প্রাণস্পন্দন•পর্বঃ৩১

0
1984

#প্রাণস্পন্দন
#পর্বঃ৩১
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

বিভাবসুর তপ্ত কিরণে আধঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ আর আয়েন্দ্রি। উষ্ণতায় অতিষ্ঠ জনমানবপূর্ন জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছে তারা।

বিশ দিন হসপিটালে শুয়ে-বসে কাটিয়ে একটা তিক্ত অনুভূতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিলো সীমান্ত। তাই আর দেরি না করে সীমান্তের বড় ভাই তাকে বাসায় নিয়ে যায়। সীমান্তকে দেখতেই তাদের এলাকায় আসে আয়েন্দ্রি আর নিষ্প্রাণ। কিশোরী বিকেলে ভীড়ভাট্টা প্রচুর। গন্তব্যে ফেরা মানুষগুলো তখন তটস্থ, উদ্বিগ্ন, বিচলিত। সময়কে ডিঙিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফিরতে হবে।

প্রায় আধাঘণ্টা দাঁড়িয়েও কোনো বাস পেল না নিষ্প্রাণ যাতে তারা নির্বিঘ্নে চড়তে পারে। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে ওঠা মানুষগুলোর অবস্থা দেখেই গা গুলিয়ে উঠছে আয়েন্দ্রির। তবুও থেমে থাকার নয়। বাধ্য হয়ে অনেকটা মনের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা বাসে ওঠে দুজনে। সিট খালি নেই। পেছন দিকে গুটিকতক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আয়েন্দ্রি অস্বস্তিকর চোখে তাকায়। আয়েন্দ্রির উচাটন বুঝতে পেরে নিষ্প্রাণ বদ্ধ শ্বাস ফেলে। বাসের মাঝামাঝি গিয়ে বাম দিকের সিটের সাথে ঘেঁষে দাড়ায় সে। আয়েন্দ্রিকে দাঁড় করায় নিজের সামনে। বাস চলতে শুরু করে। লোকাল বাস হওয়ায় একটু পরে আরো কিছু মানুষ বাসের ভেতরে ওঠে। ফুঁসতে থাকে নিষ্প্রাণ! আয়েন্দ্রির সামনেই কৃশাঙ্গ দেহের একটা ছেলে এসে দাঁড়ায়। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল—

“ঘুরে দাঁড়া ধ্রুবতারা।”

আয়েন্দ্রি দ্বিরূক্তি করল না। আজকাল মেয়েরা নিজের সেফটির জন্য সামনে ব্যাগ নিয়ে চলতেও দ্বিধা করে না! নিষ্প্রাণের দিকে ঘুরে দাঁড়ায় আয়েন্দ্রি। আয়েন্দ্রির পেছন দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির চোখ বলে দিচ্ছে নেশায় পেয়েছে তাকে। চলন্ত বাসের সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেটি একটু একটু করে আয়েন্দ্রির দিকে চেপে আসে। নিষ্প্রাণের কুপিত দৃষ্টি। কিন্তু তা দৃষ্টিগোচর হলো না আয়েন্দ্রির।

মহান আল্লাহ্ পাকের এক অদ্ভুত সৃষ্টি নারী। তাকে না-কি বুঝা যায় না!
সত্যিই কী তাই? হ্যাঁ, তাই। নিজের শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত একগোছা তুলোর স্পর্শও নারীর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট! সেখানে কাঙ্ক্ষিত যন্ত্রণাময় ছোঁয়াতেও নারী মন পুলকিত হয়!
আয়েন্দ্রিও আজ তাই হচ্ছে। নিষ্প্রাণের এতটা কাছে সে এর আগে কখনো আসেনি। তার নিমগ্ন দেহে আছড়ে পড়ছে নিষ্প্রাণের শ্বাস। ঝলসে দিচ্ছে তার দেহপিঞ্জর। ড্রাইভার গাড়ির ব্রেক কষতেই নিষ্প্রাণের বুকের উপর আছড়ে পড়ে আয়েন্দ্রি। লজ্জায়, সংকোচে শিউরে ওঠে সে। তার নারী সত্ত্বায় নিষ্প্রাণের দৃঢ় বুকের পাটাতনের স্পর্শে বিগলিত হতে থাকে। নাজুক চোখে নিষ্প্রাণের মুখের দিকে তাকায়। নিষ্প্রাণ দৃঢ়, কঠোর, প্রকুপিত। কিন্তু তার ধারণা করতে পারল না আয়েন্দ্রি। সে প্রফুল্লচিত্তে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের দিকে। কৃশাঙ্গ ছেলেটির ধাক্কাতেই আয়েন্দ্রি হেলে পড়ে নিষ্প্রাণের বুকে। তাতে খানিকটা প্রসন্ন হয় আয়েন্দ্রি, কিন্তু রোষানলে জ্বলে ওঠে নিষ্প্রাণ। আয়েন্দ্রির বাম দিকের সিটেই এক দম্পতি বসে আছে। পুরুষটির বুকের সাথে জড়িয়ে আছে ছয়- সাত বছরের একটি মেয়ে। ঘুম জড়ানো আঁখি দুটো খুব কষ্টে মেলে রাখতে চায় বাচ্চাটি। নিমিঝিমি চোখে আয়েন্দ্রিকে দেখে। আয়েন্দ্রি দুই হাতে নিষ্প্রাণের শার্ট খামচে ধরে আছে। মিটিমিটি হেসে বাচ্চাটির সাথে চোখের ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করছে। খোলা জানালা দিয়ে হুরহুরে উষ্ণ বায়ু ঢুকছে। গাড়ি স্লো হতেই নিষ্প্রাণ তার কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে আয়েন্দ্রির পিঠের উপর রাখে যাতে করে আর কারো স্পর্শ না লাগে তার ধ্রুবতারা শরীরে। চোখাচোখির এক পর্যায়ে বাচ্চাটি ফিক করে হেসে ফেলে। তার বাবা মুগ্ধ গলায় বলল—

“কী হয়েছে আমার রিনী মামুনির?

রিনী হৃদয় গলা হাসে। আয়েন্দ্রির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে দন্তপাটি বের করে। মায়া লাগে আয়েন্দ্রির! বাচ্চা বাচ্চা চোখ দুটো তাকে টানছে! নিষ্প্রাণের দিকে তাকাতেই ক্ষুণ্ণ হয়ে সে। এই ছেলেটা এমন কেন!
কেমন অদ্ভুত !

আচমকা নিজের কোমরে কারো ছোঁয়া অনুভব করে আয়েন্দ্রি। তার সপ্রতিভ মন নিষ্প্রাণের দিকে চেয়ে আছে। ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ গভীর হয়। আয়েন্দ্রি মৃদু গলায় বলল—

“প্রাণ!”

মুহূর্তেই নিষ্প্রাণের উগ্র চেহারা দেখে আত্মারাপ কেঁপে ওঠে আয়েন্দ্রির। সেই স্পর্শ নিষ্প্রাণেরই ছিল। পেছনের ছেলেটি নিজের হাত বাড়াচ্ছিলো দেখে নিষ্প্রাণ নিজেই আয়েন্দ্রির কোমরে হাত রাখে। এক হাতে ব্যাগ, অন্য হাতে আয়েন্দ্রির কোমর। নিজেকে পুরোদস্তুর ঠেসে রেখেছে সিটের বাড়ন্ত জায়গাটার সাথে। কষে এক লাথি বসায় ছেলেটির উরুতে। অকস্মাৎ সংঘটিত ঘটনায় ছেলেটা ধড়াস করে পড়ে যায়। বাসভর্তি মানুষ হকচকিয়ে ওঠে। হেল্পার চেঁচামেচি শুরু করতেই ড্রাইভার বাস থামায়। নিষ্প্রাণ আয়েন্দ্রির কাছ থেকে সরে এসে ছেলেটার গেঞ্জির কলার ধরে মুখে টপাটপ কয়েকটা ঘুষি মেরে বসে। আয়েন্দ্রির থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। ছোট্ট মেয়েটির বাবা উঠে এসে বলল—

“আপনি আমার সিটে বসুন। বি রিল্যাক্স।”

আয়েন্দ্রি ভয়াতুর চোখে নিষ্প্রাণের হিংস্রতা দেখছে! ছেলেটিকে ইচ্ছে মতো ঘুষি মারছে, সাথে লাথি। বাসের অনেকেই থামাতে গিয়েও ব্যর্থ। একটু সুযোগ পেতেই ছেলেটি বাস থেকে নেমে পড়ে। দ্রুতপায়ে নামে নিষ্প্রাণ। ছেলেটির পিঠে এক লাথি বসাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আয়েন্দ্রি বাস থেকে নেমে আসে। নিষ্প্রাণের হাত চেপে ধরে ভীত গলায় বলল—

“প্রাণ থাম। প্লিজ থাম।”

ছেলেটির মুখ দিয়ে লহুর ধারা বইছে। শীর্ণ শরীরে এরচেয়ে বেশি আঘাত সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। ছোট্ট বাচ্চাটি বাবার কোল থেকে ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে। পুরুষটি বলল—

“সমস্যা কী আপনার? এদেরকে এভাবেই শায়েস্তা করা উচিত। এদের মতো কিছু পিশাচের দলের জন্য মেয়ে মানুষ ঠিক মতো রাস্তায় চলাফেরা করতে পারে না।”

বাচ্চাটির মা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে—

“রিনীর আব্বু!
চুপ করুন। দেখছেন না মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে।”

আয়েন্দ্রির চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সেদিকে এক পলক তাকিয়েই আহত ছেলেটির পুরুষাঙ্গ বরাবর সজোরে এক লাথি বসায় নিষ্প্রাণ। দমবন্ধ হয়ে আসে আয়েন্দ্রির। আজরাহান বাঁকা হাসে। তার হাত চেপে ধরে প্রহর। প্রহরিনী বাবার বুকে সমাহিত। উৎসুক জনতার কলকাকলি। আজরাহান গাঢ় গলায় বলল—

“এদের মতো মানুষদের উপযুক্ত শাস্তি। না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাশরী।”

প্রহর হজম করে নিল সেই বাক্য। সে অভ্যস্ত এতে। আয়েন্দ্রি কেঁপে যাচ্ছে। নিষ্প্রাণ হট করেই বাসের ভেতরে ঢোকে। তার ব্যাগটা নিয়েই বেরিয়ে আসে। শক্ত হাতে আয়েন্দ্রির হাত চেপে ধরে বলল—

“চল্।”

আজরাহান মুগ্ধ হাসে। প্রহরকে খোঁচা মেরে বলল—

“প্রেমিক পুরুষ দেখেছিস! দেখে নে।”

একটা রিকশায় চড়ে বসে দুজন। আয়েন্দ্রি নৈঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।নিষ্প্রাণের হাতটা বুকের সাথে চেপে ধরে আর্দ্র গলায় বলল—

“এত রাগ কেন তোর? নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে পারিস না? যদি বাবা জানতে পারে এসব…।”

আয়েন্দ্রির হাত সরায় নিষ্প্রাণ। জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁস করছে। এলোথেলো চুলে ঢেকে আছে কপাল। কর্কশ স্বরে বলে উঠে নিষ্প্রাণ—

“রিকশা থামান মামা। থামান।”

নিষ্প্রাণের ভারী কন্ঠে রিকশাওয়ালা ধম মেরে যায়। নিষ্প্রাণ নেমে পড়ে। ভাড়া মিটিয়ে কিছুদূর চলে যায়। আয়েন্দ্রিও নেমে যায় রিকশা থেকে। নিষ্প্রাণের হাত ধরে কাতর গলায় বলল —

“কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

নিষ্প্রাণ খরখরে গলায় বলল—

“তোকে আমায় নিয়ে ভাবতে হবে না। আর তোর বাবাকে বলবি বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। সেইটা কারো জন্যই ভালো হবে না।”

নিষ্প্রাণ চলতে শুরু করে। নিরন্তর চলা। খুটখুট শব্দে কাঁদছে আয়েন্দ্রি। ঘোলা চোখে চেয়ে আছে নিষ্প্রাণের যাওয়ার পানে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here