#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
পর্ব : ৪৫
🌼
চার চাকার কালো গাড়িটা ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে।ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা বাজে।সাহিল আরো একবার মোবাইলের স্ক্রীনে চোখ বুলিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিল।যেভাবে হোক তাকে দ্রুত বাড়ি পৌছাতে হবে।আজ তার কপালে মঙ্গল বাদে শনি রবি সবই আছে।বিকেল থেকে নাতাশার কন্টিনিউয়াসলি ফোন এলেও সন্ধ্যার পর থেকে ফোন আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে।সাহিল যখন মিটিং শেষ করে বোর্ডরুম থেকে বেরোলো ঘড়িতে তখন পুরো পুরি দশটা বাজে।টানা দুই ঘন্টা মিটিং এর পর শরির যেন ছেড়ে দিয়েছিল অনেকটাই।নিজের বরাদ্দকৃত কেবিনটাতে এসে যখন চেয়ারে গা এলিয়ে দিল,, সাথে সাথেই চোখ ভেঙে এল ঘুমে।ক্লান্তিতে যখন শরিরের শিরা উপশিরা গুলো নেতিয়ে পড়ছিল তখনই সচেতন মষ্তিষ্ক জানান দিল বাড়িতে তার একটা বউ আছে।এবং বউ তাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছে।কিন্তু আজই ইমপর্টেন্ট মিটিং পড়ে গেল।সাহিল দ্রুত ইন্টারকমে ফোন দিল,
-মিস রোহিনি তাড়াতাড়ি আমার কেবিনে আমার ফোনটা দিয়ে যান।বি কুইক…
ফোনটা রেখে চেয়ারে গা এলালো সাহিল।কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজায় কেউ নক করলো।দরজার ফাক গেলে সুরেলা একটা গলা ভেসে এলো,
-মে আই কান ইন স্যার?
-ইয়া…
সাহিলের পারমিশন পেয়ে এক সেকেন্ডও দেরি না করে উচু হিলে খটখট আওয়াজ তুলে ভেতরে এল রোহিনি।সাহিলের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
-এই নিন স্যার।
-থ্যাংক ইউ। নাউ ইউ মে লিভ।
-সিওর স্যার।
রোহিনি দরজা অবধি গিয়েও থেমে গেল।সাহিলের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল,
-নাতাশা ম্যাম কয়েক বার কল করেছিলেন স্যার।আপনি মিটিং এ ছিলেন সেজন্য…
রোহিনিকে কথা শেষ করতে না দিয়েই সাহিল মুখ খুললো।ফোনের স্ক্রীনে দৃষ্টি রেখেই বলল,
-ইটস ওকে মিস রোহিনি।
রোহিনি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতেই নাতাশার নাম্বারে ফোন লাগালো সাহিল।এক বার, দু’বার, তিন বার,অসংখ্য বার ফোন করেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পাওয়া গেল না।সাহিল কাচের টেবিলটার উপর ফোনটাকে ঠেলে দিলে দুহাতে মুখ ঢেকে লম্বা শ্বাস নিলো।চেয়ারের হাতল থেকে কোর্টটা তুলে নিয়ে উঠে দাড়ালো ।টেবিলের উপর থেকে ফোন আর গাড়ির চাবিটা তুলে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে এল কেবিন থেকে।ম্যানেজারকে বাকি কাজের সিকুয়েন্স বুঝিয়ে দিয়ে নিজেই পার্কিং লট থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে।সাহিলের জানে বউটা তার ভিষন রেগে আছে।সেও তো তাড়াতাড়ি বেরোতে চেয়ে ছিল।কিন্তু হঠাৎ বোর্ড মিটিং পড়ে যাওয়ায় বেরোনোটাই ঘেটে গেল।রাস্তাটা অনেকটাই শূনশান।শর্টকাট নিতেই এই রাস্তাটা ধরেছে সাহিল।এই রাস্তাটাই সন্ধ্যার পরে হাতে গোনা কয়েকটা মানুষ ছাড়া তেমন একটা গাড়ি চলাচল চোখে পড়ে না।সাহিল যখন দ্রুত গতিতে ব্রীজ ক্রস করছিল তখন হঠাৎই মনে হল ব্রীজের রেলিং এর উপর কেউ দাড়িয়ে আছে।সাহিল চোখের ভুল ভেবে পাত্তা দিল না।তবুও কেমন যেন খটকা লাগল মনে।গাড়ির মিররে নজর দিতেই দেখল রেলিং এর উপর সত্যিই কেউ একজন দাড়িয়ে আছে।সাহিল দ্রত ব্রেক কঁষলো।গাড়িটাকে কিছুটা রিভার্সে নিয়ে বেরিয়ে এল গাড়ি থেকে।রেলিং এর উপর ভারি লেহেঙ্গা পড়া একটা মেয়েকে দেখতে পেতেই ভ্রু কুচকে এল সাহিলের।মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না।তবে কিছুটা দূরে মাথা উচিয়ে দাড়িয়ে থাকা সোডিয়ামের আলোই অনেকটাই স্পষ্ট জায়গাটা।মেয়েটা যখন সামনের দিকে পা বাড়াতে যাবে তখনই পেছন থেকে অজ্ঞাত কোনো পুরুষের কথায় থেমে গেল মেয়েটা।মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখতে পেল শক্ত পোক্ত চেহারার কঠিন এক পুরুষ।মেয়েটা অনুভূতি শুন্য চোখে তাকালো।সাহিল মেয়েটার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-এক্সকিউজ মি…? রেলিং এর উপর কি করছো? আই মিন টু সে,,,এখান থেকে পড়ে যেতে পারো তুমি।একটু পিছিয়ে এসো প্লিজ।
মেয়েটা কিছুক্ষন নিরব থেকে মুখ খুলল।ভাঙা গলায় বলল,
-নান অফ ইউর বিজনেস।
মেয়েটার কন্ঠ শুনে কুচকানো ভ্রু জোড়া আরো খানিকটা কুচকে গেল সাহিলের।গলার স্বরটা বেশ ইউনিক। ভাল লাগছে শুনতে।সাহিল আবারো বলে উঠল,
-ওকে।বাট আমার তোমাকে এটা জানানো উচিত যে,,,তুমি পড়ে যেতে পারো।আর তুমি কে?এতো রাতে এখানেই বা কি করছো? দেখো তুমি যেই হওনা কেন প্লিজ নেমে এসো।আর যদি হাওয়া খাওয়ার জন্যে ওখানে ওঠো,, তাহলে দাড়িয়েই থাকো।তবে তোমার এত গরম লেগেছে যে সোজা রেলিং এ উঠে দাড়িয়েছো?
কথাটা বলেই মৃদু হাসল সাহিল।সাহিলের এমন কথায় আর হাসিতে মেয়েটা চোখ মুখ কুচকে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে বলে উঠল,
-আপনার মনে হচ্ছে এতো রাতে আমি এখানে হাওয়া খেতে দাড়িয়ে আছি?
-দেখো আমি জাস্ট মজা করছিলাম।আচ্ছা এটা বলো কে তুমি? আর কাঁদছোই বা কেন? কি সমস্যা বলো। আমি তোমাকে হেল্প করবো।
মেয়েটা খানিক পিছিয়ে এসে রেলিং এর উপর বসল।সাহিলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-ইটস নান অফ ইউর বিজনেস।
-ওকে।আচ্ছা লেট মি গেইজ।তুমি নিশ্চয় কোনো ফ্যাশান মডেল শো থেকে এসেছো?বা কোনো ফ্যাশান ডিজাইনার?
মেয়েটা আবারো বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকালো।সাহিল আবারো বলে উঠল,
-তোমার শরিরে বিয়ের পোশাক। এমনটা নয়তো যে,,, তুমি নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছো?মাই গড…!!পিচ্চি একটা মেয়ে হয়ে এমন কাজ করতে পারলে?
কথাটা মষ্তিষ্ক অবধি পৌছাতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মেয়েটা।চাপা ক্রোধ নিয়ে বলে উঠল,
-পিচ্ছি…? আমাকে দেখে পিচ্চি মনে হচ্ছে?বাইশ বছরের আমি।
সাহিল আক্ষেপের সুর তুলে বলল,
-সরি।সতেরো বছরের দেখতে লাগছো।অবশ্য এতে আমার কোনো দোষ নেই।বয়সের তুলনায় বড় হওনি এটা টোটালি তোমার দোষ।চেহারা পিচ্চি পিচ্চি হলে মানুষে পিচ্চি বলবে এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু তুমি এটা বলো,,,,এতো রাতে তুমি এখানে কি করছো? আর এই সাজ..?
মেয়েটা ভুস করে নিশ্বাস ছাড়লো।অন্ধকার আকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে আবারো সাহিলের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে উঠল,
-নিজের বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছি এখানে।সুইসাইড কমিট করতে।
সাহিল চমকে তাকালো।বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠল,
-মানে?
-মানে… আত্মহত্যা করতে এসেছি।
সাহিল বিষ্ময় নিয়ে বললো,
-মানে তুমি এতো উঁচু থেকে লাফ দিবে?
মেয়েটা এবার ভ্রু কুচকে তাকালো।বলল,
-আপনি আমায় চ্যালেঞ্জ করছেন?আপনার মনে হয় আমি এখান থেকে লাফ দিতে পারবো না?
মেয়েটা উঠে দাড়াতে নিলেই সাহিল ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে,
-ওয়েট ওয়েট ওয়েট।প্লিজ ওয়েট।আমি কখন বললাম তুমি লাফ দিতে পারবে না?আচ্ছা শোনো,,,,আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে তুমি?
-কাজ..!!!কি কাজ?
-দেখো আমি একজন রাইটার।গল্প লিখি।তুমি আমাকে বলো তোমার সাথে ঠিক কি কি হয়েছে সেটা আমি আমার গল্পে লিখবো।এরপর তুমি ইচ্ছেমত লাফ দিও আই মিন তখন তুমি এখান থেকে লাফ দিও।আমি আটকাবো না।প্লিজ মরার আগে এটুকু হেল্প অন্তত করো।আমার ক্যারিয়ার সেট হয়ে যাবে ইয়ার।
মেয়েটা চোখ মুখ কুচকে চাপা রাগ দেখিয়ে বলে উঠল,
-আপনার মনে হয় আপনার ওই বোরিং রাইটিং ক্যারিয়ার সেট করার জন্য আমি এখানে দাড়িয়ে আছি?হাউ ডিসগাস্টিং…
-আরে মরার আগে একটা ভাল কাজ তো করে যাও।দেখো এতে আমার লাইফ সেট হয়ে যাবে।আর যতো দূর ক্রডিটের কথা,,,আমি এর সম্পূর্ন ক্রেডিট তোমাকে দেবো। আই প্রমিস। বইয়ের উপরে বড় বড় করে লিখবো “ইন দি লাভিং ম্যামোরি অফ…..
-আমিশা।
সাহিল খানিক হাসার চেষ্টা করে বলল,
-মাইসেল্ফ সাহিল।
-নো ওয়ান আস্কড ইউ।
-আরে এক মিনিট এক মিনিট।কথায় কথায় এভাবে দাড়িয়ে পড়ছো কেন?
মেয়েটা বিরক্ত চোখে তাকালো।চাপা তেজ দেখিয়ে বলল,
-হোয়াট ইজ ইউর প্রবলেম?
-প্রবলেম!!আই হেভ নো প্রবলেম।প্রবলেম তো তোমার।আই মিন,,,প্রশ্ন উত্তর পালা চলছে আগে শেষ তো হতে দাও। তারপর নাহয় আরাম করে লাফিয়ে পইড়ো।আচ্ছা এটা বলো আমার ক্যারিয়ার বেশি বোরিং?
-অফকোর্স ।রাইটিং ভিষনই বোরিং জিনিস।একেতো আপনি রাইটার তারউপর ফ্লপ।তো অনেস্টলি আমি আপনার জায়গায় থাকলেও সুইসাইডই কমিট করতাম।
-তাই!! আচ্ছা একটু ওয়েট করো। আমাকে একটু সময় দাও।আমি গাড়ি থেকে ফোনটা নিয়ে আসি।
-কেন?
-কেন আবার!!! তুমি লাফ দিবে আর আমি ভিডিও বানাবো।দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার একটা কর্তব্য আছে না… তোমার মৃত্যুর খবরটা সবাইকে জানানোর।
-সেটার প্রয়োজন নেই।আমি অলরেডি সুইসাইড নোট লিখে এসেছি।
-সুইসাইড নোট?সিরিয়াসলি? মানে তুমি দুই হাজার একুশে দাড়িয়ে সুইসাইড নোট লিখেছো?মানে ভিষনই ওল্ড ফ্যাশানে সুইসাইড কমিট করছো তুমি।
-তাছাড়া আর কি করতাম?
-দেখো তোমার জায়গায় আমি থাকলে একটা হোয়াটস আ্যাপ গ্রুপ বানাতাম।নিজের সমস্ত বন্ধুকে তাতে এ্যাড করতাম।একটা লম্বা চওড়া সেন্টিমেন্টাল ম্যাসেজ লিখতাম।নয়তো একটা ভয়েস নোট।কিংবা একটা ভিডিও কল।ভিডিও চ্যাট হলেও প্রবলেম নেই।এতে কত ইমোশন পাওয়া যায় জানো?
-কিন্তু আমি আমার ফোন নিয়ে আসি নাই।
-সেজন্যেই তো বলছি আমাকে আমার ফোনটা আনতে দাও।তুমি লাফ দিবে আর আমি ভিডিও বানাবো।আচ্ছা এসব ছাড়ো।আমায় এটা বলো,,,কিছু খেয়েছো তুমি?নাকি খালি পেটেই বিয়ে ছেড়ে পালিয়েছো?নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে।আমায় বলো কি খাবে? আমি এখুনি নিয়ে আসছি।
-আপনার মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে মজা করছি? লাফ দেওয়ার জন্যে এখানে দাড়িয়ে অাছি আমি।আর আপনি খাওয়ার কথা বলছেন?
সাহিল খুব গোপনে দির্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
-আমাকে এটা বলো,, তুমি কিভাবে জানো এখান থেকে পড়লে তুমি মরে যাবে?
-এখান থেকে পড়লে কেউ বাঁচে না।
-হতে পারে তুমি বেঁচে গেলে।মানে তুমি এখান থেকে লাফ দিলে।আর তোমার সমস্ত হান্ডি ভেঙে গেল আর তুমি মরলে না।তখন?আমার কথা শুনো।এটা ভিষন রিস্কি কাজ।তুমি বরং বাড়ি গিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলে মরে যাও।
-সম্ভব না।বাড়িতে প্রচুর লোক।পাপীরা মরতে দেবে না আমায়।
-এটা একটা বড় সমস্যা।বিয়ের অজুহাতে এতো মানুষ আসে যাদের আমরা কোনো দিন দেখিই নি।আমার তো সন্দেহ আছে আসলে ওরা আমাদের আদৌও আত্মীয় কি না!!বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই বিষয়ে এ্যাকশন নেওয়া।কিন্তু তুমি আমায় বলো,,,বাইশ বছর বয়সে এত বড় সিদ্ধান্ত?
-বড় সিদ্ধান্ত নয়।খারাপ সিদ্ধান্ত।নিজের ইচ্ছেই বিয়ে করার অনুমতি পাইনি আমি।
-তাই বলে সুইসাইড করবে?পালিয়ে গিয়েও তো বিয়ে করতে পারতে।আই মিন,,, পালিয়ে তো তুমি এসেছোই।তাহলে বিয়েও করে নিতে?
-যার জন্যে পালিয়েছিলাম সে অন্য কারো সাথে পালিয়ে গেছে।
কথাটা শুনা মাত্রই ফিক করে হেসে ফেলল সাহিল।আমিশাকে রেগে যেতে দেখে যথাসম্ভব হাসি আটকানোর চেষ্টা করে বলে উঠল সাহিল,
-আই এম সরি।আমি একদমই হাসতে চাই নি।কিন্তু ব্যাপারটাই হাসির।এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার ওকে জিজ্ঞাসা তো করতে,,,ও কি চাই।
-আপনারা ছেলেদের কাছে সবকিছুকে শুধু মজা মনে হয় তাইনা?একটা মেয়ে তার বাবা মাকে ছেড়ে,পুরো পরিবার ছেড়ে,নিজের বিয়ে ছেড়ে এখানে এসেছে সুইসাইড কমিট করতে।আর এটা শুনে আপনার হাসি পাচ্ছে?
কথাটা বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল আমিশার।সাহিল খানিকটা অপরাধের স্বরে বলল,
-দেখো তুমি যেমনটা ভাবছো তেমনটা নয়।আমি বুঝতে পারছি এই মুহূর্তে তোমার মনে ঠিক কি চলছে। আই এম সরি।
-সরি বলার প্রয়োজন নেই।এতে আপনার কোনো দোষ নেই।ছেলেরা হয়ই এমন।সেও এমনই ছিল।
এরপর দুজনেই চুপ।খানিক বাদে আমিশা যখন চোখ তুলে তাকালো তখন দেখল সাহিল তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।আমিশা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করল,
-আমার পায়ের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
সাহিল এবার আমতা আমতা করে বলে উঠল,
-না মানে দেখছিলাম আরকি। তুমি ভূত টূত নও তো?অবশ্য তোমার পা তো সোজায় আছে।
আমিশা ভুস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠল,
-সব ভূতের পা উল্টো হতে হবে এমন কোনো মানে নেই।ভূতের পা সোজাও হতে পারে।আর আপনার আমাকে ভূত বলে মনে হচ্ছে?
-আরে রেগে যাচ্ছো কেন?চারপাশে একবার তাকিয়ে তো দেখো।অন্ধকার রাত,শূনশান ব্রীজের উপর বিয়ের সাজে একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে সুইসাইড কমিট করতে।ব্যাপারটা অনেকটা ভূতুড়ে টাইপ লাগছে না?আমি এমন অনেক ভূতুড়ে গল্প পড়েছি।
-আপনি আমার সাথে মজা করছেন? আমি এখানে সুইসাইড করতে বসে আছি আর আপনি তখন থেকে বাজে বকে যাচ্ছেন।আপনি যাবেন এখান থেকে? নাকি শান্তিতে একটু সুইসাইডও করতে দিবেন না?
আমিশার রাগান্বিত কথা আর কঠিন চেহারা দেখে দুষ্টু হাসলো সাহিল।সাহিলের এমন হাসির কোনো কারন খুজে পেল না আমিশা।ভ্রু কুচকে সাহিলের দিকে তাকাতেই দেখল সাহিল তার দিকে এগিয়ে আসছে।
-সুইসাইড করতে চাও তো? ওকে ফাইন। আমি হেল্প করছি। অামারও অনেক দিনের শখ কাউকে খুন করার।আজ দুজনেরই ইচ্ছে পূরন হয়ে যাবে।হ্যাভ এ গুড ডেথ মিস আমিশা।
কথাটা শেষ করে আমিশাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে হাত তুলতেই চোখ মুখ বন্ধ করে দুহাতে রেলিং খামচে ধরে খিঁচে বসে রইল আমিশা।ভয়ে শরিরটা হালকা কাঁপছে তার।হঠাৎ করেই সাহিলের হাসির শব্দ কানে আসতেই চট করে চোখ মেলে তাকালো আমিশা।সাহিল ওর থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে পেটে হাত দিয়ে হাসছে।আমিশা ভ্রু কুচকে তাকাতেই হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো সাহিল।মুখটাকে খানিক গম্ভির করে বলে উঠল,
-এই সাহস নিয়ে সুইসাইড করতে এসেছিলে?দেখো আমার কথা শোনো,,,,সুইসাইড কোনো সমাধান নয়।জিবন হল খুব সুন্দর একটা মিথ্যে।আর মৃত্যু হল কঠিন সত্য।জিবন অনিশ্চিত কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত।তুমি না চাইলেও তোমাকে মরতে হবে।এটাই জিবনের সত্যতা।জিবনের রঙ কখনো রঙিন কখনো ধূসর।তাই বলে সুইসাইড করতে হবে? আমার কথা মানো আর বাড়ি ফিরে যাও।এই রাতে তোমার এখানে থাকাটা সেইভ নয়।যেকোনো বিপদে পড়তে পারো।বখাটে ছেলেদের খপ্পরেও পড়তে পারো।এরথেকে ভালো সুইসাইড এর ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বাড়ি ফিরে যাও।
আমিশা চোখ নামিয়ে নিল।করুন গলায় বলল,
-বাড়ি ফিরতে চাই না আমি।
-কেন?
-আমি বিয়ে ছেড়ে পালিয়েছি।বাবা মা নিশ্চয় ভিষন রেগে আছে আমার উপর।আমি অযথায় ওদের কষ্ট দিলাম।আই হেট মাইসেল্ফ।
সাহিল ছোট্ট শ্বাস টেনে মুচকি হাসলো।বলল,
-লাইফে যেকোনো সিচয়েশনে কম্পেয়ার করতে শেখো আমিশা।যখন কম্পেয়ার করা শিখে যাবে তখন সব কিছু সিম্পল মনে হবে।বাবা মা কখনো সন্তানের খারাপ চাই না।হ্যা এটা ঠিক,, অনেক সময় তারা সন্তানের ভালো করতে গিয়ে অজান্তেই খারাপ করে ফেলে।তবে হিসেব করে দেখতে গেলে ভালোর দিকটাই বেশি। নিজের পছন্দ করা ছেলেকে তো দেখলে।এবার নাহয় বাবা মার পছন্দের সাথে খানিক কম্পেয়ার করো।লাইফ ইজ অল এবাউট ব্যালেন্সিং।জিবনে ব্যালেন্স থাকাটা ভিষন ইমপর্টেন্ট।আর কি বলছিলে? আই হেইট মাইসেল্ফ? আমরা নিজেকে নিজে যদি ভালো না বাসি তাহলে দুনিয়ার কেউই আমাদের ভালবাসবে না আমিশা।আমার কথা শোনো আর বাড়ি ফিরে যাও।বাবা মাকে গিয়ে শুধু একটা সরি বলো,,,দেখবে ওনারা তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন।তোমাকে না পেয়ে ওনারা নিশ্চয় ভিষন চিন্তা করছে।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে আমিশা আর সাহিল।দুজনেই চুপ।সাহিল এটা ভেবে স্বস্তি পাচ্ছে যে মেয়েটাকে সে বাঁচাতে পেরেছে।সাহিলকে চুপ থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো আমিশা।বলল,
-আপনি কি সেই সাহিল চৌধুরি? অধির চৌধুরির ভাই!!
সাহিল ড্রাইভিং করতে করতেই মুচকি হাসল।আমিশা এবার চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-তাহলে যে বললেন আপনি একজন রাইটার?
-সেটা তো ব্যস তোমাকে ডিসট্র্যাক করার জন্য বলেছিলাম।তোমার সাথে মজা করছিলাম যাতে তুমি ডিসট্র্যাক হও আর কিছুটা সময় পেয়ে সুইসাইডের ভূতটা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।
সাহিলের কথায় হাসল আমিশা।আরো কিছুটা যেতেই গাড়ি থামাতে বলল আমিশা।
-এখানেই নামিয়ে দিন আমায়।ওটাই আমার বাড়ি।
সাহিল ভ্রু কুচকে তাকালো আমিশার দিকে।বিষ্ময় নিয়ে বলল,
-তুমি রায়হান শেখের মেয়ে!!!
আমিশা হেসে ফেলল।ঠোটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,
-কেন আপসোস হচ্ছে? এমন মনে হচ্ছে কি যে….. আমাকে বাঁচানোটা আপনার ভুল হয়েছে?
সাহিল চোখ নামিয়ে নিল।শান্ত গলায় বলল,
-না তেমন কোনো ব্যাপার না।
-এমনটা মনে হতেই পারে মিষ্টার সাহিল।যতই হোক আমি আপনাদের বিজনেস রাইভালস্ এর মেয়ে বলে কথা।
সাহিল হেসে উঠে বলল,
-কর্ম জিবনে প্রতিযোগিতা অবশ্যই থাকে মিস আমিশা।সেই সাথে থাকে অসংখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই বলে বিজনেস ইস্যুতে থাকা শত্রুতার জের ধরে আমি তোমার মৃত্যু কামনা করতে পারি না।বাই দা ওয়ে,,,তুমি এবার যেতে পারো।আসলে আমার ইমিডিয়েট বাড়ি ফিরতে হবে।কেউ একজন অপেক্ষায় আছে।
আমিশা আর কথা বাড়ালো না।গাড়ি থেকে নেমে যেতেই সাহিল বলে উঠল,
-আই হোপ যে এর পর থেকে সুইসাইডের কথা মাথায় আনবে না।
আমিশা গেটের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলে উঠল,
-আই হোপ যে সেকেন্ড টাইমও আপনি এসে আমায় বাঁচিয়ে নিবেন।
সাহিল হাসলো।গাড়ি বাড়ি পথে ঘুরিয়ে হাত ঘড়িতে চোখ বুলাতেই চমকে উঠল সে।বারোটা বাজতে আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি।সাহিল গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল।যে করেই হোক বারোটার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও বারোটার আগে পৌছানো গেল না।ঘড়ির কাটা বলছে এখন বারোটা বেজে বারো মিনিট।সাহিল বাড়ির মেইন গেট পার হয়ে গাড়ি থেকে নামতেই সদর দরজায় রিয়াকে দাড়িয়ে থাকতে দেখল।সাহিলকে আসতে দেখেই দৌড়ে এল রিয়া।সাহিলের দিকে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসতেই ভ্রু কুচকালো সাহিল।
-এভাবে হাসছিস কেন?বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
রিয়া লস্বা হেসে বলে উঠল,
-আমার বিয়ে ছেড়ে তুমি নিজের বিয়েটা আগে বাচাও সাহিল চৌধুরি।তোমার বিয়েটা বোধ হয় আর টেকানো গেল না।
সাহিল ভ্রু উচিয়ে বলল,
-মানে?
-মানে আজকে চৌধুরি বাড়িতে বিশাল এক ধামাকা হবে।এবং সেই ধামাকার মূখ্য চরিত্র হলে তুমি।দি গ্রেট সাহিল চৌধুরিইইই….
সাহিল অসহায় চোখে তাকালো।বলল,
-বেশি রেগে আছে?
রিয়া মাথা দুলিয়ে জবাব দিতেই ভুস করে নিশ্বাস ছাড়ল সাহিল।সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে নিতেই পেছন থেকে রিয়া এক গাল হেসে বলে উঠল,
-গুড লাক ভাইয়া।
সাহিল অসহায় চোখে চেয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো।দরজার বাইরে কিছুক্ষন পায়চারি করে কাপা কাপা হাতে দরজা খুলে ভেতরে এল।ছোট ছোট পা ফেলে রুমে আসতেই দেখল বিছানার ঠিক মাঝ বরাবর উপর হয়ে শুয়ে আছে নাতাশা।সাহিল সাবধানে কোর্টটাকে সোফায় রেখে নাতাশার পাশে শুয়ে পড়ল।সিলিং ফানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
-খিদে পেয়েছে ভিষন।
নাতাশা তাকাল না।সাহিলের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল,
-নিচে গিয়ে রহিম চাচাকে বলো খাবার দিয়ে দেবে।
সাহিল আরো কিছুটা নরম সুরে বলে উঠল,
-রহিম চাচা তো প্রতিদিনই দেয়।আজ আমার বউ এর হাতে খেতে ইচ্ছে করছে।
-আমি পারবো না।
-সোনা প্লিজ রাগ করো না।আমি তাড়াতাড়িই আসতাম কিন্তু হঠাৎ মিটিং পড়ে গেল। সরি জান।প্লিজ রাগ করো না।তুমি তো জানো অধির নেই।তুমিও দুদিন ধরে অফিসে যাচ্ছো না।সব কাজ এখন একা আমাকেই সামলাতে হচ্ছে।বুঝার চেষ্টা করো জান,,,আমি কাজে ছিলাম।
নাতাশা এবার শোয়া থেকে উঠে সাহিলের পেটের উপর উঠে বসে কলার চেপে ধরে বলতে লাগল,
-চুপ… এক দম চুপ।একটাও কথা বলবি না।নয়ত আমি তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো।এই গরমে এতো কষ্ট করে আমি তোর জন্যে রান্না করলাম আর তুই তাড়াতাড়ি আসতেই পারলি না?চার চার রকমের ডিসেস রান্না করেছি।আর তুই আমাকে কাজ দেখাচ্ছিস?আমার দিকে তাকা।এদিক ওদিক কি দেখিস।আমি কথা বলছি তো।আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি। এবার বল,,,এমন কি মিটিং ছিল যেটা শেষ হবার নামই নিচ্ছিল না!!চুপ করে আছিস কেন? বল আমায়।কোন মিটিং রাত বারোটা অবধি থাকে বুঝা আমায়।নয়ত সত্যি সত্যি আমি তোর মাথা ফাটিয়ে দিবো বলে দিলাম।
নাতাশাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টুপ করে নাতাশার ঠোটে চুমু দিয়ে বসল সাহিল।নাতাশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই দুষ্টু হেসে চোখ টিপ দিয়ে আবারো একই কাজ করে বসল ।নাতাশা চোখ মুখ শক্ত করে তাকাতেই সাহিল মুচকি হেসে বলে উঠল,
-জান,,,??ইউ নো হোয়াট…?ইউ হিট মি দেন আই কিস ইউ।এবার চুমু খেতে চাইলে তুমি আমার মাথা ফাটাতেই পারো।আই হেভ নো প্রবলেম।
সাহিল আরো একবার নাতাশার ঠোটে চুমু দিতেই বিছানা ছেড়ে নেমে দাড়ালো নাতাশা।সোফার হাতলের উপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে গলায় ঝুলাতে ঝুলাতে বলে উঠল,
-ঝগড়া করার মুডটাই নষ্ট করে দিল বেয়াদবটা। পাচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেস হয়ে নিচে আসবে।আমি ডায়নিং এ খাবার রেডি করছি।পাচ মিনিটের এক সেকেন্ডও দেরি করলে খাবার অফ।এন্ড ইউর টাইম স্টার্ট নাও।
চলবে…..