#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
১৫তম পর্ব
সুমি হকচকিয়ে উঠলো। সবাই তার মুখপানে জবাবের আশায় তাকালো। সজীব আর লিনার মুখপানে চাইতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে ওঠলো। সুমির হয়েছে শাখের করাত। কোন দিকে যাবে মাথায় আসছে না। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। থমথমে মুখে মাথা উঁচু করে রেশমির দিকে এক পলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আগের ন্যায় মাথা নিচু করে ফেললো। তার জবাবের আশায় করুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রেশমি। সে কি জবাব দিবে সবাই শুনতে চায়।
বেশ খানেক সময় মনের সাথে যুদ্ধ করে মুখ খুললো সুমি। অনেক সাহস নিয়ে বলে,
‘ভাবী যা বলছেন সব সত্যি। চাচীআম্মা সকালে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার পর আমার কপালের এ দশা হয়েছে। তাছাড়া ভাবীর গলার পাশে এখনও আম্মার চুড়ির দাগ বসে আছে। বিশ্বাস না হলে দেখতে পারেন।’
দুজন মহিলা উঠে গিয়ে রেশমির গলার পাশ দেখলেন। এখনো লাল হয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখের কালো পর্দা সরে গেলো। ধিক্কার জানিয়ে লিনার আশেপাশে থু থু দিতে লাগলো। বিষয়গুলো এত দ্রুত হয়ে গেলো যে লিনার বুঝতে অনেক সময় লেগে গিয়েছে। সুমির কাজে লিনা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
যে মেয়ে কখনো তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতো না আজ সে জনসম্মুখে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে রইলে সুমির মুখপানে।
কিন্তু সুমি আজ ভয় পেলো না,বরং মনে ভীষণ শান্তি অনুভব করলো।
কঠিন লাঞ্চনার মাধ্যমে বিচারকার্য সুষ্ঠ হয়। অপমানে লিনার চোখে জল আসতে বাধ্য হলো। মাথানিচু করে ঘরে ফিরে আসতে হয় তাকে। ঘরে এসেই দরজায় খিল মেরে নিজেকে আটকে রাখলো সে। লজ্জায় কারো সামনে উপস্থিত হলো না। দিন পেরিয়ে রাত এলো তবুও লিনা রুম থেকে বের হলো না। তার স্বামী, সন্তানেরা বেশ কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া পায় নি।
সুমি আর রেশমিকে কেউ কিছু বললো না। তারা নিজেদের মতো কাজ কর্ম করে গিয়েছে। রেশমি বেশ কয়েকবার সুমিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তার পক্ষে জবাব দেওয়ায়। বিপরীতে সুমি সৌজন্যবোধক হাসি উপহার দিয়েছে।
অধিক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন লিনার সাড়া পাওয়া গেলো না, তখন গাবড়ে যায় তার স্ব-পরিবার। বাধ্য হয়েই সজীবকে দরজা ভেঙ্গে ডুকতে হয়েছে। সজীবকে অস্থির হয়ে রুমে ডুকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের কব্জির উপর ব্লেড দিয়ে টান মারলো লিনা। মুহূর্তেই রক্তের ফোয়ারা বইতে লাগলো হাত দিয়ে। বিষয়টি সবার জন্য বড়সড় এক ধাক্কা ছিলো। কেউ ধরতে পারলো না এসব লিনার এই মুহূর্তে করা চক্রান্ত। সজীব বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলো। চোখের সামনে রক্ত ভাসতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আসলো তার।পাগলের মতো মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে লাগলো। লিনা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সজীবের হাত ধরে বলে,
‘বাবার রে,আমি জানি আমি আর বাঁচবো না। তোরা সুখে থাকিস, আমার সিয়াম রে দেখে রাখিস। তোর বউ আর বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করিস। ‘
এটুকু বলেই লিনা হাপিয়ে উঠলো। মরে যাওয়ার মতো অবস্থা তার। সজীব বারবার বলতে লাগলো,
‘মা তোমার কিছু হবে না।’
———————-
অনেক্ষণ পর ডাক্তার এসে লিনার সুস্থতার খবর জানালো। বস্তুুত লিনার হাতের চামড়া খানিকটা কেটে গিয়েছিলো। ডাক্তার ও বিষয়টা স্পষ্ট জানালো। কিন্তু লিনার বিষয়টা সবাই অতি রঞ্জিত ভাবে নিলো। হাসপাতালে বাচ্চারা কেঁদে ভাসিয়ে দিতো লাগলো।
বাড়ীতে নিয়ে আসার বেশকিছুক্ষণ পর সজীব মায়ের কাছে গেলো। তাকে দেখেই লিনা আফসোসের সুরে বললো,
‘হাহ্,বেঁচে গেলাম রে বাবা। তোর বউয়ের সুখের সংসার আর করা হলো না। কীভাবে যে বেঁচে গেলাম! কতবার দোয়া করেছি,মরে যাই যাতে তোর বউ সুখে সংসার করতে পারে।’
‘ এসব কি বলো মা? তুমি মরে গেলে আমরা কীভাবে থাকতাম?’
‘কেনো,তোর বউ আছে। আমি জানি তোরা খুব সুখে সংসার করতি। অথচ দেখ বেঁচে গেলাম।’
‘মা,দোহাই লাগে চুপ করো। আজ তোমার কিছু হলে ওই মেয়ের সাথে সংসার করা দূর,তাকে এক কাপড়ে বিদায় করে দিতাম।’
সজীবের চক্ষুজোড়া লাল হয়ে ওঠলো। হাতে মুষ্ঠিবুদ্ধ করে বসে রইলো। মায়ের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে রুমে চলে আসলো।
রুমে এসেই সুমির চুলের গুছি মুঠোয় পুরে বলে,
‘খুশি তো। আমার মা মরে যাচ্ছিলো খুশি হয়েছিলি না? বেঁচে যাওয়ায় বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?’
সুমি কাতরাচ্ছে। চুলে ভীষণ ব্যাথা পাচ্ছে। গোড়া টনটন করছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সজীবের দিকে তাকালো। সাথে সাথে সজীব ছেড়ে দিলো। তার হাতে এক গাছি চুল ও উঠে এসেছে। সুমি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে একবার চুল তো আরেকবার সজীবের দিকে তাকাচ্ছে। সজীব বেশিক্ষণ সুমির দিকে তাকাতে পারলো না। ঘুরে গেলো, তার বুকের গভীরেও সে একই কষ্ট অনুভব করছিলো। মায়ের অবস্থা তার উপর এতটাই প্রভাব ফেললো যে সে কি করছে না করছে মষ্তিষ্ক সজাগ করতে পারলো না। সুমি চুপ করে রইলো। কোনো প্রতিত্ত্যুর করলো না।
সেদিনের পর থেকেই শুরু হলো সুমির নরক যন্ত্রণা। উঠতে বসতে স্বামী,শাশুড়ির শরীর জ্বালানো কথা সাথে সব ধরনের কাজ। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া স্বত্তেও তাকে দিয়ে ভারী কাজ করানো হতো। এমনকি ধোয়া কাপড় গুলোও ধুতে হতো।
রেশমির এসব সহ্য হচ্ছিলো না। কিন্তু সে যতবার প্রতিবাদ করতে যেতো ততবার ই সুমির উপর আলাদা অত্যাচার হতো। যতটুকু পারতো ততটুকু সে সাহায্য করতো। মাঝে মাঝে সুমির এত কষ্ট দেখে রেশমি কেঁদে দিতো।
না সইতে পারা রেশমিও একদিন এসবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠলো। সুমিকে যত কাজ করতে দেওয়া হতো তার সবকিছুই সে করে দিতো। যাতে সুমি একটু শান্তি পায়।
হঠাৎ একদিন খবর আসলো সুমির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তখন সুমির চারমাস চলছিলো। তার জীবনে অনেক বড় ধাক্কা ছিলো এ ঘটনা। সবার উপর প্রভাব ফেলেছিলো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ঘটনা। সেদিন চাপা স্বভাবের সুমি টাও গলা ছেড়ে কেঁদেছিলো। তার আর্তনাদের ধ্বনি কাঁদতে বাধ্য করেছিলো মানুষজনকে। বাচ্চা বাচ্চা করে কাঁদতে লাগলো রাত-দিন। তার এই আহাজারি দেখে শাশুড়ি বলে,’ এসব তার ঢং। বাচ্চা টাকে সে ইচ্ছা করেই নষ্ট করেছে।’ বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পরেও কম কথা শুনতে হয় নি সুমিকে। যা মুখ দিয়ে আসতো তাই বলতো লিনা। এসব শুনে সুমি নিজেকে গুটিয়ে নিলো সবার থেকে। সুমির অবস্থা বেগতিক দেখে রেশমি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
”আপু,আমি যদি জানতাম সেদিন সাক্ষী দেওয়ার পরিণাম এমন হবে তাহলে জীবনেও আপনাকে সাক্ষী দিতে দিতাম না।”
সুমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে কেমন যন্ত্রের মতো হতে লাগলো। কারো সাথে কথা বলতো না,মিশতো না,সবসময় একাকী থাকতো।
‘আপু,তুমি ঠিক আছো তো?’
সুমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিতো,
‘হ্যা,ঠিক আছি। কি হবে আমার?’
রেশমি আর করার মতো কোনো প্রশ্ন পেতো না। সুমি তার সাথে স্বাভাবিক দেখাতো। রেশমি জানে, যতটা স্বাভাবিক সুমি নিজেকে দেখাচ্ছে সে ঠিক ততটা স্বাভাবিক নয়। হয়তো বড় কিছু চলছে সুমির ভেতরে যা সে টের পাচ্ছে না। অবশেষে বাচ্চার শোক কাটাতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো সুমি। মানুষিক চাপের ফলে তার নিঃশ্বাস নেওয়ার সকল বায়ু কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। যেখানেই নিঃশ্বাস নিতো সেখানেই বিষ পেতো। তাই বাঁচতে পারলো না বেশিদিন এই বিষাক্ত পরিবেশে। চলে গেলো সবাইকে মুক্ত করে। নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে শান্তিতে বাঁচতে দিলো না । সে কি চেয়েছিলো? এক মুঠো সুখ। আর তো বেশি কিছুই চায় নি। তিনবেলা খেটে খেয়ে স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে চেয়েছিলো । হেসে খেলে বাঁচতে চেয়েছিলো। এর থেকে তো আর বেশি কোনো প্রত্যাশা ছিলো না তার।
এ শহরে সুখের বড্ড অভাব। বড্ড অভাব! সকলে যাকে সুখি মানুষ হিসেবে চিনতো বাস্তবে তার জীবনে সুখের ফোঁটাও ছিলো না। ছিলো না কোনো আনন্দ, ছিলো শুধুই হতাশা আর এক সাগর দুঃখ।
#চলবে……
®সোনালী আহমেদ
~~লেখায় মন বসাতে পারছি না,কেমন আগোছালো হয়ে যাচ্ছে।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। সাথে অবশ্যই আপনাদের জাদুকরী মন্তব্যগুলো করবেন। যেসব পড়লেই মোহিত হয়ে গল্প লেখার প্রতি টান অনুভব করি। ভালোবাসা সকলের প্রতি।