#জান্নাহ্
#পর্বঃ৭২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
সময় বহতা নদী।সে চলে তার আপন মহিমায়।সময়ের সাথে চলতে হয় মৃত্তিকার গড়া মহান আল্লাহ্ পাকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে।
মান,অভিমানের পালা বদলের সাথে কেটে যায় আরো চার মাস।ষোড়শী জান্নাহ্ সপ্তদর্শীতে রূপ নেয়।তার শরীর জুড়ে ফুটে উঠে মাতৃত্বের লক্ষণরেখা।জান্নাহ্ এর সামনেই নির্লিপ্ত হয়ে বসে আছে শরীফ।চোখে,মুখে থমথমে ভাব।নির্ভয়চিত্তে অপলক চেয়ে আছে তার দুই পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে।কাতর গলায় শুধায় জান্নাহ্—
“তুমি সারহানকে ক্ষমা করেছো তো মামা?
শরীফ নির্বাক রইলেন।শুধু গ্রহণ করলেন জান্নাহ্ এর মুখ নিঃসৃত শব্দ।জান্নাহ্ ব্যাকুলতায় বললো–
“ক্ষমা করবে না তুমি সারহানকে?না বুঝে সে ভুল করে ফেলেছে।ক্ষমা করে দাও তাকে মামা।”
নরম চোখে জান্নাহ্কে দেখলেন শরীফ।বাঁধাহীন সুরে বললেন—
“আমি সবসময় আমার দুই মেয়েকে সুখী দেখতে চেয়েছি।তার জন্য যা করার আমি করেছি।হোক তা ন্যায় বা অন্যায়।কিন্তু আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ।পাপের শাস্তি সবার প্রাপ্য।এক মেয়ের ঘর বাঁচাতে আমি অন্য মেয়েকে ডুবিয়ে ফেললাম।”
স্বশব্দে কেঁদে উঠে জান্নাহ্।বিচলিত গলায় বলে উঠে শরীফ—
“কাঁদবেন না পরীজান।সারহানকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।কারণ সে অনুতপ্ত।নিজের মুখে সে তার অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে আমার কাছে।
বিবেকের স্বীকারোক্তি,দেহের পাপের কাছে হার মানে।”
নৈঃশব্দে নয়ন বারির বর্ষা নামিয়েছে জান্নাহ্।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর।বাগানের দোলনায় বসে আছে সারহান।নিশ্চল তার দৃষ্টি।নির্বাক তার কন্ঠ।উন্মনা তার মস্তিষ্ক।তার অতীত খুবলে খুবলে খাচ্ছে তার বর্তমান।তার ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন।আদৌ কী সারহান তার অতীতের পাপ থেকে মুক্তি পাবে?
ভেতর থেকে শরীফের দারাজ কন্ঠস্বর পেয়ে ছুটে যায় সারহান।বিছানায় কাতরে যাচ্ছে জান্নাহ্।ডেলিভারি পেইনে মিইয়ে গেছে বিছানার সাথে।উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসে ভীতসন্ত্রস্ত সারহান বললো–
“কী হয়েছে?
ব্যতিব্যস্ত হয়ে শরীফ বললো—
“পরীজানকে এখনই হাসপাতাল নিতে হবে।”
,
,
,
হসপিটালের শুভ্র বিছানায় বসে আছে জান্নাহ্।স্থির,নিষ্কম্প,কঠোর।আবেগশূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে সফেদ রঙের সেই বিছানায়।তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্মিত শীতল,স্বচ্ছ অঝোর ধারা।বিড়ালপায়ে কেবিনে ঢুকে সারহান।তার শক্ত,কঠোর,নির্বিঘ্ন চিত্ত।ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে জান্নাহ্ এর সামনে এসে বসে।প্রতিক্রিয়াহীন জান্নাহ্।সে এখনো পাথরমূর্তি মতো স্থির।
তাচ্ছল্য হাসলো সারহান।করুণ সুর তুলে বললো—
“বদলা নিলেন রজনীগন্ধা?এতোটা ঘৃণা আপনার আমার প্রতি।এই ঘৃণার আগুনে এতোটা না পুড়ালেও পারতেন।কেন প্রাণ দিয়ে সে প্রাণটা কেড়ে নিচ্ছেন আপনি?
নিরুত্তর জান্নাহ্।কোনো ধরনের ভাবান্তর হলো না তার।নিরুত্তেজ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে সারহান—
“আমার মেয়ে কোথায় রজনীগন্ধা?
জান্নাহ্ ভাবলেশহীন গলায় প্রত্যুত্তর করে–
“জানি না আমি।”
নিরুত্তেজ গলায় সারহান বললো–
“আমার পরীকে ফিরিয়ে দিন আমায়।”
জান্নাহ্ অনুচ্চ গলায় বললো–
“আমি জানি না ও কোথায়।”
ক্ষেপে উঠে জান্নাহ্ এর গাল চেপে ধরে সারহান।দাঁতের সাথে দাঁত নিষ্পেষণ করে বললো—
“আমার মেয়েকে আমার চাই।বলুন কোথায় আমার পরী?
জান্নাহ্ অর্ধ ঢোক গিলে চোখের বদ্ধ পানি ছেড়ে দেয়।ভেজা গলায় বললো—
“আমার লাগছে সারহান।”
তড়িৎ গতিতে জান্নাহ্কে হালকা হাতে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় সারহান।বিছানার পাশে থাকা চলন্ত ট্রে তে থাকা ঔষধাদি সব ফেলে দেয়।বজ্র গলায় বলে উঠে—
“এতোই যখন ঘৃণা তাহলে তাহলে মেরে ফেলতেন আমাকে।মৃত্যু যন্ত্রণা কেন দিচ্ছেন?
জান্নাহ্ ঠায় বসে রইলো।নেই কোন আবেগ,নেই কোনো অনুভূতি।একটা শীতল,সমাহিত বরফখন্ড।বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে উঠে সারহান—
“আপনার কী মনে হয় আমি ওকে খুঁজে বের করতে পারবো না?
আমার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করবোই। আপনি ঠিক করেন নি রজনীগন্ধা,আপনি এইটা ঠিক করেন নি।”
সারহান চলে যেতেই দরজায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা জাবিনকে দেখে জান্নাহ্।অবাক গলায় বললো—
“জাবিন!
মৃদু হাসে জাবিন।পায়ের কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা তিতি দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জান্নাহ্ এর বুকের উপর।আহ্লাদী গলায় ডেকে উঠে—
“পরীমা।”
জান্নাহ্ বুকের সাথে চেপে ধরে তিতিকে।নিজের শূন্য বুকটা যেনো থইথই করে ভরে উঠলো জান্নাহ্ এর।ছলছল অশ্রু ঝরে পড়লো।বইয়ে দিলো খুশির বন্যা।তিতির চোখে,মুখে অজস্র চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো জান্নাহ্—
“কেমন আছো তিতি সোনা?
কোমল গলায় ছোট্ট করে বললো তিতি—
“ভালো।”
নিজের কোলে পুরোদস্তুর তিতিকে গুঁজে নেয় জান্নাহ্।সামনে বসা জাবিন নিস্পলক চেয়ে আছে।যেনো অন্য জান্নাহ্কে দেখছে সে।কেবিনের বাইরে ঘটা সারহানের উন্মাদের মতো আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত জাবিন।হাসি হাসি মুখে জান্নাহ্ বললো—
“কেমন আছো জাবিন?এতোদিন পর মনে পড়লো আমার কথা?
জাবিন নিরুপায়ের সুরে বললো—
“মামা তো আসতে দিচ্ছিলো না।ঠিকানা বলে নি কখনো।গত তিনদিন ধরে তিতি সমানতালে কেঁদে যাচ্ছে।ওর জন্যই…।”
জাবিনের কথা কেটে বললো জান্নাহ্–
“বাড়ির সবাই কেমন আছো?
জাবিন নিশ্চল গলায় বললো–
“ভালো।”
“শুভ্রা আপু কেমন আছে?
তিতি মাথা ঘুরিয়ে বললো—
“মামুনি কথা বলে না।আদর করে না।”
মুহূর্তেই ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে তিতি।ব্যস্ত হয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করে জান্নাহ্।জাবিন আহত গলায় বললো—
“আমি ভাবতে পারি নি মা মামার সাথে এমন করবে!মায়ের হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।”
“শুভ্রা আপুর কী হয়েছে?
জাবিন নম্র গলায় বললো—
“ডক্টর বলেছে সায়ানাইডের ইফেক্ট মায়ের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।তাই সে কাউকে চিনতে পারছে না।”
“সারহানকে ক্ষমা করে দিও।সে রাগের মাথায়..।”
“মামার জায়গায় আমি হলেও এমনটা করতাম।”
এক মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে যায় জান্নাহ্ এর মুখমণ্ডল।অপলক চোখ দুটোতে ভর করে জলরাশি।জাবিন সংকীর্ণ গলায় বললো–
“মামাকে কষ্ট কেন দিচ্ছো জান্নাহ্।”
জান্নাহ্ চোখের চাহনি শক্ত করে।কড়া গলায় বললো—
“তার কষ্টের পথ সে নিজেই সৃষ্টি করেছে।”
তিতি তার ছোট্ট কোমল হাত দিয়ে জান্নাহ্ এর গাল স্পর্শ করে তার দিকে ফেরায়।মখমলে গলায় বললো—
“পরীমা,বাবু কোথায়?
জাবিনের দিকে তাকায় জান্নাহ্।জাবিন নির্ভীক গলায় বললো—
“আমি বলেছি বাবুর কথা।”
তিতি আবারও তাড়া দিয়ে বলে উঠে—
“পরীমা,বাবু কোথায়।আমি কোলে নিবো।”
জান্নাহ্ আলতো করে তার ঠোঁট ছোঁয়ায় তিতির কপালে।মৃদু গলায় বললো–
“বাবু তার বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গেছে।”
চলবে,,,