#জান্নাহ্
#পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সদ্যস্নান করে বেরিয়েছে সারহান।শরীরের নিম্নাংশে সাদা টাওয়েল জড়ানো।চুল থেকে টপটপ পানি পড়ছে।গায়েও লেগে আছে বিন্দু বিন্দু পানি।অতর্কিতে ঘরে ঢুকে পড়ে নিধি।সারহানকে এই অবস্থায় দেখে সে থতমত খেলেও সারহান নিরুত্তাপ।চুল মোছার টাওয়েল টা বিছানায় ফেলে সেখানে রাখা সাদা রঙের পাতলা টি শার্টটা গায়ে গলিয়ে নেয়।বেখেয়ালিপনায় বললো–
“কারো ঘরে ঢুকতে হলে পারমিশন নিতে হয় ইটস আ জেনারেল নলেজ।”
নিজের কাজে লজ্জিত হয়ে অনুযোগের সুরে নিধি বললো-
“সরি,এই সময় তুমি শাওয়ার নিবে ভাবতে পারি নি।”
সারহান ফিচেল হেসে বললো–
“আজকাল শাওয়ার নিতেও টাইম দেখতে হবে!আজিব!
আয়নায় দাঁড়িয়ে চুলে হাত বুলাতে থাকে সারহান।নিধি সেইসবের তোয়াক্কা না করে গম্ভীর গলায় বললো–
“ভাবি আর আমি তিতিকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি।খালাম্মা ঘুমাচ্ছেন।তাই তোমাকে বলতে এলাম।”
সারহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো–
“ওকে।”
বিছানা থেকে ডেনিমের প্যান্ট টা হাতে নিতেই নিধির কন্ঠ শুনতে পায়।
“রাফাতকে চেনো তুমি?
সারহান ভ্রু কুঁচকে জিঙ্গাসু গলায় বললো—
“কোন রাফাত?
নিধি নির্দ্বিধায় বললো–
“জান্নাহ্ এর স্কুলের টিচার।”
সারহান সপ্রতিভ হয়ে বললো–
“বাবাকে যে বাসায় নিয়ে এসেছিলো?
নিধি মৃদু গলায় বললো—
“হুম।”
বাঁকা হাসে সারহান।তীর্যক গলায় বললো—
“এই জন্যই মানুষের উপকার করতে নেই।ভালো মানুষের কোথাও ভাত নেই।মানুষের স্বভাব আজ,যেই থালায় খাবে সেই থালায় ফুটো করবে।বেচারা উপকার করলো আর তার বিনিময়ে আমার বউকে জড়িয়ে…।”
সারহান তার কথার সমাপ্তি ঘটায়।বিরক্ত লাগছে তার।নিধি স্বশব্দে বলে উঠে–
“ঘটনা পুরোপুরি মিথ্যে নয়।রাফাত ইন্টারেসটেড জান্নাহ্ এর প্রতি।”
সারহান নিধির সামনে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।এইভাবে নিধির সামনে দাঁড়ানোতে অপ্রস্তুত হয় সে।সারহান বুকে হাত ভাঁজ করে বাঁকা হাসে।গম্ভীর গলায় বললো—
“আমার বউয়ের প্রতি যদি হাজারো পুরুষ ইন্টারেসটেড থাকে তাতে আমার কিছু যায় আসে না।ইউ নো হোয়াই?কজ শী ইজ ডিপলি অ্যাডিক্টেড টু মি।নাউ আউট।আউট ফ্রম হেয়ার।”
সারহানের ধমকে ক্ষুব্ধ হয় নিধি।কিন্তু তা প্রকাশ না করে দমদম করে পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।সারহান তার মুখ বিকৃত করে স্বগতোক্তি করলো–
“উপযুক্ত ভাইয়ের উপযুক্ত বোন।আমার রজনীগন্ধার নখেরও যোগ্য না।আর এসেছে ইন্টারেস্টের কথা বলতে!ভাইতো ঝুলেছে এখন বোনটাও ঝুলে পড়তে চায়।জাস্ট লাইক আ…।”
নিজের অযাচিত কথাকে অবদমন করে সারহান।
,
,
,
তপ্ত পিচ ঢালা রাস্তায় ত্রস্ত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে জান্নাহ্।রোদের তাপ আর ভয় সবকিছু ঘিরে ধরেছে তাকে।সে চায় না রাফাতের মুখোমুখি হতে।সামনে পা বাড়িয়ে আবার পেছন ফিরে তাকায়।আজ শেষ ক্লাস টেস্ট ছিলো।এরপর আর দীর্ঘ সময়ের জন্য স্কুলে আসবে না জান্নাহ্।এতে অবশ্য সে খুশিই হয়েছে।রাফাত থেকে দুরে থাকতে পারবে।স্কুলের সামনেই তিন রাস্তার মোড়।লম্বা লম্বা পা ফেলে মোড় ঘুরতেই তার সামনে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে রাফাত।চকিতে দাঁড়িয়ে যায় সে।জান্নাহ্ চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে লম্বা লম্বা দম ফেলে।মৃদু হাসে রাফাত।গম্ভীর গলায় বললো–
“পালিয়ে যাচ্ছো?আমার কল কেন রিসিভ করছো না?
বৃহৎ ঢোক গিলে জান্নাহ্।ভীত গলায় বললো–
“যেতে দাও আমায়।”
“আমার প্রশ্নের উত্তর?
“বাধ্য নই আমি।”
“আমি শুনতে চাই।”
জান্নাহ্ চুপ করে থাকে।রাফাত হালকা ঝুঁকে বললো–
“তোমার হ্যাজবেন্ড এসেছে?
জান্নাহ্ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।কিন্তু কোনো আওয়াজ করলো না।ঝলসানো রোদে উষ্ণ দেহের নোনতা জল গড়িয়ে পড়ছে।রাফাত গাঢ় দৃষ্টিতে জান্নাহ্ এর চোখের দিকে তাকায়।ভ্রু জোড়া ভিজে আছে বিন্দু বিন্দু ঘামে।চোখের পাপড়িগুলো লেপ্টে আছে একে অপরের সাথে।তাদের পাশের এসে থামে একটি সাদা গাড়ি।ব্রেক কষার আওয়াজে সেদিকেই ফিরে তাকায় জান্নাহ্ আর রাফাত।গাড়ি থেকে নরম পায়ে নেমে আসে ইহতিশাম।চোখে লাগানো কালো রঙের রোদ চশমাটা খুলে প্যান্টের পকেটে রাখে।জান্নাহ্ বার কয়েক ঢোক গিলে।তাদের দুইজনকে দেখেই স্মিত হাসে ইহতিশাম।নম্র গলায় বললো–
“বয়ফ্রেন্ড,গার্লফ্রেন্ড?
রাফাত শক্ত গলায় বললো–
“নো।টিচার,স্টুডেন্ট।”
ইহতিশাম অনুযোগের সুরে বললো–
“ওপস সরি।এক্সপ্রেশন চিনতে ভুল হলো।একটা হেল্প পাওয়া যাবে?
রাফাত অস্ফুট সুরে বললো–
“হুম।”
ইহতিশাম সজাগ দৃষ্টি রাখে জান্নাহ্ এর দিকে।চোখেগুলোতেও কেমন ভয়ের ছাপ।মিচকি হাসে ইহতিশাম।তার ধারণা হয়তো সত্য হতে পারে।তাই মেয়েটি ভয়ে কথা বলছে না।সেদিক থেকে মনোযোগ অপসারণ করে ইহতিশাম।বুক পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রাফাতের সামনে ধরে।রাফাত ঠিক ঠাওর করতে পারলো না।সে না সম্মতি জানাতেই জান্নাহ্কে দেখায় ছবিটি।জান্নাহ্ অবাক হয়।ছবিটি আর কারো নয় সারহানের।জান্নাহ্ এর মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এলোমেলো দৌঁড়াতে শুরু করে।আঁতকে উঠে সে।জান্নাহ্ এর চোখের প্রস্ফুরন বুঝতে পারে রাফাত।আজ সকালেই সারহানকে বারান্দায় দেখেছে সে।কিন্তু ঠিক মতো চেহারা দেখতে পায় নি।জান্নাহ্ হাত দিয়ে ইশারা করলো।হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইহতিশাম।কারণ সে তার তীক্ষ্ম বুদ্ধির জোরেও জান্নাহ্ এর কোনো কথাই বুঝতে পারলো না।রাফাত ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো–
“এখান থেকে সোজা গিয়ে বামে।সেখান থেকে দেখবেন দুটো গলি।আপনার হাতের ডান পাশের গলি দিয়ে পাঁচমিনিট হাটবেন।”
ইহতিশাম কিছুক্ষন বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের গন্তব্য ধরে।
,
,
,
সারহানের সামনে বসে আছে ইহতিশাম।সরল তার দৃষ্টি।সারহানের মুখভঙ্গিতে ইহতিশাম বুঝতে পারছে না সে আসলে খুশি না অখুশি।সারহানকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নরম গলায় বললো–
“কীরে,একবার জিঙ্গেস তো করতে পারিস কেমন আছি?
সারহান হেয়ালি গলায় বললো—
“অসুস্থ থাকলে তো এই পর্যন্ত আসতি না।”
ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।ঠান্ডা স্বরে বললো–
“এখনো ক্ষমা করতে পারিস নি আমাকে?
সারহান তীর্যক গলায় বললো–
“তুই পেরেছিলি!দোষ না করেও দোষি হয়েছি আমি।তোর একটু ভয় আমার নাম ক্রিমিনালের খাতায় উঠিয়ে দিয়েছে।তোর জন্য আমি আমার জীবনের সেই মানুষকে হারিয়েছি যার কাছে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর ছিলো।”
“দেখ সারহান আমি…।”
ইহতিশামের কথার ফাঁকেই জান্নাহ্ এসে দাঁড়ায়।ইহতিশামের চোখ যায় সরাসরি জান্নাহ্ এর চোখে।নাস্তার ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রাখতেই ইহতিশাম দেখে জান্নাহ্ এর হাতের কাটা সেই দাগ যা সে বিকেলে দেখোছিলো।কপট বিস্মিত গলায় বললো–
“আপনি এই বাড়িতে থাকেন?
সারহান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।বিগলিত হাসে জান্নাহ্।ঝলমলে গলায় বললো—
“জ্বী।”
ইহতিশাম এক আকাশ বিস্ময় প্রকাশ করে বললো—
“আপনি কথা বলতে পারেন?
জান্নাহ্ ঠোঁট চিপে মুচকি হাসে।সারহান ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করে বিষয়টা।জান্নাহ্ মৃদু গলায় বললো-
“জ্বী।”
অবিশ্বাস্য হাসে ইহতিশাম।সরব গলায় বললো—
“তখন কথা বললেন না কেন?
জান্নাহ্ ক্ষীন চোখে তাকায় সারহানের দিকে।সারহান গমগমে গলায় বললো–
“আপনি যান।”
জান্নাহ ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে রান্না ঘরে যায়।ইহতিশাম কৃত্রিম তাজ্জ্বব মুখভঙ্গি করে বললো–
“আজব মেয়ে তো?কে হয় তোর?
সারহান শক্ত কিন্ত ধীর গলায় বললো–
“ওয়াইফ।”
এক লাফ মেরে উঠে ইহতিশাম।হাত দুটো ভাঁজ করে সারহানের দিকে ঝুঁকে বললো—
“তুই বিয়ে করেছিস?
সারহান কাউচে আয়েশ করে বসে।থমথমে গলায় বললো–
“এতে অবাক হবার কী!
ইহতিশাম একটা দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।হয়তো তার ধারণা ভুল।সারহান বিয়ে করেছে।তার মানে সেই কালো অধ্যায় হয়তো বন্ধ হয়েছে।তাহলে এই খুন!ইহতিশাম যা জানতে এসেছে তা সে ঠিকই বের করবে।কিন্তু আপাতত সারহানের বিয়ের খুশিতে সে আর কোনো ঝামেলা করতে চায় না।এক বুক খুশি নিয়ে সারহান থেকে বিদায় নেয় ইহতিশাম।
ইহতিশাম যেতেই জান্নাহ্ আসে।সারহান হাত টেনে জান্নাহ্কে তার উরুর উপর বসায়।ঝলমলে গলায় বললো–
“কী ব্যাপার রজনীগন্ধা!ইহতিশাম আপনাকে দেখে অবাক হলো কেন?
জান্নাহ্ সব খুলে বলে।প্রানখোলা হেসে বললো–
“আপনিই বলুন,কেউ ছবি দেখিয়ে ঠিকানা জিঙ্গেস করে?নাম ধরে বলে।”
সারহান হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো–
“ও তো গাধা।কিন্তু ইউনিক ট্যালেন্টে ভরা ওর ওই স্পেশাল গোবরওয়ালা মাথা।এক এলাকায় বসবাসরত অনেকের চেহারাই আমরা সচরাচর দেখি।কিন্তু সবাইকে নামসহ চেনা হয় না।তাই ছবি দেখিয়ে খোঁজাটা বেশি সহজ।”
“হুম।”
সারহান চুমু খায় জান্নাহ্ এর বাজুতে।মিষ্টি হাসে জান্নাহ্।ঘরের ভেতর প্রবেশ করে জাবিন।ড্রয়িং রুমের দিকে তার চোখ পড়তেই ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায় জান্নাহ্।জাবিন নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ডেকে উঠে সারহান।
“জাবিন।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দমকে যায় জাবিন।ফিরে তাকায় তার সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটির দিকে।সারহান একটা মোবাইল এগিয়ে দেয় জাবিনের দিকে।Realme x7(6/128)।জাবিন এক পলক দেখে গাঢ় গলায় বললো–
“কোনো প্রয়োজন নেই।”
জান্নাহ্ ফট করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে জাবিনের কাছে যায়।জাবিন আপত্তি করে।জান্নাহ্ জাবিনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো—
“এইটা আমার তরফ থেকে।আম্মার মারের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছো তাই।”
জাবিন স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। থমথমে গলায় বললো—
“তোমার স্বামীকে বলে দাও সে যদি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে তাহলে যেনো নিজেকে বদলে নেয়।”
জান্নাহ্ এর হাত থেকে মোবাইল নিয়ে হাঁটা ধরে জাবিন।জান্নাহ্কে কাছে টেনে নেয় সারহান।জান্নাহ্ ঠোঁট গুঁজ করে বললো–
“আপনি ওর সাথে এতো কঠোর ব্যবহার কেন করেন? এই জন্যই ও আপনাকে পছন্দ করে না।”
“কেউ না করুক,আপনি তো করেন।যান ব্যাগ গুছান।বের হবো আমরা।”
জান্নাহ অবাক গলায় বললো–
“এখন?
“হুম।”
ব্যাগ গুছানো শেষ জান্নাহ্ এর।বই খাতাসহ প্রয়োজনীয় সব জিনিস ব্যাগ ভর্তি করেছে।রাত তখন আটটা।পেছনে দাঁড়ানো সারহান ফট করেই বললো–
“আমরা এখন যাচ্ছি না রজনীগন্ধা।কাল সকালে যাচ্ছি।”
জান্নাহ্ নাকের পাটা ফুলিয়ে কপট অভিমানি গলায় বললো—
“তাহলে বললেন কেন?
“কারণ সকালেই যাচ্ছি আমরা।”
আচমকা শয়তানি চাপে সারহানের মাথায়।জান্নাকে সুড়সুড়ি দিতে থাকে।বিছানায় লুটিয়ে পড়ে সে।খিলখিল করে হাসে জান্নাহ্।তার হাসিতে নেচে উঠে পুরো ঘরের নিস্তব্ধতা।সারহান নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে।তার স্থির চাহনিতে থেমে যায় জান্নাহ্।জান্নাহ্ এর উপর পুরোদমে ঝুঁকে আছে সারহান।নরম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে জান্নাহ্—
“এভাবে কী দেখছেন?
“আপনাকে।”
জান্নাহ্ এর চোখের পাতায় অধর ছোঁয়ায় সারহান।জান্নাহ্ অনুভব করে সারহানকে।স্বগতোক্তি করে বললো সারহান—
“আপনার এই চোখেই তো খুন হয়েছি আমি মাই মিল্কি বিউটি।”
চলবে,,,