এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব-৫৫

এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব-৫৫
#লেখিকা- কায়ানাত আফরিন

আনভীরের কথা শুনে আমি বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আমি যে ভয় পেয়েছি উনার কোনো মাথাব্যথাই নেই। বরং মুখে ঝুলছে একটা দুষ্টু হাসি। আমার চোখের পলক পড়া যেনো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানে,,,কিস আর আদরের মধ্যে আদৌ কোনো পার্থক্য আছে কি না তা আমার অজানা। শুধু এতটুকুই জানি যেকোনো একটায় রাজি হলেই লজ্জার চরম প্রান্তে পৌঁছে যাবো। আমি উনার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিলাম নিজের কাছে থেকে। অস্বস্তি সুরে বললাম,

-কোনোটাই দরকার নেই?

-কেনো আদর পেতে ইচ্ছে করেনা?

-তা না।

-এর মানেই আদর পেতে চাও?

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম উনার দিকে৷ উনি বরাবরের মতো ভ্রু নাড়িয়ে ঠোঁটের চাপা হাসি টেনে রেখেছেন। আমি উষ্ণ শ্বাস ছাড়লাম। এই লোকে রীতিমতো জব্দ করার চেষ্টা করছেন আমায়। আমি মিনমিনিয়ে বললাম,

-আমার ভয় দূর করার এটা কেমন টিপস?

-ইটস কলড আনভীর’স লাভটিক্স।

বলেই উনি চোখ টিপ মারলেন আমায়। আমি কথা বাড়ালাম না। ব্যাটা বিয়ের প্রথম ছয় মাস শুধু ধমকের ওপর রাখছে, আজ বাপ হওয়ার পর মহাশয়ের ফ্লার্ট করতে ইচ্ছে করে। শখ কত! আমার চোখে ঘুম জরিয়ে আসছে। আনভীর এবার আমায় বুকে টেনে নিলে আলতো করে বিলি কেটে দিতে রাখলেন চুলে। আমার চোখ আচমকাই জুরিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে ঘুমের অন্ধকার রাজ্যে পাড়ি দিয়ে দিলাম উনার ভালোবাসাময় স্পর্শে।

আয়নার যতবারই নিজেকে দেখি ততবারই অবাক হই আমি। বিগত কয়েকমাসে নিজের মধ্যে কতটা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে আমার৷ সময় ভারী অদ্ভুত। একবার ছুটে চলা শুরু করলে ছুটে চলতেই থাকে অবিন্যস্ত ধারায়। মনে হচ্ছে এইতো কিছুদিন আগেই জানতে পেরেছিলাম আমি প্রেগন্যান্ট। তারপর আনভীরের জড়ানো কথাবার্তাগুলো নিছক স্মৃতি হিসেবে মানতে একটুও মন সায় দেয়না৷ যেদিন আমি জানতে পারলাম আই এক্সেপ্ট টুইন, আমি যেন নিজের হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই সাথে আনভীরও৷ উনি খুশিতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন যেহেতু টুইন বেবির প্রতি সবসময়ই উনার একটা মারাত্মক দুর্বলতা কাজ করতো। তবে যেদিন ডাক্তার বললেন যে আমার আর আমার বেবির মধ্যে কিছু কমপ্লিকেশনস আছে উনি ভয়ে সিটিয়ে ফেলেছিলেন নিজেকে৷ আনভীর নিঃসন্দেহে একজন পারফেক্ট ম্যান। উনার সবকিছুতে সবসময়ই ডিসিপ্লিন প্রকাশ পায়। তবে সেদিন প্রথম উনার মুখে অস্থিরতা আর ভয়ের চরম রেশ দেখতে পেয়েছিলাম আমি৷ পাগলাটে লাগছিলো উনাকে। ডাক্তারের সেদিন অ্যাপয়েনমেন্টের পর আনভীর আরও বেশি সিরিয়াস হয়ে পড়েছিলেন আমার প্রতি৷ আমায় খুব কমই একা একা রাখেন৷ ডেলিভারি ডেট যতই এগোচ্ছে ততই অস্থিরতার মাত্রা বাড়ছিলো উনার৷ আমার এখন এসব কিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে নিছক৷ কিন্ত না, আয়নায় যতবারই আমি তাকাই তারপর নিজের প্রতিবিম্বকে দেখি, মনে হয় এখানে শুধু আমি না, আমার সাথে আরও দুইটা প্রাণ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের হার্টবিট এর শব্দ কাঁপন ধরিয়ে দেয় আমার শরীরে।
হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আমায় জরিয়ে ধরতেই ধ্যান ভেঙে গেলো আমার। আয়নায় দেখতে পেলাম আনভীরের প্রতিবিম্ব। উনি সবেমাত্র গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছেন। স্নিগ্ধ লাগছে উনাকে দেখতে৷ আনভীর সময় বিলম্ব না করে আমার ঘাড়ে নিজের থুতনি রেখে আলতো করে চুমু দিলেন গলায়। মিনমিনিয়ে বলে ওঠলেন,

-কি ভাবছো মিসেস আহি?

উনার ‘মিসেস আহি’ ডাকটিতে বরাবরই অন্যরকম একটা মাদকতা কাজ করে। কানের কাছে নুপুরের ন্যায় বাজতে থাকে সেই গহীন কথাবার্তাগুলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,

-আপনার পাগলামি কাজগুলোর কথাই ভাবছি।

-কে পাগলামি করছে? আমি কোনো পাগলামি টাগলামি করছি না। আমি শুধু একটু ওভার প্রোটেকটিভ তোমায় নিয়ে।দ্যাটস ইট! বুঝেছো?

আমি পেছনে ঘুরলাম। চোখ ছোটো ছোটো করে বললাম,

-আমি পাগলামি বলবো না তো কি বলবো বলেন তো? সারাদিন খাটে বসিয়ে রাখেন। একটু এদিক সেদিকও যেতে দেননা। আগে তো কত টাইপ চকলেটও আনতেন, এখন তাও আনেন না। ওয়েদার চেন্জ হয়েছে মানি,, তাই বলে এখনই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে হবে? আপনি সেই কাজটাই করেন। আগে কত গল্প করতেন আমার সাথে, এখন তাও না। এটা করো, ওটা করো, এটা খাও, ওটা খাও, জলদি ঘুমাও, তারপর শেষ। বাবা-মায়ের বিবাহ বার্ষিকীর সময়েও আপনি সবার সামনে আমায় ধমক মেরে সোফায় বসিয়ে রেখেছিলেন। এমনকি অয়নকেও কোলে নিতে দেননি। পারলে তো গোসলের সময়ও আমার সাথে বাথরুমে ঢুকে পড়েন সেফটির জন্য। এসবকে পাগলামি বলবো না তো মহৎ কর্ম বলবো?

আনভীর প্রতিউত্তরে কিছু বললেন না এবার। যেন আমার কিছু বলা আর না বলাতে কিছুই যায় আসবে না উনার। আমার হাত টেনে খাটে বসিয়ে দিয়ে আলতো করে চুমু খেলেন কপালে। শীতল কন্ঠে বললেন,

-এত ছোট্ট মাথায় চাপ নিও না। আমার জায়গায় তুমি নেই তো, তাই আমার টেনশনের কারন বুঝো না৷ যখন থেকে ডাক্তার বলেছে যে টুইন বেবির জন্য তোমার আর বেবির মধ্যে কমপ্লিকেশনস থাকতে পারে তখন থেকেই আমার নিঃশ্বাস বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে৷ তোমার বিন্দুমাত্র লাইফ রিস্ক ট্যাকেল করা আমার পক্ষে পসিবল না আহি। এখন ভদ্র মেয়ের মতো বসে থাকো। আমার একটু বাহিরে যেতে হবে। আসার সময় তোমার জন্য একটা ডেইরি মিল্ক নিয়ে আসবো কেমন?

আমি মাথা নাড়ালাম নিঃশব্দে। আনভীর চলে যাওায়র পর পরই মা আর ভাবি আমার কাছে আসলেন৷ মা এখন বেশিরভাগ সময়েই কাথা সেলাইয়ে ব্যাস্ত থাকেন৷ এমনিতেও ঘরে অলরেডি অয়ন আছে, আবার আমার দুই বেবির জন্যও তো প্রচুর কাথা লাগবে। তাই মা নিজের সব পুরোনো শাড়ি দিয়ে কাথা বানাচ্ছে নিজের নাতি-নাতনীদের জন্য। নুড়ী আপাও কয়েকটা বানিয়ে দিয়েছেন আমায়৷ কথাটা অবাস্তব হলেও সত্যি, যে এবাড়িতে আমি হলাম সবার চোখের মনি। আমার এখানে কখনোই নিজেকে বাড়ির বউ বলে মনে হয়নি। কেননা বাবা মা আমায় মনে করেছে নিজ সন্তানের মতো, নুড়ী আপা, শিউলি ভাবি, আজরান ভাইয়া আমায় নিজের ছোট বোন হিসেবেই মানে। কথায় আছে না, কষ্টের পর সুখ মেলে!
আমার ছোটবেলাটা যতটাই দুর্বিষহ কেটেছিলো, ঠিক ততটাই আনন্দে কাটছে আমার বর্তমান। ইনশাআল্লাহ! ভবিষ্যতটা আরও সুন্দর হবে।

মা এখন একটা নিমার ওপর ফুল আঁকছেন সন্তর্পণে৷ উনার চোখে চশমা, সেটা নাকের ডগায় পড়ে গিয়েছে। শিউলি ভাবি অয়নকে ঘুম পাড়িয়ে এসে আমার সাথে কথা বলতে মগ্ন। একপর্যায়ে হঠাৎ মা বললেন,

-তোমার বাবা বিগত কয়েকদিন ধরেই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে চাচ্ছে আহি।

মুখ নিকষ অন্ধকার হয়ে গেলো আমার। মা আমার ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বললেন,

-তুমি দেখা করতে চাইলেই সে আসবে৷ অন্যথায় আসবে না।

-তাকে বলে দিও মা আমি এখন আর তাদের বোঝা নই৷ তাই আমার সাথে দেখাও করতে হবে না৷ যেই মানুষ আমার অগোচরে বিয়ে করে আরামের সংসার করেছিলো আমায় একা রেখে তাকে আমার বাবা হিসেবে মানতে বেজায় কষ্ট হয় মা।

মা আর কিছু বললেন না। ঘটনাটি একপর্যায়ে এখানেই থেমে গেলো৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম আমরা৷ সন্ধ্যায় আনভীর কল দিয়ে বললেন, উনি খিলগাঁওয়ে জ্যামে আটকা পড়েছেন। আসতে কিছুটা সময় লাগবে৷ সাথে এটাও বললেন রাতের খাবার সময়মতো খেয়ে নিতে৷ আমি তাই করলাম কথামতো৷ এখন আমি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রুমে এসে শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসটি পড়ছিলাম আনমনে। এটা বরারই আমার প্রিয় এক উপন্যাস৷ রমেশ চরিত্রটা যতবারই পড়ি ততবারই নতুন মনে হয় আমার কাছে। কিন্ত হঠাৎ পেটে চিনচিন ব্যাথা শুরু হলো আমার। প্রথমে ব্যাপারটা নজরে দিলাম না কারন আমার মনে হচ্ছিল বেবি বুঝি কিক মারছে পেটে৷ কারন আমাদের দুই চ্যাম্প সারাক্ষণই পেটে ফুটবল খেলে মিশমিশে। পরক্ষণে ব্যাথাটি গাড়িয়ে গেলো আমার। টের পেলাম এটা অন্য ব্যাথা।

ঘটনাটি এতই দ্রুত ঘটলো যে বিষয়টা মাথায় ক্যাচ করতে সময় নিলো আমার৷ ঘড়ির কাটা আটটা ছাপান্ন ছুঁই ছুঁই। বাইরে বাতাসের সমাগম অল্প, তবে জানান দিচ্ছে মধ্যরাতে ঘটা করে বৃষ্টি নামবে। কিছুক্ষণ আগেই আজরান ভাইয়া দেখে গেলো আমায় যেহেতু আনভীর নেই৷ বললো এখনি সে শিউলি ভাবিকে ডেকে দিবে। এর মধ্যেই যে এত বড় একটা কান্ড হয়ে বসবে একেবারে ধারনাই ছিলো না আমার৷ আমি তলপেটে হঠাৎ অনুভব করলাম অসহ্য যন্ত্রনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে চোখে ভীর করেছে রাশি রাশি পানি৷ তখনই আমি গগনবিদারী চিৎকার করাতে একে একে মা-বাবা, আজরান ভাইয়া এমনকি ভাবীও এসে পড়লো অয়নকে একা ছেড়ে।
আনভীর যেই ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হয়েছে। উনি দ্বিধায় ছিলেন উনার অনুপস্থিতিতে আমার পেইন হলে কি হবে আমার? যন্ত্রণায় ছটফট করছি আমি। মা বারবার আমায় শান্ত করার চেষ্টা করছেন আর আজরান ভাইয়া ইতিমধ্যে গাড়ি বের করে ফেলেছেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য৷ শুধু আনভীর নেই এখানে। আমার পাগল বরটা যদি এসে দেখে আমার এ অবস্থা আরও পাগলামি করবেন উনি। আফসোস উনার বেসামাল পাগলাটে মুখটা আমার আর দেখা হলো না, আমার চোখ বন্ধ হওয়াতে ঢলে পড়লাম শিউলি ভাবির বুকে।

————-

চোখ খুলতেই আনভীরের ঘুমহীন রক্তিম মুখটার মুখোমুখি হলাম আমি। আমার চোখ খোলা মাত্রই উনি হতদন্ত হফ ছুটে এলেন আমার কাছে। আমি এখন হাসপাতালে। আশপাশে মেডিসিনের কড়া ঘ্রাণ অনুভব করতে পারছি। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে এবার। একে তো ডেলিভারি ডেটের আগে তখন পেইন উঠেছিলো তারওপর আমি এখানে কেনো?

আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলেন ডাক্তার নাজনীন। উনার চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত। বললেন,

-অনেক সমস্যা হয়েছে মিঃ আনভীর!

দাঁড়িয়ে পড়লেন আনভীর। একে একে ভাইয়া ভাবিও ভেতরে আসলো। আনভীর জিজ্ঞেস করলেন,

-কি সমস্যা?

– বেবি দুইটার পজিশন চেন্জ হয়ে গিয়েছে। আর ডেলিভারি সময়ের আগেই বেবির পজিশন চেন্জ হওয়ার ব্যাপারটা কত কমপ্লিকেটেড জানেন?আর যদি টুইন বেবি হয় তবে ব্যাপারটা আরও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়।একে তো বেবির মায়ের বয়স অল্প। ওয়াটার ব্রেক না হওয়ার দরুন নরমাল ডেলিভারি করাও অসম্ভব আমাদের পক্ষে। এখন সি সেকশনেই নিতে হবে আহিকে৷

আনভীরের চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। কেননা সে ভালোমতোই জানে টুইন বেবির জন্য সি সেকশন অনেকটাই রিস্কি৷ সবার মুখেই দুশ্চিন্তার চরম রেশ। আমার প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে এবার। জ্ঞান ফিরে আসার পর সেই যন্ত্রণা আরও যেনো বেড়ে গিয়েছে৷ আমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম,

-যেটা ভালো ওটাই করুন ডাক্তার। প্লিজ! আমার জানপাখি দুইটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

অবশেষে আমায় সিজারিয়ান সেকশনেই নিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। আনভীর একটা কথাও বললেন না তখন। উনি বেসামাল হয়ে পড়েছেন বাচ্চাদের মতো। আমায় কি সান্ত্বনা দেবেন যেখানে উনি নিজেই আছেন অস্থির হয়ে? আমার হঠাৎ ভাবিমণির ডেলিভারির সময়কার উনার বলা একটি কথা মনে পড়ে গেলো,

-দেখেছো আজরান ভাইয়ার কি অবস্থা? তোমার এমন কিছু হলে আমি তো মরেই যাবো আহি। সুসংবাদ শোনার আগেই উদ্বিগ্নতায় আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো!
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

পর্বটা বড়ো হয়েছে। তবে কয়েকটা মিসকনসেপশন ক্লিয়ার করার জন্য আরেকটু সময় নিয়ে লেখা উচিত ছিলো যেই সময়টা আপাদত আমার নেই। আগামী পর্বেই তা পরিষ্কার করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কেমন হয়েছে জানাবেন।
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখার অনুরোধ রইলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here