উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-৬

0
4211

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৬)
#কুরআতুল_আয়েন

মাঝারি সাইজের খাবার টেবিলটায় বাহারী রকমের খাবার,ফল,ফ্রুটস এ ভর্তি।তার ঠিক সামনে বরাবরই রান্নাঘর।শ্বাশুড়ি আফিয়াকে বেলী টুকটাক কাজে সাহায্য করছে।হাতের জিনিস গুলো এগিয়ে দিচ্ছে শ্বাশুড়ির হাতের কাছে।গ্রামের মেয়ে হলেও সে রান্নাবান্না জানে না।এমনকি তার আম্মা তাকে রান্নাঘরের কাছেই ঘেঁষতে দেয় নি।শুধু পড়াশোনায় ডুবিয়ে রেখেছিলো।আজকে ভাগ্য তার উল্টো ঘুরে গিয়েছে।তাই তো বেলী,এই ভাগ্যের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলারও চেষ্টা করছে।আফিয়া ফ্রাইপ্যানের মধ্যে ভাজা ডিমটাকে একটা কাচের প্লেটে তোলে নিলেন।বেলীর হাতে দিয়ে বললেন,

–“বেলী যা এইটা টেবিলে রেখে দিয়ে আয়।এখনি সবাই খেতে চলে আসবে।ডিম ভাজা বুরাগের অনেক প্রিয়।আর,ধনে পাতা দিয়ে করে দিলে আর কিছু লাগে না বুরাগের।’

বেলী মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,

–“ঠিকাছে মা!”

বেলী কাচের প্লেট তোলে নিলো।গরম থাকায় সাবধানতার সাথে প্লেটটার সাইডে ধরে টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো।টেবিলে রেখে চলে আসবে সেই মুহূর্তেই সিড়ির কাছে চোখ গেলো।বুরাগ খুব দ্রুত নেমে আসছে।খয়েরী রঙের শার্ট আর গ্যাবার্ডিন প্যান্টটায় অসম্ভব সুন্দর লাগছে।তার উপর আবার ফরমাল লুক।সাথে ভিজা চুল গুলো কপালের উপর অবাধ্যভাবে পড়ে আছে।দাড়ি গুলোতেও হালকা পানির ছোঁয়া।যার ফলে দূর থেকে পানির কণা আকারের বিন্দু গুলো চিকচিক করে উঠছে।ভিজা চুল গুলোর দিকে তাকাতেই বেলীর কালকের রাতের কথা মনে পড়ে যায়।মুখে শুধু একটু শুকনো হাসি ফুটে উঠে।যতোই বুরাগ তার কাছে আসুক না কেন তার মন তো জানে বুরাগ কালকে তাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নেয়নি।হয়তোবা তার পাগলামির জন্য।
বুরাগ সামনে বেলীকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখকে এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে তুললো।কিন্তু,বেলীর মুখটায় শুকনো হাসি টা যেনো কিছুতেই তার কাছে ভালো লাগলো না।আর কিছু না বলে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।আজকে থেকে সে বাবার সাথে অফিস জয়েন করবে।ব্যবসা সামলাবে।আফিয়া দ্রুত গতিতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন।এরিমধ্য হাসি খুশিও চলে আসলো।কোহিনূর রাগে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন।আফিয়া কোহিনূর কে রাগতে দেখে বললেন,

–“কিরে!তোর আবার কি হলো?”

কোহিনূর রেগে গিয়ে হাসি আর খুশিকে দেখিয়ে আফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“যেইখানে ওদের মতো ফাজিলের হাড্ডি আছে সেইখানে কি আমি ভালো থাকতে পারবো বলো।সব কিছু আমার একা করা লাগে।দুজনকে স্কুলের জন্য রেডি করতে গিয়ে বেশ হিমশিম খেতে হয়।আর তোমার দেবর তো একবার ওয়াশরুমে ঢুকলে আর বের হতে চায় না।”

ফুপির কথায় বেলী হেসে দিলো।নিজের ফুপির কান্ডকারখানা গুলো শুনতে ভালোই লাগে বেলীর কাছে।আফিয়াও হেসে উঠলেন।হাসি,খুশি নিজেদের মা’র কথা কানে অবধি নিলো না।আর নিবেই বা কেন যেখানে তাদের নামে বদনাম করা হচ্ছে সেখানে চুপ থাকাই ভালো।তাই তারা মনোযোগ দিয়ে খাবার খেতে শুরু করলো।বুরাগ কিছুক্ষণ ফোনে চোখ গুজে রেখেছিলো।ফোনটা রেখেই তাড়া দিয়ে মাকে বললো,

–“মা তাড়াতাড়ি খাবার দাও।আজকে অফিস জয়েন করবো একটু তাড়াতাড়িই যেতে হবে।”

ছেলের অফিস জয়েনের কথা শুনেই আফিয়া আবারও দৌড় লাগালেন।ছেলের পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন।বেলী মনোযোগ দিয়ে দেখছে সব কাজগুলো।কারণ,পরের দিনগুলোতে নাকি তাকেই এইসব সামলাতে হবে।একটু আগেই রান্নাঘরে শ্বাশুড়ির মুখে শুনেছিলো।

বুরাগ চুপ করে খেয়ে যাচ্ছে।কিন্তু,হাসি আর খুশি একটু পর পর একজন আরেকজনের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছে।সম্পূর্ণ টাই বুরাগের চোখে পড়ছে।আর,চোখে পড়ারই কথা কারণ বুরাগের ডানপাশের চেয়ার দুটো হাসি আর খুশি দখল করে আছে।বুরাগ খাবারের প্লেটে চোখ রেখেই গম্ভীর মুখে বলে উঠলো,

–“হাসি,খুশি আর একটাও কথা হবে না।চুপচাপ খেয়ে উঠো।”

ভাইয়ার গলার আওয়াজ পেয়ে হাসি খুশি কিছুটা দমে গেলো।এই দমে যাওয়াটা বেশিক্ষণ আর থাকেনি।আবারও উশখুশ করতে লাগলো তারা দুজনে।লাস্টে হাসি বুরাগের কানের কাছে এসে কিছুটা আস্তে গলায় বললো,

–“ভাইয়া একটা কথা বলি।”

বুরাগ আগের মতোই খাবারের প্লেটে চোখ রেখে বললো,

–“হ্যাঁ বলো!”

–“ভাইয়া বেলীপু না ব্যথা পেয়েছে।আর ব্যথা পেলে বেলীপু কাউকে বলে না।একবার নানুবাড়ি গিয়েছিলাম আমরা,বিকেলে মাঠে খেলতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে যায় বেলীপু।পায়ে অনেক ব্যথা পেয়েছিলো কিন্তু ছোট মামীকে বলে নি।”

মনোযোগ সহকারে হাসির কথাগুলো শুনছিলো বুরাগ।বেলীর ব্যথা পাওয়ার কথা শুনে চট করে বেলীর দিকে তাকালো।কিন্তু,বেলী অন্যমনস্ক হয়ে সোফার সামনের কর্ণার টার দিকে তাকিয়ে আছে।খুঁটেখুঁটে দেখছে কর্ণারের জিনিস গুলো।বুরাগ বেলীর হাতের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো।হাতে কোনো ব্যথার চিহ্ন দেখতে না পেয়ে হাসিকে বললো,

–“কই ব্যথা পেয়েছে।হাতে তো দেখলাম না ব্যথার চিহ্ন।”

হাসি মাথায় হাত দিয়ে বললো,

–“আরে ভাইয়া!হাতে কেনো পাবে।বেলীপু তো কোমড়ে ব্যথা পেয়েছে।তুমি দেখো বেলীপুর কোমড়ে রক্তের মতো চিহ্ন।”

বুরাগ তাড়াতাড়ি করে মাথা ঘুরিয়ে বেলীর দিকে আবার তাকালো।কোমড় টা থেকে শাড়ি সরে যাওয়ায় রক্তজমাট কালসিটে দাগটা একদম দেখা যাচ্ছে।তার চেয়ে বড় কথা ফর্সা কোমড় টায় দাগটা একদম ফুটে উঠেছে।বুরাগ খুকখুক করে কেশে উঠলো।একবার মা আর ছোটআম্মুর দিকে তাকালো তারা দুজনেই রান্না ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত।বুরাগের খুকখুক কাশির শব্দে বেলী অন্যমনস্কতা কাটিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেলো।কাচের জগ টা থেকে পানি ঢেলে বুরাগের সামনে ধরলো।হাসি,খুশি কিছু না বলে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।বুরাগ বেলীর হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে এক চুমুকেই শেষ করে দিলো।কয়েক সেকেন্ড চুপ করে নিজেকে ঠিক করে নিলো।বুরাগের কাশি কমে আসতেই বেলী চলে আসতে নেয়।কিন্তু,বুরাগ বেলীর কুচিগুলো চেপে ধরে আটকিয়ে দেয়।এতে বেলী অনেকটাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়।বারবার শ্বাশুড়ি আর ফুপির দিকে তাকাচ্ছে।তাঁরা কথা বলতে ব্যস্ত থাকলেও বেলীর খুব অস্বস্তি হচ্ছে।
বুরাগ হাসি আর খুশির দিকে তাকিয়ে বললো,

–“তোমরা খেয়ে নাও।তোমাদের স্কুলের দেরি হয়ে যাবে।”

স্কুলের কথা মাথায় আসতেই হাসি খুশি আবারও খাওয়া শুরু করে দিলো।বুরাগ বেলীর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে কাছে আসতে বললো।বুরাগের ইশারা বুঝতে পেরে বেলী মাথা দিয়ে না বুঝালো।বুরাগ চোখ,মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।বেলী ভয় পেয়ে বুরাগের কাছে এগিয়ে গেলো।বুরাগ সবার অগোচরে বেলীর কানের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলতে শুরু করলো,

–“তোমার কাছে আসার চিহ্ন টা কি তুমি সবাইকে দেখাতে চাও।এমন হলে তো কালকে আর একটু বেশি করে আদর করে দিতাম।তাহলে আদরের চিহ্ন গুলো আর একটু ফুটে উঠতো।”

বেলী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।কিছুই বুঝতে পারছে না সে।বুরাগ বেলীর চাহনি টা উপেক্ষা করে আগে সবার দিকে আরো একবার চেয়ে নিলো।মা আর ছোটআম্মু রান্নাঘরে চলে গিয়েছেন আর পাশে বসা হাসি আর খুশি একমনে খেয়ে যাচ্ছে।বুরাগ নিজের মুখটা বেলীর কানের আরেকটু কাছে নিয়ে গেলো।হিসহিসিয়ে বললো,

–“কোমড়ের দিকের শাড়ির আঁচল টা ঠিক করো।কালকের আদরের কালসিটে দাগটা দেখা যাচ্ছে।বোকা মেয়ে।”
বলেই বেলীর কানের লতিতে ছোট করে একটা কামড় বসিয়ে দিলো।বুরাগের পুরো কথাটা শুনে আর কানের লতিতে কামড়ানোর ফলে বেলী ছিটকে দূরে সরে যায়।মুখটাতে লজ্জা এসে ভর করলো।বেলী কোমড়ের আঁচল টা ঠিক করে আড়চোখে বুরাগের দিকে তাকালো।বুরাগ তার দিকেই ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।এতে যেনো লজ্জাটা আরো বেড়ে গেলো।তাই,দ্রুত গতিতে এইখান থেকে চলে গেলো বেলী।

এরিমধ্যে বুরাগের বাবা আজাদ রহমানও টেবিলের চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।স্বামীকে আসতে দেখে আফিয়া দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন।স্বামীকে খাবার রেডি করে দিতে লাগলেন।আজাদ রহমান একবার ভ্রু কুঁচকে নিজের সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলেন।পরোটা একটু ছিড়ে সবজি দিয়ে মুখে পুড়ে নিলেন।
স্নিগ্ধা হাই তোলতে তোলতে বুরাগের পাশের চেয়ার টায় ধপ করে বসে পড়লো।বুরাগ স্নিগ্ধাকে দেখে চোখ,মুখ শক্ত করে ফেলেছে।কালকের অপরাধ টা আবার নিজের মনের মধ্যে জেঁকে বসেছে।
আজাদ রহমান বুরাগের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।অফিস জয়েন করবে তুমি,আমার ব্যবসার হাল ধরবে।এইটাই তো আমি এতোদিন চেয়েছিলাম”

–“হ্যাঁ!আমিও নিজেও এখন কাজ করতে চাই।”

আজাদ রহমানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।কয়েকদিনের মধ্যেই অফিসে একটা বড়সড় খানাপিনার আয়োজন করবেন আর সেখানে নিজের পার্টনার রাখেশ আর তাঁর মেয়ে জয়নবকেও ইনভাইট করবেন।তারপর বুরাগের সাথে আলাপ করিয়ে দিবেন।ছেলে তো আর এই বিয়েটা মন থেকে মানে না।ভাবতেই মুখে মেকি হাসি ফুটে উঠলো।

বুরাগ আর কিছু বলে না।প্লেটের অর্ধেক ডিমটা খেতে থাকে।পরিবেশ টা একদম নিরব হয়ে গিয়েছে।স্নিগ্ধা নিজের ডান পা টা বুরাগের বাম পায়ের উপর তোলে দিলো।নিজের পা টা দিয়ে বুরাগের পা টায় চেপে ধরে আছে।এমন হওয়াই বুরাগ বিরক্তি নিয়ে তাকালো স্নিগ্ধার দিকে।স্নিগ্ধা নিচের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।বুরাগ নিজেকে শক্ত করে পা দুটো সরিয়ে চেয়ারের নিচে দিয়ে দিলো।স্নিগ্ধাও দমে যাওয়ার মেয়ে না।নিজের ডান হাত টা দিয়ে বুরাগের উরুর উপর রেখে স্লাইড করতে লাগলো।স্নিগ্ধার এমন আচরণে বুরাগের রাগের মাত্রা যেনো বেড়ে উঠলো।ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধার গালে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে দিতে।কিন্তু,সামনে বাবাকে দেখে এমন ইচ্ছাটাকে বাধ্য হয়ে দমিয়ে রাখলো বুরাগ।তাই,টেবিলের নিচ দিয়ে বুরাগ স্নিগ্ধার হাত টা চেপে ধরে নিলো।আর,দাঁতে দাঁত চেপে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু,স্নিগ্ধা এখনো আগের মতো মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে।স্নিগ্ধার হাসি দেখে বুরাগ স্নিগ্ধার দিকে ভ্রুকুঁচকে তাকিয়ে আছে।

বেলীর চোখ দুটো আটকে গিয়েছে বুরাগ আর স্নিগ্ধার হাতের ভাজের উপর।আবারও মনে পড়ে গেছে কালকের ঘটনাটা।তাদের কাছের আসার দৃশ্য টা।ভিতর টা যেনো আবারও জ্বলে উঠলো।আবারও কষ্ট হতে লাগলো।একটু আগে যখন বুরাগ ওইসব কথা গুলো বলে তার কানের লতিতে কামড়ে দিয়েছিলো তখনও তার মনের গহীনে একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছিলো।আবারও সেই অনুভূতি টা নিজের মনের গহীন থেকে মিহিয়ে গেলো।অনুভূতি গুলো জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই যেনো মরে যাচ্ছে।বুক ফাটিয়ে কান্না করতে ইচ্ছা করছে তার।ছলছল চোখে বুরাগের দিকে তাকিয়ে আছে।

বুরাগও এখনো স্নিগ্ধার হাত টা জোরে চেপে ধরে আছে।না হলে আবারও আগের মতোই অসভ্যতা শুরু করে দিবে।তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাত টা ধরে আছে।হঠাৎ করে বুরাগের চোখদুটো রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেলীর উপর পড়লো।ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।বুরাগের বুঝতে অসুবিধা হয়নি বেলী কেনো এইভাবে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।বেলীর ছলছল চোখ দুটো আর মায়াময় মুখটা দেখে বুরাগের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।সাথে সাথে স্নিগ্ধার হাত টা ছেড়ে দিলো।পাশে থাকা গ্লাস টা নিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো।দ্রুত গতিতে মেইন দরজা পেরিয়ে গাড়ির দিকে যেতে লাগলো।
গাড়িতে এসেই ড্রাইভিং সিটে বসে মাথাটা চেপে ধরলো বুরাগ।চোখের সামনে বেলীর কালকের কান্নামাখা মুখ, আর আজকের ছলছল চোখ দুটো মনে পড়তেই ভিতরটা একদম জ্বলে উঠতে শুরু করলো।।আবারও আর একটা ভুল করে বসলো সে।ড্রাইভিং সিটটায় মাথাটা এলিয়ে দিলো।হঠাৎ পাশের সিটটায় তার চোখ পড়লো।কালকের কিনা বেলী ফুলের গাঁজরা গুলো মজে গিয়ে অবহেলা ভাবে পড়ে আছে।বেলী ফুলের গাঁজরা গুলোর কথা বুরাগ একেবারেই ভুলে গিয়েছিলো।তার উপর গত কাল রাতে বাসায় অনেক দেরিতে ফিরাতে নিতেও ভুলে গিয়েছে।গাঁজরা গুলোকে নিয়ে জানালার বাহিরে ফেলে দিতে গিয়েও আবার থেমে যায় বুরাগ।মনে মনে ভেবে উঠলো,এই শুষ্ক বেলী ফুল গুলো তার নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দিবে।যতোই হোক বেলীর জন্য এইটাই তো প্রথম কিনেছিলো সে।আজকে না হয় ১০০ টা তাজা বেলীফুলের গাঁজরা নিয়ে আসবে।ভেবেই মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।
—————————————
শিউলির আজকে স্কুলের ক্লাস গুলো একদম ভালো লাগছে না।কিছুতেই মন বসাতে পারছে না।গালে হাত দিয়ে বসে আছে আর চোখ দুটো দূরের মাঠে গিয়ে আটকে আছে।মাঠের মধ্যে গ্রামের ছেলেরা একজোঁট হয়ে বসে আছে।তার মধ্যে কালো গেঞ্জি পড়া করিমের দিকে বারবার তাকাচ্ছে শিউলি।করিমের গাওয়া কালকের গানটা হুট করেই মনে পড়ে যায় তার।আবারও মুখটাতে লজ্জা এসে ভর করলো।মাঠটার পাশেই বড় টিউবওয়েল।কেনো জানি তার খুব যেতে ইচ্ছে করছে করিমের আশপাশটায়।খুব কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে করিমকে।শিউলি অনেকটাই সাহস করে উঠে দাঁড়ালো।হাত দুটো কচলাতে কচলাতে বললো,

–“ম্যাডাম আমি একটু পানি খেতে যাবো।”

ম্যাডাম চশমাটাকে একটু ঠিক করে গম্ভীর গলায় বললো,

–“যাও।”

যাওয়ার অনুমতি পেয়ে শিউলি অনেকটাই খুশি হয়ে যায়।মাঠের পাশের টিউবওয়েল টার দিকে দৌড় লাগায়।টিউবওলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শিউলি।বারবার আড়চোখে করিমকে দেখছে।

করিম মাঠে বসে আড্ডা দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলো।হঠাৎ করে টিউবওয়েলের পাশে শিউলিকে দেখে অনেকটা চমকে উঠলো।তার উপর শিউলি যে তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে তা দেখেই মুখটায় একটা লালসার হাসি ফুটে উঠলো।হাত উঁচিয়ে শিউলি কে ইশারা দিয়ে নিজের উপস্থিতি বোঝালো।করিমের ইশারা পেয়ে শিউলির মুখটায় আপনাআপনিই হাসি ফুটে উঠলো।

আজকে অনেকটাই তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করেছে বুরাগ।তবুও ঘড়ির কাঁটা ১২ টায় চলে গিয়েছে।আরো একটু দেরি হয়ে গিয়েছে তার কারণ হলো ১০০ টা বেলী ফুলের গাঁজরা খুঁজতে গিয়ে।বুরাগের মনটা আজকে অনেক খুশি লাগছে।দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।দরজা টা ঠেলে রুমে ঢুকে নিঃশব্দে আবার দরজা টাও লাগিয়ে দিলো।সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।কিন্তু,বিছানা আর ফ্লোরে নিজের অতীতের স্মৃতি গুলো পড়ে থাকতে দেখে বুরাগের যেনো নিমিষেই রাগ উঠে গেলো।স্নিগ্ধা আর তার সব গুলো ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।নিজের ব্যক্তিগত কোনো কিছুতে অন্যকারোর হস্তক্ষেপ করাটা একদমই পছন্দ করে না বুরাগ।এইসবে কারোর হাত দেয়ার সাহস নেই এমনকি নিজের মারও না।এই রুমে বেলী ছিলো এতোক্ষণ।বুরাগের আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি এইসব বেলীই করেছে।বুরাগ রাগে গাঁজরা গুলো বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বারান্দার দিকে রওনা হলো।

বারান্দার দেয়াল ঠেসে বসে আছে বেলী।হাতে বুরাগ আর স্নিগ্ধার হাসি উজ্জ্বল একটা ছবি।স্নিগ্ধার কাঁধে বুরাগ মাথা ঠেকিয়ে নদীর পাড়ে বসে আছে।ছবিটা দেখতেই বেলী নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো।আজকে নিজের কাপড়চোপড় বুরাগের আলমারিতে রাখতে গিয়ে এইসব ছবি গুলো নিজের সামনে পড়ে।যেগুলো বেলীর মনে আগুন জ্বালাতে সক্ষম।তারপর থেকেই এইভাবে বসে আছে।নিচেও যায়নি এমনকি খাবার টুকুও পর্যন্ত খায়নি।ফুপি ডাকতে এসেছিলো ইনিয়েবিনিয়ে অনেক কিছু বুঝিয়ে না করে দিয়েছে।

বুরাগ রাগে এসে থামলো বারান্দায়।রাগে বারান্দায় থাইগ্লাস টা জোরে সরিয়ে দিলো।কিন্তু সামনে বেলীকে দেখতে না পেয়ে রাগ টা যেনো আরো বেড়ে উঠলো।বারান্দার এককোনায় বেলীকে চুপটি করে বসে থাকতে দেখে বুরাগের ভিতর টা কেমন ছ্যাঁত করে উঠলো।আস্তে করে বেলীর পাশে হাটুগেড়ে বসে পড়লো।বেলীর গাল টা ধরে নিজের দিকে ফিরালো।বেলীর চোখের পানিটায় বুরাগের রাগ যেনো অনেকটাই উধাও হয়ে গিয়েছে।বেলীর হাতে তার আর স্নিগ্ধার ছবিটা দেখে বুঝতে পেরেছে বেলী এইটা দেখেই এতোক্ষণ কান্না করেছে।বুরাগ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

–“বেলী উঠো!”

বেলী হুট করে বুরাগকে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগের বুকে একপ্রকার যেনো লুটিয়ে পড়লো।কান্না করতে করতে বললো,

–“বিশ্বাস করুন আমি এইসব সহ্য করতে পারছি না।আপনাকে অন্যকারোর সাথে আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছি।আপনাকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি।”

বুরাগ বেলীর ক্রন্দনরত কথাগুলো শুনে মুখে রোদের ঝলমলানির মতো একটা হাসি ফুটে উঠলো।বেলীকে কোলে তোলে নিলো।বুরাগ কোলে নেওয়াতে বেলী কান্না থামিয়ে নিজের মুখটা বুরাগের বুকে গুজে দিলো।তবে একটু পর পর কেঁপে উঠছে।

বেলীকে কোলে করে নিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে দিলো।নিজের শরীরের ভার টাও বেলীর উপর ছেড়ে দিলো।বুরাগ তার মুখটা বেলীর গলার ভাজে ডুবিয়ে দিয়ে বললো,

–“স্নিগ্ধার সাথে আমার এখন কোনো সম্পর্ক নেই।স্নিগ্ধা আমার প্রাক্তন প্রেমিকা।এইসব ছবি গুলো অনেক আগের।তখন আমি সবেমাত্র ভার্সিটি পড়ুয়া উড়ন্ত এক যুবক।”

বেলী আরো কিছু বলতে নিলেই বুরাগ বেলীর গলা থেকে মুখটা তোলে নিলো।বেলীর ঠোঁট দুটোতে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরল।কিছুক্ষণ শুষে নিয়ে আবারও চোখ তোলে বেলীর দিকে তাকালো।বেলী চোখ দুটো বুজে রেখেছে।বুরাগ একটা মুচকি হাসি দিয়ে বেলীর কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

–“হুশ!এখন আর এসব কথা হবে না।”

পুনরায় আবারও বেলীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো।শুষে নিতে লাগলো বেলীর ঠোঁট দুটো।আবারও নামহীন ভালোবাসার অনীল এক সাগরে ডুব দিতে লাগলো।যতোই গভীরে যাচ্ছে ততই বুরাগ বেলী দুজনেই অনেকটা বেসামাল হয়ে উঠছে।তবে বেলীর অভিমান আগের থেকে কমেনি বরং কালকের অভিমান সহ আজকের অভিমানের পাল্লাটা মনে আর একটু ভারী হয়ে উঠেছে।যা ভাঙাতে অনেকটায় হিমশিম খেতে হবে বুরাগকে।

চলবে..

(কালকে রঙতুলি দিবো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here