেদনায় ভারি এই নবাব বংশের সদস্যদের জন্য।

কারো চোখে নেই নিদ্রা, নেই একটু খানি স্বস্তি। চোখ বদ্ধ করে, অবিরাম ধারা জল ফেলছে প্রতিটি নরনারী।

অনুতাপের জ্বলন্ত অনলে পুড়ছে যামিনী। তবুও কি ফেরানো যায় তার নেওয়া পদক্ষেপ?

আগামীকাল সকাল হতেই আসবে কতো শতো সাংবাদিক, পুলিশ। আসামীর ন্যায় ধরে নিয়ে যাবে তারই চোখে সামনে তার বাবু মশাইকে। অভিনন্দন জানাবে তাকে অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এ দৃশ্যের কথা ভাবতেই বক্ষ কাঁপে তার।

বারংবার মনে মনেই প্রশ্ন করছে সে নিজেকে কোনো কি উপায় নেই? পরিস্থিতি যেন চিৎকার করে উত্তর দিচ্ছে, ‘না, নেই রে সর্বনাশী! নেই!”। অতঃপর ক্রন্দনরত অবস্থাতেই নিজের ভালোবাসাকে হারানোর অপেক্ষার প্রহর গুনে যায়।
||শেষপর্ব|| (ইতি)
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=328779682583458&id=100063542867943
চলবে…
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here