উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-৭

0
4408

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৭)
#কুরআতুল_আয়েন

পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বেলীর।সাথে মুরগীর ডাকও আছে।সামনেই ছোটখাটো একটা বস্তিবাসী আছে।সেখানে অনেকেই মুরগী লালন-পালন করে।যার কারণেই সকাল হতে না হতেই মুরগীর ডাকও শোনা যায়।বেলীর চোখ জোড়া খুলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।শেষরাতের দিকে ঘুমিয়েছিলো।তাও কষ্ট করে চোখ দুটো মেলে।আড়মোড়া কাটানোর জন্য কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে।কিন্তু উঠতে গেলেই বিপত্তি বাজে।বেলী কিছুতেই বুরাগের জন্য উঠতে পারছে না।বেলীর বুকের উপর বুরাগ আরামসে ঘুমিয়ে আছে।বেলীর চোখের সামনে শুধু বুরাগের চুল গুলোই বিদ্যমান।মুখটা দেখতে পারছে না।বেলী আস্তে আস্তে বুরাগের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।আর,মনে মনে ভাবতে শুরু করলো,কবে বুরাগের ভালোবাসা পাবে,কবে বুরাগের মনে নিজের জন্য একটু জায়গা করে নিতে পারবে!আদোও কি সে পারবে বুরাগের মনে জায়গা করে নিতে।ভাবতেই বেলীর চোখ জোড়া ভরে উঠলো।বেলী আর এসব না ভেবে নিজের বুকের উপর থেকে বুরাগকে আস্তে করে সরিয়ে দিলো।অনেকটাই কষ্ট হয়েছে বুরাগকে সরাতে।বেলী উঠে ফ্লোরের উপর থেকে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে কোনোমতে আলমারির সামনে এগিয়ে গেলো।অনেক বেছে বেছে কালো কালারের একটা জামদানী শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

বালিশের নিচ থেকে অনবরত ফোনের এলার্ম টা বেজে চলেছে।৫ বারের মতো বেজে আবারও শুরু করেছে।বুরাগের কানে এলার্মের শব্দ টা আসতেই ঘুমের মধ্যেই তার কপাল কুঁচকে গেলো।আর না পেরে বিরক্তি নিয়েই ঘুম থেকে উঠে পড়লো।বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে নিলো।তখনো ফোনের এলার্ম টা বেজে উঠছিলো।এতোক্ষণ বালিশের নিচ থেকে এলার্মের শব্দটা খুব কমই লাগছিলো।কিন্তু,এখন একদম মাথাধরা শব্দ হচ্ছে।এই একটু সময়েই মনে হয় বুরাগের মাথাটা ধরে গেছে।অফিস যাওয়ার জন্যই মূলত এলার্ম দেওয়া।বুরাগে চোখ দুটো আধো আধো খুলে এলার্ম টা বন্ধ করে দিলো।আর,বিরবির করে বলতে লাগলো,
–“বাল!ঘুমটাই একদম নষ্ট করে দিয়েছে।ভালো করে তিন ঘন্টাও হয়নি ঘুমানোর।”
বিছানার সাথে বালিশটা সোজা করে রেখে সেখানে হেলান দিয়ে বসে রইলো বুরাগ।পাশে বেলীর খোঁজ লাগালো।কিন্তু বেলীর খোঁজ পায়নি।ওয়াশরুম থেকে পানি ছাড়ার আওয়াজ পেয়ে বুঝে নিয়েছে বেলী ওয়াশরুমে।বুরাগ হেলানো অবস্থাতেই শরীরটা কিছুটা মোচড়ামুচড়ি করতে লাগলো।

বেলী মাথায় গামছা বেঁধে বের হয়ে আসলো।সামনের দিকের কয়েকটা চুল ভিজা মুখটায় এসে লেপ্টে আছে।বুরাগ মোচড়ামুচড়ি শেষ করে আড়মোড়া হয়ে হেলান দিয়ে বসে ছিলো।ওয়াশরুমের দরজা ভেদ করে যখন বেলী বের হয়ে আসলো তখনই বুরাগ বেলীকে দেখে বড়সড় একটা শক খেলো।কালো জামদানী টা তে অসম্ভব সুন্দর আর মায়াবী লাগছে।তার উপর চাইনিজ হাতা ব্লাউজ।চাইনিজ হাতাটায় ফর্সা হাতদুটো যেনো আরো আকর্ষণীয় লাগছে।বুরাগ নিঃশব্দে একটা ঢোক গিললো।মনে মনে ভাবতে লাগলো,মেয়েটা কি আমার হার্টফেল করিয়ে দিবে।তাকালেই কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে।বেশি একটা তাকানো যাবে না হলে রাতের মতো বেসামাল অবস্থা হবে।যার ফলে অফিস টাও মিস যাবে!!

বিছানার উপর থেকে চাদর টা নিয়ে কোমড়ে পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো বুরাগ।বেলী আড়চোখা হয়ে বুরাগকে একবার দেখে নিলো।পরক্ষণেই আবার চোখও ফিরিয়ে নিলো।বুরাগ নিঃশব্দে বেলীর পিছনে এসে দাঁড়ালো।কোনো কথাবার্তা ছাড়াই বেলীর মাথায় বাঁধা গামছা টা টান মেরে খুলে নিলো।এমন হওয়ায় বেলী কিছুটা ভয় পেয়ে যায়।তার বুঝতে একটু সময় লাগলো আসলে কি হয়েছে।পিছনে ফিরে বুরাগের হাতে গামছা টা দেখে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো।বুরাগের দিকে শান্ত চোখে তাকালো।বেলীর চাহনি দেখে বুরাগ দাঁত কেলিয়ে বললো,

–“বউ!চটজলদি করে আলমারি থেকে আমার কালো শার্ট আর প্যান্ট টা বের করে দাও তো।বাহ্!এতে ভালোই হবে জামাই বউ ম্যাচিং ম্যাচিং।ডেটে যাওয়া উচিত কি বলো।”

বেলী বুরাগের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।চুপ করে আলমারির কাছে এগিয়ে গেলো।বুরাগ বেলীর কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও গলা ছেড়ে বলতে শুরু করলো,

–“আচ্ছা!ডেটে যাওয়ার আগে হানিমুনে যাবো।হানিমুন গিয়ে একটার পর একটা ডেট করবো।”

বেলী আলমারি থেকে বুরাগের প্যান্ট,শার্ট নিয়ে এসে বুরাগের হাতে ধরিয়ে দিলো।শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

–“আমি কোথাও যাবো না।”

বুরাগ হাতে প্যান্ট,শার্ট নিয়ে কিছুটা ভ্রু কুঁচকে বললো,

–“আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই।হানিমুনে তো যাবোই আমরা।কিন্তু তার আগে বলো,শুধু শার্ট,প্যান্ট দিলে হবে?আন্ডারওয়্যার,গেঞ্জি দিবা না?ভিতরের জিনিসগুলোই দিলা না!”

বেলী জিহবা কামড় দিয়ে আবারও এগিয়ে যেতে নিলো আলমারির দিকে।কিন্তু বুরাগের গম্ভীর গলা পেয়ে তার পা দুটো থেমে যায়।বুরাগের দিকে তাকানোর আগেই বুরাগ তার পিছনে এসে দাঁড়ালো।বুরাগের হাত টা বেলীর পিঠের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।নিজের পিঠে বুরাগের ছোঁয়া পেতেই বেলী কিছুটা সরে আসতে নেয়।কিন্তু বুরাগ বেলীর কাঁধ দুটো চুম্বকের মতো চেপে ধরলো।যার ফলে বেলীও থেমে যায়।আগানোর আর সাহস করে না।

ব্লাউজের আস্তরণ থেকে বেরিয়ে আসা কালো কালারের বক্ষবন্ধনীর ফিতা টা যত্ন করে ব্লাউজের ভিতর ঢুকিয়ে দিলো বুরাগ।বুরাগের স্পর্শ টায় বেলী বুজে গিয়েছে তার বেখেয়ালিপনা টা।তাই মাথাটা নিচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে।বুরাগ কিছুটা থমথমে গলায় বললো,

–“নেক্সট টাইম যেনো এইসবের প্রতি কোনো হেলাফেলা না হয়।নিজেকে গুছিয়ে চলতে শিখো।এইখানে মাথা নিচু করে না থেকে এইটা ভাবো আর,যেনো এইসব ভুল না হয়।”

বলেই বুরাগ নিজেই আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো।যাবতীয় জিনিসগুলো নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।বুরাগের যাওয়ার পানে বেলী একরাশ হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে।মনে মনে ঠিক করে নিলো এইসবের দিক দিয়ে আর কোনো ভুল হবে না।তাকে এখন অনেক কিছু খেয়াল করে চলতে হবে।বয়স ছোট হলেও তার অনেক কিছু ঠিক রেখে চলতে হবে।এমনকি বুরাগের ভালোবাসাটাও আদায় করে নিবে।বুরাগের হৃদয়ে নিজের জন্য জায়গাও করে নিবে।

বুরাগ খুব দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে।বুরাগের একটু পিছনে বেলীও আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে।উদ্দেশ্য তারা লিভিং রুমে যাবে।বুরাগ আর একটু আগাতেই তার সামনে স্নিগ্ধা এসে দাঁড়িয়ে যায়।যার ফলে বুরাগের হাঁটা থেমে যায়।বেলী স্নিগ্ধাকে বুরাগের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ফেলে দুজনকে ক্রস করে চলে আসতে নেয়।কিন্তু,কিছুদূর আগানোর পর বুরাগের গলার আওয়াজে থেমে যায় বেলী।বুরাগ কিছুটা শান্ত কন্ঠে বললো,

–“বেলী আমার পাশে আসো!”

বুরাগের কথা অনুসারে বেলী বুরাগের পাশে এসে দাঁড়ালো।বুরাগ বেলীর কাঁধে হাত রেখে নিজের সাথে একটু চেপে ধরলো।স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“কিছু বলতে এসেছো!”

স্নিগ্ধা গরম চোখে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।ও ভেবে নিয়েছিলো বুরাগ এখনো তার উপর দূর্বল।আরো একটু নিশ্চিত হয়েছিলো ওইদিন রাতের বুরাগ আর তার কাছে আসার সুন্দর মুহূর্তটা।স্নিগ্ধা কিছুটা থমথমে গলায় বললো,

–“চলে যাবো তো তাই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।ভেবেছিলাম মা আসলে আরো কয়েকদিন থেকে যাবো কিন্তু মা তো আর আসতে পারেনি।তাই চলে যেতে হচ্ছে।”

বুরাগ মাছি তাড়ানোর ভঙিতে বললো,

–“তোহ্ যাও!না করেছে কে।”
বলেই বেলীকে কে নিয়ে নিচে নেমে আসলো।বেলী একবার পিছন পানে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বুরাগের পায়ের সাথেও পা মিলিয়ে নেমে আসলো।

স্নিগ্ধা অবাক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে বুরাগ আর বেলীর যাওয়ার পানে।বুরাগের এই আচরণ টা কেন জানি স্নিগ্ধা সহ্য করতে পারছে না।ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো স্নিগ্ধা।আর,কোনো কিছু না ভেবে ছাদের দিকে রওনা দিলো।কারণ,ছাদে তার জন্য লিটন অপেক্ষা করছে।
—————————
অলি সাহেব নাকের ডগায় চশমা রেখে কিছু কাগজপত্র দেখছিলেন।তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনিই পড়াশোনা জানেন।মাঝখানে ছোট-খাটো একটা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য একটা প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন।তার পর থেকেই গ্রামের ছোট-ছেলে মেয়েরা অসুস্থ হলে তাদেরকে টুকটাক চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।তারপর থেকেই অলি সাহেবকে সবাই মোটামুটি ডাক্তার নামেই চিনেন।জাবেদা চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলেন।বিছানার পাশের টেবিলটাতে চায়ের কাপটা রেখে দিয়ে স্বামী অলি সাহেবের পাশে বসে পড়লেন।অলি সাহেব চশমার উপর দিয়ে জাবেদাকে একবার পরোক্ষ করে নিলেন।কাগজপত্র গুলোতে চোখ রেখেই জাবেদাকে বললেন,

–“কিছু বলবে!”

জাবেদা অলি সাহেবের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন।তারপর,আমতাআমতা করে বললেন,

–“একটু ফোনটা ধরিয়ে দিবেন কোহিনূরের কাছে।বেলীর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।”

অলি সাহেব হাতে থাকা কাগজপত্র গুলো বিছানার বিপরীত সাইডে রেখে হাতে বাটন ফোনটা নিয়ে কিছুটা হেসে বললেন,

–“সামান্য এই কথাটা বলতে তোমার এতো সংকোচ কেন লাগছে জাবেদা?মানলাম বিয়ের পর এই সংসারে এসে তোমাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।তোমার প্রথম স্বামী,প্রথম সংসার নিয়েও অনেক কটূ কথাও শুনেছো।কিন্তু এইসবে তো আমার কোনো সমস্যা নেই জাবেদা।তাও,তুমি এখনো আমার সাথে অনেকটা উশখুশ করে কথা বলো।যেটা আমার একদমই ভালো লাগে না।”

জাবেদা কিছু বলেন না।মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকেন।স্বামীর জন্যই এখনো এই সংসারে টিকে রয়েছেন।অলি সাহেব রিং ধরিয়ে দিলেন।জাবেদা খুশি হয়ে ঘরের জানালাটার সামনে চলে যান।জাবেদা চলে যাওয়ার পর পরই অলি সাহেব আবারও কাগজপত্র নিয়ে মশগুল হয়ে গেলেন।

আজকে শিউলি অনেকটাই তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো।স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায় সময় রাস্তায় করিমকে দেখে।দিনদিন কিশোরী শিউলির মনটা যেনো করিমের উপর অনেকটাই দূর্বল হয়ে পড়ছে।যখন করিমকে সামনে দেখে তখন তার উপর লজ্জা এসে ভর করে।লজ্জায় থাকাতেও পর্যন্ত পারে না।এখন তো আরেকটা রোগ এসে চেপে বসেছে সেটা হলো,পড়ার মধ্যে কিছুতেই মন বসে না।পড়তে গেলেও কেন জানি করিমের কথা মনে পড়ে যায়।এমনকি অনেক কিছুই কল্পনা করে ফেলে সে।যেমন,করিমের সাথে ঘুরতে গিয়েছে,করিমের কাঁধে মাথা রেখে আছে।
ভাবতেই,শিউলির মনটা কেমন পাখির মতো উড়ুউড়ু করে উঠলো।কিন্তু সামনে তাকাতেই শিউলির মুখটা কেমন অন্ধকারের মতো কালো হয়ে গেলো।এই বট গাছটার সামনেই তো প্রায়সময় করিমকে বসে থাকতে দেখে কিন্তু,আজকে করিমের ছায়া টুকু দেখতে না পেয়ে মনটা একদম কালো হয়ে গিয়েছে।খুব কান্না পাচ্ছে তার।মুখে মাখা তিব্বত পাউডার গুলো রাগে মুছে ফেলে।টলমল চোখে দ্রুত পায়ে স্কুলের পথে হাঁটা ধরলো।আশেপাশে বলতে কেউ নেই।অনেকটাই আগে চলে এসেছে সে।
কয়েক কদম যাওয়ার পরই শিউলির হাত টা জোরে টেনে নিয়ে বট গাছের আড়ালে চলে গেলো করিম।এতোক্ষণ সে বট গাছের আড়াল থেকেই শিউলি কে পর্যবেক্ষণ করছিলো।শিউলির মনে তার জন্য কিছু একটা কাজ করছে তা ভাবতেই করিমের মনটা একপ্রকার আকুপাকু শুরু করে দিয়েছে।

এমনটা হওয়ায় শিউলি ভয়ে অনেকটাই জমে যায়।চোখ বন্ধ করে বট গাছটার সাথে একদম লেপ্টে আছে।করিম কিছুক্ষণ শিউলির দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে নিলো।শিউলির শরীরের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত লালসাযুক্ত চোখ নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো।শিউলি এখনো আগের মতোই ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।করিম শিউলির কানের কাছে গিয়ে বললো,

–“আমারে খুঁজতাছিলা।”

করিমের কন্ঠ পেয়ে শিউলি অবাক চাহনি নিয়ে তাকালো।সামনে করিমকে দেখে মুখ দিয়ে আচমকাই বের হয়ে আসলো,

–“করিম ভাই”

করিম শিউলির সামনে থেকে সরে গিয়ে শিউলির পাশে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালো।শিউলি লজ্জায় একদম মিহিয়ে যাচ্ছে।করিম সামনের সবুজের সমারোহ ধান ক্ষেত গুলোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

–“মুখ থাইক্কা পাউডার টা মুইচ্ছা ফেলছো কেন?সুন্দরেই তো লাগতাছিলো।”

এই কথাটায় শিউলি যেনো আরো একটু লজ্জা পেয়ে গেলো।খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার।করিমের থেকে কিছুটা দূরে সরে গেলো।করিম শিউলির দিকে আড়চোখা হয়ে তাকিয়ে আবারও বলে উঠলো,

–“ভালোবাসো আমারে?”

শিউলি এবার বিস্ময় চোখে করিমের দিকে তাকালো।হঠাৎ করে তার মাথায় কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না।এমতাবস্থায় শিউলি বললো,

–“ভালোবাসার মানে কি করিম ভাই।”

–“ভালোবাসার মানে বুঝো না?”

শিউলি সাথে সাথে না সূচক মাথা দুলালো।শিউলির না সূচক মাথা দুলানো দেখে করিম শিউলির সোজা বরাবর দাঁড়ালো।শিউলির দুপাশে হাত রেখে মুখটা কিছুটা কাছে নিয়ে বললো,

–“আমারে কি অনুভব করতে পারো তুমি?সবজায়গা কি আমারে মনে পড়ে তোমার?আমারে নিয়া কি কল্পনার জগতে ভাসতে ইচ্ছা করে?আমারে কি সবসময় দেখতে মন চায়?”

করিমের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর করলো না শিউলি।শুধু চেয়ে আছে করিমের মুখপানে।করিম শিউলির ঠোঁটের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো।তার মাথাটা কেমন একটা ঝিমঝিম করছে।তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে শিউলি কি আবারও বললো,

–“আমার কথাগুলার উত্তর দাও?”

–“করিম ভাই স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে।”

করিম নাছোড়বান্দা হয়ে জবাব দিলো,

–“আগে আমার কথার উত্তরডি দাও।না হলে ছাড়া পাবা না।”

শিউলি পড়েছে বিপাকে।করিমের মুখোমুখি হয়ে উত্তর গুলো দিতেও পারছে না।তাই বুদ্ধি করে হুট করে করিমের হাতের নিচ দিয়ে মাথাটা নিচু করে বেরিয়ে পড়লো।দৌড়ে কিছুটা সামনে চলে গেলো।এমন হওয়ায় করিম কিছুটা থতমত খেয়ে যায়।শিউলির দিকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে।শিউলি দৌড় থামিয়ে পিছনে ফিরে মুখটায় মুচকি হাসি টেনে কিছুটা জোর গলায় বললো,

–“এমন পান খাওয়া লাল দাঁতের ছেলেকে আমি ভালোবাসবো না।আগে পান খাওয়া ছাড়তে হবে।”
বলেই আবারও দৌড়তে শুরু করে দিলো শিউলি।করিম শিউলির পানে তাকিয়ে বলে উঠলো,
‘এহন আমার স্বাদের পান খাওয়া টাও ছাড়তে হইবো।কিছু উসুল করতে গেলে কিছু ছাড় দেয়া লাগবো।হায় রে বেলী!তোমার আম্মার একটা ভুল আর তোমার বিয়া করার শাস্তিডা তোমার এই কিশোরী বইনডার পাওয়া লাগবো।কি করমু কও ভিতর টা জ্বলে আমার তোমার লাইগা।তুমি বিয়াডা নাও করতে পারতা।ভাবছিলাম তোমার গোসলখানায় উঁকি মারার কথাডা গ্রামবাসীরে ছড়াইয়া দিমু।গ্রামবাসীগোর কটূ কথায় তারপর চাচী বাধ্য হইয়া আমার লগে তোমার বিয়াডা দিয়া দিবো।কিন্তু,কি থাইকা যে কি হইয়া গেলো কিছুই বুঝলাম না।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে আপনমনে চেয়ে আছে বেলী।আজকের আকাশ টাকে মনে হয় খুব সুন্দর লাগছে।আকাশের বুকে মেঘের কোনো ছড়াছড়ি নেই আছে শুধু শুকতারা।বুরাগ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে।হাতে তার একটা শপিং ব্যাগ।রুমে এসে উঁকিঝুঁকি মেরে বেলীকে রুমে দেখতে পায়নি।বারান্দার সামনে বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আস্তে পায়ে এগিয়ে গেলো বেলীর দিকে।বেলী এখনো আকাশপানে তাকিয়ে আছে।বুরাগ বেলীর কাছে গিয়ে আস্তে করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগের স্পর্শ টা বুঝতে পেরে বেলীর মনের সুপ্ত অনুভূতি টা জেগে উঠলো।বুরাগের এই স্পর্শ টায় সে কেন জানি ভালোবাসা খুঁজে পায়।মনের শিরদাঁড়া যেনো শিরশির করে উঠে।বেলী চোখ বুজে বুরাগের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো।বুরাগ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি টেনে নিজের থুঁতনিটা বেলীর মাথার উপর রেখে দিলো।নিজেও আকাশের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।মুখটা নিচু করে বেলীর দিকে তাকিয়ে দেখলো বেলী চোখ বুজে রয়েছে।বুঝতে পেরেছে বেলী পরিবেশ টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করছে।কোমল কন্ঠে বুরাগ বলে উঠলো,

–“বেলী!বিছানার উপর একটা শপিং ব্যাগ আছে।ওইখানে তোমার জন্য একটা শাড়ি রাখা আছে।তাড়াতাড়ি করে শাড়ি টা পরে নাও।”

মনমাতানো এমন মুগ্ধকর পরিবেশে বুরাগের কোমল কন্ঠটা শুনে বেলীর হৃদপিন্ডের গহীনে একপ্রকার ভালোবাসার অনুভূতি জেগে উঠলো।সাথে হাতের লোমগুলোও কেমন খাঁড়া হয়ে গেলো।এতো সুন্দর কন্ঠ বুঝি ছেলেদেরও হয়।বেলী বুরাগের বুক থেকে মাথাটা তোলে নিলো।বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে পিছনে ফিরে বুরাগের দিকে তাকালো।কিছুক্ষণ চেয়ে বলে উঠলো,

–“এখন কেন শাড়ি পড়বো আমি।একটা তো পড়া আছে।”

বুরাগের বেলীর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

–“লংড্রাইভে যাবো।”

বেলী অবাক হয়ে উত্তর দিলো,

–“এতো রাতে।”

বুরাগ বেলীকে ছেড়ে দিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো।শপিং ব্যাগ টা নিয়ে বেলীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

–“ঢাকা শহরে এইটা এতো রাত না বেলী।ভেবে নাও এইটা সন্ধ্যা।এমনকি মাঝরাতেও ছেলেরা রাস্তায় ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেয়।এখন তোমাকে ৫ মিনিটের মতো সময় দিলাম চট করে রেডি হয়ে নাও।আর,চুল গুলো খোলা রাখবে।”

বেলী আর কিছু বলে না।বুরাগের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো।
————————–
রাতের অন্ধকারের ছায়া ভেদ করে বুরাগের গাড়িটা পিচঢালা রাস্তা দিয়ে শো শো করে নাম না জানা এক পথের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।একহাত দিয়ে বেলীর হাতটা সযত্নে নিজের হাতের ভাজে আটকে রেখেছে।আর একহাত দিয়ে ড্রাইভ করে যাচ্ছে।বেলী আকাশ পানে তাকিয়ে আছে।আজকের আকাশটা বেশ পরিষ্কার।অসংখ্য তারাদের মেলায় ভরপুর।সেই আকাশের বুকে ভেসে উঠা বড় চাঁদটাও মুগ্ধকর লাগছে।বেলীর আজকে খুব ভালো লাগছে।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলোতে রাস্তাটা খুবই আকর্ষণীয় লাগছে।বুরাগ মেইন শহর থেকে অনেক টা দূরে চলে এসেছে।অবশ্য,ঢাকা শহরে সবজায়গায় জাঁকজমকপূর্ণ।তাও বেছে বেছে বুরাগ একটা খালি জায়গায় গাড়িটা থামিয়েছে।সিটবেল্ট টা খুলতে খুলতে বেলীকে বললো,

–“এই যে ভাবনার রানী নামো!”

প্রকৃতি দেখায় ব্যস্ত ছিলো বেলী।গাড়ির থামানোটাও বুঝে নি।বেলী বুরাগের কন্ঠ পেয়ে বুরাগের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“এইখানে!”

–“হ্যাঁ!এইখানে তোমাকে মাটির পাত্রে চা খাওয়ানোর স্বাদ বুঝাবো।তাড়াতাড়ি নামো।”

বেলী বুরাগ দুজনেই সামনের ছোট টিনের দোকান টার দিকে এগিয়ে গেলো।বুরাগ বেলীকে নিয়ে দোকানের সামনের বেঞ্চিটাতে বসে পড়লো।বুরাগ দোকানদারকে তাড়া দিয়ে বললো,
–“মামা দু কাপ দুধ চা দাও তো।সবকিছুই যেনো ঠিক থাকে।”

দোকানদার মাথা নেড়ে বললেন,

–“আচ্ছা বাজান”

বেলী চুপচাপ বেঞ্চিটাতে বসে আছে।এমন রাতে তার প্রথম বাহিরে আসা।ব্যাপারটা ভাবতেই তার কেমন এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে।বুরাগ বেলীর হাসি উজ্জ্বল চেহারাটা দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে দিলো।কিছুক্ষণের মধ্যেই দোকানদার মাটির পাত্রে দু কাপ চা নিয়ে এলেন।বুরাগের হাতে দিয়ে পুনরায় নিজের জায়গায় চলে গেলেন।বুরাগ নিজে এককাপ নিয়ে আরেককাপ বেলীর হাতে ধরিয়ে দিলো।তারা দুজনেই চায়ের কাপে চুমুক বসালো।মৃদু মৃদু বাতাস বইছে দুজনেই এই বাতাসটাকে উপভোগ করছে।মৃদু বাতাস টার সাথে হঠাৎ করেই আকাশে মেঘের গর্জনও শুরু হলো।বেলী চমকে গিয়ে বুরাগের দিকে তাকিয়ে বললো,

–“এইমাত্র তো আকাশ টা ভালো ছিলো।কি সুন্দর ভাবে আকাশের তারাগুলো দেখা যাচ্ছিলো।আর একমুহূর্তেই মেঘের গর্জন শুরু হয়ে গেলো।”

বুরাগ চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,

–“আমার আর তোমার লংড্রাইভের সাক্ষী হবে বৃষ্টি তাই।”

বেলী ভ্রুকুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চেয়ে রইলো বুরাগের দিকে।আর কিছু না বলে নিজেও চায়ের পাত্রে চুমুক বসিয়ে দিলো।

হঠাৎ করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।সব কিছুই কেমন যেনো হুট করেই হয়ে যাচ্ছে।এতো সুন্দর একটা আকাশ দেখে বুঝাই যাচ্ছিলো না এমন ঝুম বৃষ্টি হবে।বুরাগ হাতে থাকা চায়ের মাটির পাত্র টা রেখে দিলো।জোর করে বেলীর টাও রেখে দিলো।বেলী শুধু আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ বেলীর হাত টা ধরে নিয়ে সোজা রাস্তার মাঝখানে চলে গেলো।গাড়িঘোড়া বলতে গেলে একদমই নেই।বৃষ্টির ফোঁটা বেলীর গায়ে পড়তে নিলেই বেলী বুরাগকে বললো,

–“তাড়াতাড়ি চলুন!না হলে একদম ভিজে যাবো।”

–“উহুহু!আমরা এখন বৃষ্টিবিলাস করবো সাথে একটু একটু আদর বিলাসও থাকবে।”

বুরাগের কথা শুনে বেলী খিলখিল করে হেসে উঠলো।বুরাগ একপলকে বেলীর হাসিটার দিকে তাকিয়ে আছে।বৃষ্টিতে দুজনে একদম ভিজে গিয়েছে।বেলীর সামনের চুল গুলো বৃষ্টির তেজে কপালে,চোখে লেপ্টে রয়েছে।বুরাগ বেলীর কাছে এসে কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে গভীর একটা চুম্বন খেয়ে বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।বেলীও বুরাগের শার্টের বোতামের ফাঁক দিয়ে লোমযুক্ত বুকটাতে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বুরাগকে জাপটে ধরলো।দুজনে খুব করে অনুভব করছে একে-অপরকে।

চলবে..
(খেলা দেখি ভালো করে রিচেক করি নি।ভুল থাকতে পারে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here