উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-৫

0
3997

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৫)
#কুরআতুল_আয়েন

একপ্রকার ঝড়ের গতিতেই বুরাগ তার রুমের দরজা টা খুললো।অস্থিরতা নিয়েই রুমের আশপাশ টায় চোখ বুলাচ্ছে।কিন্তু রুমে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির দেখা পাচ্ছে না।এতে যেনো অস্থিরতা আরো একটু বেড়ে গেলো।মনে মনে শুধুই একটা প্রশ্ন জাগছে,বেলী কোথায়?এই দিক দিয়েই তো দৌড়ে গেলো।মাথাটা চেপে ধরে ফেলে বুরাগ।মনের ভিতরটা তার খুব জ্বালা করছে।আবারও আগের মতোই রুম থেকে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসলো।কিন্তু কথা হচ্ছে কোথায় খুঁজবে এখন বেলীকে।এতো রাতে কি মা’র রুমে যাবে?ভেবে পাচ্ছে না বুরাগ।কি করবে এখন,কোথায় খুঁজবে।এক নিমিষেই কোথায় উধাও হয়ে গেলো মেয়েটা।

অনেক ভেবে চিন্তা করে সামনের দিকে পা বাড়ালো বুরাগ।কিছুটা দূর আগাতেই স্টোর রুমের দরজা টা আধ খোলা পেয়ে অনেকটাই চমকে যায়।দরজাটার কাছে এসে দাঁড়ালো।অর্ধখোলা দরজা টা আস্তে করে পুরোপুরি খোলে দিলো।আবছা আলোয় কোনো মেয়ের অবয়ব দেখে বুরাগ সেদিকেই এগিয়ে গেলো।বেলীকে বিধস্ত অবস্থায় বসে থাকতে দেখে বুরাগের হৃদয়ের গহিনে যেনো কেউ ছুরি দিয়ে আঘাত করছে।ভিতর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বেলীর কাছে এগিয়ে গেলো।নিঃশব্দে বেলীর পাশে গিয়ে বসে পড়লো।

নিজের পাশে কারোর উপস্থিত টের পেতেই বেলী পাশে ফিরে তাকালো।পাশে বুরাগকে বসে থাকতে দেখে চোখের সামনে সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা ভেসে উঠলো।ভিতর টায় যেনো কষ্টের বেগ টা বেড়ে উঠলো।পারছে না বেলী এই কষ্টটা থেকে বের হয়ে আসতে।কষ্টটা কিছু কমানোর জন্য ঠোঁট কামড়ে নাক দিয়ে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো।কিন্তু না কষ্ট কমার থেকে যেনো আরো বেড়ে গেলো।চোখের কার্ণিশ বারবার ভিজে উঠছে।গাল অবধি বেয়ে আসার আগেই বেলী তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো।চুপ করে চেয়ে আছে স্টোর রুমের সামনের দেয়ালটার দিকে।

বুরাগ কি বলবে বুঝতে পারছে না।অনেকক্ষণ নিরবে বসে আছে বেলীর পাশে।বেলী একবারও তার দিকে তাকায়নি।ভাবতেই মনটা তার নিমিষেই কালো হয়ে উঠলো।দেয়ালের উপরের দিকে বিদ্যমান লাইট টার আধো আধো আলোয় বেলীকে দেখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তার।বেলীর হলদেটে ফর্সা মুখটায় যে গভীর রাতের নিকষ কালো আকাশটার মতো একরাশ অভিমান এসে যুক্ত হয়েছে তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি বুরাগের।নিজের কাজটায় খুব অপরাধ বোধ করছে সে।স্নিগ্ধার ওই চোখের চাহনি সে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারেনি।এই চোখের চাহনিতেই তো সে স্নিগ্ধার প্রেমে পড়েছিলো।আজকে আবার হুট করে স্নিগ্ধা ওই চাহনি টায় আগের সুন্দর মুহূর্ত গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো।কিন্তু কখনো ভাবেনি স্নিগ্ধা এমন একটা কাজ করে ফেলবে।আর,সেও স্নিগ্ধার সাথে তাল মিলিয়ে উঠবে।আর কিছু না ভেবে বেলীর দিকে চেয়ে আছে বুরাগ।

এইভাবে অনেকক্ষণ বসে থাকায় আর কান্নার ফলে মাথাটা খুব ব্যথা করছে বেলীর।এইখানে বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।আর না পেরে উঠে দাঁড়ালো।বুরাগের দিকে একবারও তাকায়নি।মনে মনে ভেবে নিয়েছে এই রুমটায় সে একা।আর কারোর কোনো অস্তিত্ব নেই এই রুমে।বেলীর এইভাবে উঠে পড়ায় বুরাগ কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়।এতোক্ষণ বেলীতেই মগ্ন ছিলো সে।বেলীর মায়াময় মুখটায় দারুণ এক মগ্নতা খুঁজে পেয়েছে।কিন্তু,তার মগ্নতায় বাঁধা দিয়ে বেলী উঠে দাঁড়াতেই বুরাগ কিছু না বলে শুধু বসা থেকে বেলীর মুখপানে চেয়ে আছে।বেলী বুরাগকে অতিক্রম করেই চলে আসতে নিলেই বুরাগ বেলীর আঁচল টেনে ধরলো।

কিছুদূর আগাতেই বেলী নিজের আঁচল টায় টান অনুভব করলেও পিছনে ফিরে তাকায়নি।তার আঁচল টা যে বুরাগ ধরেছে তা তার সম্পূর্ণ জানা।তাই তো বেলী সেই মুখের দিকে তাকাতে চায় না।বুরাগ বেলীকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁচল টা হাতে ধরে রেখেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।বেলীর কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে শান্ত কন্ঠে
“বউ” বলে উঠলো।

বউ ডাক টা শুনেও বেলীর মধ্যে কোনো ভাবান্তর এলো না।আগের ন্যায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।ওই ঘটনা টা নিজের চোখের সামনে না দেখলে হয়তো বুরাগের আজকের বউ ডাকটা তার মনের কোণের সুপ্ত অনুভূতি টা যেনো আরো একটু জমে যেতো।আগের থেকে গাল দুটো মনে হয় লজ্জায় আরো লাল হয়ে যেতো।লজ্জার জন্য হয়তোবা বুরাগের কাছে আসতোও না।কিন্তু,সামন্য কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এইসব কিছু কেমন উলোটপালোট হয়ে গেলো।বুরাগ বেলীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আঁচল টা ছেড়ে দিয়ে বেলীর হাত ধরে নিজের দিকে ফিরালো।তবুও বেলীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসলো না।বুরাগ বেলীর হাত টা ছেড়ে দিয়ে নিজের বিশাল বড় হাতদুটো দিয়ে বেলীর মুখটাকে নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নিলো।বেলী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।বুরাগের এমন স্পর্শে বেলীর কোনো অনুভূতিই কাজ করছে না।নিজের মনের ভিতর এক বড় পাথর জমে আছে।

–“বউ কথা বলো আমার সাথে।”

বেলী একটাবারও বুরাগের দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছে না।এমনকি তার কানে বুরাগের কথাগুলো যেনো বিষের মতো লাগছে।আর বুরাগকে বিষধর সাপ।অনুভূতিরা সব যেনো মরে গেছে বিষধর সাপের বিষের প্রকোপে।বুরাগ বেলীর মুখটা আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে বললো,

–“আমার মনের গহীনের জমে থাকা মেঘ গুলো একটু একটু বর্ষণের দেখা মিলছিলো।আর,সেই বর্ষণকারী হলে একমাত্র তুমি।আমি চাই আমার মনের মেঘ গুলো যেনো পুরোপুরি বর্ষণে পরিনত হয়।আমি একটু শান্তি চাই।সুখ চাই।এইসব কিছু আমি তোমার কারণে উপলব্ধি করতে পেরেছি।”

বুরাগ কথা গুলো বলেই বেলীর মুখ ছেড়ে দিয়ে বেলীকে জাপটে জড়িয়ে ধরলো।বেলীর গলায় মুখ গুজে দেয়।এবার বেলী একটু নড়েচড়ে উঠলো।বুরাগের আগের কথাগুলো অনুভব করতে লাগলো।কি এমন কারণে বুরাগের মনে মেঘ জমেছে তা ভেবে পায় না বেলী।বেলীর গলায় ভেজা অনুভব হতেই বুঝে নেয় বুরাগ কান্না করছে।বেলীর হুট করেই মনে পড়ে যায় শ্বাশুড়ি আফিয়ার কথা।”যখন কোনো কারণে বুরাগ কষ্ট পায় তখন সে একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।”বেলী অনিচ্ছাকৃত ভাবেই বুরাগের পিঠে হাত রাখে।

নিজের পিঠে বেলীর হাতের ছোঁয়া পেতেই বুরাগ আর একটু শক্ত করে বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

–“বিশ্বাস করো বেলী আমি একটু শান্তি পেতে চাই।তোমার মধ্যেই আমি সেই শান্তির সূচনা খুঁজে পেয়েছি।অচেনা তোমাকে খুব কাছের মনে হচ্ছে।ভরসা করতে ইচ্ছা করছে।স্নিগ্ধা আমার প্রথম ভালোবাসা বেলী।ওকে দেখলে আমার ভিতর টা কষ্টে ফেটে যায়।নিজেকে ঠিক রাখতে খুব কষ্ট হয়।”

আচমকাই বেলী বুরাগকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলো।প্রথম প্রথম বুরাগের কথাগুলো মন দিয়ে কর্ণপাত করলেও স্নিগ্ধার কথাগুলো শুনতেই ভিতর টা আবারও জ্বলতে শুরু করে দিয়েছে।হুট করে চোখের সামনে একটু আগের ঘটনা ভেসে উঠলো।বেলী আর না পেরে হু হু করে কেঁদে দিলো।চোখ দিয়ে তার বাঁধাহীন ভাবে পানি পড়ছে।গাল বেয়ে বেয়ে গলায় এসে থামছে।বুরাগের চোখের কোণে পানির ছোঁয়া।বেলী তাকে সরিয়ে দেওয়ায় বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো।হঠাৎ করেই রাতের এমন শান্তশিষ্ট পরিবেশে বেলীর কান্নাটা যেনো এক ভয়ংকর শুনাচ্ছে।যে কেউ শুনলে ভয় পেয়ে যাবে আবার সেই সাথে বুকে গিয়েও বাঁধা খাবে।ঠিক এমনটাই হলো বুরাগের সাথে প্রথমে ভয় পেয়ে গেলেও ঠিকই পরে বুকে গিয়ে লেগেছে।বুরাগ বেলীর কাছে আসতে নিলেই বেলী পিছিয়ে যায়।হাত উঁচু করে থামিয়ে দিলো।কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“একদম আমার সামনে আসবেন না আপনি।আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

বেলীর কান্নার বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে।তাও কোনোরকমে কান্না টা থামিয়ে আবারও কিছুটা চেঁচিয়ে বললো,

–“কেন বিয়ে করেছিলেন আমাকে?মা যখন আপনাকে বাধ্য করেছিলো তখন কেন না করতে পারেননি।তখন কেন বলেননি আপনার ভালোবাসার কথা?আমি মুক্তি চাই।এইসব আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।আপনার সাথে আপনার প্রেমিকার এইসব লীলা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না।”

বেলী তেড়ে এসে বুরাগের শার্টের কলার চেপে ধরলো।শার্টের কলার অনেকটা জোরেই চেপে ধরেছে।যার ফলে শার্টের গলার কাছের বোতাম টা ছিড়ে গিয়ে নিচে পড়ে যায়।এতে বেলীর কোনো মাথা ব্যথা নেই।বুরাগ নিষ্পলক চেয়ে আছে বেলীর দিকে।শান্ত মেয়েটা যে রেগে গিয়ে এমন পাগল হয়ে যাবে তা ভেবেই মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো।আচ্ছা!বেলী কি তাকে স্নিগ্ধার সাথে দেখে কষ্ট পেয়েছে?তার মানে কি বেলী তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো।কথাটা ভাবতেই বুরাগের মনটায় একটু শান্তির নিঃশ্বাস পেলো।কেন পেলো তা বুরাগের অজানা।

–“আপনি পারতেন আমাকে এইভাবে অন্যকারোর সাথে দেখতে?”

কথাটা শুনেই বুরাগ একরাশ চমক নিয়ে তাকালো বেলীর দিকে।কথাটা আবার কানে বাজতেই চোখ,মুখ একদম শক্ত করে ফেললো।

পরক্ষণেই বেলী মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলে উঠলো,

–“আমিও না একদম বোকা।যার মনে আমার জন্য কোনো জায়গা নেই তার কেনো খারাপ লাগবে আমাকে এইভাবে দেখে।আমি যদি পতিতালয়েও যাই এতে তার কোনো কিছু যায় আসে না।”

কথাটা শেষ করতে না করতেই বেলীর গালে সজোড়ে একটা থাপ্পড় পড়লো।থাপ্পড়ের প্রকোপ টা একটু বেশি জোরে হওয়ায় বেলী দুকদমের মতো পিছিয়ে যায়।চোখ দিয়ে তার পানি পড়লেও মুখে তার কোনো কথা নেই।এই বিয়েটা কিছুতেই করতে চেয়েছিলো না বেলী।বিয়ের দুদিনের মধ্যেই বেলী বুরাগের প্রতি অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে।বুরাগের স্পর্শ গুলো তার মনটায় ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে।ভালোবাসা তো হুট করেই হয়ে যায়।ভালোবাসার তো কোনো সময়,দিনকাল থাকে না।বেলী তো তার বরকেই ভালোবেসে ফেলেছে।কোনো ভুল তো করেনি সে।কিন্তু,নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে অন্যএকজন কে দেখে কী করে নিজেকে ঠিক রাখবে?বেলীর নিজেকে কেমন একটা পাগল পাগল লাগছে।মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে।

বুরাগ রাগে তাকিয়ে আছে বেলীর দিকে।পতিতালয়ে যাওয়ার কথাটা শুনে তার চোয়াল আপনাআপনিই শক্ত হয়ে গেছে।কিন্তু বুকের ভিতর তার ঝড় বেয়ে যাচ্ছে।যখন বেলী তার নিজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মেরেছিলো,”এইরকম ঘনিষ্ঠ অবস্থায় অন্য কারোর সাথে বেলীকে দেখতে পারবে কিনা।”এই কথা টা শুনেই বেলীর প্রতি তার নিজের ফুফার লালসাযুক্ত চেহারাটা ভেসে উঠলো।তার ফুফা যে বেলীকে পেতে চায় তা তো তার কাছে অজানা নয়।তাহলে কি বেলীও স্নিগ্ধার মতো তাকে ছেড়ে চলে যাবে তার ফুফার ভালোবাসার ফাঁদে!অবশ্য,বুরাগ বেলীর নিষ্পাপ চেহারা টায় চোখ বুলিয়ে নিজের মনকে স্বান্তনা দেয় বেলী এইরকম করবে না।বেলী তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।বেলীর চোখে তাকে হারানোর কষ্ট দেখতে পারছে।বেলীর কান্নাই বলে দিচ্ছে আজকের ঘটনা টা বেলী কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি।এইসব ভেবেও কিছুতেই নিজের মনকে স্বান্তনা দিতে পারছে না বুরাগ।মনে বারবার ভয় জেঁকে বসছে।কিছুটা পাগলের মতো এগিয়ে গেলো বেলীর কাছে।বেলীর কোমড়া টা নিজের সাথে চেপে ধরলো।বেলীর থুঁতনিটা ধরে মুখটা উঁচু করে তোলে মায়ামাখা দৃষ্টিতে বললো,

–“একটু কাছে আসার অধিকার দিবে বউ।”

বুরাগের কথায় পিলে চমকে তাকালো বেলী।মনের ভিতর দিয়ে শিরদাঁড়া বয়ে যাচ্ছে।বুরাগের দৃষ্টি কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারছে না।এই দৃষ্টি বলে দিচ্ছে বুরাগ তার অনেক কাছে আসতে চায়।বেলী আর না পেরে বুরাগকে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগও শক্ত করে বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।নিজের চোখে পানিটুকু মুছে বেলীর গলার ভাজে মুখ ডুবিয়ে দিলো।বেলীকে নিজের অনেক গভীরে নিয়ের যাওয়ার উন্মাদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে বেলীকে আজকে নামহীন এক ভালোবাসার গভীরে নিয়ে যেতে লাগলো।বেলীর মনের অভিমান টা না কমলেও বুরাগের কাছে আসাটায় ঠিকই সে উন্মাদ হচ্ছে।এইভাবেও যদি নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পাওয়া যায়,ভালোবাসা যায় তাতে ক্ষতি কি!

মাঝরাত!চারপাশ নিস্তব্ধ।স্টোর রুমের ছোট জানালা টার কাছে দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ।ঘন কালো আকাশ টার দিকে তাকিয়ে আছে।আকাশে নেই কোনো তারা,এমনকি ঘন কালো মেঘের তাড়নায় চাঁদ টাও দেখা যাচ্ছে না।একবার সামুদ্রিক প্রানীর মতো উঁকি মেরে মিহিয়ে যাচ্ছে।নিজের মনটায় কিছুতেই শান্তি ফিরে পাচ্ছে না।দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিছানার দিকে তাকালো বুরাগ।বিছানার মাঝখানটায় বেলী বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে।শরীরটায় শুধু পাতলা একটা চাদর টানা।সারা রুম জুড়ে তার আর বেলীর কাপড় ছড়িয়ে আছে।নামহীন এক ভালোবাসার অনীল সাগরের গভীরে ডুব দিয়েও বুরাগের মন থেকে কিছুতেই ভয় সরাতে পারছে না।বারবার,কানে বেজে উঠছে বেলীকে অন্যকারোর সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখতে পারবে কিনা।কথাটা মনে পড়তেই ভিতরটা মনে হয় কয়লার মতোন জ্বলে উঠে।বুরাগ বেলীকে ভালোবাসতে না পারলেও তাকে কিছুতেই ছেড়ে থাকতে পারবে না।এই সম্পর্কের কি নাম দিবে বুরাগ তাও ভেবে পাচ্ছে না।ধীরগতিতে বেলীর কাছে এগিয়ে গেলো।নিজেও পাতলা চাদরের আস্তরণে ঢুকে পড়লো।বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে পলকহীন ভাবে।বেলীর চোখের কোণে শুকিয়ে থাকা পানির দাগটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।মেয়েটা যে তাকে হারানোর কষ্টে,আর তার তীব্র কাছে আসার তেজ সহ্য করতে না পেরে কেঁদেছে তা ভাবতেই বুরাগের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো।এখন কেন জানি তার ভিতর টায় একটু সুখের রেশ পাচ্ছে।

খুকখুক করে কেশে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন পারভীন।ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা।এতেই যেনো পেট অনেকটাই ফুলে উঠেছে।আর ফুলে উঠবেই না কেন দুই দুইটা বাচ্চা তার পেটে বেড়ে উঠছে।বিছানার সাইড বক্স টায় হাতড়িয়ে পানির খোঁজ লাগান।কিন্তু বিছানার সাইড বক্সে পানির সন্ধান পেলেন না।তবে সামনের বুক সেলফের পাশে রাখা টেবিলটার উপর নীল কালারের পানির বোতলটা দেখতে পারছেন।উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছে উনার।পাশে ফিরে স্বামী লিটন কে ডাক দেওয়ার জন্য ঘুরতেই পাশের জায়গাটা ফাঁকা দেখতে পান।কিছুটা চিন্তিত হয়ে যান স্বামীকে দেখতে না পেয়ে।মাথাটা একটু উঁচু করে পাশের সাইড টেবিলটায় খোঁজ লাগালেন।ফোনটা দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন।এরিমধ্যেই বাথরুমের দরজা ভেদ করে লিটন বের হয়ে আসলো।হাতে তার তোয়ালে।তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বিছানায় চোখ পড়লো।বিছানায় আধবসা স্ত্রীকে দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।
পারভীন কিছুটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে লিটনের দিকে।বুঝাই যাচ্ছে গোসল করে বেরিয়ে এসেছে।লিটন বউয়ের চাহনি দেখে কিছুটা মেকি হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো।তোয়ালেটা টেবিলের সামনের চেয়ারটায় রেখে পারভীনের কাছ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো।

–“আর বলো না।খুব গরম লাগছিলো তাই গোসল করে নিয়েছি।এখন একটু শান্তি লাগছে।”

পারভীন পাশে চোখ বুলিয়ে এসির পাওয়ার টা দেখে নিলেন।গরম লাগার মতো এসির পাওয়ার দেওয়া নেই।কেন জানি স্বামীর কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না।তেমন কিছু না বলে মুখে শুধু ছোট করে উত্তর দিলেন,

–“ওহহ!”

লিটন পারভীনের ফোলা পেটটায় চুমু খেয়ে বলে উঠলো,

–“আমার বাচ্চারা।”

–“ভাবছি এইখানে কিছুদিন থেকে যাবো।বাসায় আমার একা থাকতে ভালো লাগে না।এইখানে আফিয়া ভাবি আছে কোহিনূর ভাবি আছে।তাদের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে।তাছাড়াও বুরাগ নতুন বিয়ে করেছে।বেলী মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।বুরাগের সাথে বেলীকে খুব মানিয়েছে।”

লিটন পারভীনের কথাটা শুনে মুখে একটা কামনার হাসি ফুটে উঠলো।মুখে হাসি টেনেই বললো,

–“ঠিকাছে!আফিয়া ভাবি আর কোহিনূর ভাবির কাছেই থেকো।আর,আমিও থাকছি তোমার সাথে।”

–“তুমি থাকলে অফিস কে করবে?”

–“আমি এইখান থেকেই গিয়ে করবো।নিজের বউ বাচ্চাদের ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে।আমিও তো একটা মানুষ।আমারও তো মন আছে তাই না।”

পারভীন লজ্জা পেয়ে লিটন কে কিছুটা লজ্জামিশ্রিত হাসি টেনে বললেন,

–“শ্বশুড় হয়ে গেছো অথচ তোমার এইরকম লাগামছাড়া কথা গেলো না।”

লিটন চমকে উঠলো।কিছুটা মিহিদানা গলায় বললো,

–“বুঝলাম না তোমার কথা।”

পারভীন বিরক্তির সুরে বললেন,

–“বুরাগ বিয়ে করেছে।আমাদের বংশের প্রথম সন্তান বিয়ে করেছে।আমি তার ফুপি হই।তোহ বুরাগের বউয়ের ফুপি শ্বাশুড়ি না।আর তুমি ফুফা শ্বশুড়।তাই বলছি সবার সামনে যদি এইভাবে লাগামছাড়া কথা বলো তাহলে লজ্জায় পড়তে হবে বুঝলে।”

লিটন মনে মনে বলে উঠলো,ওহহো!আমি তো ভুলেই গেছিলাম আমি ফুফা শ্বশুড়।তাতে কি!বুরাগের বউকে দেখলে তো নিজের পুরুষত্ব ফলাতে ইচ্ছে করে।

–“কোথায় যে হারিয়ে যাও তুমি।আগে একটু পানি খাওয়ায় তো।”

পারভীনের আওয়াজ পেয়ে লিটন কিছুটা চমকে উঠলো।তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে পানির বোতল টা আনার জন্য বিছানা থেকে উঠে পড়লো।
————————–
চন্দরনগর গ্রামটিতে হেমন্তের রেশ।কৃষকেরা নতুন ধান কেটে ঘরে তুলছে।গ্রামের চারপাশটা ধানের রঙে ভরপুর।জাবেদা উঠোন পেরিয়ে সামনের সরু রাস্তাটির দিকে এগিয়ে এলেন।মাথার কাপড় টা টেনে কপাল পর্যন্ত টেনে নিলেন।শিউলির স্কুল থেকে অনেকক্ষণ আগে আসার কথা কিন্তু এখনো আসছে না।অবশ্য মেজো ভাসুরের ছেলে সবুজও আসে নি।শিউলি আর সবুজ দুজনেই একসাথে স্কুল ছুটির হওয়ার পর বাড়ি ফিরে।জাবেদার তাও কেমন জানি চিন্তা হচ্ছে খুব।বেলী চলে যাওয়ার পর বাড়িটা একদম মনমরা হয়ে গিয়েছে।শিউলিও যেনো তার বোনের চলে যাওয়ায় অনেকটাই একা হয়ে গিয়েছে।তাই স্কুল ছুটির হওয়ার পর সবাই মিলে অনেকক্ষণ খেলাধুলা করে বাড়ি ফিরে।এতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।দেরিতে ফিরলেও জাবেদা বকেন না।তবে আজকে অন্যদিনের তুলনায় অনেকটাই দেরি হচ্ছে।সামনের পুকুরটায় মহিলারা এক জোট বেঁধে গোসল করছে।পুকুরের মধ্যে থেকে একজন মহিলা জাবেদাকে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

–“কি গো জাবেদা!ছোড মাইয়ার লাইজ্ঞা খাড়াই আছো?”

জাবেদা মুখে সৌজন্যমূলক হাসি টেনে বললেন,

–“আসলে ছোট মানুষ তো তাই আর কি।”

মহিলাটি পুকুর থেকে উঠে সিমেন্টের তৈরি সিড়িগুলোতে বসেন।ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পড়ায় আর ভিজা থাকা শাড়িটা একদম গায়ের সাথে লেপ্টে আছে।সবকিছুই স্পষ্ট বিদ্যমান।পুকুরের পাশের সরু রাস্তাটা দিয়ে কৃষকেরা মাথায় ধানের আঁটি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন।তারা একবার পুকুরের দিকে তাকিয়ে আবার তাদের মতো করে হেঁটে যাচ্ছেন।জাবেদা লজ্জায় শাড়ির আঁচল টা দিয়ে মুখ ঢেকে নিলেন।মহিলাটা পঁচা সাবানটা হাতে নিয়ে মুখ বাঁকিয়ে জাবেদাকে বলে উঠলেন,

–“শিউলির বয়সে এহন কতো মাইয়া সংসার করতাছে।ভালা করছো তোমার মাইয়া বেলীরে বিয়া দিয়া।এহন শিউলিরেও দিয়া দাও।সুন্দর মাইয়া ঘরত বেশিদিন রাখতে নাই।”

জাবেদা কিছু বলেন না।চুপ করে মাথাটা নিচু করে চলে আসেন।

গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে শিউলি আর সবুজ।আজকে গোল্লাছুট খেলতে গিয়ে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।সদ্য কিশোরীতে পা দেয়া শিউলির মনটা বেশ উড়ুউড়ু করছে।দুপুরের কড়া রোদের মৃদু বাতাসটায় বেশ ভালো লাগছে তার।সবুজের হাতে গুলতি।সে গুলতি মারতে মারতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।শিউলি একটু নিচু হয়ে পায়ের কাছে লজ্জাবতী গাছের ফুলটা সাবধানতার সাথে ছিড়ে কানে গুজে দিলো।আবারও আগের মতো এগিয়ে গেলো।

–“শিউলি”

কারোর ডাক পেয়ে পিছনে তাকালো শিউলি।চেয়ারম্যানের ছেলে করিমকে দেখে অনেকটাই উশখুশ করতে থাকে।আম্মা তাকে বলে দিয়েছে কিছুতেই যেনো রাস্তায় কোনো ছেলের ডাকে না থামে।তারমধ্য চেয়ারম্যানের ছেলে করিমের ডাক তো আরো না।শিউলি করিমের ডাক উপেক্ষা করে সামনে হাঁটা ধরলো।করিমও নাছোড়বান্দা।সেও শিউলির সামনে দৌড়ে এসে থামে।শিউলির পাশে হাঁটা ধরে বললো,

–“চাচি কিন্তু বেলীরে বিয়া দিয়া ঠিক করে নাই।”

শিউলি করিমের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,

–“এই কথাটা আম্মাকে গিয়ে বলেন করিম ভাই।শুধু শুধু আমার পথ কেন আটকে আছেন।”

শিউলির কথাটা শুনে করিম তাকালো পাশে থাকা সদ্য কিশোরী শিউলির দিকে।রোদে শিউলির মুখটা একদম লাল হয়ে আছে।করিম কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।কেমন যেনো একটা নেশা ধরে যাচ্ছে তার শিউলির প্রতি।তবে তা ভালোবাসার নেশা না শরীর ভোগ করার নেশা।
শিউলি আর কথা না বলে জোরে হাঁটা ধরলো।করিম শিউলির হাঁটা দেখে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠলো,

–“চুমকি চলেছে একা পথে সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে!”

করিমের গাওয়া গান শুনে শিউলি পিছনে তাকালো।করিমকে বুকে হাত দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখটায় একটা লজ্জার হাসি ফুটে উঠলো।সামনে ফিরেই শিউলি বাড়ির পথেই দৌড় লাগায়।

এদিকে করিম শিউলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে চিন্তা করে উঠলো,”বেলীকে না পাওয়ার ক্ষোভটা সে শিউলিকে দিয়ে মিটাবে।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here