#সায়াহ্নের_প্রণয় 🦋🦋
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টম_পর্ব
২১.
– “হলিডে! কিন্তু সামনের মাসেই তো এক্সাম। আমি না গেলে হয় না ভাইয়ু?”
ইশরাকের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠে প্রাচী।
– “হ্যাঁ, সেটাই তো! তোমাদের দুজনের নতুন বিয়ে হয়েছে। তোমাদের দুজনের কিছু একান্ত সময় কাটানো দরকার। আর তুমি এখানে কি জেদ ধরে বসেছো ইশরাক?”
খাবারের টেবিলে চেয়ার টেনে বসতে বসতে গম্ভীর গলায় বলে উঠেন আনোয়ার সাহেব। প্রত্যুত্তরে ইশরাক কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইশরাককে থামিয়ে ফিহা মাথা নতজানু করে অনুরোধের কন্ঠে বলে উঠে,
– “বাবা, এখানে ইশরাকের কোনো দোষ নেই। আমিই বলেছিলাম তাকে এ সম্পর্কে। আমি চাই এত সুন্দর একটা সময় আমার পুরো পরিবারের সাথে কাটাতে। প্লিজ বাবা রাজী হয়ে যান।”
– “হ্যাঁ, বাবা রাজি হয়ে যাও। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই, সমুদ্রও যাবে আমাদের সাথে।”
ইশরাকের কথা কর্ণপাত হতেই বিষম খেয়ে বসে প্রাচী।
– “আরে কি করছিস প্রাচী? কতবার বলেছি খাওয়ার সময় তাড়াহুড়া করবি না। দেখলি তো বিষম খেয়ে বসলি।”
বলতে বলতেই প্রাচীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দেন মিসেস জেবা বেগম। মিনিট পাঁচেক পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই প্রাচী ইশরাকের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত স্বরে বলে উঠে,
– “কিন্তু ভাইয়ু কেন? আর তাছাড়া তার তো এই সপ্তাহের মধ্যে ইউকে ব্যাক করার কথা তাইনা?”
– “হ্যাঁ, কথা তো ছিল সেটাই। কিন্তু আঙ্কেলের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে আমার। সমুদ্র আর ইউকে ব্যাক করবে না। এখন থেকে বিডিতেই থাকবে। আর এতে সমস্যা কোথায়? একদিক দিয়ে তো ভালোই হয়েছে। আফটার অল সমুদ্র তো আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মতোই।”
প্রাচীর কথার জবাবে ইশরাকের প্রত্যুত্তর পুরো পরিবেশকেই থামিয়ে দেয়।
– “হ্যাঁ, ফ্যামিলি মেম্বার ই তো। এই লোকটাকে মাথায় তুলে নাচলে তো এমন হবেই। কেন প্রাচী? তোর সাথেই এমন কেন হতে হয়? লোকটা আবার ইউকে ব্যাক করবে ভেবে কত খুশি হয়েছিলাম; কিন্তু না। এখন থেকে সে বিডিতেই থাকবে। তার মানে! তার মানে কোনো না কোনোভাবে ঘুরেফিরে আবার তার সাথে দেখা হবেই। নসিব রে, সবই নসিব প্রাচী।”
খেতে খেতে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠে প্রাচী।
ডিসেম্বর প্রায় শেষের দিকে। সাথে করে বছরও। ঘড়িতে রাত প্রায় রাত ৩:০০ টা ছুঁই ছুঁই। শরীরে কম্বল জড়িয়ে বিছানায় একপাশ থেকে অন্যপাশে ফিরছে প্রাচী। চোখে ঘুমের বিন্দু পরিমাণ রেশ টুকুও নেই। কিন্তু ঠান্ডার প্রকোপ বেশি হওয়ার ফলস্বরূপ কম্বল ছেড়ে উঠতেও মন চাইছে না।
– “আচ্ছা এসবের মাঝে মি. ইনভিজিবলের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আচ্ছা লোকটা দেখতে কেমন? রাগী, মুডি নাকি কিউট, সুইট?
ধ্যাত, কি সব ভাবছি আমি? প্রাচী তোর মাথা এবার আসলেই গিয়েছে। হবে কোনো সাইকো যার কি না মাথা পুরোপুরি গিয়েছে। রোজ রোজ এসব চিরকুট, প্রেমপত্র দিয়ে কি জানাতে চায়? তার এসব ওয়ার্নিং এ আমি ভয় পেয়ে যাব? তার পাঠানো গিফট, ফুল, প্রেমপত্র দেখে তার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে যাব? নো, নেভার! একদিন না একদিন তো সামনে আপনাকে আসতেই হবে মি. ইনভিজিবল!
আর সেদিনই বোঝাব আপনাকে এই প্রাচী কি জিনিস!”
মাথার উপরে থাকা ঘুরন্ত সিলিং ফ্যানটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আনমনেই প্রলাপ বকে প্রাচী।
২২.
বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে সিলেটও অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন নৈস্বর্গিক দৃশ্যে ভরপুর এ শহরের আনাচে কানাচে রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, ডিবির হাওর, বিছনাকান্দি, জাফলং, চা বাগান ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানের সমন্বয়ে গঠিত সিলেট।
দীর্ঘ ৬.৫ ঘন্টার জার্নি করে অবশেষে সিলেট শহরে প্রবেশ করে প্রাচী ও তার পুরো পরিবার। এতটা দীর্ঘ জার্নির ফলে অনেকটাই হাঁপিয়ে উঠেছে প্রাচী। আগে থেকেই হোটেল বুক করায় স্টেশন থেকে নেমে পরপর দুটো ট্যাক্সি থামিয়ে তাতে উঠে পড়ে সবাই। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই ট্যাক্সি এসে থামে হোটেল ‘নিরভানা ইন’ এর সামনে।
সুসজ্জিত এই হোটেলের ভেতরে লাগেজ, ব্যাগপত্র নিয়ে প্রবেশ করতেই বুক করা রুমের জন্য চারটে চাবি কালেক্ট করে নেয় সমুদ্র। অতঃপর গাইডের সাহায্য নিয়ে রুমের সামনে পৌঁছাতেই সবাই যার যার নিজস্ব রুমের চাবি নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
বিশালাকার বেডরুম, পরিপাটি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো রুমটায় কোনোমতে লাগেজ নিয়ে প্রবেশ করে প্রাচী। এত ঘন্টার ধকলে শরীরে বেশ ক্লান্তি ধরেছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিতেই চোখে নেমে আসে ঘুমের এক বিশাল রাজ্য।
সন্ধ্যে হতে চলেছে। অস্তীয়মান সূর্যের অস্তিত্ব পশ্চিম আকাশে প্রায় বিলীন। সারাদিনের ক্লান্তি থাকায় আজ হোটেল ছেড়ে কেউই বের হয়নি। বিকেলের পর থেকেই সবাই হোটেলের রুফ টপে চলে গিয়েছে। সন্ধ্যে নামার পরপরই রুফ টপের সৌন্দর্য যেন আরো কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। চারপাশে ছোট ছোট মরিচবাতি, ক্যান্ডেল, বিভিন্ন ফুলের সংমিশ্রণে সুসজ্জিত টেবিল।
ফিহা, ইশরাক আর মিসেস জেবা বেগম, আনোয়ার হোসেন সাহেব দুই কাপলই পরপর দুটো টেবিলে বসেছেন। কারণ এখানে টেবিল গুলোই সব দু সিটের। বাকি রইল প্রাচী আর সমুদ্র। প্রাচী আশপাশে একবার তাকিয়ে আবার আড়চোখে সমুদ্রকে দেখে যাচ্ছে। আর অন্যদিকে সমুদ্র রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত।
প্রাচী ও সমুদ্রকে ব্যস্ত থাকতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে পেছনের কর্ণারের দিকে থাকা টেবিলে গিয়ে বসে পড়ে। কথা শেষ হতেই সমুদ্রও পকেটে ফোন গুঁজে ধীর পায়ে এসে প্রাচীর টেবিলে থাকা ফাঁকা সিটে বসে পড়ে। আর সেটা চোখে পড়তেই চোখ বড় করে হুট করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় প্রাচী।
– “কি হয়েছে?”
খানিকটা ভ্রু কুঁচকে প্রাচীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সমুদ্র।
– “আপ্ আপনি এখানে কেন? না মানে এখানে কি করছেন? আরে ধুর,না মানে এখানে বসেছেন তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলে উঠে প্রাচী।
– “হ্যাঁ, তো? এখানে তো একটা সিট ফাকাই ছিল। আর হোটেলে শুধু আমরা একা আসিনি। আমি না বসলে অন্য কেউ এসে বসত। আই হোপ এতে তোমার কোনো সমস্যা নেই।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দেয় সমুদ্র।
– “হ্যাঁ, শুধু সমস্যা কেন? আরো অনেককিছুই হবে। আর আপনি থাকতে সমস্যাকে কি আলাদাভাবে ইনভাইট করতে হয় নাকি?”
বিড়বিড় করে বলতে বলতে বসে পড়ে প্রাচী।
– “আমাকে মনে মনে গালি দেয়া শেষ হলে খাওয়ার জন্য কিছু অর্ডার করি, মিস প্রাচী?”
সমুদ্রের বলা কথা কর্ণকুহরে ঠেকতেই চোখ বড় বড় করে তাকায় প্রাচী। তার মুখশ্রী জুড়ে বিস্ময়তার ছাপ।
২৩.
– “ম্যাম, স্যার আপনারা দুজন কি অর্ডার করবেন?”
একজন মধ্যবয়স্ক ওয়েটার এসে সমুদ্র আর প্রাচীর টেবিলের সামনে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
– “বাটারস্কচ আইসক্রিম!”
সমুদ্র আর প্রাচী দুজন প্রায় একইসাথে বলে উঠে। ওয়েটার দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠে,
– “বাহ্, আপনাদের কাপল দুজনের মিল তো একই। আচ্ছা আমি দিয়ে যাচ্ছি।”
এদিকে ওয়েটারের বলা কথায় কাশি উঠে গিয়েছে প্রাচীর। লজ্জায় মাথা তুলে তাকানো যাচ্ছে না। সমুদ্রও পড়েছে বেশ অস্বস্তিতে আর সেটা প্রাচী ও তাকে বলা কথাকে ঘিরেই।
পাশে থাকা পানির গ্লাস প্রাচীর দিকে এগিয়ে দিতেই প্রাচী গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয়।
কোনোমতে সবটা চুপচাপ নীরবে সহ্য করে খাওয়া শেষ হতেই দ্রুত টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ে প্রাচী। এখানে আর একটা মুহূর্ত ও থাকা সম্ভব না। নাহলে আবারো কোনো লজ্জাজনক ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে তার এই ভেবে সবার সাথে দ্রুত পায়ে রুফটপ ত্যাগ করে প্রাচী।
পরপর দুইদিন ক্লাসে প্রাচীর অনুপস্থিতি রাইয়্যানকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। আজ ক্যাম্পাসে আকাশ, হৃদিতা, ইহান, নেহা কারো সাথেই প্রাচীকে দেখতে পায় নি সে।
ক্যাম্পাসে এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে হৃদিতা আর আকাশ যখন হাসি মুখে কথাবার্তায় ব্যস্ত তখন রাইয়্যানের ডাক শুনে কথা থামিয়ে দেয় হৃদিতা।
– “মিস হৃদিতা?”
পেছনে ঘুরতেই রাইয়্যানের মুখশ্রী চোখে পড়ে হৃদিতার।
– “ইয়েস স্যার। কিছু প্রয়োজন ছিল?”
– “আপনাদের সাথে থাকা আর একটা মেয়ে কি যেন নাম, ইয়েস মিস মেহরিশ আয়াত প্রাচী। তার কোনো খোঁজ নেই। সামনেই তো এক্সাম। এভাবে ক্লাস মিস দেয়া তার রেজাল্টের উপর ইফেক্ট ফেলতে পারে। ডু ইউ নো হোয়ার ইজ সি?”
– “স্যার প্রাচী তো ঢাকাতে নেই। প্রাচীর পুরো পরিবার সিলেটে। আর ওকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ওর কাছে এই গ্যাপ কিছুই না। টানা একমাস গ্যাপ দিয়ে প্রাচীই ফার্স্ট ক্লাস পাবে।”
হৃদিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই আকাশ ফট করে উত্তর দিয়ে বসে।
– “ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ গাইস। ইউ বোথ ক্যারি অন।”
বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করে রাইয়্যান।
– “মেয়েটা বেশ ইন্টারেস্টিং। আই লাইক ইট।”
মনে মনে বিড়বিড় করতেই ঠোঁটের কোণে হাঁসি ফুটে ওঠে রাইয়্যানের।
সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মি মাথা বরাবর। ডিসেম্বর মাস হওয়ায় সেটা খুব একটা প্রভাব ফেলে না শরীরে। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৬২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রকৃতি কন্যা জাফলং। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা থেকে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে যার সীমানা।
পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানি, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে সবার কাছে প্রিয়।
পিয়াইন নদীর কাছে পৌঁছাতেই পানির স্বচ্ছ পানির ভেতর থেকে সুউচ্চ পাথরগুলো দৃশ্যমান। হাতে থাকা ক্যামেরাতে মেঘের দলের উড়ে যাওয়া, আকাশপানে মুক্ত বিহঙ্গের ছোটাছুটি, সবকিছুই ক্যামেরাবন্দি করছে সমুদ্র। অবসর সময়ের সবচেয়ে প্রিয় একটা শখ হলো ফটোগ্রাফী যার দরুন অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগাচ্ছে সমুদ্র।
শুভ্র, সাদা রঙের লং কামিজ, গলায় ওড়না পেঁচিয়ে রাখা, কোমড় অবধি লম্বা গুলো চুলগুলো বাতাসের সাথে খেলায় মেতে উঠেছে। নদীর পাড় ঘেঁষে খুব সাবধানে পাথরের উপর বসে পানির মাঝে পা ডুবিয়ে দেয় প্রাচী। খানিকটা পানির ছড়াছড়ির মাঝে বাচ্চামো কান্ডে মেতে উঠে সে।
ভালো একটা দৃশ্য খুঁজতে ব্যস্ত থাকা সমুদ্রের একসময় চোখ আটকে যায় সামনে থাকা একটা রমণীর দিকে। চোখ ফেরাতে চাইলেও তা যেন হার মেনে যায় বসে থাকা শুভ্র রমণীর জন্যে।………
#চলবে 🍂