শেষ বিকেলের আদর❤️পর্ব : ৪১

0
3869

#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৪১

🌼
ভোর পাঁচটা।তখনও পুরোপুরি ভোর হয় নি।আবছা অন্ধকারে ঢেকে আছে আকাশ।খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে আসা ঠান্ডা বাতাসে শরির কেপে ওঠার জোগাড়।জানা অজানা হরেক রকম পাখির কিচির মিচির ডাক কানে আসতেই নড়ে চড়ে উঠল রোশনি।ইট পাথরের ব্যস্ত শহরে সচরাচর পাখির এমন মাতাল করা ডাক শোনা যায় না।কংক্রিটের শক্ত আবরনে সবই আজ বিলুপ্তের পথে।রোশনির ঘুম তখনও কাটেনি।ঘুমের ঘোরেই নাকে ভেসে এলো পরিচিত এক গন্ধ।রোশনি ঘুমে বোজা চোখ জোড়া পিটপিট করে খুলতেই অধিরের ক্লান্ত মুখটা স্পষ্ট হল।অধিরকে দেখা মাত্রই যেন ঘুম ছুটে পালালো রোশনির।কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করলো আদৌও কি এটা অধির নাকি শুধু কল্পনা মাত্র?অধিরের গরম নিশ্বাস যখন তার চোখে মুখে আছড়ে পড়তে লাগল তখনই বুঝলো এটা কল্পনা নয় বরং অপ্রিয় বাস্তব, তখনই যেন কোটর থেকে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হল রোশনির।রোশনি অধিরের থেকে সরে আসতে চাইলো।রোশনির চাওয়াটা বোধহয় খুব একটা পছন্দ হল না অধিরের।তাইতো ঘুমের মাঝেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল রোশনিকে।রোশনি চোখ মুখ কুচকে আবারো নড়ে উঠতেই ঘুম জড়ানো চোখে তাকালো অধির।হাতের বাধন শক্ত করে বলল,

-নড়ছো কেন?ডিস্টার্ব করবে না একদম।ঘুমাতে দাও।

কথাটা শেষ করেই রোশনিকে আরো কিছুটা কাছে টেনে চোখ বুজলো অধির। রোশনির মাথায় কিছুই ঢুকছে না।অধির এখানে কি করে এলো? আর কখনই বা এলো? রোশনি অধিরের বাহুডোর থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠল,

-আপনি এখানে কি করে মিষ্টার চৌধুরি? কখন এলেন? আপনার তো…

রোশনির কথার মাঝেই চোখ মুখ কুচকে তাকাল অধির।বিরক্ত গলায় বলল,

-বললাম না ডিস্টার্ব করো না?সারা রাত ঘুমায় নি ঘুমাতে দাও।আর একটা কথা।আমি যতোক্ষন ঘুমাবো ততোক্ষন এখানে আমার কাছেই থাকবে।বিছানা থেকে নামলেই মাইর।আর এমনিতেও তোমার দিনটা আজ খুব একটা ভাল যাবে বলে মনে হচ্ছে না।তাই দিনটা আরো খারাপ যাতে না হয় তাই চুপ চাপ শুয়ে থাকো।আর এখন মাথায় বিলি কাটো।

কথাগুলো শেষ করেই রোশনির বুকের উপর মাথা রেখে গলায় মুখ গুজলো অধির।অধিরের এহেন কাজে রোশনির দম বন্ধ হয়ে এল।অধিরের স্পগুলো এখন বিদ্যুতের মত কাজ করে। ছুঁয়ে দিলেই যেন শক লাগে।অধিরের ছোঁয়া গুলোও আগের তুলনায় গভির হতে শুরু করেছে।হুটহাট কাছে চলে এসে তাকে বেসামাল করে দিয়ে হারিয়ে যায়।রোশনিকে কাপাকাপি করতে দেখে চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই নেশা লাগা গলায় বলে উঠল অধির,

-এভাবে কাঁপাকাঁপি করো না সুইটহার্ট। বেসামাল হয়ে পড়বো।আর একবার বেসামাল হয়ে গেলে কিন্তু তোমাকেই প্রয়োজন হবে সামলানোর জন্যে।

কথা বলার তালে তালে অধিরের ওষ্ঠদ্বয় বার বার রোশনির গলা স্পর্শ করছে।অধিরের ঠোটের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কোনো রকমে দুহাতে খামচে ধরলো অধিরের মাথার পেছনের চুলগুলো।অধির খানিক ব্যথা পেলেও শব্দ করল না।রোশনির এমন কাঁপনিতে তার ভেতরটাও কাঁপতে শুরু করেছে।নিজের ভেতরের পুরুষ মানবটা বেসামাল হতে চাইছে খুব করে।নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রিয়তমাকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার তিক্ত বাসনা জানান দিচ্ছে।অধির রোশনির গলায় মুখ গুজে আলতো আদর দিতেই রোশনির কাঁপুনি তীব্রতে পৌছাল।অসহ্য অনুভূতিতে মরে যেতে লাগল।অধিরের ঠোটের ছোঁয়া যত গভির হতে লাগল ততোই যেন নিষ্তেজ হয়ে এল শরির।অধির রোশনির গলায় আদুরে কামড় বসাতেই অধিরের পিঠ খামচে ধরলো রোশনি।অধিরের অসহ্য অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাড়তে লাগল নিশ্বাসের গতি।দ্রুত নিশ্বাসে কখনো উপরে তো কখনো নিচে নামতে থাকা বুকের উপর মাথা রেখে রোশনির শরিরের উপর ভর ছেড়ে দিল অধির।রোশনিকে পিষে দেওয়ার সুনিপুণ চেষ্টা চালিয়ে বলল,

-আমাকে আটকাও সুইটহার্ট। থামিয়ে দাও আমায়।আমি এভাবে তোমাকে নিজের করতে চাই না। আমি চাই আমার স্পর্শ গুলো তোমায় যেন গভির ভাবে স্পর্শ করতে পারে।আমি যতটা তৃষ্ণা নিয়ে তোমায় ছুয়ে দেবো ঠিক ততোটা তৃষ্ণা নিয়ে তুমিও আমার ছোঁয়াগুলোকে শুষে নিবে।সেদিনটা এখনো আসে নি সুইটহার্ট। তোমার উচিত আমাকে আটকানো।থামিয়ে দাও সুইটহার্ট।

অধিরের কথায় কাঁপুনিটা আরো একটু বেড়ে গেল রোশনির।সেই সাথে আরো জোরে খামচে ধরলো অধিরের পিঠ।যেটা অধিরের নেশা আরো গভির করে তুলছে।একদিকে রোশনির এমন কাঁপাকাঁপি অন্য দিকে রোশনির নখের অত্যাচার।এটুকুই যেন যথেষ্ট অধিরের সমস্ত স্ট্যাটাস, নাম,ইগোকে দমিয়ে দিয়ে তাকে বেসামাল করতে।অধির নিজেকে সামলাতে রোশনির থেকে সরে এসে বালিশে মাথা রাখল।চোখ বুজে লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলিয়ে রোশনির দিকে তাকাতেই দেখল রোশনি চোখ বুজে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।অধির বুঝলো তার এই মূহূর্তে এদিকে তাকানো উচিত হয় নি।এতোক্ষন নিজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টাটা তার বোধ হয় বৃথায় গেল।অধির বালিশ ছেড়ে মাথা তুলে রোশনির দুপাশে হাতে ভর রেখে ঝুকে এলো অনেকটা।ডান হাতে রোশনির কাপতে থাকা ঠোট জোড়াতে স্পর্শ করতেই সব কন্ট্রোল সব নিয়ম যেন হারিয়ে গেল।কয়েক সেকেন্ড ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থেকে ঠোটের চারপাশে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে স্লাইড করতে লাগল।রোশনির ঠোটের দিকে আরো একটু ঝুকে গিয়ে নেশাতুর গলায় বলতে লাগল অধির,

-লাভ ইউ সুইটহার্ট।আই রেইলি ডু।ইউ আর মাইন।ইউ আর অনলি মাইন।তোমার ভাগ আমি কাউকে দিতে পারবো না।তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না।আমার তোমাকে চাই।অনিয়মের নিয়ম ভেঙে হলেও তোমাকেই চাই।আমার তুমিটাকে হারানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কোনো মতেই সম্ভব নয়।

অধির রোশনির এতোটা কাছে যে কথা বলার তালে তালে অধিরের ঠোট রোশনির ঠোটকে স্পর্শ করছে।অধিরের পাতলা ঠোট রোশনির ঠোটে দু চার বার আলতো করে ছুঁয়ে যেতেই অদ্ভুদ শিহরনে কাপান্বিত হল রোশনি।নিশ্বাস যেন থমকে গেল।গলার কাছে দলা বেধে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল সাজানো কথার বহর।একটা পুরুষের স্পর্শ এতোটা ভয়াবহ হতে পারে?নাকি শুধু অধিরের ছোঁয়া গুলোই এমন মারাত্বক?

_

judaa hum ho gaye maana
আমরা আলাদা হয়ে গেছি জানি

magar yeh jaan lo jaana
তবে এটা জেনে রেখো প্রিয়

kabhi main yaad aaun toh
কখনও আমায় মনে হলে তোমার

chale aana, chale aana
ফিরে এসো, ফিরে এসো

tumhe main bhool jayunga
তোমায় আমি ভুলে যাবো

yeh baate dil mein na lana
এ কথা তুমি মনেও আনবে না

khabhi main yaad aaun toh
কখনও আমায় মনে হলে তোমার

chale aana, chale aana
ফিরে এসো, ফিরে এসো

tha kon mera ek tu hi tha
কে ছিল আমার শুধু তুমিই ছিলে

saanso se zaada jo jaruri tha
নিশ্বাসের চেয়েও বেশি প্রয়োজনী ছিলে

tere liye main kuch nahi lekin
আমি তোমার জন্য কিছুই না কিন্তু

mere liye tu mera sab kuch tha
আমার জন্যে তুমিই আমার সব ছিলে

nahi jaana bhoola karke
আমাকে যেন ভুলে যেও না

yeh baatein tum hi kehte the
এ কথা তুমিই বলতে

rahi khushiyan nahi meri
খুশি আর রইলো না আমার

ki tum bhi wakt jaise the
তুমিও সময়ের মতই ছিলে(যা পাল্টে গেছে)

tumhara tha rahega bhi
তোমার ছিলাম তোমারই থাকবো

kare kya dil hai deewana
কি করবো মনটা যে পাগল

khabhi main yaad aaun toh
কখনও আমায় মনে হলে তোমার

chale aana, chale aana
ফিরে এসো, ফিরে এসো

maine tumhari baat maani hai
আমি তোমার কথা মেনেছি

maine manaya dil ko hai kaise
কিন্তু আমার হৃদয়কে মানাবো কিভাবে

ab se raho tu khush jaha bhi ho
যেখানেই থাকো ভালো থাকো

mera tumhara tha bhi kye waise
এমনিতেও,তোমার আমার মাঝে কিই বা ছিল

bhale doori rahe jitni
যতো দূরেই থাকো না কেন

nigaho se nigaho ki
চোখ থেকে চোখের আড়ালে

magar khawbo ki duniya mein
তবে স্বপ্নের দুনিয়ায়

milunga tumse rojana
দেখা করবো প্রতিদিন

yahi tak tha safar apna
এই পর্যন্তই ছিল আমাদের পথচলা

tumhe hai laut kar jaana
তোমাকে এবার ফিরে যেতে হবে

kabhi mai yaad aaun toh
কখনো আমায় মনে হলে তোমার

chale aana, chale aana
ফিরে এসো, ফিরে এসো

na ra na ra ra hey hmmm
oh ho ho ha haa.

গানটা শেষ করতেই চোখ থেকে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।সুনিপুণ হাতে বেশ যত্ন নিয়েই নোনা পানিটুকু মুছে নিলো জয়।রক্তিম আকাশের দিকে তাকাতেই বুকের জ্বালা পোড়াটা বাড়ল।ভেতর থেকে কেউ তাছিল্যের হাসি হেসে উঠতেই জয় আস্তে করে বলে উঠল,

-হাসছো কেন? হাসির মত কি কোনো ঘটনা আদৌও ঘটেছে?

সাথে সাথেই ভেতররের মানব সত্তাটা কটাক্ষ করে বলে উঠল,

-ঘটেনি?

-না ঘটেনি।

-সত্যিই কি ঘটেনি নাকি সব জেনে শুনেই এমন ভান ধরে রয়েছো?

-কি বলতে চাইছো তুমি?

-এতো কিছুর পরে সত্যিই কি আর কিছু বলার থাকতে পারে নাকি বলা উচিত? তুমি হলে একজন ব্যর্থ পুরুষ।তোমার মত মানুষের এই পৃথিবীতে কোনো মূল্য নেই।মূল্যহীন তুমি।তোমার থাকা না থাকা দুটোই এক এই পৃথিবীতে।তোমাকে ভালবাসার মত কেউ নেই ।

-আমি মানি না।খুজে দেখো আমাকে ভালবাসার মত অনেক মানুষকে তুমি পাবে।তাই তুমি আমাকে এভাবে বলতে পারো না।

মানব সত্তা এবার যেন গা কাপিয়ে হাসতে লাগলো।জয় বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল,

-আবারো হাসছ? হাসি থামাও।আমার সহ্য হচ্ছে না।

-এখন আমার হাসির দিকে নজর পড়েছে তোমার?নিজে তো হাসা ছেড়েই দিয়েছো এখন আমাকে বলছো হাসি বন্ধ করতে?তুমি পাল্টে গেছো জয়।

-সত্যিই কি পাল্টে গেছি?

-কেন তুমি বুঝতে পারছো না? মনে আছে শেষ কবে হেসেছিলে?জানি মনে নেই।মনে করতে হবে না।সবকিছু মনে করা বা রাখা গুরুত্বপূর্ণও নয়।তবে তোমার একটা কথা জানা উচিত।সেটা হল আজকাল তুমি সিগারেট খেতে শুরু করেছো।তুমি কি জানো সিগারেটের সেই বিষাক্ত ধোয়ায় আমি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছি?আমাকে শেষ করতেই বুঝি এতো আয়োজন?জিবনে অনেক কিছুই তো হারালে। একদিন আমাকেও হয়ত হারিয়ে ফেলবে।কি নিয়ে থাকবে তখন?কি করবে সেই অপূর্ন জিবন দিয়ে?

-কিছু করতে চাইছি না তো।এই তো বেশ আছি।জিবনে পাওয়ার থেকে না পাওয়ার হিসেবটাই বেশি। কি পেলাম আর কি পেলাম না সেটা খুজতে গেলে বাস্তবতার ঝুড়ি শূন্যই মিলবে।কি দরকার অযথা হতাশা বাড়ানোর?থাকনা কিছু অপূর্নতা।সব কিছু কি পেতেই হবে?কিছু অপূর্নতা থাকা ভালো। তবেই তো সেটার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যায়।অপূর্নতা মানুষকে শক্তিশালী হতে সাহায্য করে।তাহলে অপূর্নতায় দোষ কোথায়?

-এতো সহজেই হার মেনে নিয়ে ভুলে যেতে চাইছো তাকে?ভুলে যাওয়া কি এতোই সোজা?সত্যিই কি ভুলে যেতে পারবে কখনও?

-ভুলতে চাই না তো আমি।ভালবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়াটা অপরাধ।মারাত্বক অপরাধ।আমি সেই মারাত্বক অপরাধটা করতে চাই না।না পেলেই ভুলে যেতে হবে তার তো কোনো মানে নেই।ভালবাসা যেমন ভুলার মত না তেমন ফুরানোর মতোও না।ভালবাসা থাকলে দূর থেকেও ভালবাসা যায়।আমার ভালবাসা না কোনো দিন ফুরাবে আর না কোনো দিন ভুলে যাবো।

-এতোই যখন ভালবাসো তখন যেতে দিলে কেন তাকে? কেন আটকে রাখলে না?

-অনেক দিন আগে একটা মুভি দেখেছিলাম।
যেখানে নায়ক বলেছিল,, “মোহাব্বত হে ইচ লিয়ে জানে দিয়া।জিদ হোতি তো বাহো মে হোতি”।যদিও বাস্তব জিবন মুভি বা গল্পের মত হয় না তবুও আমার ক্ষেত্রে অনেকটা তেমনই ঘটেছে।ধরে রেখে লাভ নেই ছেড়ে দিতে হয়।মুক্ত করার পরও যদি দিন শেষে ফিরে আসে তখনই বুঝবো সে আমাকে ভালবাসে।তবে আমি জানি সে ফিরবে না।যেখানে চাওয়াটাই একার সেখানে তার ফিরে আসার কথাটা ভাবা বোকামো ছাড়া কিছুই নয়।আমি চাইও না সে ফিরে আসুক।ভালবাসলেই পেতে হবে এমনটা তো নয়।আমি যেমন তাকে ভালবাসি তেমন এটাও চাই সে যেন সুখে থাকে।ভালবাসায় বিয়েটা প্রয়োজন না হলেও, বিয়েতে ভালবাসাটা প্রয়োজন।আমি জানি অধির ওকে সুখে রাখবে।

-এইভাবে আর কতদিন চলবে?

জয় জবাব দেবে তার আগেই মায়ের আগমন হলো।হাতে তার দুটো চায়ের কাপ।মুচকি হেসে জয়ের দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিতেই হাত বাড়িয়ে কাপটা হাতে তুলে নিল জয়।মাকে সোফায় বসিয়ে নিজেও বসে পড়ল মায়ের পাশে।

-রুমে আসতেই মনে হল কারো সাথে কথা বলছিলি।কার সাথে কথা বলছিলি বাবু?

মায়ের কথা শুনে নাক ছিটকে তাকাল জয়।বলল,

-উফফ আম্মু কতো বার বলেছি বাবু ডাকবে না।তুমি যে কেন এখনো সেই বাবুতেই আটতে আছো বুঝি না।তুমি জানো এখন এই বাবু শব্দটা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড একে অপরকে বলে।তুমি তো..

জয়ের কথার মাঝেই মুখ কুচকে তাকালেন উনি।বললেন,

-আমার এতো সব জেনে কাজ নেই ।আমি তোকে বাবু বলেই ডাকবো।এতো দিনের অভ্যাস ছাড়া যায় নাকি?ছোট থেকে তো তোকে বাবু বলেই ডেকে এসেছি।এভাবে হুট করে বন্ধ করবো কিভাবে?তাছাড়া তোর আব্বুও তোকে বাবু বলে ডাকতো।

কথাটা বলেই হাসলেন উনি।স্বামির স্মৃতি মনে পড়তেই চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো ওনার।মায়ের মমতা মাখা মুখের দিকে তাকিয়ে জয় বলে উঠল,

-তুমি আর আব্বু পালিয়ে বিয়ে করেছিলে তাই না আম্মু? পালিয়ে বিয়ে করার কি দরকার ছিল? নানুরা কি মেনে নিচ্ছিলো না তোমাদের সম্পর্ক?

ছেলের কথা শুনে হাসলেন উনি।চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলেন,

-উহু তোর নানুরা না।আমার শাশুড়ি মানে তোর দাদি রাজি ছিল না।রাজি ছিল না তেমনটা নয়।এর পেছনেও একটা ঘটনা আছে।

জয় কৌতুহলি চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-কি ঘটনা?

-একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বসার ঘরে অপরিচিত কয়েকজন বসে আছে।আমি এর আগে কখনো তাদের দেখিনি।স্বাভাবিক ভাবেই তাদের সাথে কোনো রুপ কথা না বলে আমি আমার রুমে চলে আসি।রুমে আসতেই দেখি মা তাড়াহুড়ো করে রুমে ঢুকে আমার হাতে একটা শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে দিল।মাকে প্রশ্ন করার আগেই মা বলল তাড়াতাড়ি শাড়িটা পড়ে একটু সেজে নে।আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তোর নানু এসে দাড়ালো দরজায়।আমাকে তৈরি হয়ে বাইরে যেতে বলে দরজা ছাড়লেন তিনি।আব্বাকে আমি বেশ ভয় পেতাম।তাই আর কোনো কথা না বলে শাড়ি পড়ে একটু সাজলাম।কিছুক্ষন পর মা এসে নিয়ে গেল বসার ঘরে।সেখানে তোর দাদি মানে আমার শ্বাশুড়ির পাশে গিয়ে বসালো আমায়।ওনারা আমাকে দেখে নিয়ে নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে কিসব কথা বললেন।এর পর আব্বাকে জানালেন আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে।ওনাদের কথায় দেখলাম আব্বা মাও বেশ খুশি।আমার মাথায় তখনও কিছু ঢুকছিল না।একেতো বয়স কম তার উপর ছিলাম ঘরকুনো মেয়ে।স্কুল আর বাড়ি এ নিয়েই থাকতাম।সেদিনই তোর দাদি আমাকে নাকফুল পড়িয়ে দিয়ে যান।

-নাকফুল?

-হ্যা নাকফুল।এখন যেমন আংটি পড়ানোর নিয়ম হয়েছে, আমাদের সময় নাকফুল পড়ানোর প্রচলন ছিল।

-তারপর?

-তারপর আর কি? ওনারা নাকফুল পড়িয়ে চলে যাওয়ার পর জানতে পারি আমার বিয়ে পাকা হয়ে গেছে।বিয়ের কথা শুনে আমার সে কি কান্না!! সারা রাত না খেয়ে বিছনায় উপর হয়ে কেদে কেটে ভাসিয়েছিলাম।

কথাটা বলতে বলতেই হেসে উঠলেন উনি।জয় চায়ের কাপটা টি টেবিলের উপর রেখে উত্তেজিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

-তুমি বললে দাদি রাজি ছিল না তাই পালিয়ে বিয়ে করেছো।এখন আবার বলছো দাদি নিজেই তোমাকে পছন্দ করে নাকফুল পড়িয়েছে। কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না আম্মু।

-পরের ঘটনা শোন তাহলেই বুঝবি।পরের দুই দিন আমি ঘর থেকেই বের হয় নি আর।এরপর প্রায় এক সপ্তাহ পর আমি স্কুলে গেলাম।স্কুল ছিল আমাদের একগ্রাম পরে।পায়ে হেটেই যাওয়া আসা করতে হতো।স্কুলে যাওয়ার পথে দেখলাম তোর বাবা রাস্তার ধারে দাড়িয়ে আছে।আমি তো ভয়ে শেষ।এখনকার মত তখন এতো মোবাইলের ব্যবহার ছিল না।তাই বিয়ে পাকা হওয়ার পরেও তোর বাবার সাথে আমার কথা হয় নি।এদিকে তোর বাবা আমার দিকে এগিয়ে আসতেই দিলাম এক দৌড়।দৌড়ে সোজা স্কুলে।সারাটা সময় ভয়ে ভয়ে ক্লাস করলাম।ছুটির পরে একা একা ফিরছিলাম আর দোয়া পড়ছিলাম যাতে তোর বাবার সাথে দেখা না হয়।কিন্তু আমার ইচ্ছেটা পূরন হলো না।তোর বাবাকে একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার ভয়ে গলা শুকিয়ে এল।আমি দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই ও আমার সামনে এসে দাড়ালো।আমার দিকে তাকাতেই আমি কেদে দিলাম ভ্যাঁ ভ্যা করে।আমার কান্নায় তোর বাবা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিল আমার দিকে।হয়ত আমার কান্নার কারনটা বুঝার চেষ্টা করছিল।আমার কান্না শুনে কয়েকজন কৃষক ছুটে এলো।গ্রামের মানুষ তো আর শহরের মানুষদের মত এতোটা স্মার্ট না।এসেই একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগল।আমি কেন কাদছি তা জানতে চাইল।আমাকে যখন ওরা বলল আমি তাকে মানে তোর বাবাকে চিনি কি না তখন ভয়ের চোটে আমি বলে দিলাম আমি চিনি না।তোর বাবা অবশ্য বারবার বলছিল আমি তার হবু বউ।কিন্তু আমি কিছুতেই স্বীকার না করাই তোর বাবাকে সেদিন দু চার ঘা খেতে হয়েছে ওদের হাতে।তোর দাদুর বাড়ি গ্রামে থাকলেও ওনারা শহরে থাকতেন। তাই তোর বাবাকে গ্রামের লোক তেমন চিনতোও না।

জয় আরাম করে বসল।চোখে মুখে কৌতুহল নিয়ে বলল,

-বাপরে!!!আব্বু মাইরও খেয়েছে? তারপর কি হল?

-ওই ঘটনার পরেরদিন আবারো রাস্তায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম তোর বাবাকে।সেদিন সাহস করে তার দিকে এগিয়ে গেলাম।ওই ঘটনার পর নিজেকে কেমন অপরাধি মনে হচ্ছিল।যতোই হোক দোষটা তো আমারই ছিল।সেদিন থেকেই টুকটাক কথা শুরু হয়।আস্তে আস্তে তোর বাবাকে ভাল লাগতে শুরু করে।যখন তোর বাবার প্রতি দূর্বল হয়ে গেলাম তখনই তোর দাদি জানতে পারলো আমার জন্যেই তার একমাত্র ছেলে মাইর খেয়েছ।একথা জানার সাথে সাথে তিনি বিয়েতে না করে দিলেন।কিছুতেই ওনাকে রাজি করানো গেল না।তোর দাদি ছিলেন যেমন একরোখা তোর দাদা ছিলেন তেমনই রসিক।তোর দাদাই তোর বাবাকে বুদ্ধি দিলেন আমাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে।ওনার কথা মতোই তোর বাবার হাত ধরে ঘর ছাড়লাম।কাজি অফিস থেকে বিয়ে করে তোর দাদির সামনে এসে দাড়ালাম।সেদিন মেনে না নিলেও আস্তে আস্তে মেনে নিলেন উনি।

ওনার কথা শেষ হতেই শব্দ করে হাসতে লাগল জয়।ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে উনিও হাসলেন।হাসি থামিয়ে হঠাৎই চোখ মুখ কুচকে উঠে দাড়িয়ে বললেন,

-চুলায় দুধ বসিয়ে এসেছিলাম।গল্প করতে করতে ভুলেই গেছি।ওদিকে বোধ হয় সব পুড়ে গেল।

উনি ব্যস্ত পায়ে বারান্দা ছাড়তেই বেতের সোফায় গা এলিয়ে দিল জয়।মা বাবার প্রেম কাহিনিটা তার মনে ধরেছে।হঠাৎই ওর রোশনির মুখটা মনে পড়ল।মনে পড়ল তার অসম্পূর্ণ ভালবাসার কথা।তার ভালবাসাটাও যদি এভাবে পূর্নতা পেত? তিক্ত দির্ঘশ্বাসে বুকটা যখন ভারি হয়ে আসতে লাগল তখনই মন বলে উঠল “কিছু সম্পর্ক দূর থেকেই সুন্দর”।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here