জীবন সাথী💜 পর্ব-১৬

0
1200

#জীবন_সাথী💜
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৬.
~
কেন্টিনে বসে কফি খাচ্ছে অনু আর তার ঠিক সামনে তিহা;রুমি আর রিহান গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।তাদের তাকানোর স্টাইল দেখে মনে হচ্ছে অনু কোনো ভিন গ্রহের প্রাণী।অনুর চোখে মুখে বিরক্ত ভাবটা স্পষ্ট।সে কফি খাওয়া শেষ করে একরাশ বিরক্ত নিয়ে তাদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে;

”কি সমস্যা!আমার দিকে এমন ভাবে কেন তাকিয়ে আছিস যেন আমি একটা এলিয়েন।”

অনুর কথায় রিহান একটু নড়েচড়ে বসে তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে ,
”তুই না বলেছিলি ভার্সিটিতে এসে সব কিছু বলবি।তো এবার বল আর কত ওয়েট করবো?”

রিহানের কথার অনুর বিরক্ত ভাবটা আরো স্পষ্ট হয়।সে ব্রু কুঁচকে বলে,
”হুম বলছি তো।এত উতলা হওয়ার কি আছে।তবে হ্যাঁ আমার বলার মাঝখানে কেউ কোনো প্রশ্ন করবি না।আর আমি নিজেই সবটা জানি না।বাবা যতটুকু বলেছে আমিও ততটুকুই বলতে পারবো এর বেশি কিছু না।”

রুমি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠে,
”আরে দোস্ত যা জানোস বলতে থাক।আমরা আর অপেক্ষা করতে পারতেসি না।”

অনু ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলে,
”আচ্ছা।তোরা সবাই জানিস যে আমার বাবা এক বছর যাবৎ মিসিং ছিল।আর অনেক খোঁজা খুঁজি করার পরও উনার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।বাবার মুখে শুনেছি বাবাকে কিছু খারাপ লোক নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নাকি ১ বছর আটকে রেখেছিলো।কিন্তু তারা কে বা কারা সেই ব্যাপারে বাবা আমাকে কিছুই বলেনি।আর বাবাকে ওই খারাপ লোকদের থেকে আরাফ স্যারই উদ্ধার করে।আরাফ স্যার বাবাকে ছোট বেলা থেকেই চেনে।বাবাকে তিনি পি.এ বলে ডাকেন।কিন্তু দুঃখের ব্যাপার আমি তাকে চিনতাম না।বাবার মুখে আরাফ স্যারের অনেক কথা শুনেছিলাম।কিন্তু বুঝতে পারেনি বাবার বলা সেই আরাফ আমাদের ভার্সিটির আরাফ স্যার।আরাফ স্যার কি করে বাবাকে উদ্ধার করলো তাও আমি জানি না।এখানে আরো একটা রহস্য আছে;বাবাকে যে বিল্ডিং এ আটকে রাখা হয়েছিল সেই বিল্ডিংয়ে আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারও ছিলেন।আর সেদিনের আগুনে স্যারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়ে।কিন্তু উনি সেখানে কি করছিলেন আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।বাবাও কিছু খুলে বলছে না;সবটা কেমন যেন একটা রহস্যে ঘেরা।”

অনুর কথা শুনে তিন জনই চরম অবাক।রুমি বড় বড় চোখ করে বলে,
”তাহলে দোস্ত আরাফ স্যারের কি হবে উনার বাবার যে এই অবস্থা।”

”উনাকে বাবা আমাদের বাড়িতেই রেখেছেন।বাবা বলেছে স্যার পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের বাসায়ই থাকবে।”

অনুর কথায় তিহা আর রুমির চেহেরার কোনো পরিবর্তন না হলে রিহানের চেহারার পরিবর্তন হয়েছে।আরাফের অনুদের বাসায় থাকার কথা শুনে রিহানের ব্রু কুঁচকে আসে।তার কাছে যেন এই ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হয়নি।রিহান কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে কিছু সিনিয়র ছাত্র ছাত্রী এসে অনুকে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
”আচ্ছা তুমিই তো অনু?যার বাবা ১ বছর পর ফিরে এসেছে?আর তোমার বাবাকে নাকি আমাদের আরাফ স্যারই বাঁচিয়েছে?”

অনু ব্রু কুঁচকে পেছনে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে পেছনে দাঁড়ানো ।অনু বুঝতে পারে ইতিমধ্যে এই ব্যাপারটা সবাই মোটামোটি জেনে গিয়েছে;তাই অনু মুখে একটা মেকি হাসি দিয়ে বলে,

”জ্বি ভাইয়া।আমার বাবাই ১ বছর পর ফিরে এসেছে।আর আরাফ স্যারই আমার বাবাকে বাঁচিয়েছে।”

ওদের মধ্যে ব্লু কালারের শার্ট পড়া একটা ছেলে বলে উঠে,
”হুম।নিউজে দেখলাম আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপাল স্যারও নাকি আগুনে মারাত্মক ভাবে দগ্ধ হয়েছে।উনারও কি তোমার বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে এমন হয়েছে?”

ছেলেটির কথায় অনুর বেশ বিরক্ত লাগছে।ইচ্ছে তো করছে দু চারটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু এই মুহূর্তে তার ঝগড়া করার ইচ্ছে নেয়।তাই অনুকে নিজেকে শান্ত রেখে বলে,

”ভাইয়া আমি আসলে সবটা জানি না।আমার বাবা আমাকে যেটুকু বলেছে আমি সেইটুকুই জানি।আর পুলিশ তো তদন্ত করছেই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে;আশা করছি খুব শীঘ্রই সবটা বুঝতে পারবেন।”

অনুর কথা শুনে ছেলেগুলো আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে যায়।আর অনু একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
”চল ক্লাসে যাই।”
.
সবাই ক্লাসে মনোযোগ দিলেও তিহার মনোযোগ রিহানের দিকে।তিহা;অনু আর রুমি যে বেঞ্চে বসেছে রিহান তার ঠিক উল্টো পাশে বসেছে।তিহা আড় চোখে বার বার রিহানকে দেখে যাচ্ছে।হালকা আকাশি রঙের একটা শার্ট পড়েছে রিহান।শ্যামলা গায়ে শার্টটা যেন নিখুঁত ভাবে ফুটে রয়েছে।চুল গুলো এলো মেলো হয়ে কপালের উপর পড়ে আছে।এই ছেলের চুল সবসময় এমন অগোছালোই থাকে।মাঝে মাঝে তিহার ইচ্ছে করে রিহানের এই অগোছালো চুলগুলি সে তার হাত দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে দিবে।কিন্তু সেই সাহসটা তার নেয়;যার কারণে তার এই অনুভূতিটা তার অজান্তেই মনের কোণে পড়ে থাকে।আরাফের গাঢ় কালো চোখ গুলোর উপর তিহা সব থেকে বেশি দুর্বল।ভীষণ রকম মায়া আছে এই চোখ গুলোতে।তিহাও সেই মায়ায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।সে খুব ভালো করেই জানে এই মায়া সে কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবে না।এখন যে সে তার নিজের মনের এক কোণে রিহানের অস্তিত্ব টের পায়।কিন্তু রিহানের মনে কি আদৌ কখনো তিহার কোনো অস্তিত্ব তৈরী হবে!!নাকি সারাজীবন সেই জায়গাটায় অনুই থেকে যাবে!!কথা গুলো ভাবতেই তিহার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।সে যে রিহানকে খুব ভালোবাসে।কিন্তু রিহান কি কখনো বুঝবে তার ভালোবাসাটা।এক দৃষ্টিতে রিহানের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো ভাবছে তিহা।হঠাৎই রিহান পাশে তাকিয়ে তিহাকে তার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দুষ্ট হাসি দিয়ে চোখ টিপ্ মারে।সঙ্গে সঙ্গে তিহা ধড়ফড়িয়ে রিহানের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে।সে বড় বড় চোখ করে সামনে থাকা স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে।নিশ্বাসটা কিছুক্ষিনের জন্য বেড়ে গিয়েছে।রিহান তাকে চোখ মেরেছে ব্যাপারটা যেন কিছুতেই সে হজম করতে পারছে না।আর এই দিকে রিহান তিহার এমন অস্থিরতা দেখে মনে মনে হেসে বলে;’পাগলী একটা’
.
বাড়ি ফিরতেই অনু দেখে আরাফ তাদের বাড়ির সামনের উঠানটাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।দৃষ্টি তার সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে স্থির।স্যারকে এই সময় বাইরে দেখে অনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

”স্যার আপনি এখানে কি করছেন?”

অনুর প্রশ্নে আরাফ তার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেয়,
”আসলে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখছিলাম।এই গাছটার মধ্যে কেমন যেন একটা মাদকতা আছে তাই না?”

অনু ধীর পায়ে আরাফের সামনে এসে দাঁড়ায় তারপর মিহি কণ্ঠে বলে,
”জ্বি স্যার।আমিও প্রতি রাতে এর মাদকতায় হারিয়ে যায়।”

আরাফ আড় চোখে একবার অনুর দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট কন্ঠে বলে,
”তোমার মধ্যেও এক ভয়ংকর মাদকতা আছে।যে মাদকতার নেশা আমাকে পুড়িয়ে মারছে।”

আরাফের এই অস্পষ্ট কথাটা অনুর বোধগম্য হয়নি তাই সে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে,
”স্যার কিছু বললেন?”

অনুর কথায় আরাফ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
”না কিছু বলেনি।বাই দা ওয়ে ভার্সিটির কি অবস্থা?নিশ্চয় সবাই সব কিছু জানে?”

অনু ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
”স্যার এই ঘটনাটা অলরেডি খবরে শুনানো হচ্ছে;তাতে তো সবার জানাটায় স্বাভাবিক।”

আরাফ ধীর কণ্ঠে বলে,
”হুম।আচ্ছা তো তুমি গিয়ে ফ্রেশ হও।”

অনু ঠিক আছে বলে চলে যেতে নিবে তখনি তার চোখ যায় আরাফের বাম হাতের দিকে।বাম হাতের ব্যান্ডেজটাও খুলা।অনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

”স্যার আজকে কি আপনার বাম হাতের ব্যান্ডেজটাও খুলে ফেলেছেন?”

আরাফ তার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে বলে,
”হুম।সকালে পি.এ আর আমি হসপিটাল থেকে ড্রেসিং করিয়ে এসেছি।”

”ওহ আচ্ছা।আর আপনার বাবা কেমন আছে।”

বাবার কথা শুনে আরাফ চোখ মুখ শক্ত করে অনুর দিকে তাকায়।এমন ভাবে তাকিয়েছে যেন অনু কোনো ভুল কথা বলে ফেলেছে।আরাফ দৃষ্টি সরিয়ে বলে,

”ডাক্তার বলেছে আগের মতোই আছেন।তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।”

আরাফের কথায় অনু ভাবে হয়তো বা আরাফ তার বাবার জন্য মন খারাপ করছে তাই আর কিছু না বলে অনু নিজের রুমে চলে আসে।
.
সন্ধ্যার দিকে অনু তার বাবার মার রুমে সোফার উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে শিনশেন দেখছে;আর থেকে থেকে সে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছে।অনুর বাবা একটু বাইরে গিয়েছে।এতো দিন পর ফিরেছে তাই তিনি তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন।আর অনুর মা রান্না ঘরে চা বানাচ্ছে।পারভেজ সাহেব ফিরে আসার পর থেকে রাহেলা বেগম পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠেন।এখন উনি আবার উনার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছেন।যে মানুষটার জন্য পুরো পরিবারটা এতদিন অন্ধকারে ছিল সেই মানুষটা ফিরে আসায় তাদের পরিবারটা আমার সজীব হয়ে উঠেছে।
.
বেশ কিছুক্ষন যাবৎ ব্রু কুঁচকে অনুর কান্ড গুলো খেয়াল করছে আরাফ।এত বড় একটা মেয়ে কিনা এখনো এইভাবে কার্টুন দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি।ব্যাপারটা আরাফের কাছে বেশ বিরক্তিকর।তাই সে একবার গম্ভীর গলায় ডাক দেয়,
”অনু!”

কিন্তু অনুর তো সেদিকে খেয়ালই নেয়।সে তো নিজের মতো পা দুলাচ্ছে আর কার্টুন দেখছে।আরাফ আরো কয়েকবার অনুকে ডাকে;কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না দেখে আরাফ ছো মেরে অনুর হাত থেকে টিভির রিমোটটা নিয়ে টিভিটা অফ করে দেয়।অনু বিরক্ত নিয়ে পাশে তাকাতেই আরাফকে দেখে ধরফরিয়ে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।তারপর দাঁত কেলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

”স্যার টিভিটা অফ করলেন কেন?”

আরাফ বিরক্ত নিয়ে বলে,
”আমার তো জানা ছিলনা অনু তুমি যে এতো বড় বাচ্চা।”

আরাফের কথায় অনুর ব্রু যুগল হালকা কুঁচকে যায়;সে আরাফকে জিজ্ঞেস করে,
”কেন স্যার কি হয়েছে?”

আরাফ সোফায় বসতে বসতে বলে,
”এই যে এইভাবে কার্টুন দেখে হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছো।এমন তো ৪-৫ বছরের বাচ্চারা করে।আমার তো তোমাকে দেখে কোনোদিক দিয়েই ৪-৫ বছরের বাচ্চা মনে হচ্ছে না।”

অনু ব্রু কুঁচকে বলে,
”কার্টুন দেখতে হলে যে বাচ্চা হতে হয় সেটা আপনাকে কে বললো স্যার!কার্টুন যেকোনো বয়সী মানুষরাই দেখতে পারে।”

অনুর কথায় আরাফ হালকা হেসে বলে,
”হুম দু দিন আমাদের বাচ্চাদের কোলে নিয়ে একসাথে বসে কার্টুন দেখো।”

”হুম তো আমি,,”

বলতে গিয়েও থেমে যায় অনু।আরাফ কি বললো;আমাদের বাচ্চা!!আমাদের বাচ্চা মানে কি?

আরাফও বুঝতে পারে সে মুখ ফস্কে ভুল কথা বলে ফেলেছে।তাই সে কথা কাটানোর জন্য হালকা গলা কাশি দিয়ে বলে,

”যাও অনু এখন গিয়ে পড়তে বস।”

অনু এখনো অবাক চোখে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে।তার মাথায় এখনো যেন এই আমাদের বাচ্চা কথাটা ঢুকছে না।অনুকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরাফ এবার কিছুটা কঠোর হয়ে বলে,

”কি হলো কি বললাম বুঝনি!পড়তে বস গিয়ে।গো”

লাস্টের কথাটা একটু জোরে বলায় অনু কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।তাই সে মাথা কিছু করে চুপচাপ নিজের রুমে চলে আসে।অনু যেতেই আরাফ স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে।
.
বই খুলে বসেও অনু একটা কথায় ভাবছে’আমাদের বাচ্চা’।এই ‘আমাদের বাচ্চা’ বলতে আরাফ কাদের বাচ্চার কথা বলেছে! তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না অনু।তার ছোট্ট মস্তিষ্কটা এতো বড় কথাটাকে বিশ্লেষন করতে পারছে না।তাই সে এক প্রকার বিরক্ত হয়ে পড়ায় মন দেয়।
*
”আমি তোমাকে ভালোবাসি অনু!”
”এসব কি বলছেন আপনি আরাফ স্যার?”
”হুম ঠিকই বলছি সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি;ভীষণ ভালোবাসি তোমায়।”
.
চলবে…
(আল্লাহকে ভয় করো;পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here