প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ১৩

0
2765

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ১৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সন্ধ্যারাগের আলোকচ্ছটায় প্রাণবন্ত পশ্চিমাকাশ।সোডিয়ামের লাইটগুলো জ্বলে উঠবে খানিক পরেই।অাকাশ জুড়ে থাকবে তখন নিকষকৃষ্ণ অন্ধকার।তার ফাঁক গলিয়ে উঁকি দিবে সুধাংশু।তার মিষ্টি আলোয় কালো অন্ধকার ঢিঙিয়ে ধরণী দেখবে প্রান্তর,উচ্ছল হবে পরিবেশ।বিষন্ন মন পাবে সতেজতা।

বাসায় এসে হাত,মুখ ধুয়ে প্রথমেই হালকা কিছু খেয়ে নেয় নিষ্প্রাণ।মাসের আজ পাঁচ তারিখ।ম্যানেজার আসবে ভাড়া নিতে।গায়ের জামাটা খুলে ঝোলানো দড়িতে তা মেলে দিয়ে বিছানায় বসে নিষ্প্রাণ।একটা সাধারণ চৌকি তার পাশেই পড়ার টেবিল।সেখানে বইয়ে ঠাসা।টেবিলের সামনেই একটা চেয়ার।চৌকিটির পায়ের কাছে একটা বুকশেল্ফ।জামা -কাপড় রাখার জন্য একটা ছোট্ট ওয়্যারড্রব ছাড়া আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য আসবাবপত্র নেই নিষ্প্রাণের এই মেসে।দরজায় খটখটানি হতেই সপ্রতিভ হয় নিষ্প্রাণ।নিশ্চয় ম্যানেজার এসেছে ভাড়া নিতে।খামটা খুলে তিন হাজার টাকা বের করে নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ।

ম্যানেজারের চোখ দুটো টসটসে।মুখে থাকা পানের রসটা পিচ করে ফেলে অনাবিল হাসলেন।হেসে হেসে বললেন–

“কেমন আছেন নিষ্প্রাণ সাহেব।আইজ কিন্তু মাসের পাঁচ তারিখ।”

নিষ্প্রাণ স্মিতহাস্য অধরে বললো—

“জ্বী,জানি।এই নিন আপনার ভাড়া।”

টাকাটা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক গুনে দেখলেন ঠিক আছে।হাত উঠিয়ে একটা লম্বা সালাম জানালেন নিষ্প্রাণকে।তার বিনিময়ে উষ্ণ হাসলো নিষ্প্রাণ।

দরজা লাগিয়ে ভেতরে আসে সে।মেসের কারো সাথেই সখ্যতা নেই নিষ্প্রাণের।সকাল দিকে একজন মহিলা এসে রান্না করে রেখে যায়।দিনের বেশিরভাগ সময় ভার্সিটি,কোচিং আর বন্ধুদের সাথে কাটায় নিষ্প্রাণ।কোনোদিন বাসায় এসে খায় তো কোনোদিন না।
খামটা সন্তর্পনে খুলে তার ভেতরে অবস্থা দেখে সে।অনুপলেই নিষ্প্রাণের শান্ত চোখ জোড়া চঞ্চল হয়ে উঠে।খামের ভেতর শুধু পাঁচ হাজার টাকা আছে।নিষ্প্রাণ অস্থির হয়ে উঠে,অশান্ত হয়ে উঠে তার মন।কাউকে কল করে নিষ্প্রাণ।কল রিসিভ হতেই ব্যস্ত গলায় বলে উঠে—

“দাদু,আমি আপনাকে বলেছিলাম আমার বাড়তি টাকার প্রয়োজন।কিন্তু…।”

ওপাশ থেকে কিছু একটা বলে লাইন ডিসকানেক্ট করে দেয় দাদু।ফুঁসে উঠে নিষ্প্রাণ।সামনে থাকা চেয়ারে সজোরে এক লাথি মেরে বসে।
,
,
,
সকাল থেকেই থমথমে অম্ব।জমে আছে গুমোট মেঘ।প্রভাকর তার দীপ্তি ছড়াতে পারেনি।বাঁধা আছে তার।কৃষ্ণাভ মেঘের ভাঁজে ভাঁজে আত্মগোপণ করেছে সে আজ।দীর্ঘকায় জারুল গাছটাও চুপ মেরে আছে।ঝিম ধরে আছে তার পত্রপল্লব।প্রকৃতি জানান দিচ্ছে অবশ্যম্ভাবী সেই ক্ষণের।বর্ষণ হবে আজ অন্তরীক্ষের শান্ত চাদর ভেদ করে।

অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথেই শুরু হয়েছে প্রোগ্রাম।বাধ্যবাধকতা নেই সকলের অংশগ্রহনের।শিক্ষার্থীদের অবাধ বিচরণে মুখরিত ভার্সিটির প্রাঙ্গন।আয়েন্দ্রির একান্ত অনুরোধে তার বন্ধুরাও এসেছে।স্টেজ সাজানো হয়েছে তাজা ফুলের সমারোহে।স্টেজ থেকে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে তিন বন্ধু।কথা চলছিল আগামী মাসে অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষা নিয়ে।কথার মাঝেই সীমান্তের ছোট,ছোট অক্ষিজোড়া অশিথিল হয়ে পড়ে।তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু ক্রুটি করে প্রাবিশ।ধাক্কা মেরে হুশ ফিরিয়ে বললো–

“এমন স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন?

সীমান্তের চোখজোড়া সামনেই সীমাবদ্ধ।অনিমেষ চেয়ে থেকে বললো—

“ওইটা আমাগো আন্দি না?

প্রাবিশ আর নিষ্প্রাণ গেইটের দিকে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে যায়।একটা লাল জামদানি পরেছে আয়েন্দ্রি।খোঁপা করা চুলে বেলি ফুলের গাজরা জড়ানো।ভরাট নেত্রযুগলে কাজলের মোটা আঁচড়।অধর রাঙানো সিঁদুর রঙে।আয়েন্দ্রির চোখে,মুখে অদ্ভুত দীপ্ততা।নিষ্প্রাণের ভীত চোখ প্রথমেই থমকে যায় আয়েন্দ্রির ঠোঁটে।আজ আর সেই তীল দৃশ্যমান নয়।স্বাভাবিক চাহনিতেই আয়েন্দ্রিকে দেখে নিষ্প্রাণ।তাদের এই অদ্ভুত চাহনির মাঝেই সামনে এসে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি।সীমান্ত ভাবলেশহীন হয়ে দুই পাশে থাকা প্রাবিশ আর নিষ্প্রাণকে বললো—

“এই সর,সর।আন্দি রে তুই আজ কি মাইখা আইছোস?

তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে আয়েন্দ্রির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সীমান্ত।আয়েন্দ্রির গালে তর্জনী দিয়ে একটা ঘঁষা মেরে বললো—

“ওরে আল্লাহ!তুই আমাগো আন্দি তো?কী মাখছোস এডি?

আয়েন্দ্রি রাগ দেখিয়ে বললো–

“একদম হাত লাগাবি না।এক ঘন্টা লাগিয়ে মেকআপ করেছি।তোর এই নোংরা হাত দিয়ে ধরবি না।যা স্যানেটাইজার লাগিয়ে আয়।”

প্রাবিশ ফিক করে হেসে ফেলে।সীমান্ত বিস্ময় নিয়ে বললো—

“এই ছোঢ এক অনুষ্ঠানে তোর এতো সাজ!মাই গড !বিয়ার দিন কিতা করবি তুই?

আয়েন্দ্রি মুচকি হেসে ফিচেল গলায় বললো—

“সেদিন তো তিন ঘন্টা লাগিয়ে সাজবো।আমার বরের চোখে সেদিন সবচেয়ে সুন্দরী আমাকে দেখাতে হবে।”

সীমান্ত মাথা চাপড়িয়ে ধরে।কুসুম কোমল গলায় বললো—

“তোর আবার কী হলো?

সীমান্ত এক বুক নিরাশা নিয়ে বললো—

“ভাবতাছি আন্দির জামাইর কী হবে?
বাসর রাতের পরদিন তো ব্যাটায় আর বাথরুম ছাড়তে পারবো না।সাররাইত যে অখাদ্য খাইবো পেট তো নামবোই।”

আয়েন্দ্রি রেগে সীমান্তের পেটে এক গুঁতো মেরে বসে।নিষ্প্রাণ হালকা ঝুঁকে হাসে।আয়েন্দ্রি খুব করে খেয়াল করে এতো কথার মাঝে নিষ্প্রাণ একটা কথাও বলেনি।
,
,
,
অন্তরীক্ষ আজ বজ্রকঠোর।শান্ত চাঁদোয়া ফেঁড়ে নামবে ধরা সিক্ত বর্ষণ।থমথমে আকাশটা মুহূর্তেই রাশভারী হয়ে গেলো।কৃষ্ণবর্ণ জলদ ছড়িয়ে পড়লো গগন তলে।কিশোরী বিকেলেও প্রকৃতি রূপ নিলো সন্ধ্যারাতির।চারপাশে নেমে এলো অন্ধকার।ধূসরের মাঝে জায়গা হলো কৃষ্ণ কাদম্বিনীর।শুরু হলো সমাহিত গগনের তান্ডব।ক্ষণে ক্ষণে বেজে উঠছে কালো চাঁদোয়া চিরে তীক্ষ্ম সাদাটে আলোর ঝলকানি।সমীরণ খেলে গেলো দুরন্ত খেল।ধরা কাঁপিয়ে তুললো তার তোড়ে।ক্ষণপলেই তার আধিক্য তোলপাড় করে তুললো শান্ত,স্থির,নিষ্কম্প ধরণী।ঝমঝমিয়ে ধরণী বাষ্প গলিয়ে দিলো বাদলের ধারা।

স্টেজ ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে সবাই নিজেকে বর্ষণের তোড় থেকে বাঁচাতে।আয়েন্দ্রি সবেই মাইক হাতে নিয়েছিলো।কিন্ত তার গাওয়া আর হলো না।দ্রুত প্রস্থান করলো সকলে।বিরান স্টেজ শীতল জলে সিক্ত হয়ে গেলো।

ক্লাস রুমে ব্যতিব্যস্ত সবাই।ভিজে জবুথবু সীমান্ত।সিগারেট ফুঁকে মহাজাগতিক সুখে ভাসতে চেয়েছিলো সে।কিন্তু তাকে ভাসিয়ে দিলো বর্ষণের স্রোত।হুড়োহুড়িতে নিষ্প্রাণের কপালের সামনে এসে পড়েছে তার চুল।বাম হাত দিয়ে তা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে হোয়াইট বোর্ডের সাথে দাঁড়িয়ে চোখে কচলে যাচ্ছে আয়েন্দ্রি।এক চোখ কচলাতে থাকলে আয়েন্দ্রির অপর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে স্মিত জলস্রোত।উৎকন্ঠিত নিষ্প্রাণ উঠে দাঁড়ায় বেঞ্চ থেকে।আয়েন্দ্রি কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো–

“ক্যান আই হেল্প ইউ?

আয়ন্দ্রি খেলনা হারানোর বাচ্চাদের মতো কেঁদেই ফেললো।শিশুসুলভ আচরণের ন্যায় ঠোঁট উল্টে বললো–

“এইটা আবার বলা লাগে!দেখনা চোখে কী পড়েছে।ভীষণ যন্ত্রণা করছে।”

“দেখি।হাত সরাও।”

আয়েন্দ্রির সচেতন মস্তিষ্ক ব্যথায় এতোটা পিষ্টিত যে নিষ্প্রাণকে তুই বলার পরও সে যে কোনো রিয়েক্ট করে নি তা আয়েন্দ্রি খেয়ালই করেনি।আয়েন্দ্রির অক্ষিপুট টেনে ধরে বারকয়েক ফুঁ দিলেও কাজ হয় না।একগটা ছোট্ট পোকা আয়েন্দ্রির চোখের কার্ণিশে জলসিক্ত হয়ে আছে তাই ফুঁ তে তা সরছে না।নিষ্প্রাণ তার পকেট থেকে রুমাল বের করতে গেলে অধৈর্য গলায় বলে উঠে আয়েন্দ্রি—

“তাড়াতাড়ি কর না।”

“ধৈর্য ধরো।”

নিষ্প্রাণ তার রুমালটা রোল করে তার কোণা বের সূঁচালো রুপ দেয় তার।অতি সন্তর্পনে আয়েন্দ্রির চোখের কোণ থেকে সেইটার সাহায্যে পোকাটা বের করে আনে।ব্যাগ থেকে বোতল বের করে আয়েন্দ্রির হাতে দিয়ে বলে—

“পানির ঝাঁপটা দাও ভালো লাগবে।”

খানিক ধাতস্থ হতেই আয়েন্দ্রির ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় জানান দেয় সে এতোসময় নিষ্প্রানকে তুই করে বলেছে।তড়িৎ গলায় বলে উঠে–

“সরি,সরি।আসলে চোখে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিলো তাই আর খেয়াল করতে পারিনি।তোমাকে তুই বলে ফেললাম।”

নিষ্প্রাণ বিগলিত হেসে ছোট্ট করে বললো–

“ইটস ওকে।”

প্রসন্ন হাসে আয়েন্দ্রি।ভ্যালভ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে নিজের শার্ট ঝাড়া মেরে বললো সীমান্ত–

“তুই আর তুমি নিয়া এতো ফর্মালিটিস শুরু করলি ক্যান?আমি তো মাইয়া দেখতে গেলেও এতো ফর্মালিটিস করমু না।”

প্রাবিশ মৃদু হেসে বললো–

“রাইট।ফ্রেন্ডকে তুমি বলা ইটস উইয়ার্ড ইয়ার।যদিও তোদের পরিচয়টা নতুন।তবে নতুন থেকেই সব পুরাতন হয়।কি বলিস?

একগাল হাসে সীমান্ত।হাই বেঞ্চের উপর দুই পা ফাঁক করে বসেছিলো সে।দুই হাতের তালুর উপর ভর দিয়ে বেঞ্চ থেকে নেমে এসে ভেজা গায়েই কাঁধে হাত দেয় নিষ্প্রাণের।হাস্যোজ্জ্বল গলায় বললো—

“আন্দি নিষ্প্রাইন্নারে তুই বলছে এর জন্য আজ নিষ্প্রাইন্না ট্রিট দিবো আমাগোরে।”

নিষ্প্রাণ চমকিত হয়।ট্রিট!আমতা আমতা করে বললো—

“আআআমি?

“হ তুই।আর আইজ আন্দি সাইজ্জা গুইজ্জাও আইছে।সাথে সুন্দরী থাকলে ডিসকাউন্ট পাওয়া যায় বুঝলি।ওই সেদ্ধ ডিমের কুসুমডা কইরে?এইটা সাথে নিয়া নেই।ওইটারেও ভালো লাগতাছে আজ।হলুদ আর সাদা।পুরাই বয়েলিং আন্ডা।”

হু হা করে হেসে উঠে সবাই।নিষ্প্রাণের চিন্তিত হাসি।এমনিতেও টাকা কম পাঠিয়েছে তার দাদু।এখন আবার বাড়তি খরচ।নিষ্প্রাণের গলা ধরে আসে।

বাইরে চলছে নিরবধি বর্ষণ।কৃষ্ণ নীরধর ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে।উঁকি দিচ্ছে শুভ্র আকাশ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here