মোহঘোর #পর্বঃ৩৭

0
511

#মোহঘোর
#পর্বঃ৩৭
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি

নির্নিমেষ চেয়ে রইল রেহাংশী। অন্তঃরিন্দ্রিয়তে আছোঁয়া ভয় ধীরে ধীরে অঙ্কুরোদগম হচ্ছে। ইনজাদ মাথাটা হেলিয়ে ফিসফিসানো গলায় বলল—

“তোমাকে কিন্তু ওর চেয়ে বেশি সুন্দর লেগেছে। অবশ্য ওটা ছাড়াও তোমাকে….।”

ইনজাদের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেহাংশী ক্ষুদ্র চোখে তাকাল। হেসে ফেলল ইনজাদ। এগিয়ে এলো সিন্ধুজা। ইনজাদ সজীব গলায় বলল—

“এত দেরি করলে যে?”

সিন্ধুজা খানিকটা বিরক্তি নিয়েই বলল—

“আর বলো না। মম ড্রেস চুজ করতেই ঘণ্টা পার করে দিয়েছে।”

“ম্যাম আসছেন? কোথায় তিনি?”

“ড্যাডের সাথে আসছে।”

“ওও।”

রেহাংশীর নির্লিপ্ত দৃষ্টি ঠাওর করে বলে উঠে সিন্ধুজা—

“কেমন আছ রেহাংশী?”

“এই জামাটা…?”

সিন্ধুজা নিজের দিকে তাকাল। ইনজাদ অপ্রস্তুত হলো রেহাংশীর ছোড়া প্রশ্নে। সিন্ধুজা দিলখোলা হেসে বলল—

“একচুয়েলী, বাংলাদেশ থেকে তেমন কিছু কেনা হয় না। সেদিন তোমার জন্য ইনজাদ গাউনটা পছন্দ করল, ডিজাইনটা দেখে আমারও পছন্দ হয়। ভাবলাম সামনে মেহমাদের বিয়ে তো নিয়ে নেই। তাই নিয়ে নিলাম।”

কথা পাল্টালো সিন্ধুজা। চাহনি পরিবর্তন করে ইনজাদের দিকে বিদ্ধ করল। ঝলমলে গলায় বলল–

“মেহমাদ কোথায়? চলো তো তিয়ার সাথে কথা বলে আসি।”

ইনজাদ সম্মতি দিতেই পা বাড়ায় সিন্ধুজা। রেহাংশী বরফখন্ডের মতো স্থির হয়ে রইল। ইনজাদ হালকা গলায় বলল—

“চলো রেহাংশী।”

কেমন আড়ষ্ট হয়ে রইল রেহাংশী। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস দেখে ফেলল সে কিছুক্ষণ আগেই! ইনজাদ ভাবুক চোখে তাকিয়ে বলল—

“কী হলো? চলো!”

রেহাংশী স্থবিরতা কাটিয়ে অস্থির গলায় বলল—

“আমরা বাসায় কখন যাব?”

ইনজাদ বেশ অবাক হলো। চমকে উঠে বলল—

“সবে বিয়ে হয়েছে রেহাংশী! আর এত তাড়া কীসের?”

রেহাংশীর চোখের সাথে তার মুখচ্ছবির উজ্জ্বলতাও ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অনিচ্ছা সত্তেও ইনজাদের পেছন পেছন চলতে লাগল। বিশাল হল রুমের মাঝ বরাবর সিমেন্টের উঁচু পাটাতন। হাতে গোনা তিনটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। পাটাতনের ওপর সাদা রঙের পাতলা কাপড় বিছানো, আর তাতে ছেড়া গাঁদাফুলের ছড়াছড়ি। পেছনে ফুলের মেলা। থোঁকা থোঁকা গোলাপ আর অর্কিডের বহর। তীব্র মিষ্টি ঘ্রাণ!
টুকটুক করে তিয়ার সাথে কথা বলছে সিন্ধুজা। তিয়ার গায়ে লাল খয়েরী রঙের বেনারসি। তার নাকের নথের দিকে চেয়ে আছে রেহাংশী। ঠোঁট ভর্তি হাসতেই তিয়ার ঠোঁটের সাথে সংঘর্ষ ঘটে গোলাকার নথের। তা হাত দিয়ে একটু পরপর সরিয়ে দেয় তিয়া। তার পাশেই মেহমাদ। অফ হোয়াইট কালারের শেরওয়ানিতে তাকে আজ অন্যরকম লাগছে। গলায় পেছানো রেড আর গোল্ডেন কালারের সরু ওড়না।

রেহাংশী ভীত দৃষ্টিতে ইনজাদের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। ইনজাদ একহাত পকেটে গুঁজে রেখেছে। তার চোখ হাসছে। অন্য হাত দিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে রেহাংশীর হাত।নিজের অজান্তেই বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে রেহাংশীর হাতের উলটো পাশ ঘষে যাচ্ছে।রেহাংশীর আনম্র চোখে চাইল ইনজাদের দিকে। অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা, অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বে পেষিত হচ্ছে সে। ইনজাদ ছোট্ট করে হেসে বলল—

“যাও, কথা বলো ওদের সাথে।”

রেহাংশী ভাবাবেশ ছাড়া মাথা নাড়িয়ে না সম্মতি দেয়। ইনজাদ বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বলল—

“কী হয়েছে তোমার?”

রেহাংশী উদাস গলায় বলল—

“কিছু না।”

“তাহলে? যাও, কথা বলো ওদের সাথে। তিয়ার সাথে আলাপ হয়নি তোমার তেমন। যাও, সিন্ধুজাও আছে। ”

“উঁহু।”

ইনজাদ কপাল ভাঁজ করল। রেহাংশীর হাত মুঠো থেকে আলগা করে কণ্ঠে কাঠিন্যতা ফুটিয়ে বলল—

“কী হয়েছে তোমার? এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছ কেন?”

রেহাংশী ম্লান চোখে তাকাল। নত করল মাথা। ইনজাদকে অবাক করে দিয়ে আলতো করে তার হাত আঁড়ড়ে ধরল। ইনজাদ ভড়কে গেল নীরব আশংঙ্কায়! বিচলিত গলায় বলল–

“কী হয়েছে তোমার? খারাপ লাগছে? এমন ঘামছ কেন? গরম লাগছে? গরম লাগার তো কথা নয়। এই তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”

রেহাংশীর চাহনিতে ধ্বস নামল। একটা অবুঝ শিশুর মতো চাইল সে ইনজাদের দিকে। ইনজাদ ফের কিছু বলতে গেলেই মেহমাদ এসে দাঁড়ায়। টগবগ করে বলল–

“এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় এদিকে। ভাবি আসুন।”

লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে গেল রেহাংশী। কিন্তু তাকে ছোঁয়ার প্রয়োজন পড়ল না। ইনজাদের চোখে-মুখে অব্যক্ত রাগের স্ফুলিঙ্গ। রেহাংশীর এহেন আচরণ একদমই বোধগম্য হচ্ছে না তার। মেহমাদ পরিস্থিতির থমথম ভাব আঁচ করতে পেরে বলল—

“কিছু হয়েছে?”

ইনজাদ নাক ফোলাল। রেহাংশীর ধরে রাখা হাতের কব্জিতে চাপ প্রয়োগ করল। শক্ত করে ধরে উঁচু পাটাতন থেকে নেমে যেতে যেতে বলল—

“তোরা থাক, আমি আসছি।”

ইনজাদ রেহাংশীকে নিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। তপ্ত মরুর বুকে হলকে উঠা তাপ ছড়িয়ে বলল—

“কী শুরু করলে তুমি? এমন করেছ কেন?”

“বাসায় যাব।”

ইনজাদ দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। তিক্ত স্বরে বলল—

“মানে কী রেহাংশী? বাসায় যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলে কেন?”

রেহাংশী জবাব দিলো না। বুকের উপরের জায়গায়াটা ক্রমশ দৃশ্যত অনুভবে উঠা-নামা করছে। ইনজাদ কণ্ঠ শিথিল করে। চোখে আনে নমনীয়তা। পেলব গলায় বলল—

“কী হয়েছে খুলে বলো? কিছু খাবে?”

“উঁহু।”

ইনজাদ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নিষ্পলক। রেহাংশীর কোনো গতিবিধি তার নজরে এলো না। নুইয়ে রাখা মাথা, স্থির কায়া। ইনজাদ গাঢ় গলায় বলল—

“আরেকটু অপেক্ষা করো। স্যারের সাথে দেখা করেই চলে যাব।”

তৎক্ষণাৎ ক্যাটক্যাটে আওয়াজে বেজে উঠল ইনজাদের মোবাইল ফোন। রিসিভ করতেই জানতে পারল সিন্ধুজার বাবা এসেছেন। ইনজাদ পকেটে রাখল মোবাইল। নির্মল গলায় বলল—

“চলো, স্যার এসেছেন।”

“আমি ওয়াশরুমে যাব।”

“এসো।”

হলরুমের একপাশে সরু করিডোর। সেখান দিয়ে ভেতরে গেলে দুইপাশে বিভক্ত একটা দেয়াল। যার এপাশে মহিলা আর অপর পাশে পুরুষদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা। ইনজাদ ক্ষীণ গলায় বলল—

“তুমি যাও, আমি বাইরে যাচ্ছি।”

রেহাংশী আঁতকে উঠে খপ করে ইনজাদের হাত ধরে ফেলে। ভয়চকিত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল—

“আপনি যাবেন না।”

ইনজাদ অপ্রস্তুত গলায় বলল—

“আরে, এখান থেকে বেরিয়ে বাম দিকে গেলেই হবে। তুমি এসো।”

“না, আপনি যাবেন না। দয়া করে যাবেন না।”

“ওকে, ওকে। কোথাও যাচ্ছি না আমি। ফর গড সেক! জাস্ট রিল্যাক্স। যাও, আমি এখানেই আছি।”

রেহাংশী টলটলে চোখে চেয়ে একটু একটু করে ভেতরের দিকে এগোতে থাকে। অল্প সময় পরে ফিরে আসে।
,
,
,
স্থির হয়ে দাঁড়ায় ইনজাদ। একগাল হেসে বলল—

“হ্যালো স্যার?”

ব্যক্তিটি মেহমাদের সাথে খোশগল্পে মশগুল। ইনজাদের কণ্ঠে পেছন ফিরে। ইনজাদ সরস গলায় সালাম দিতেই তিনি প্রত্যুত্তর করেন। গাল ভর্তি হেসে বললেন—

“হ্যালো ইয়াং ম্যান! কী খবর? হাউ আর ইউ?”

ইনজাদ সরব গলায় বলল—

“আই এম ফাইন স্যার। আপনি কেমন আছেন?”

ব্যক্তিটি চমৎকার করে হাসলেন। নাকের ডগায় ভারী পাওয়ারের চশমা। সাদা রঙের পাঞ্জাবি, বৃহদাকার দেহ দেখে বুঝায় যাচ্ছে বয়সকালে সুপুরুষ ছিলেন। হেসে বললেন তিনি—

“ভালো আছি।”

“ম্যাম আসেননি?”

“এসেছে। ওই তো সৌরভের সাথে। তোমার ওয়াইফ আসেনি?”

ইনজাদ মুচকি হেসে রেহাংশীকে দেখিয়ে বলল—

“শি ইজ মাই ওয়াইফ।”

ব্যক্তিটি কেমন অবাক চোখে চাইলেন। কেন যেন তার এই ক্ষুদ্র, গোলগাল মুখটি পরিচিত মনে হচ্ছে। তিনি পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলেন। মনে করতে চাইছেন কোথায় দেখেছেন!
ইনজাদ রেহাংশীর দিকে তাকাতেই এক অবিশ্বাস্য ঘটনার সঞ্চারণ হলো। অচেনা প্রৌঢ়টির বিশাল বক্ষে সজোরে এক ধাক্কা বসায় রেহাংশী। ছিটকে পড়লেন তিনি মেঝেতে। ফুঁসতে থাকল রেহাংশী। তার পদ্মদিঘীতে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে। উপস্থিত সকলের হতভম্ব দৃষ্টি। সিন্ধুজা দৌড়ে এসে বাবাকে ওঠাল। ভীত গলায় বলল—

“ড্যাড! আর ইউ ওকে?”

ব্যক্তিটি রেহাংশীর দিকে বিমূঢ়,কৌতূহলী দৃষ্টি রেখেই বলল—

“ইয়েস, আই এম ওকে।”

সিন্ধুজা দাঁড় করালো তার বাবাকে। রেহাংশীর দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল—

“ইউ সিলি গার্ল! হোয়াট ইজ দিস?”

ইনজাদ তেড়ে এসেই রেহাংশীর হাত ধরল। দমদমে গলায় বলল—

“এইটা কী করলে তুমি? ”

রেহাংশী বিক্ষুব্ধ গলায় বলল—

“করেছি, বেশ করেছি। একটা খুনির সাথে এমন করাই উচিত।”

ইনজাদের বিস্ময় আকাশ ছুঁল। সচকিত গলায় বলল—

“খুনি! কে খুনি?”

রেহাংশীর কণ্ঠ এবার বাতাস কাঁপিয়ে দিলো।

“ওই জিবরান খন্দকার!”

“কী?”

হলরুমের অসংখ্য নারী-পুরুষের উৎসুক নজর আবদ্ধ হলো জিবরান খন্দকারের দিকে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here