জান্নাহ্ “পর্বঃ৩৮

0
3947

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৩৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

নিরাক,থমথম পরিবেশ।নিকষ কালো আকাশ জুড়ে বিশাল থালার মতো চাঁদ।তার সাথেই জ্বলছে টিমটিম তারা।দেখে মনে হচ্ছে সুপারি গাছের ফুল।যেনো অগোছালো হয়ে ঝরে পড়ে আছে।হাত বাড়ালেই কুড়িয়ে নিয়ে পকেট ভর্তি করা যাবে।ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে দূরের দালানগুলো।দালানের জানালার পর্দাসহ থাই গ্লাস ভেদ করে লালচে আলোর ছড়াছড়ি।

তপ্ত বালুতে এক পা ভাঁজ করে মাথার নিচে দুই হাত দিয়ে শুয়ে আছে সারহান।তার বিষন্ন দৃষ্টি ওই স্পর্শসীমার বাইরের আকাশে।
আজ সারাদিন সারহান এখানেই ছিলো।যেই হোটেলটায় সারহান এন্ট্রি নিয়েছে তার পাশেই একটা ছোট্ট খেলার মাঠ।যেহেতু এলাকাটা ঘনবসতি তাই বাচ্চাদের খেলার তেমন একটা জায়গা।এই ছোট্ট জায়গাটাই তাদের আত্নার খোরাক যোগায়।

সারাদিনের দিবাকরের নিংড়ানো গনগনে,উষ্ণ লাভা বালু তার বুকের মধ্যে ধারণ করেছে।এখন রাতের স্নিগ্ধ,নিরাক পরিবেশে তা উগড়ে দিচ্ছে।সেই জ্বলন্ত বালু যেনো স্ফুলিঙ্গ মতো বিঁধছে সারহানের পিঠে।তবুও অনুভূতিশূন্য হয়ে সে সমাহিত হয়ে আছে সেই ধূ ধূ বালুর বুকে।সারাদিন বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় দেখার পর হোটেলে গিয়ে কিছুক্ষন থেকে আবার আসে।মাঠটা বেশি বড় নয়।তার একপাশে সংকীর্ণ রাস্তা।দুই পাশে নড়বড়ে,পলেস্তার উঠানো মানুষে গিজগিজ করা অনাবাসিক হোটেল,টেবিল বেঞ্চের সমন্বয়ে ছোট্ট খাবার দোকান।আর আরেক পাশে একটা একটা বিশাল নদী।এখনো নদী থেকে ট্রলারের ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে আসছে।

সেই খোলা মাঠের একপাশে অশ্বথ গাছ।সারহান মাঠের ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে।তার চোখের সামনে ভাসছে তার অতীত।এমনটা না হলেও পারতো।কী দরকার ছিলো এতো ভালোবাসার !ভালোবাসা মানুষের জীবনে সুখ বয়ে আনে।তবে তার জীবনে কেন যন্ত্রণা বয়ে আনলো!সারহান আরো গভীরভাবে ওই চাঁদকে দেখে।মানুষ বলে চাঁদেরও কলঙ্ক আছে।কিন্তু তবুও সে রাতের রাণী।তার ওই মনোহারিণী রূপে ভুলে যায় তার কলঙ্ক।
তপ্ত নিশ্বাস ফেলে সারহান।তার জীবনও কলঙ্কে ভরা।যেখানে শুধু অন্ধকার।এমনটা কী সত্যিই হওয়ার ছিলো।সারহানের তার দাদার কথা মনে পড়ে।বুড়ো প্রচন্ডরকম ভালোবাসতো তাকে।তার মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার দিনগুলোতে সকালের সেই স্নিগ্ধ পরিবেশে চিরচেনা সেই রাস্তা ধরে বৃদ্ধ দাদার হাতের আঙুল ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা।দাদার কাছে বায়না করা।মেলায় যাওয়ার বায়না,আইসক্রীম খাওয়ার বায়না,ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার বায়না,পাশের বাড়ির ছোট মালিহার সাথে খেলতে যাওয়ার বায়না।
বাবার ঘাড়ে চড়ে সিড়ি বেয়ে উঠা,বাইরে যাওয়ার জন্য তার কোলে উঠে বসে থাকা।আড়তে যাওয়ার জন্য জেদ ধরা।
মা কখনো সারহানকে বকে নি।পাশের বাড়ির মালিহা খেলবে না বলে যখন চলে যাচ্ছিলো রাগের বশে সারহান পেছন থেকে তাকে ধাক্কা মারে।মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে মালিহার সামনের একটা দাঁত ভেঙে যায়।বাড়িতে বিচার নিয়ে আসে মালিহার মা।অন্তরা খেঁকিয়ে উঠে নিজের ছেলের দোষ আড়াল করে।মায়ের হাতের এক লোকমা খাবার মুখে নেওয়ার পর দ্বিতীয় লোকমা সারহানের মুখে ঠুসে দিতে সারা ঘর দৌঁড়ে বেড়াতে হয় অন্তরাকে।সামান্য কাঁশি হলে সারারাত বুকের সাথে জড়িয়ে বসে থাকতেন অন্তরা।

একটা শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে সারহান।এতো আবেগ,এতো ভালোবাসা,এতো স্নেহ কী করে লোক দেখানো হয়!বারো বছর!বারো বছর আগের সেই ঘটনা সব পাল্টে দিলো।বদলে দিলো সারহানকে।নিজের অস্তিত্বকে খুঁজতে গিয়ে নিজেকে ক্ষয়ে ফেললো সে।
সারহানের ভাবনার ব্যবচ্ছেদ হয় তার মোবাইলের রিং এ।শোয়া অবস্থায় হালকা নড়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সারহান।তার রজনীগন্ধার মনে পড়লো তার কথা।রিসিভ করে চুপ করে রইলো সারহান।তার মাথার নিচে বা’হাত।চোখ দুটো ওই চাঁদেশ্বরীতে আবদ্ধ।ওপাশের কোমল গলায় স্মিত হাসে সারহান।

“আসসালামু আলাইকুম।”

প্রত্যুক্তি করে সারহান।

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।কেমন আছেন রজনীগন্ধা?

জান্নাহ স্থির গলায় বললো–

“ভালো।আপনি কেমন আছেন?

সারহান দায়সারা ভাবে বললো—

“হয়তো ভালো।”

জান্নাহ উদ্বিগ্ন গলায় শান্তভাবে বললো—

“এমন কেন বলছেন!কী হয়েছে?

সারহান বিরস হেসে অচঞ্চল গলায় বললো–

“কিছু না।”

জান্নাহ্ ছোট্ট দম ফেলে প্রশ্ন ছুঁড়ে–

“আপনার কাজ শেষ হয়েছে?

সারহান অস্ফুট গলায় বললো—

“হুম।”

“কবে ফিরবেন?

সারহান অধর কোণে হাসে।ম্লাণ গলায় বললো-

“কেন!ডিবোর্স দিবেন নাকি আমাকে?

উবলে উঠে জান্নাহ্।বিপন্ন গলায় বললো–

“সারহান!
এইসব কী বলছেন?

মৃদু ছন্দে হেসে উঠে সারহান।অবিচলিত গলায় বললো—

“খেয়েছেন?

“হুম।”

“তাহলে জেগে আছেন কেন?অনেক রাত হয়েছে ঘুমান।”

“আপনি খেয়েছেন?

সারহান চুপ করে রইলো।আজ দু’দিন ধরে সে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনা।গত দেড় মাসে যে আশায় সে বুক বেঁধে ছিলো তা শেষ।পায়নি সে ওই মানুষটাকে।আর কখনো পাবে বলেও মনে হয় না।তার জীবনটা সে এই মানুষটাক খুঁজতে খুঁজতেই বিনাশ করে ফেলেছে।সেদিন যদি ওই নিষ্ঠুর সত্য তার সামনে না আসতো তাহলে সে কোনো দিন ওই বাড়ির বাইরে আসতে না।না,ইহতিশামের সাথে তার দেখা হতো।না ওই নোংরা স্ক্যান্ডাল হতো।না তার জীবনটা এমনভাবে বিষিয়ে উঠতো।

জান্নাহ্ অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠে—

“সারহান!আপনি কথা বলছেন না কেন?আপনি ঠিক আছেন তো?

সারহানের চোখ ভিজে আসে।উঠে বসে সে।নদীর বুকে ট্রলার যাচ্ছে।নৌকাও আছে।তাতে ফিকে আলো দেখা যাচ্ছে।লন্ঠনও জ্বলছে।সারহান নির্নিমেখ তাকিয়ে আছে সেই দিকে।তার বুকটা ক্রমশ ভার হয়ে আসছে।এই মেয়েটাকে কী জবাব দিবে সে?তার নর্দমার জীবনে কেনো এলো এই মেয়ে?
প্রথমবার জান্নাহ্কে দেখেও বেমালুম তাকে ভুলে যায় সারহান।কিন্তু ছয় মাস পর নতুনরূপে তার সামনে এসে ধরা দেয় তার রজনীগন্ধা।সেদিন নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়েছে সারহানের ।এক পবিত্র ফুলকে সে দুমড়ে মুছড়ে দিয়েছে তার অপবিত্র হাতে।বিয়ের পরও জান্নাহ্কে সাথে রাখেনি সারহান তার এই নোংরা স্বভাবের জন্য।জড়াতে চায়নি ভালোবাসা নামক মায়ায়।কিন্তু যে দুই মাস জান্নাহ্ তার কাছে ছিলো সেই দুই মাস সারহানের কেনো যেনো নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে হলো।শুরু থেকে সবটা সাজাতে ইচ্ছে হলো।কিন্তু তা অসম্ভব ভেবে নিজের চোখের ঘুম উবে গেলো সারহানের।
তার জীবনে যত নারী এসেছে তারা কখনো সারহানকে ভালোবাসেনি।ভালোবেসেছে তার বিছানাকে।হারিয়েছে নিজেদের সেই নোংরা সুখে।সারহানের জীবন চলছিলোও এমনভাবে।তার জীবনে এমন কারো প্রয়োজন ছিলো না।বিয়ে নামক বন্ধনে সে কখনো নিজেকে বাঁধতে চায় নি।এই বাঁধন পীড়াদায়ক।
কিন্তু পারেনি সারহান।ওই নিষ্পাপ ফুটন্ত রজনীগন্ধা যখন নিজে এসে তার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়ালো তখন আর নিজের ইচ্ছাকে অবদমন করতে পারেনি সারহান।জড়িয়ে নিলো তাকে নিজের সাথে।

কোনো নেশাগ্রস্ত মানুষ একদিনে নেশা ছাড়তে পারে না।সারহানের দীর্ঘদিনের সেই ঘৃনিত অতীত মুছতেও তার সময় প্রয়োজন।একদিনে যদি নেশা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে তাহলে আর শহরে শহরে নেশামুক্তির কেন্দ্র গড়ে উঠতো না।চাইলেই নেশা ছেড়ে দিতে পারলে নেশাগ্রস্ত মানুষ তার নেশার প্রয়োজনীয়তা অনুভবে মানুষ খুন করতো না।

সারহানের কানে ভেসে আছে অ্যাম্বুলেন্সের আর্তনাদের শব্দ।বিগলিত হাসে সারহান।এই সরু রাস্তায়ও প্রয়োজনে বৃহৎ গাড়ি ঢুকতে হয়!
আহত গলায় জান্নাহ্ এর কথার প্রত্যুক্তি করে সারহান—

“কিছু না।আমি ঠিক আছি।”

ঝরা হাসে জান্নাহ্।অনুরক্তির সুরে বললো—

“সারহান!

সারহান সন্তর্পনে বললো–

“বলুন,আমি শুনছি।”

ফিক করে হেসে ফেললো জান্নাহ্।যেনো নিজের কথায় সে অত্যধিক মজা পাবে।আহ্লাদী গলায় বললো–

“তিতি বলেছে ওর জন্য বাবু নিয়ে আসতে।”

ঠোঁট চিপে ওপাশ থেকে সলজ্জ হাসে জান্নাহ্।সারহানের অধর কোণে তাচ্ছিল্যের হাসির রেখা ঝুলে।নিরেট গলায় বললো–

“তাহলে শুভ্রা আপুকে বলুন নিয়ে আসতে কিনে কোনো বাচ্চাকে।”

জান্নাহ্ ভ্রু নাঁচিয়ে হতবুদ্ধির গলায় বললো–

“এইসব কী বলছেন!কিনে আনবে কেন?

করুন হাসে সারহান।গম্ভীর গলায় বললো—

“এই বয়সে তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে পারবে না।আর এইসব কেনা কাটার অভ্যাস তাদের ফ্যামিলিতে আছে।”

জান্নাহ্ ধুম ধরে বসে সারহানের কথা বোঝার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।গা ঝাড়া দিয়ে বললো–

“আপনি সবসময় আজেবাজে কথা বলেন।”

ঝরা হাসে সারহান।নরম গলায় বললো–

“আপনার পরীক্ষা কেমন হয়েছে?

“ভালো।”

“আমি আপনার জীবনে না থাকলে সবকিছুই ভালো হবে।”

জান্নাহ্ কী বলবে বুঝতে পারে না।আজকাল সারহান বেখেয়ালি কথাবার্তা বলে।জান্নাহ্ চায় সারহান দ্রুত ফিরে আসুক।তাকে যে একটা খুশির সংবাদ দেওয়া বাকি।কিন্তু জান্নাহ্ এর মন ভয়ে আড়ষ্ট হয়। যদি হিতে বিপরীত হয়।সারহান কোমল গলায় বললো–

“রজনীগন্ধা,ঘুমান।অনেক রাত হয়েছে।রাখি।ভালো থাকবেন।”

কল কেটে ঝরঝরে বালির উপর মোবাইলাটা রাখে সারহান।ঘাড়টা পেছনে হেলিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।সারহানের মনে হলো একটা শুকতারা খসে পড়ছে।সারহান উদ্ব্যস্ত হয়ে তার হাত বাড়িয়ে দেয় সামনে।জ্বলন্ত ঝিকিমিকি তারাটা যেনো তার হাতে এসেই পড়লো।সারহানের চোখ হীরে ঝলসানো চোখের মতো চকচক করে উঠে।তার অধরে ফুটে উঠে পরম প্রাপ্তির হাসি।সারহান আলতো করে হাতভর্তি সেই তারাকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে যেখানটায় তার রজনীগন্ধা থাকে।যেনো তার হৃদপিন্ডের ভেতর গলে গেলো সেই জ্বলন্ত তারা।সারহান প্রানবন্ত হাসে।হাতটা একটু সরিয়ে বুকের মাঝ বরাবর ঘষতে থাকে।পাঁজরের হাড়গুলো আজকাল বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার উপর।স্বামীর পাঁজরের হাড়ে নাকি স্ত্রীকে তৈরি করা হয়।তার এতো এতো নারী!ক্লান্ত পাঁজর যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায় সারহানের সাথে।সারহান পরাস্থ সৈনিকের মতো হাত জোড় করে অনুযোগের সুরে বলে,”তার জীবনে শ্রেষ্ঠ নারী একজনই।তার রজনীগন্ধা।”ফিচেল হাসে সারহান।আদৌ কী সে নারী!সে তো এখনো কিশোরী।এই কিশোরী রজনীগন্ধাকে সে টেনে এনেছে পচা গন্ধযুক্ত আস্তাবলে।

সারহান সম্মুখে তাকায়।তার পায়ের কাছে ঝরঝরে বালিতে তর্জনী চালায়।লিখে জেড,এ,এন,এন,এ,এইচ।জান্নাহ্।ভালো লাগলো না সারহানের।মুছে ফেললো তা এলোমেলো করে।হাতের তালু দিয়ে সেই এলোমেলো বালু আবারও চেপে চেপে সমান্তরাল করে সারহান।তাতে লিখে র,জ,নী,গ,ন্ধা।রজনীগন্ধা।শুধু তার রজনীগন্ধা।

জীবন কোনো নাটক বা সিনেমা নয়।এখানে কেউ মি.পারফেক্ট হয় না।খাদবিহীন সোনাতে কখনো টেকসই গয়না হয় না।আর সে তো মানুষ!

সারহান খুশিতে মুখভর্তি হাসে।তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে।সে তার অতীত ভুলতে চায়।একটা ঝলমলে দাগহীন বর্তমান চায়।তার রজনীগন্ধার সাথে বাঁচতে চায়।জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ সে কখনো পায়নি।অন্ধকার গহীনে আপনজন খুঁজে বেড়িয়েছে সে।কিন্তু চাঁদের আলোয় যে আপনাজন দাঁড়িয়ে আছে তাকে কেন দেখতে পায়নি সে!
সারহান আবারো আকাশের দিকে তাকায়।বিদ্রুপপূর্ণ হাসে ওই চন্দ্রকে দেখে।আশাভরা বুক নিয়ে অনুনয় করে বললো—-

“একটা সুযোগ দিবেন আমাকে রজনীগন্ধা?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here