জান্নাহ্ “পর্বঃ৪৬

0
3463

#জান্নাহ্
#পর্বঃ৪৬
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইশাককে দেখে খলবলিয়ে উঠে রাফাত।যখন থেকে ওই গ্রাম থেকে ফিরে এসেছে এই ঘরে নিজেকে বদ্ধ করে নিয়েছে।গর্জে উঠে রাফাত বললো—

“কেন এসেছিস এখানে?বের হ,বের হ আমার ঘর থেকে।”

হতচকিত গলায় ইশাক বললো–

“এমন করছিস কেন?কী হয়েছে তোর?

দাপিয়ে উঠে রাফাত।ইশাককে এক ধাক্কা মেরে বললো—

“চলে যা এখান থেকে,চলে যা।আমার কাউকে চাই না।কাউকে না।”

ইশাক রাফাতকে শান্ত করা চেষ্টা করছে।কিন্তু রাফাতের রাগ তরতর করে যেনো তার সর্বোচ্চ সীমা লঙ্ঘনের চেষ্টায় অব্যাহত।খাবলে ধরে ইশাকের টিশার্ট রাফাত।গরগরে গলায় ক্ষীপ্ত হয়ে বললো—

“বলছি না চলে যা।আর কখনো আসবি না।কেউ আসবি না আমার কাছে।কাউকে চাই না আমার।সবাই ধোঁকাবাজ।সবাই।”

রাফাতের চিৎকার চেঁচামেচিতে দৌঁড়ে আসে তার বাবা মা।কোনো মতে ক্ষুব্ধ রাফাত থেকে ইশাককে ছাড়িয়ে রুমের বাইরে নিয়ে আসে।দরজা লক করেই দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিচে বসে পড়ে রাফাত।দুই হাতে নিজের চুল খাবলা মেরে ধরে।চিৎকার করে উঠে রাফাত।সেই চিৎকারে কেঁপে উঠে রাফাতের মা,বাবা আর ইশাক।
পুরো ঘরে সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ওয়াইনের বোতলের টুকরোগুলো ফ্লোরে গড়িয়ে আছে।সিলিং আর দেয়াল জুড়ে শ’খানেক ড্রিম ক্যাচার।বিছানায় পড়ে আছে জান্নাহ্ এর জন্য আনা সেই রেড গাউন।শুকনো চেরি ফুলের ধ্বংসাবশেষ।খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে আছে রাফাতের নির্জীব চেহারা।চোখের নিচটায় দেবে আছে।কালো রঙে ছেয়ে আছে তা।ফ্লোরে আছে কালচে রক্তের ছোপ।রাফাতের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শুকনো রক্ত কালসে হয়ে আছে।সমস্ত ঘরজুড়ে ভোটকা গন্ধ।এক মৃত্যুপুরীতে বসবাস রাফাতের।এক হতজীব প্রাণি সে।

রাফাতের বাড়ি থেকে বিষন্ন মন নিয়ে বের হয় ইশাক।ঝাপসা চোখে পকেটে দু হাত পুরে অগোছালোভাবে হাঁটছে।আকস্মিক সামনে আসা তীব্র বেগের গাড়ির হুডের উপর আঁছড়ে পড়ে ইশাক।ধাতস্থ হয়ে সামনে তাকাতেই গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে উগ্রমুর্তি ধারণকারী সুদর্শন পুরুষটি তড়িৎ বেগে এসে ইশাকের গালে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয়।হতভম্ব ইশাক কিছু বুঝে উঠার আগেই তার কান চেপে ধরে ব্যক্তিটি।অরুনলোচন চোখে তাকিয়ে তপ্ত গলায় বললো—

“তাহলে এই তোর ডাক্তারী?

ইশাক কিছু বলবে তার আগেই ব্যক্তিটি তার কান চেপে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসায়।
,
,
,
বিভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে ইশাক।সামনের ব্যক্তিটির প্রকুপিত মুখ দেখে ভয়ে তটস্থ সে।সামনের ব্যক্তিটি দারাজ গলায় বললো–

“কবে এসেছিস তুই?

ইশাক ভাঙা ভাঙা গলায় প্রত্যুক্তি করে—

“সাত মাস।”

উবলে উঠে ইহতিশাম,বললো—

“সাত মাস! আর তুই এই পর্যন্ত আমার সাথে দেখা করিস নি!

ইশাক ভীত গলায় নরম হয়ে বললো—

“ভাই।আই এম রিয়েলী সরি।আসলে..।”

ইহতিশাম নাকের পাটা ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে।দমদমে গলায় বলে উঠে—

“চাচা,এতো কষ্ট করে তোকে ডক্টরী পড়তে পাঠিয়েছে আর তুই চলে এলি!চাচার কষ্টের কোনো দাম নেই তোর কাছে?

ইশাক অনুযোগের সুরে বললো—

“ভাই,আই এম সরি।আসলে যা হয়েছে তার জন্য আমি..।”

ইশাক চুপ হয়ে যায়।ক্ষুব্ধ গলায় শাসিয়ে উঠে ইহতিশাম–

“বল।চুপ করে আছিস কেন?

ইশাক ধীর গলায় রাফাতের পুরো কথা শোনায়।ইশাক ইহতিশামের চাচাতো ভাই।ইশাক দেশে ফিরেও গ্রামে যায়নি।এতোদিন রাফাতের সাথেই ছিলো।কিন্তু গ্রাম থেকে ফিরে এসে একটা ম্যাসে থাকা শুরু করে।সম্পূর্ন ঘটনা শুনে উদ্দীপিত হয় ইহতিশাম।কৌতূহলী গলায় বললো—-

“মেয়েটার নাম কী?

সহজ গলায় উত্তর করে ইশাক—

“জান্নাহ্।”

ঝিমুনি দিয়ে উঠে ইহতিশামের শরীর।চোখের পাতা কাঁপতে শুরু করে।নৈঃশব্দে শ্বাস ফেলে সে।চাপা গলায় প্রশ্ন করে—

“ওর হ্যাজব্যান্ডের নাম সারহান?সারহান জেইদি?

ইশাক উৎসুক গলায় বললো–

“তুমি কী করে জানলে?

ইহতিশাম শীতল নিঃশ্বাস ফেললো।নাকের তলায় হাত রেখে কিছু একটা ভাবছে।পৃথিবী আসলেই গোল।এক গোলকধাঁধা।সেই ধাঁধার উত্তর পেতে আমরা সবাই একে অপরের অপর নির্ভরশীল।ইশাক সম্মোহিনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।গভীরভাবে ইহতিশামের চিন্তিত মুখের অর্থোদ্বার করার চেষ্টা করলো।সে দেখলো ইহতিশামের দুই ভ্রু এর সন্ধিস্থলের সেই তারকা চিহ্ন মৃদু ছন্দে নড়ছে।কপালের উপরে মসৃনতা ভেঙে মোটা মোটা ভাঁজ পড়েছে।মৌনতা ভেঙে চটপটে গলায় আবদার করে বসে ইহতিশাম–

“তুই আমার সাথে রাফাতের দেখা করিয়ে দিতে পারবি?

ইশাক দ্বিধান্বিত গলায় প্রত্যুত্তর করে বললো—

“ভাই,রাফাত এখন উন্মাদ।কাউকে সহ্য করতে পারে না।হি ইজ লাইক আ ব্লাডি হান্টার।”

ইহতিশাম জীভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তা আবার চেপে ধরে গম্ভীর গলায় বললো—

“আই উইল ম্যানেজ।তুই আমার সাথে ওর দেখা করিয়ে দে।”

ইশাক আশ্বস্ত গলায় বললো–

“আচ্ছা ভাই।”

তপ্ত গলায় বললো ইহতিশাম—

“আজ এখানেই থাকবি।বস,মাকে খাবার দিতে বলছি।রাফাতের সাথে আমার মিট করিয়েই বাড়ি যাবি।চাচা আমাকে পাগল করে ফেলছে।”

ইশাক আনম্র চোখে তাকায়।
,
,
,
বিছানায় আসন পেতে বসে আছে জান্নাহ্।চারপাশে সুনসান নিরবতা।জান্নাহ্ এর কোমর জড়িয়ে তার কোলে মাথা দিয়ে বসে আছে সারহান।শান্ত,শীতল,নিষ্কম্প।প্রায় এক ঘন্টা ঠাঁই এভাবেই বসে আছে সারহান।জান্নাহ্ আলতো হাতে সারহানের ঘন চুল নাড়িয়ে যাচ্ছে।তার দুই চোখের পল্লব সিক্ত।নাক টেনে নিয়ে বললো—

“সারহান,এমন কেন করছেন?আমি ঠিক আছি।”

সারহান এক চুলও নড়লো না।কোনো প্রতিক্রিয়াও করলো না।উল্টো আরও জোরে চেপে ধরলো জান্নাহ্কে।মুখটা সোজা করে জান্নাহ্ এর পেটের দিকে গুঁজে দেয়।ক্ষনকাল পরপর বিক্ষিপ্ত শ্বাস টানে সারহান।তার শুষ্ক অধর ছোঁয়ায় জান্নাহ্ এর উন্মুক্ত উদরে।কেঁপে উঠে জান্নাহ্।সারহানের ভেজা গালের স্পর্শ পায় জান্নাহ্।আলগোছে সারহানের মাথাটা উঠিয়ে নির্বিকার চোখে তাকায় সে।সারহানের দুই গালে লেপ্টে আছে নোনতা জল।যা জবজবে।জান্নাহ্ দুই হাতের তালু দিয়ে ভালো করে মুছে দেয় সারহানের গাল।নরম গলায় বললো—

“আমি ঠিক আছি সারহান।দেখুন,একদম ঠিক আছি।”

চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে আবারও আঁকড়ে ধরে জান্নাহ্কে।কেঁপে কেঁপে উঠে সারহান।তার ভয় তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো।একটু আগেই তিতির সাথে ছোটাছুটি করতে গিয়ে সিঁড়িতে পিছলে যায় জান্নাহ্।দুই সিঁড়ি নিচে গড়িয়ে পড়তেই সিঁড়ির ধারালো কোণা লেগে ছুঁলে যায় জান্নাহ্ এর হাঁটু।ভাগ্যিস সারহান ধরে ফেলেছিলো তার হাত।তাই পেটে কোনো চাপ লাগেনি।চিৎকার চেঁচামেচিতে ছাদ থেকে ত্রস্ত পায়ে দৌঁড়ে আসে নিধি।একটু আগেই একগাদা কাপড় নিয়ে ছাদে উঠেছে সে।সিঁড়ির উপরে পানি হয়তো তার অজান্তেই পড়েছে।
অন্তরা পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে।নিধির চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে অভব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।বেচারি নিধি শুধু চোখের জল নাকের জল এক করেছে।

আর সেই থেকে সারহান ঘরের দরজা বন্ধ করে জান্নাহ্কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।কাউকে একটা কথাও বলেনি।এমনকি নিধিকেও না।বাড়ির সবাই তাজ্জব বনে যায় সারহানের এই আকস্মিক পরিবর্তনে।এইসব কী শুধুই সারহানের প্রায়শ্চিত্ত নাকি ওই ছোট্ট প্রাণটার প্রতি আর হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা !

দুপুরের সূর্য হেলে পড়তে শুরু করেছে।জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা রোদ যেনো আগুনের লেলিহান শিখা।নিরাক পরিবেশ।একটা পাতাও নড়ছে না।সূর্যের দম্ভ করা অগ্নিলাভা থেকে শেষ রক্ষে হলো না।থমথমে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠাঁল গাছটা যেনো রোদকে শাসিয়ে বলছে সময় একদিন আমারও আসবে।মুহূর্তেই কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে কাঠাঁল গাছের পাতা।কাকের কর্কশ ধ্বনির সাথে তাল মিলিয়ে যেনো পাতারা হাসছে।

মৃদু গলায় সারহান বললো—

“এতো কষ্ট না দিয়ে একবারেই মেরে ফেলুন আমাকে।মরে যাই আমি।”

জান্নাহ্ এর বুকের মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়।সারহানকে না জানিয়ে যখন সে কনসিভ করে জান্নাহ্ বুঝতে পারেনি সারহান এতো সহজে সবটা মেনে নিবে।কিন্তু যখন থেকে বাবা হওয়ার আনন্দকে সে উপলব্ধি করেছে সে যেনো অন্য এক সারহান।ঘি ঢালা আগুনে তেঁতে উঠা সারহান যেনো তাপে গলে যাওয়া প্যারাফিন।বাচ্চা নিয়ে এতোটা কনসার্ন হবে তা জান্নাহ্ কখনো ভাবতে পারে নি।সারহানের কখনো এইসবে আগ্রহ ছিলো না।উপরন্ত সে চাই নি জান্নাহ্ মা হোক।কিন্তু এমন কী হয়েছে এখন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তান ই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে!

নিষ্প্রভ সুরে বললো জান্নাহ্—

“সারহান,নিজেকে সামলান।আমি সাবধানে থাকবো।বিশ্বাস করুন।আর কখনো এমন হবে না।”

সারহান তপ্ত হয়ে উঠে।কড়া গলায় বললো—

“কী করে বিশ্বাস করি আপনাকে!আজই তো আমার সবকিছু শেষ করে দিচ্ছিলেন।”

“সরি।”

সারহান রাগের সাথে অভিমান মিশিয়ে বললো—

“আপনি কেন বুঝতে পারছেন না আমি নিজেকে বদলাতে চাই।কেন দিচ্ছেন না সেই সুযোগ আমাকে?

অপ্রত্যাশিত এক ঘটনার সম্মুখীন হয় জান্নাহ্।সারহানের দুই শান্ত চোখ মুহূর্তেই আগ্নেয়গিরির মতো উগরে উঠে।হিংস্র হায়েনার মতো জান্নাহ্ এর উপর ক্ষেপে উঠে তার দুই গাল নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে ধরে দাঁতখামটি মেরে বললো—

“যদি আমার সন্তানের কিছু হয় জান নিয়ে নিবো আপনার।আমার পরীর গায়ে যদি কেউ একটা ফুলের টোঁকা দেয় তার পুরো জীবন ভ্রংশ করে দিবো আমি।”

ব্যথায় কুঁকড়ে যায় জান্নাহ্।তার দুই চোখ টলটল করে উঠে।সারহান শিথিল করে তার হাত।জান্নাহ্ এর ভীতসন্ত্রস্ত দুই চোখ আটকে আছে সারহানের ওই ক্ষীপ্ত চাহনিতে।একটু ধাতস্থ হয়ে জান্নাহ্ এর পেটের উপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে গনহারে চুমুর আন্দোলন চালাতে থাকে।অস্বাভাবিক কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে সারহান বললো—

“ডোন্ট ওয়ারি পরী।পাপা আপনার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না।আপনি একটুও ভয় পাবেন না।পাপা ইজ অলওয়েজ উইথ ইউ।”

সারহান চোখ তুলে তাকায় জান্নাহ্ এর দিকে।পেছন দিকে ঝুঁকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে জান্নাহ্।তার শ্বাস যেনো তার মায়া ছেড়ে দিচ্ছে।সারহান গম্ভীর থাকলেও আজ পর্যন্ত তার সাথে কোনোদিন এমন আচরণ করে নি।ফাঁকা ঢোক গিলে জান্নাহ্।ঠোঁট দুটো চেপে ভেতরে নিয়ে তা ভিজিয়ে নেয়।গাঢ় দৃষ্টিতে সারহানকে দেখে।কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করছে সে।জান্নাহ্ এর নরম মেদহীন উদরে হাত বুলাতে থাকে।যেনো কোনো শিশুকে আদরে ঘুম পাড়াচ্ছে ।অস্পষ্ট ছড়া কাটে সারহান।অধরে বোকা বোকা হাসি।চোখে আদুরে ভাব।তার অঙ্গভঙ্গি কেমন দিশেহারা,পাগল,চেতনাহীন মানুষের মতো।জান্নাহ্ এর শ্বাস ভারি হতে থাকে।এ কোন মহাবিপদ সংকেত!না চাইতে আঁতকে উঠে জান্নাহ্।ভয়ে তার কলিজা ফুড়ে যাচ্ছে।সারহানের আচরণ স্বাভাবিক নয়।এইটুকুতেই সারহান আজ যে আচরণ তার সাথে করেছে যদি সত্যিই কিছু হয়ে যায়!
তাহলে প্রলয় শুরু করে দিবে সারহান।সেই প্রলয়ে সব ভ্রষ্ট হয়ে যাবে।

চলবে,,,

😏😏😏

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here