#অসুখের_নাম_তুমি’ (পর্ব_৭)
#সোনালী_আহমেদ
নিস্তব্ধ এলাকা। চারপাশে পাখিরা কিচিরমিচির ডেকে যাচ্ছে। তপ্ত বাতাসে গাছের ডালাপালাগুলো এদিক-ওদিক দুলছে। সূর্যের তাপ এখনো যায় নি। ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রেশমি। তার ইচ্ছা করছে রান্না-বান্না সব রেখে উড়াল দিয়ে চলে যেতে। পরক্ষনেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিলো,দেখা যাবে মামি চিল হয়ে উড়ে গিয়ে তাকে ধরে এনে রান্নায় বসিয়ে দিবেন।
এত গরমে আগুনের পাশে কার ই বসতে মন চাইবে?
রেশমির অবস্থা অন্যন্যা দিনের মতো স্বাবাভাবিক হলে বোধ হয় এত বেগ পেতে হতো না। সমস্যা হলো সে তলপেটের ব্যাথায় ভুগছে। ব্যাথায় প্রায় জান বেরিয়ে যাচ্ছে তার।
কাউকে কিছু বলতেও পারছে না লজ্জায়। বলেই বা কি হবে? তাকে তো রাঁধতে হবেই। আজ প্রথম তার স্বামী এ বাড়ীতে এসেছে, কীভাবে সে উপোস রাখবে?
বিকাল হওয়ার আগেই তারা এসে পৌঁছায়। রেশমিদের ঘর বেশ বড় নয়। দো-চালা টিনের ঘর আর পাশে একটা ছোটখাটো রান্নার ঘর। বাড়ী থেকে একটু দূরেই টয়লেট। রুম দুটোর একটি ছোট আরেকটা অন্যটির তুলনায় সামান্য বড়। এক রুমে রেশমির মামা আর মামী থাকেন। অন্য রুমে রেশমি আর তার মা এবং মামাতো বোন রুহানী থাকে। মূলত রুম টা রুহানীর,কিন্তু রেশমিরা আসায় তাদের এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আসবাবপত্র বলতে একটা খাট, একটা ছোটখাটো টেবিল আর একটা ভাঙ্গা সুকেচ। অন্য রুমেই বাকিসব টুকটাক জিনিস রয়েছে। কয়েকদিন আগেই রেশমির মা শরীরে কঠিন অসুখ বাধিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তিনি বেশ নড়াচড়া করতে পারেন না। রেশমি থাকতে সে ই তার মায়ের সমস্ত কাজ করতো। মা বিছানা থেকে নড়তে না পারার সুবাদে সে ই মায়ের গা মুছিয়ে দিতো। এমনকি তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমেও পৌঁছে দিতো।
রেশমি এসেই মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার কান্না দেখে সৌহার্দ গাবড়ে গিয়েছিলো। রেশমির মা সেদিকে লক্ষ্য করে তাকে কাছে ডাকলেন।
সৌহার্দ শাশুড়িকে সালাম জানাতেই তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। তার হাত ধরে বলেন,
–‘ কিছু মনে করো না,বাবা। কোনোদিন আমাকে ছাড়া থাকে নি তো, তাই। তোমাদের কষ্ট দেয় নি তো? মেয়েটা বড্ড অবুঝ,ওর ভুল হলে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিও। বাচ্চা মেয়ে আমার,তাই এখনো বুঝ হয় নি। একটু খেয়াল রেখো।’
সৌহার্দ বিষম খায়। এ মেয়ে নাকি বাচ্চা?
রেশমি তাকে বসতে দিয়ে বের হয়ে যায়। রুহানী এসে নিজেই সৌহার্দের সাথে পরিচিত হয়।
সৌহার্দকে, রেশমির মামাতো বোন তাদের এলাকা ঘুরাতে নিয়ে যায়। রেশমি কিছু বলে নি, তবে তার ও ইচ্ছা করছিলো ঘুরতে যেতে। তা আর মুখ ফুটে বললো না।
মামি এসে তাকে রান্না করার তাগিদ দিয়ে চলে যান।ঘরে ভালো কোনো সবজি নেই। রেশমি তো নানা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। সৌহার্দকে কি এই আলু যার অর্ধেকগুলো পঁচা আর এই বাসি করলা দিয়ে কি খাবার দিবে সে? মানুষ টা প্রথমবার তাদের ঘরের খাবার খাবে,সে এসব কীভাবে দিবে?
ঝটপট বাড়ীর পেছনে তাদের ছোট ফসলের ক্ষেত এ গিয়ে তাজা কিছু সবজি নিয়ে আসে।
দুইহাতে কাটাকাটি করেই রান্না চড়ায়।
এর মধ্যে তার গ্রামের সখিদের সাথেও দেখা-সাক্ষাৎ চুকিয়ে নেয়। দিনে দু-দুবার রান্না করে সে ক্লান্ত। শরীর টা বোধ হয় চলছে না।
কোনোরকম গায়ে পানি ঢেলে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় । শরীর আর চলছে না। এই মুহূর্তে বিশ্রাম না নিলে বোধ হয় সে আর বাঁচবে না। পেটের ব্যাথা টা আবারো বেড়ে গেলো।
চোখ দুটো একত্রিত হয়েছে সবে। এর মধ্যেই তার মামীর হইচই শুনা যায়।
রেশমি চোখ খুলে দেখে সাঁঝ নেমে এসেছে। চোখদুটো কচলে বিরবির করে বলে ওঠে,
—‘মাত্রই তো ঘুমালাম। এত দেরী কবে হলো?’
মুখে পানির ছিঁটকা দিয়ে বের হতেই দেখে সৌহার্দ দুই হাতে বাজার নিয়ে এসেছে। মামীর মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। তিনি ব্যাগদুটো নিতে নিতে বলছেন,
—‘ কি দরকার এসব নিয়ে আসার? কোনে দরকার ছিলো না। শুধু শুধু কেনো নিয়ে আসতে গেলেন?’
সৌহার্দ বলে,
–‘ শুধু শুধু বলছেন কেনো? আসার সময় তো কিছু নিয়ে আসতে পারি নি তাই এখন নিয়ে আসলাম।’
–‘তবুও বাবা!কি দরকার ছিলো?’
—‘আরে ঘরে নিয়ে রাখেন, আমার দায়ওত্ব তাই এনেছি। আর শুনুন, কালো পলিথিনে আম্মার জন্য কিছু ফল এনেছিলাম ওগুলা উনাকে খেতে দিয়েন, বেশ অসুস্থ উনি।এগুলা খেলে উপকার হবে।’
রুজি ফট করে ব্যাগদুটো নিয়ে ঘরের দিকে চলে যেতে লাগলো। যেতে যেতে বলেন,
–‘ এ আর বলা লাগবে?এসব তো আপাকেই খাওয়াবো।’
রেশমি জানে মামি এসব তার মা কে দেখাবেও না। তিনি নিয়ে তার সন্দুকে তালা মেরে রাখবেন।
—‘আপনাকে এসব নিয়ে আসতে কে বলেছে?’
রেশমির ফোলা ফোলা চোখ, এলোমেলো চুল,ঘুমু ঘুমু মুখ সৌহার্দের চোখে পড়তেই থমকে যায় সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে পাশ কেটে ঘরে ডুকে যায় সে। রেশমি হতভম্ভ হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকায়। তা দেখে রুহানী হেসে দেয়। রেশমির গা জ্বলে ওঠলো। সে যদি পারতো এখনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো শয়তান টাকে।
ঘরের প্রায় প্রয়োজনীয় সব জিনিস ই এনেছে সৌহার্দ। তাজা গরুর মাংসের লোভ সামলাতে না পেরে রুজি এই সন্ধ্যায় আবারো রান্না বসায়। কতদিন খায় না, আহা আজ তৃপ্তি করে খাবে।
অভাবে স্বভাব নষ্ট। রুজির ও হয়েছে তাই। রান্না শেষ না হতেই পাতিলের উপর খেতে বসে যায়। গরম গরম এক প্লেট ভাত নিয়ে এসে রান্নাঘরেই সাভার করে ফেলে সে।
মাংসের ঘ্রাণ চারদিকে মৌ মৌ করছে। রুজির জামাই মাত্র এসে বাড়ীতে ডুকে। কাদা মাটিতে ভরে আছে সে। আজ বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে নি। দুপুরেই কাজে গিয়েছে। কয়েক ঘন্টা কাজ করে হাতে গোনা কয়েক টা টাকা পেয়েছে। মুখ টা বেশ ভার করে রেখেছেন তিনি।
রেশমি এগিয়ে এসে মামাকে কল চিপে বালতি ভরে দেয়। পেটের ব্যাথা টা আরো বেড়ে গেলো। রেশমি চুপচাপ ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সৌহার্দ আর রুহানী একসাথে বসে গল্প করছে। আজ সারাদিন তারা একসাথে থেকেছে,নানান জায়গা ঘুরে গল্পগুজব করেছে। রুহানী কথা কম সৌহার্দের গায়ের উপর পড়ছে বেশি।
কথার মাঝেই রুহানী কেশে উঠলো। সৌহার্দ সাথে সাথে বলে ওঠে,
–‘ রুহা,কি হয়েছে? পানি খাবে?’
—‘না,না। ঠিক আছি। তুমি বরং বসো।’
ওদের আলাপ শুনে রেশমির গা জ্বলে উঠলো। রেগে দুম করে বসে গেলো। সৌহার্দের দিকে রাগী চোখে তাকায়। মন মেজাজ এমনিতেই ভালো ছিলো না,এবার আরো খারাপ হয়ে গেলো।
রেশমি ওঠে গিয়ে ওদের মাঝখানে বসলো। পেটের ব্যাথায় নড়তে পারছে না তবুও সে ওখানে ওদের মাঝে বসলো। সৌহার্দের দিকে এক পলক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুহানী কে বলে,
—‘ আপু,উনি আপনার বড়। আমার বয়সী নয় যে তুমি বলবেন। আপনি করে বলবেন।’
—‘আমি তো আপনি করেই বলছিলাম,উনিই বললেন তুমি বলতে। উনার নাকি আনইজি লাগছে।’
রেশমি সৌহার্দকে চোখ রাঙ্গায়। তারপর বলে,
—‘ আপু,উনি হয়তো জানেন না তুমি আমার বয়সী। আসলে তোমাকে দেখতে অনেক বয়স্ক লাগে তো।তাই বলেছেন হয়তো,তাই না?’
সৌহার্দ হতভম্ভ হয়ে রেশমির দিকে তাকায়। সে এমন কবে বললো? রেশমি চোখ রাঙ্গাতেই অগত্যা মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।
রুহানীর চোখে জল চলে আসে। সে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে উঠে চলে যায়। রেশমি বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।
–‘এটা কি হলো?’
–‘রুহা,তাই না?’
রেশমি দাঁত চেপে কথাটা বলে ওঠে চলে যায়।
সৌহার্দ হতভম্ভ হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হলো সব ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।
চলবে!