#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৩ (প্রথম পরিচ্ছেদ)
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
মিলি চলে গেছে আজ প্রায় পনেরো দিন হবে। ঘরটায় হাসানের দম বন্ধ লাগে। পুরো ঘরটা জুড়েই মিলির গন্ধ। যেখানে তাকায়, সেখানেই মিলিকে দেখতে পায় সে। অসহ্য লাগে তার। পনেরো দিন পর হাসান অফিসে এসেছে। চোখ মুখের অবস্থা ভালো নয় তার।
অফিসে এসে কাজে মন বসানোর চেষ্টা করছে হাসান। কিন্তু পারছে না। সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। মিলি নেই, আর কখনও সে মিলিকে দেখবে না। যদি এমন হতো, মিলি তাকে ছেড়ে অন্য কারো সঙ্গে চলে গেছে তবুও সে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারত। আমার মিলি দূরে আছে আপত্তি নেই। তবুও সে বেঁচে থাকুক। কিন্তু মিলি নেই। একেবারেই নেই। এই দুনিয়াতেই নেই। এটাই তার মনকে বার বার কাঁদাচ্ছে। দম বন্ধ লাগে ওই ঘরটায় পা রাখলে। বুকে চাপা ব্যথা হয়। মিলিকে চাই তার। তার ইচ্ছে করছে এখনি নিজেকে শেষ করে ফেলতে। এরপর মিলির কবরের পাশে তাকে কবর দেওয়া হবে। পরকালে না হয় তারা দু’জন একত্রিত হবে।
ভাবনা তো ভাবনাতেই ভালো লাগে। সব ভাবনা বাস্তবতায় টিকে না। তাকে হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে। মিলি বিহীন তাকে জীবন কাটাতে হবে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কম্পিউটারের স্ক্রিনটা ক্রমশ ঘোলা হচ্ছে। হাসান টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ জোড়া মুছে নেয়। এমন সময় হঠাৎই ফোনটা বেজে ওঠে। ড্রয়ার থেকে ফোনটা বের করে দেখে সাজি ফোন করেছে। একদমই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তার। লাইনটা কেটে দিয়ে ফোনটাই বন্ধ করে রেখে দেয় ড্রয়ারে।
ফারহান আর জাহরাফ মুখোমুখি বসে আছে। ফারহানের মুখে স্বস্তির হাসি। জাহরাফ রাগে ফেটে পড়ছে। সে যা চেয়েছিল সেটা হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে।
‘জাহরাফ সাহেবের মনটা দেখছি ভীষণ খারাপ। চেহারাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। যেটা আশা করেছিলেন সেটা হয়নি বলেই কি মন খারাপ?’
জাহরাফ তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। ভাবছে, এই লোকটাকে সে সব থেকে বেশি আঘাত করেছে। তবুও এই লোক এত স্ট্রং কী করে আছে? যার কাছে সব থেকে বেশি মূল্যবান ছিল বন্দনা, সেই বন্দনাকে সে নিজের করে নিয়েছে। তবুও এই লোকের এত পাওয়ার কীভাবে। জাহরাফ রাগে ক্ষোভে বলে ওঠে,
‘বন্দনাকে কেড়ে নিয়ে সর্ব শান্ত করে দিয়েছিলাম। এবার আরও বড়ো কিছু হবে তোমার সঙ্গে। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি।’
ফারহান হালকা হাসে।
‘সে বিক্রি হবার জিনিস ছিল তাই তুমি তাকে ক্রয় করে নিয়েছ। সে তোমার কাছে না হোক অন্য কারো কাছে ঠিকই বিক্রি হতো জাহরাফ। তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেই। কারণ, এতে তো তোমার একার দোষ নেই। তারও দোষ ছিল। আমি কিন্তু এই এত দিনে একবারের জন্যেও তোমার আর তার মধ্যিখানে আসিনি। এত দিন পর তোমরা নিজেরাই আসছ। তোমার স্ত্রী তোমার কাছে থাকা সত্ত্বেও আমার খোঁজ খবর রাখে। ভেবে দেখেছ একবারও, এতে জিত কার হয়েছে আর হার কার হয়েছে। কফিশপে আমার বর্তমান স্ত্রী’র সঙ্গে কথা বলে তোমার স্ত্রী। ভেবে দেখ তো, এখানে হারের পাল্লা কার ভারী। আমি তোমায় খোঁচামূলক কোনো কথা বলছি না। শুধু বোঝাচ্ছি। তুমি বা তোমরা যা করতেছ তা ঠিক হচ্ছে না৷ বন্দনা যখন তোমরা সঙ্গে চলে গেল তখন ভেঙে পড়েছিলাম এটা সত্যি কথা। তবে এতটাও ভেঙে পড়িনি যে তুমি এসে আমায় গুড়িয়ে দেবে। এইযে গতকাল তুমি যা করলে আমার সঙ্গে। আমি জানতাম তুমি এমনটাই করবে৷ তাই তো একই সময় দুই দিক দিয়ে মাল সাপ্লাই করে দিয়েছি। এক লট তুমি গায়েব করিয়েছ আর এক লট ওই একই সময়ে জায়গা মতো পৌঁছে গেছে। তুমি কি জীবনটাকে সিনেমা ভেবে বসে আছো কি না কে জানে। আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হয়েছিল, তুমি কিছু একটা করবে। আর আমার সন্দেহটাই সত্যি হলো। দেখ জাহরাফ, তুমি আর বন্দনা ভালো থাকো এটা আমিও মন থেকে চাই। মন থেকে চাই তোমরা তোমাদের আগামী দিনগুলোতে সুখী হও। তবে আমার লেজে পা দিও না। আমার লেজে পা দিলে আমি কিন্তু ফেরত কামড়টা বসাতে বাধ্য হবো।’
জাহরাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এবং দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। ফারহান একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নিঃশ্বাসটায় ঠান্ডা হাওয়া বের হচ্ছে। সমস্তটা জুড়ে প্রশান্তি কাজ করছে। ফোন হাতে নিয়ে অয়নন্দিতাকে ফোন করে ফারহান।
‘হ্যালো।’
‘অয়নন্দিতা, আমি পেরেছি। জাহরাফের ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে আমি পেরেছি। আমার মনে হয় না, জাহরাফ আর বন্দনা এবার আর আমাদের কোনো ক্ষতি করবে।’
কথাটা শুনে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। সেও আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে।
সাজি তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে পরিবারে। সে তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হবে না। ফারহানসহ বাকি সবাই অবাক। সব থেকে বেশি অবাক হয়েছে অয়নন্দিতা নিজে। সাজির মনে এত কিছু ছিল সে কখনও টের-ও পায়নি। রমজান শেখ কী বলবেন তিনি ভাবছেন। তবে ফারাশ সাজির সাপোর্টে ছিল। ড্রইংরুমে সবাই বসে আছে। রমজান শেখ মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন,
‘তুমি কি তোমার সিদ্ধান্ত থেকে নড়বে না?’
‘নাহ বাবা।’
‘ভুল করছ না তো?’
‘আমার যা ভাবার আমি ভেবে নিয়েছি বাবা।’
‘ওকে। দেখছি আমি। তুমি ঘরে যাও।’
সাজির পেছন পেছন অয়নন্দিতা যেতে নিলে রমজান শেখ তাকে আটকায়।
‘বউমা, তুমিও এখানে বোসো।’
তিনি ফারহানকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘ফারহান, তোমার কি মতামত?’
‘আমি এখনও শকড বাবা।’
‘বউমা, তুমি কি কিছু বলবে?’
‘বাবা, আমি এখনও ভাবতেই পারছি না সাজি এত বড়ো সিদ্ধান্ত নেবে।’
‘সাজির মা, তুমি?’
‘মেয়ে এমন কিছু চাইবে কখনও আশা করিনি। তবে মেয়ে যদি এখানে ভালো থাকে আমার আপত্তি নেই।’
আলাদা করে ফারাশকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি। কারণ প্রত্যেকেই জানে ফারাশের জবাব হ্যাঁ। উঁচু-নিচু হবে না। সরাসরি হ্যাঁ।
সাজি ক্যান্টিনে বসে আছে। সামনে চায়ের কাপে থাকা চা এতক্ষণে হয়তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। সাজির মনটা অশান্ত হয়ে আছে। অপরপক্ষ থেকে কী জবাব আসে সেই চিন্তাই করছে সে। তমা নামের মেয়েটা এসে সাজিকে ডাকছে।
‘তোকে একজন খুঁজতে এসেছে।’
‘কে?’
‘নাম তো বলল হাসান। দেখতেও সেই লাগল। কে রে লোকটা?’
‘হাসান ভাই! এখানে?’
সাজি ছুটে গেল। তমা তাকিয়ে ছিল সাজির চলে যাওয়ার পথে।
‘আপনি, এখানে?’
সাজি হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করে।
‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। ইমারজেন্সি।’
‘বলুন।’
‘এখানে না। এক ঘন্টা সময় হবে তোমার?’
‘হ্যাঁ হবে।’
‘চলো তাহলে৷’
হাসান আর সাজি বের হয়ে যায়। রিক্সায় বসে দু’জন। হাসানের শরীর থেকে কড়া ঘ্রাণটা সাজির নাকে লাগছে। হাসানকে অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। হাসান কাউকে ফোন করল৷
‘মোতালেব ভাই, আজ অফিসে লাঞ্চের পর ঢুকব। বসকে ম্যানেজ করে নিয়েন৷’
অপরপ্রান্তে থাকা মোতালেব ভাই কী বললেন বোঝা গেল না। হাসান ফোন রেখে দিয়েছে।
‘তুমি বাসায় যা যা বলেছ, তা কি ঠিক করেছ?’
‘কোনটা?’
‘ভণিতা কোরো না সাজি৷’
‘এমন প্রশ্নই বা করছেন কেন?’
‘আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই। যার জন্য তুমি আমার সঙ্গে থাকতে চাচ্ছো। আর আমি মিলিকে ভুলতেও পারছি না।’
‘আপনাকে ভুলতে কে বলল?’
‘মনে রাখার মতো স্কোপ-ও তো দিচ্ছো না তুমি।’
‘খবরদার। সেদিন হসপিটালে যা বলেছেন তো বলেছেন। নেক্সট টাইম এইসব বলবেন না আমায়। আমি আপনাকে বলিনি তাকে ভুলে যান। আমি আপনাকে বলিনি তাকে মনে রাখা যাবে না। আমি শুধু আমার জায়গাটুকু চেয়েছি।’
‘তোমায় ভাবতে হবে, সেই জায়গায় আমি তোমায় বসাব কি না।’
‘বসাবেন না আমায়?’
হাসান কিছুক্ষণ সাজির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাজির চোখে পানি ভর করেছে।
‘আপনাকে বলিনি মিলির ভালোবাসা আমায় দিতে হবে। আপনাকে আমার ভালো লাগে। কেন লাগে জানি না। তাই থাকতে চাই৷ এক কাজ করবেন, আমায় ভালোবাসতে হবে না। শুধু সাথে রেখে দিন৷ তাহলেই হবে।’
হাসানের নজর ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। সাজির চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে সে।
চলবে…………………………………