#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪০
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
নৈঃশব্দের মাঝেও ভয়াবহ আলোড়ন।হাত দুটো বুকে ভাঁজ করে অপরাধির মতো দাঁড়িয়ে আছে ইহতিশাম।তার সামনেই চোয়াল শক্ত করে কপালে দীর্ঘ গম্ভীরতার রেখা টেনে স্থির,শান্ত কিন্তু ভয়ংকর আক্রোশ নিয়ে তাকিয়ে আছে সরফরাজ মাহমুদ।অত্যন্ত শান্ত হলেও তার কন্ঠ বেখাপ্পা শুনালো।
“ইহতিশাম,হোয়াটস রং উইথ ইউ?
ইহতিশাম মাথাটা হালকা উঁচু করে অনুযোগের সুরে সংক্ষিপ্ত শব্দে বললো–
“সরি স্যার।”
“হোয়াট?
ইহতিশাম অবনত মাথা উঁচু করে তাকালো।এসির হাওয়ায় শীতল রুমেও ইহতিশামের গলা শুকিয়ে আসছে।ভ্যালভ্যাল দৃষ্টিতে সরফরাজের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসের দিকে তাকাতেই সরফরাজ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন–
“ড্রিংক ইট।”
ইহতিশাম আনুগত্যের সুরে বললো–
“থ্যাংক ইউ।”
ইহতিশাম চেয়ার টেনে বসলো।দীর্ঘ পনেরো মিনিট সে এভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো।পানিটা নিয়েই ঢকঢক করে পান করলো।একটু ধাতস্থ হয়ে সরফরাজের দিকে তাকাতেই কম্পিত হলো তার শরীর।সরফরাজ আহত বাঘের মতো তার দিকে চেয়ে আছে।ইহতিশাম ফিকে গলায় বললো–
“আরেকটু সময়ের প্রয়োজন আমার।”
সরফরাজ উত্তেজিত গলায় বললেন–
“সময়!আর কতো সময়!গত পাঁচ মাস ধরে তো সময় দিয়েই যাচ্ছি।”
ইহতিশাম নির্বিকার গলায় বললো–
“সরি স্যার।আমার কারণে যা হচ্ছে তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।আপনি তো শুনেছেন মিস শ্রীজা ব্যানার্জীর কেসটার কথা।”
সরফরাজ পাত্তাহীন ভাবে বললেন-
“তো?
ইহতিশাম দৃঢ় গলায় বললো–
“আই থিংক এই কেসটাও বাকি কেসগুলোর সাথে জড়িত।একই মার্ডার উইপেন ইউস করা হয়েছে।শুধু ডাম্প করার পদ্ধতি ডিফারেন্ট।”
সরফরাজ কৌতূহলী গলায় বললেন–
“কী বলতে চাচ্ছো তুমি?
ইহতিশাম নির্বিঘ্ন গলায় বললো–
“সবগুলো খুনই একজন করেছে।আর সে একা নয়।আই মিন খুনি একের অধিক।”
“আর ইউ সিরিয়াস?
” ইয়েস স্যার।”
সরফরাজ মৌনতা অবলম্বন করলেন।তার চোখের সামনে তার মেয়ে সামিরার চেহারা ভেসে উঠলো।খুন হওয়ার আগেরদিন অনেক উৎফুল্ল ছিলো সামিরা।বাবাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো।কিন্তু সরফরাজ তখন জরুরি কাজে আউট অফ টাউন থাকায় সামিরা সিদ্ধান্ত নেয় সরাসরি বাবাকে খুশির খবর দিবে।কিন্তু তার আগেই..।আর ভাবতে পারলেন না সরফরাজ।মেয়ের সেই লাশের কথা মনে পড়লে আজো তার বুক কেঁপে উঠে।ইহতিশামের দিকে গাঢ় দৃষ্টি দিয়ে বজ্রকঠোর হয়ে বললেন–
“অনলি ফিফটিন ডেইস।আই ওয়ান্ট রেজাল্ট।”
ইহতিশাম প্রসন্ন হেসে আশ্বস্ত গলায় বললো–
“শিওর স্যার।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই তীক্ষ্ম গলায় শাঁসিয়ে উঠে ইহতিশামকে সরফরাজ।
“পনেরো দিনের বেশি একদিনও নয়।তুমি না পারলে আমি ক্রাইম ব্রাঞ্চকে এই কেস হ্যান্ড ওভার করবো।যা আমি আগেই করতে চেয়েছিলাম।শুধুমাত্র সারহান তোমার নাম রিকোমেন্ড করেছিলো বলে আমি কেসটা তোমাকে দিয়েছি।”
ভ্রু নাচায় ইহতিশাম।তার দুই চোখের কোণে একটা সমান্তরাল রেখা ফুটে উঠে।কিন্ত সে উদ্বিগ্ন নয়।সে আশ্বস্ত।সারহান তার নাম রিকোমেন্ড করেছে।কোনো বড় কারণ তো আছে।সরফরাজের রুম থেকে বের হতেই একটা উষ্ণ হাওয়া ধাক্কা মারে ইহতিশামকে।বিরক্তিতে তেতো হয় মুখটা।এই গ্রীষ্মকালকে একটা জবরদস্ত গালি দিতে ইচ্ছে হলো তার।কিন্তু মুহূর্তেই খেলে যায় তার মস্তিষ্কে একটা খেল।সারহান!কী চায় সে?
ইহতিশাম ডেম শিওর এই খুনের সাথে কোথাও না কোথাও জড়িয়ে আছে সারহান।কিন্তু ইহতিশাম দ্বিতীয়বার ভুল করতে চায় না।সে আগে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।নিজের একটা ভুলে সারহানকে অন্ধকার গলিতে ছুঁড়ে ফেলেছে সে।আর সে ভুল করতে চায় না।এইবার সে বন্ধুত্ব নেভাবে।তাই পুরো বিষয়টা নিয়ে সারহানের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু সারহানকেও পাওয়াও দুষ্কর।কল তো রিসিভ করেই না।উল্টো কোথায় আছে তাও জানা নেই ইহতিশামের।শায়িখটাও হয়েছে পাক্কা চামচা।সারহানের অনুমতি ছাড়া যেনো নিঃশ্বাসও নিতে চায় না।
,
,
,
ক্লাস শেষে সিঁড়ি বেয়ে নামছে তিল আর জান্নাহ্।কৃঞ্চচূড়ার গাছটা কেমন কাঠ হয়ে আছে।জান্নাহ্ এর মন খারাপ হয়।কৃষ্ণচূড়া জান্নাহ্ এর বেশ ভালো লাগে।বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশে যখন থোকায় থোকায় রক্তিম কৃষ্ণচূড়ায় ছেয়ে থাকে পুরো গাছ তখন যেন আগুন ফুলের গাছ মনে হয়।
কিন্তু আজ আর তা নেই। বিবর্ন সেই গাছ।গাছের পাতারাও শাখা-প্রশাখার সাথে আড়ি কেটেছে।সেদিকে তাকাতে তাকাতেই হোচট খায় জান্নাহ্।পড়তে গেলেই তাকে সামলায় তিল।তীক্ষ্ম সুরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো—
“আরে দেখে হাঁট।এখনই তো পড়ে যেতি।”
ভড়কে গিয়ে নিজেকে সামলায় জান্নাহ্।বড় একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।এখন তো সে একা নয়।তাকে সাবধানে থাকতে হবে।তিলকে জানানো হয়নি।মেয়েটা বিদ্যুতের মতো চঞ্চল।ছোট খাটো বিষয়েই আকাশ কাঁপিয়ে ফেলে।এই কথা শুনলে না জানি কী করে বসে!
স্কুলের ভবন পার হয়ে গেইট অব্দি পৌঁছে যায় দুই বান্ধবী।চকিতে তিলের চোখ গিয়ে ঠেকে রাফাতের ওই হিমশৈল অবয়বে।গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো একদম শান্তু,স্থির,নিষ্কম্প।যেনো কোনো কথা নেই সেই চোখে।তিলের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে ভুবন ভোলানো হাসি।উৎফুল্ল হয়ে একটা গুতো মারে জান্নাহ্ এর কনুইতে।ইশারায় রাফাতকে দেখায়।রাফাতের পাশেই বট বৃক্ষের ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে ইশাক।তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা।ঘাবড়ে যায় জান্নাহ্।তার পা দুটো স্থির হয়ে আসছে।প্রাণহীন মনে হচ্ছে নিজেকে।ফাঁকা ঢোক গিলতে থাকে জান্নাহ্।রাফাত ভ্রু কুঞ্চি করে ভাবুক নয়নে পর্যবেক্ষন করে জান্নাহ্কে।জান্নাহ্ এর আচরণ তাকে ভাবাচ্ছে।লুকাতে চায় জান্নাহ্।কিন্তু রাফাত নাছোড়বান্দা।তার প্রশ্নের উত্তর আজ তার চাই।রাফাত পদযুগল বাড়াতেই ইশাক ধুম করে তার কাঁধে চাপড় মেরে বসে।কড়া গলায় বললো–
“ঝামেলা করিস না।পাশে ওর ফ্রেন্ড।”
রাফাত স্থির হয়।নিজেকে সংযত করে।জান্নাহ্ এখনো ভয়াতুর চোখে তাকিয়ে আছে।চোখের পল্লব যেনো আপনা আপনি তার কম্পন বাড়িয়ে চলছে।গলা ধরে আসে জান্নাহ্ এর।হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে আসে।তিল নিজের বাড়ির দিকে চলে গেছে অনেকক্ষন।কিন্তু চিন্তায় সেইদিকে মনোযোগ নেই জান্নাহ্ এর।চঞ্চল পা দুটো চলছেই বিরতিহীন।হতবুদ্ধির মতো থমকে যায় জান্নাহ্।তার সামনে অশ্বথ গাছের মতো উদ্ভব হয় রাফাতের।চমকে গিয়ে দু’কদম লাফিয়ে পিছু হটে জান্নাহ্।ঝাড়া মেরে উঠে বললো–
“এইসবের মানে কী রাফাত!
রাফাত মিচকি হাসলো।কৌতুকের ছলে বললো—
“ওয়েলকাম রেড চেরি।
তলে তলে পাখি তুমি খেয়েছো যে ধান
এইবার পাখি তোমায় বাঁধিবে পরাণ।
জান্নাহ্ নাকের পাল্লা ফুলিয়ে চোখের পাতা প্রশ্বস্ত করে ধৈর্য্য হারা হয়ে বললো—
“এইসব কী বলছো তুমি?
মৃদুহাস্য অধরে শুধালো রাফাত—
“কেমন আছো জান্নাহ্?
জান্নাহ্ বিতৃষ্ণা গলায় দৃঢ় হয়ে বললো–
“যেতে দাও আমাকে।”
ঝরঝরে হাসে রাফাত।মুগ্ধ নয়নে দেখে তার রেড চেরি ওই ভাসন্ত দুই চোখে।দীর্ঘ অক্ষিপল্লব ভিজে যেনো আরো কৃষ্ণকালো বর্ণ ধারণ করেছে।রাফাত প্রশ্বস্ত গলায় বলে উঠে—
“আমার প্রশ্নের জবাব?
জান্নাহ্ এর গলা বসে আসে।শুকনো গলায় কথা আটকে যায়।দূর্বল গলায় বললো—
“প্লিজ রাফাত,চলে যাও তুমি এখান থেকে।প্লিজ।”
ফুঁসলে উঠে রাফাত বললো–
“তাহলে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।”
জান্নাহ্ আর্দ্র গলায় বললো–
“আমি তোমাকে কিছু বলতে পারবো না।যদি সত্যিই তুমি তোমার রেড চেরির ভালো চাও তাহলে চলে যাও এখান থেকে।আর কখনো এসো না।”
রাফাত রুক্ষ কন্ঠে ঘোষণা করলো—
“যতক্ষন না আমার প্রশ্নের জবাব আমি পাচ্ছি আমি কোথাও যাচ্ছি না।কীসের এতো নাটক!কেন এই মিথ্যের মায়াজাল!কী সেই কারণ?বলো আমাকে জান্নাহ্।”
ফুঁসে উঠে জান্নাহ্।মেঘের মতো গর্জন করে বললো—
“কোনো জবাব আমি তোমাকে দেবো না।যেতে দাও আমাকে।”
রাফাতকে পাশ কাটিয়ে যেতেই জান্নাহ্ এর হাত চেপে ধরে রাফাত।তৎক্ষণাৎ গা গুলিয়ে উঠে জান্নাহ্ এর।মুখভর্তি বমি আসতেই মুখ চেপে ধরে নিজের।আটকাতে পারলো না।গরগর করে ফুটপাতের দেয়াল ধরে বমি করে দেয়।রাফাত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।তার দৃষ্টি যেনো আজ তাকেই ধোঁকা দিচ্ছে।একটু ধাতস্থ হয়েই তীব্র গতীতে শ্বাস ফেলতে থাকে জান্নাহ্।তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।দ্রুত পা চালায় সে।
রাফাতের পেছনে এসে দাঁড়ায় ইশাক।উৎসুক কন্ঠে বললো–
“কীরে কী হয়েছে?
রাফাত ভয়ংকর শীতল গলায় বললো–
“জান্নাহ্ মা হতে চলেছে।আমার রেড চেরির শরীরে অন্য কারো সত্তা।তুই ভাবতে পারছিস!
ইশাকের উদ্ভাসিত,স্থির নয়ন জান্নাহ্ এর এলোমেলো পায়ের দিকে।জান্নাহ্ চলছে।
চলবে,,,
(হাতের পালস্ চেক করে কিন্তু প্রেগন্যান্সি ধরা যায়।)