#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_42
ম্রিয়মান আলো তে ও নীলাশার রোষ মিশ্রিত মুখ টা দেখা যাচ্ছে। মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙে পরেছে মেয়েটি।একটু দূরে দাঁড়িয়ে সেসব ই দেখেছিলো নাহিদ।তবে ছেলেটা কল্পনা ও করতে পারলো না এভাবে কাইসারের উপর হামলা করবে মেয়েটা।
ফ্লাওয়ার ভাসের আঘাতে কাইসারের কান থেকে লাল রঙের তরল দ্রব্য ঝরতে লাগলো। নাহিদ এসে জাপটে ধরলো ওনাকে। মৃদু আর্তনাদ করে বলল
_হো আর ইউ হেয়ার গেট অ্যা কুইক ফাস্ট এইড কিট। ড্যাড ওয়াজ ইনজুরিড। আর ইউ ক্রেজি নীলাশা? তুই কি করে পারলি ড্যাড কে আঘাত করতে!
_ ডোন্ট মুভ। আদার ওয়াইস আই উইল
_আদার ওয়াইস ইউ উইল? থামলি কেন বল তুই তোর দা ভাই কে আঘাত করবি। মার, কর আঘাত, তবু ও এমন পাগলামি করিস না।
_নাহিদ প্লিজ তুমি থামো ওকে বকো না।
তাচ্ছিল্য হাসলো নীলাশা। পরমুহূর্তেই ঝমঝমে কেঁদে উঠলো। বলল
_শুধু মাত্র এই লোক টার জন্য আমি আমার ভালোবাসা হারিয়েছি।তোমরাই বলো রাদ আমাকে কি করে মানবে। ওর তো বউ আছে, এটা তো সত্য। আজ এই পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী ড্যাড। তুমি দায়ী। একটা কথা সব সময় মনে রাখবে আমি তোমাকে হেইট করি। পৃথিবীর সব থেকে জঘন্য ব্যক্তি তুমি।
তড়িৎ গতিতে প্রস্থান করলো নাহিদ। এক মুহূর্ত এ স্থানে থাকতে চায় না ওহ।চোখের সামনে নিজের বিধ্বস্ত হওয়া পরিবার কে দেখে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই সব কিছুর জন্য খুব বড় মূল্য চুকাতে হবে রাদ কে।
ছোট ছোট রঙিন আলো দ্বারা সজ্জিত রুম টি থেকে খিল খিল করে হাসির শব্দ ভেসে আসছে।
রাদ এতো টা দুষ্টুমি করে চলেছে যা মেয়ে টি কে হাসাতে বাধ্য করাচ্ছে। গত পাঁচ মাসে প্রতিনিয়ত এমন টাই করে যাচ্ছে রাদ। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মতো এতো সুখী বোধহয় এই ধরা তে কেউ নেই বা কেউ হতে পারে না। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বলল
_কাছে আসবেন না আপনি।রোজ এমন সুরসুরি দিবেন না তো।
_সুরসুরি দিবো আমি, আর সেটা একশ বার দিবো হাজার বার দিবো।
_দেখুন ডাক্তার সাহেব।
_দেখাও আর কি দেখার বাকি আছে দেখি।
_আশ্চর্য! লাজ লজ্জার কিছু নেই আপনার মাঝে?
_নেই রোদের মাম্মা।
_এই রোদ টা এলো কোথা থেকে?
_কেন আমাদের বাবুর নাম রোদ।
_কিই!
অবাকের সহিত উচ্চারন করলো ভোর।রাদ কিছু টা কাছে এসে বলল
_কেন পছন্দ হয় নি?
_আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন। ডাক্তার কে ডাক্তার দেখাতে হবে।
খিল খিল করে হাসতে লাগলো ভোর। রাদ কিছু টা কাছে নাকে ওর ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগলো। কিছু টা ঘোর মিশ্রিত কন্ঠে বলল
_হুম। এখন আমার এতো গুলো আদর লাগবে।
_সরুন তো।
_ছিই কেমন বউ তুমি।
_ভালো বউ আমি।
_ভালো বউ বুঝি বর কে কাছে আসতে দেয় না?
_হুম দেয় না।
_আচ্ছা। তাহলে এবার জোড় খাটাতে হবে দেখছি।
বরাবরের মতোই শক্তির জোড় খাটালো রাদ। মেয়েটা কে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো। এবার ভোর ও ছুটোছুটি থামিয়ে দিলো।লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে রাদের গলায় মুখ গুঁজে দিলো। ছেলেটার গাঁ থেকে গোলাপের নির্যাসের মতো সুভাস নাকে এসে লাগছে।
কি মাতাল করা চাহনি ওর। কাছে আসার অস্পষ্ট আহ্বান। ভোরের আঙুলের ফাঁকে আঙুল দিয়ে খেলতে লাগলো রাদ। কিছু টা ঝুঁকে মেয়েটার কানে ফু দিলো। শিহরণে জেগে উঠলো ভোরের প্রতি টি শিরায়। মাদক ময় কন্ঠে রাদ বলল
_তোমাকে দেখলেই আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ভোর। আমি যেন চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকি কখন আমার হৃদয় টা পরিপূর্ণ হবে। এ জীবনে তোমাকে কাছে পাওয়ার তৃষ্ণা কখনোই মিটবে না আমার। আমি যে তোর রোদ্দুরে উন্মাদ পাগল হয়ে গেছি। তুই কাছে থাকলে এতো সুখ সুখ কেন লাগে?
_এভাবে বলতে হয় না। জানেন না আমার লজ্জা হয়।
ভোরের লজ্জার কারন যেমন রাদ ঠিক তেমনি ওর লজ্জা নিবারণ ও হয় রাদের মাধ্যমেই। ঠোঁট কামড়ে হাসলো ছেলেটি। ধীরে ধীরে মেয়েটির মাঝে ডুবে যাচ্ছে। এতো ভালোবাসার পর ও কেন কম মনে হয় সব? প্রণয়ের দহনে যে রোদ্দুর সৃষ্টি হয় তাঁতে ও কেন মনের তৃষ্ণা মিটে না। মনে হয় আরো চাই আরো চাই।
সত্যি বলতে ভালোবাসায় চাওয়ার কোনো সীমা থাকে না। এর প্রখরতা প্রতি নিয়ত বেড়েই চলে। যাঁর জ্বলন্ত উদাহরণ ওরা দুজন।
.
রামিসার সাথে হাতে হাতে কাজ করছিলো ভোর। সিঁড়ির কাছ থেকে মেয়েটা কে নানা ভাবে ইশারা করে চলেছে রাদ। তবে একটি বার ও তাকাচ্ছে না মেয়েটি। পূর্ণ মনোযোগে রান্না করে চলেছে। ঠিক যেন অর্ধ শত বছরে রমনী।
হাজার খানেক কষ্ট নিয়ে ডাইনিং এ বসলো রাদ। শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে ইফতিহার ও যোগ দিলেন। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরামর্শ করা হলো। ডাইনিং এ খাবার পরিবেশন করে রামিসা আর ভোর ও বসলো। রাদ যেন এমন সুযোগ ই খুঁজছিলো। পায়ের স্লিপার খুলে ফেলে ধীরে ধীরে ভোরের পায়ে পা রাখলো। একটু খানি পরোটা মুখে দিয়েছিলো মেয়েটি। তৎক্ষনাৎ গলায় আটকে গেল।দ্রুত পানি এগিয়ে দিলো রাদ। ঢক ঢক করে পানি পান করছে ভোর। এক টুকরো রুটি মুখে দিয়ে বিড় বিড় করে রাদ বলল
_আন রোমান্টিক বউ।
কথা টা স্পষ্ট শুনতে পেল ভোর। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে মেয়েটির। দুষ্টুমি কি রাদ একাই পারে? ভোর ই বা কম কিসের। মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে রাদ। খাওয়া প্রায় শেষ। ঠিক তখনি ওর পা আটকে ধরলো ভোর।রাদ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে। বাঁকা হেসে ভোর বলল
_ঠেলা সামলান এবার।
_ওরে দুষ্টু। দেখাচ্ছি মজা।
ভোর কিছু বোঝার পূর্বেই বোমা ফাটিয়ে দিলো রাদ। একদম শান্ত আর সরল কন্ঠে বলল
_একি ভোর এবার আমার পা আটকে রেখেছো কেন? দেখো আমি কিন্তু অতো রোমান্টিক নই যে
ওর কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আবারো গলায় খাবার আটকে গেল মেয়েটির। রামিসা আর ইফতিহার মুখ টিপে হেসে উঠে গেলেন। ভোরের বোকা চাহনি বেশ উপভোগ করলো রাদ। নাকে আঙুল ছুঁইয়ে বলল
_মিসেস আপনি ভুলে গেছেন আপনাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আমি।
_দেখুন ডাক্তার সাহেব সব সময় কোলে পিঠে করে মানুষ করেছেন বলবেন না।
কথা টা অত্যধিক জোড়ে বলায় আবারো লজ্জা পেল ভোর। রাদের দিকে কয়েক টা ক্রোধ চাহনি মেলে ছুট লাগালো। হাসতে হাসতে ব্লেজার নিয়ে বের হলো রাদ। এই মেয়েটা কতো ভাবে বিমোহিত করবে ওকে তা এক মাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
অপরূপ সৃষ্টির মাঝে সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি হলো মানুষ।আর তাঁর ই মাঝে সব থেকে বেশি সুন্দর হয় প্রিয় মানুষটি। ভোরের নজরে এই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর সৃষ্টি ওর ডাক্তার সাহেব। কেন যেন আজ কিছু অন্য রকম ইচ্ছে জেগেছে ওর। ঘন কালো কুঁচকুঁচে আঁধারে ডুবে আছে চাঁদ। আকাশে কিছু মেঘের আভাস। হালকা বিদ্যুত চমকাচ্ছে সাথে ফুরফুরে বাতাস। এমন নজর কাড়া অদ্ভুত পরিবেশ সবর্দা পাওয়া যায় না। সত্য বলতে কিছু কিছু আঁধার সুন্দর হয়।যেমন ওর জীবনে আঁধার না আসলে কখনোই রাদ নামক রোদ্দুর পেতো না। আনমনেই হেসে উঠলো মেয়েটা। পুরো রুম জুড়ে শতেক খানেক মোম বাতি জ্বালিয়েছে। যাঁর আলো তে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে রুম টি। এমনি তেই বেশ গোছালো ভোর তারউপর অত্যধিক যত্ন নিয়ে সাজিয়ে ছে রুম টা। শেষ মোম টা জ্বালানোর সময় ওর ফোন ভাইব্রেশন হলো।এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো অধরে।কল টা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে রাদ বলল
_ভালো লাগছে না। খুব খুব খুব ক্লান্ত লাগছে।
_বাড়ি তে আসুন ক্লান্তি দূর করে দিবো।
_সেই জন্য ই তো কল করলাম তোমায়। ইউ নো তোমার মিষ্টি কন্ঠ টা আমাকে বেশ অনেক টা স্বস্তি দেয়। মনে হয় ব্রেক টাইম না হয়ে যদি বউ টাইম হতো।
_সব সময় রোম্যান্স এর ধান্দাবাজি তাই না?
_এ জীবনে রোম্যান্স ছাড়া আর কিই বা আছে বলো তো? ক্ষনিকের জীবন থেকে বউ ছাড়া পাঁচ টি বছর কাঁটিয়ে দিয়েছি। আমার তো আফসোস হচ্ছে কেন কাছে টেনে নিলাম না।
_ইসস। এতো ভালোবাসা দেখাবেন না তো। আমার হৃদয়ের গতি কমে যায়।
_হুসস মেয়ে। এমন বাজে শব্দ উচ্চারন করবে না। তোমার কিছু হলে এই রাদ আঁধারে ডুবে যাবে।
_আর আপনার কিছু হলে এই ভোরের জীবনে কখনো ভোর হবে না।
দুজনেই নিশ্চুপ। একটু আগের সুন্দর মুহূর্ত ভুলে দুজনেই যেন অন্য আশংকায় ডুবে। ভারী নিশ্বাস গুলো বাতাসে মিশে করুন শব্দ তুলেছে। হালকা বাজের শব্দ হতেই জানালায় তাকালো ভোর। ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি হচ্ছে। আনমনেই মেয়েটা বলল
_আমার না খুব ইচ্ছে হচ্ছে আপনার বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে বৃষ্টি মাখতে।
_আর আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার প্রতি টা লোমকূপে ঠোঁট ছোঁয়াতে।
_ধ্যাত।
_এই ভোর।
_হুম বলুন।
_এই বুকে ডুবে যাবে প্লিজ? আমি অশান্ত হয়ে যাচ্ছি। ধারালো কিছুর আঘাত অনুভব হয় সব সময়। মনে হয় আমি কিছু হারিয়ে ফেলবো।
_এমন বলবেন না প্লিজ। আমার কষ্ট হয়। এখন সব কথা বাদ দ্রুত আসুন সারপ্রাইজ দিবো।
_সারপ্রাইজ! ওকে হসপিটাল থেকে ঘুরে সোজা বাসায় আসছি। আজ কিন্তু অনেক ভালোবাসা হবে।
_আচ্ছা হবে। রাখছি এখন
_এই কল কেঁটো না।
কল কাটলো না ভোর। রাদ লম্বা করে দম নিয়ে বলল
_আই লাভ ইউ।
_ আই লাভ ইউ টু।
মৃদু হাসলো রাদ। ফোন টা টেবিলের এক সাইটে রেখে চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দিলো। মন টা বেশ আনচান করছে, মেয়েটার সারপ্রাইজ দেখার জন্য।
হসপিটাল থেকে গাড়ি নেওয়ার জন্য পার্কিং এ পা ফেলেছে রাদ। তখনি একটি ম্যাসেজ আসলো
‘ ইউ আর ফিনিস ডক্টর ইফতিহার রাদ। ‘
ছেলেটার ভ্রু কুঁচকে গেল। ফোনের স্ক্রিনে ম্যানেজার এর নাম দেখা যাচ্ছে। কল রিসিভ করতেই ম্যানেজারের হন্তদন্ত কন্ঠ স্বর শোনা গেল।
_স্যার হসপিটালে পুলিশ এসেছে। আর তল্লাশি চালিয়ে ড্রাগস পেয়েছেন।
_হোয়াট! আমি এখনি আসছি।
পার্কিং থেকে ছুট লাগালো রাদ। ভেতর টা খচখচ করছে। এ কোন আঁধার নেমে আসলো ওদের সুখ ময় রোদ্দুরে?
অফিসারের সাথে তর্ক করে যাচ্ছে রাদ। রাগে মুখের পেশি গুলো ফুলে যাচ্ছে। নিজ ব্যক্তিত্ব হারিয়েছে ছেলেটা। এমন অসামাজিক অভিযোগ পরলে কোন মানুষ টাই ঠিক থাকতে পারে?
পুরো হসপিটাল থম মেরে গেছে। অফিসার শান্ত কন্ঠে বললেন
_আমি দুঃখিত স্যার। বাট আপনাকে এরেস্ট করতেই হবে আমাদের। বাকি টা আদালত সিদ্ধান্ত নিবেন।
_আর ইউ ক্রেজি অফিসার?
_আমাদের হাতে কোনো উপায় নেই স্যার। এরি সাথে আপনার লাইসেন্স বাতিল করা হবে।
রাদের মাথা টা ফেটে যাচ্ছে। অফিসার রাদ কে এরেস্ট করে নিয়ে গেল। কথা টা ভোরের কানে পৌঁছাতেই মেয়েটা ধপ করে বসে পরলো।
রামিসা দু হাতে আগলে নিলো ওকে। চিৎকার করে উঠলো ভোর। রামিসা কে জড়িয়ে ক্রদন্তরত অবস্থায় মেয়েটি বলল
_আম্মু, আমাদের বেবির আগমনের কথা জানাতে পারলাম না ওনাকে। বলতে পারলাম না ছোট ছোট হাত পা আসার কথা। নরম তুলতুলে শরীরের খিল খিল হাসির শব্দ। সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমিই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।একি আঁধার নেমে এলো আমাদের জীবনে। আমি কি করে বাঁচাবো ওনাকে?
** পরের পার্টেই গল্পের সমাপ্তি হবে। সমাপ্তি পার্টে এই গল্পের উদ্দেশ্য জানাবো ইনশাআল্লাহ।**
বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।
চলবে