উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-৪

0
4632

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৪)
#কুরআতুল_আয়েন

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে বেলী আর বুরাগ।বেলী চুপটি করে মাথা নিচু করে আছে।পায়ের বুড়ো আঙুল টা সাদা ফ্লোরটায় চেপে ধরে আছে।সামনে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।বুরাগ যে তার উপর রেগে আছে তা তখনই বুঝে ফেলেছিলো বেলী,যখন তার কাঁধ চেপে ধরেছিলো।বুরাগ বেলীর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে পুনরায় দরজার কাছে ফিরে গেলো।দরজাটা সজোরে শব্দ করে লাগিয়ে বেলীর কিছুটা কাছে এসে বুকে হাত গুজে দাঁড়ালো।বুরাগের উপস্থিতি নিজের এতো কাছে অনুভব করতেই বেলী পিলে চমকে তাকালো সামনের দিকে।বুরাগ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।কিন্তু,বাদামি রঙের চোখের মনিগুলোর পাশে সাদা অংশ টা ঠিকই লাল হয়ে আছে।বুরাগের চোখ গুলো এইভাবে দেখতেই বেলী ভয়ে জড়সড় হয়ে কিছুটা পিছিয়ে আসলো।কিন্তু,বেশি দূর যেতে পারলো না দেয়ালের জন্য তাকে সেখানেই থামতে হলো।বেলীর পিছানো দেখেই বুরাগ একদম বেলীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।বেলী নিজেকে যতোটা সম্ভব দেয়ালের সাথে চেপে রেখেছে।কিন্তু সামনে তাকানোর সাহস টুকু পাচ্ছে না।কেন জানি সামনে থাকাতেই তার খুব ভয় করছে।বুরাগের ওই রক্তের মতো লাল চোখগুলোতে কিছুতেই তাকাতে পারবে না।

বেলীর এমন চিপকে থাকা ভাবটা বুরাগের কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না।রাগ টা যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে উঠলো।তার কাছে মনে হচ্ছে বেলী তার চোখের দিকে ইচ্ছে করে তাকাচ্ছে না।কিন্তু,বেলীর মনে কি চলছে তা তো বুরাগের বোধগম্য নয়।বুরাগ দেয়ালে হাত রেখে বেলীর কানের কাছে শান্ত কন্ঠে বললো,

–“বেলী আমার দিকে তাকাও।”

এই প্রথম বুরাগের মুখে বেলীর নিজের নামটা শুনে বিষ্ময় নিয়ে তাকালো।না হলে তাকে এই মেয়ে বলেই সম্বোধন করতো।তাও আবার বুরাগের এমন শীতল কন্ঠে নিজের নামটা শুনে মনের কোণে এক সুপ্ত অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।বেলী এখনো আগের মতো বিষ্ময় নিয়েই তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।কিন্তু,ঠোঁটের কোণে তার মুচকি হাসি বিদ্যমান।বুরাগ ধীরগতিতে নিজের হাত টা বেলীর আঁচলের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।বুরাগের হাতের দিকে বেলীর কোনো খেয়াল নেই।সে আগের ন্যায় বুরাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে ব্যস্ত।বুরাগ নিজের হাত টা বেলীর আঁচলের কাছে এনে হুট করে জোরে টান মেরে বেলীর বুক থেকে আঁচল টা সরিয়ে দিলো।আচমকাই এইভাবে টান দেওয়াতে সেইভটিপিনের সাথে লেগে বেলীর কাঁধ টায় বেশখানিকটা ছিলে যায়।সাথে শুভ্র সাদা শিপনের শাড়িটা এবড়োথেবড়ো ভাবে ছিড়ে নিচে পড়ে যায়।কাঁধের ব্যথাটা জানান দিতেই বেলী অস্পষ্টস্বরে,’আহহ্’ বলে চেঁচিয়ে উঠলো।বুরাগকে দেখায় এতোটাই মত্ত ছিলো যার দরুন বেলীর নিজের উপর এই আক্রমণ টা বুঝতে পারেনি।তবে এখন কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে নিয়েছে।চোখের কার্ণিশে পানি চিকচিক করছে।কান্নামাখা আর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে বুরাগের দিকে তাকালো বেলী।তার মনে একটাই প্রশ্ন কেন এমন করলেন উনি!তবে এখন বুরাগকে দেখে আগের থেকে বেশ ভয়ংকর লাগছে।গলা ভেঙে কান্না আসছে কিন্তু অনেক কষ্টে কান্নাটাকে দমানোর চেষ্টা করছে বেলী।বুরাগ রাগে গিয়ে বেলীর হাত ধরে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করালো।চোয়াল শক্ত করে চেঁচিয়ে বললো,

–“নিজেকে দেখ এবার আয়নাতে।কেমন লাগছে তোকে।”

বুরাগের কথার কর্ণপাত হতেই বেলী একরাশ চমকপ্রদ হয়ে আয়নার দিকে তাকালো।নিজেকে দেখে খুব অস্বস্তি হচ্ছে।আয়নাতে নিজের এমন প্রতিচ্ছবি দেখে লজ্জায় নিজের মুখটাকে নিচু করে ফেললো।কীভাবে এমন একটা বোকাসোকা কাজ করতে পারলো সে।আয়নাতে আবারও নিজের এইরকম প্রতিচ্ছবি টা ভেসে উঠতেই নিজেই নিজের মনকে ধিক্কার দিয়ে উঠলো।বুরাগ একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে উঠলো,

–“বাহিরের মানুষকে তোর রঙবেরঙের ব্রা দেখিয়ে বেরাবি আর যখন ওরা তোর দিকে কামনার দৃষ্টিতে দেখবে তখন দোষ হয়ে যাবে ওদের।আর তোদের মতো মেয়েদের সাতখুন মাফ হয়ে যাবে।”

বুরাগের এমন খাপছাড়া কথাবার্তায় বেলী নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না।চোখ দুটো ভেঙে তার উপচে পানি পড়ছে।সে তো আর ইচ্ছে করে এইসব করেনি।ভুলবশত হয়ে গিয়েছে।ভাঙা গলায় বললো,

–“আমি জেনেশুনে এইটা করি নি।”

বুরাগ চেঁচিয়ে উঠলো।চেঁচিয়েই বেলীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“চুপ!একদম চুপ।এইজন্যই তো বুনির গায়ে হলুদের সকালে চেয়ারম্যানের ছেলে করিম তোর গোসলখানায় উঁকি মেরেছিলো।আচ্ছা ওই করিম তোকে কি অবস্থায় দেখেছিলো রে?”

বেলী আর সহ্য করতে না পেরে ফ্লোরে হাঁটুগেঁড়ে বসে পড়লো।দুই হাঁটুতে মাথাটা ঠেকিয়ে শব্দ করে কেঁদে দিলো।বাঁধাহীন ভাবে কেদেই যাচ্ছে।নিজের আম্মর কথা খুব মনে পড়ছে।আম্মা কি সহ্য করতে পারতো তার আদরের বেলীর নামে এমন একটা মিথ্যা অপবাদ।সে তো নিজেকে অনেক সংযত করে চলতো।এমনকি বাড়ির কাজের লোকগুলোর সামনেও ইচ্ছাকৃত ভাবে যেতো না সেখানে করিম তো দূরের কথা।ওইদিনের করিমের আচরণ টায় তো মনে একবার হলেও নিজেকে শেষ করে দেয়ার বাসনাও জেগেছিলো।হাঁটুতে মুখ গুজে এখনো কেঁদে যাচ্ছে।এমনকি আগের থেকে কান্নার বেগটা চারগুণ বেড়ে গিয়েছে।

বেলীর কান্না টা বুরাগের বুকে গিয়ে লাগছে।কেন জানি এখন নিজের খুব কষ্ট হচ্ছে।সে তো এইভাবে কথা শুনাতে চায় নি।রাগের মাথায় মুখ দিয়ে যা এসেছে তাই বলেছে।ধীর পায়ে বেলীর দিকে এগিয়ে গেলো।ঠিক বেলীর পিছন বরাবর গিয়ে বসলো।বেলীর কাঁধে চোখ যেতেই বুরাগের নিজেকে কেমন অপরাধী লাগতে শুরু করলো।সেইভটিপিনের আচঁড়ে বেলীর কাঁধটায় অনেকটা কেটে গিয়েছে।নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বুরাগ বেলীর আঘাতের জায়গা টায় নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো।

হঠাৎ নিজের কাঁধে ছোঁয়া পেতেই চমকে উঠলো বেলী।চমকানো অবস্থাতেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে বুরাগকে নিজের এতোটা কাছে দেখে নিজের মনের মধ্যে একরাশ অভিমান এসে ভর করলো।বুরাগের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আনতে গেলেই বুরাগ আরো চেপে ধরলো।বেলীকে নিজের খুব কাছে টেনে এনে থুঁতনিটা বেলীর কাঁধে রেখে কিছুটা নিম্ন গলায় বলে উঠলো,

–“যেহেতু আমি ব্যথা দিয়েছি সেহেতু ব্যথা সারানোর দায়িত্বটা সম্পূর্ণ আমার দায়ভার।”

বেলী তাও নাড়াচাড়া করছে বুরাগের কাছ থেকে ছুটে আসার জন্য।বুরাগ বেলীর এমন ছোটাছুটি দেখে কিছুটা আমোদিত গলায় বললো,

–“বাঘের খাঁচায় বন্দী তুমি।সেখান থেকে এত সহজে তো তুমি যেতে পারবে না।যতই ছোটাছুটি করো না কেন আমি যতক্ষণ না চাইছি তুমি আমার থেকে ছাড়া পাবে না।”

বেলী নাড়াচাড়া থামিয়ে নিজের মাথাটা ঘুরিয়ে বুরাগের দিকে তাকালো।বুরাগের মুখে হাসি নেই আগের মতোই গম্ভীর।মানুষ গম্ভীর মুখেও কীভাবে রস মিশিয়ে কথা বলতে পারে তা বেলী বুরাগকে না দেখলো বুঝতে পারতো না।বেলীকে নিজের দিকে ফিরতে দেখে বুরাগ বেলীর ডান গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বসলো।বুরাগের এমন অদ্ভুত আচরণে বেলী ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে আছে।তাও বুরাগকে পাত্তা না দিয়ে উঠতে যায়।কিন্তু,এতেও বুরাগ বেলীকে বাঁধা দিয়ে নিজের আর একটু কাছে টেনে বেলীর গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো।প্রথম প্রথম বেলী নিজের শক্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করলেও একসময় থেমে যায়।বুরাগ ঠিকই বলেছে ছোটাছুটি করেও লাভ নেই।তাই চুপ করে বুরাগের স্পর্শ গুলো অনুভব করতে লাগলো।

ব্যস্ততম শহরের মধ্যে দিয়ে আপনমনে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে বুরাগ।কিন্তু,কোথাই যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না।যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই।আশেপাশে বড় বড় বাস,ট্রাক তার গাড়িটাকে ফেলে শো শো করে এগিয়ে যাচ্ছে।কিছুটা সামনে আগাতেই বুরাগ গাড়িটা থামিয়ে দিলো।রাস্তার পাশে ফুটপাত।তারপাশেই বিস্তর মাঠ।সবুজের ঘেরা।ঢাকা শহরে এমন খোলামেলা জায়গা পাওয়া খুবই মুশকিল।বুরাগ গাড়ির জানালার কাচ টা নামিয়ে সিটে মাথাটা হেলান দিয়ে রেখেছে।সামনের বিস্তর মাঠটার ছোট ছোট ঘাসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ তার ঘাসে থাকলেও মন ঠিকই বেলীর কান্নামিশ্রিত মায়া মুখটার উপর।মনে তার আজ কোনো কষ্ট নেই আবার আনন্দও নেই।কিন্তু,তার মনে আজকে এক শান্তির অনুভব পাচ্ছে।যখনি সে বেলীর কাছে যায় তখনি নিজের মনটায় এক অদ্ভুত শান্তি ছুঁয়ে দিয়ে যায়।যেটার খুব দরকার ছিলো তার অগোছালো জীবনটায়।তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো বেলীকে সে ডিভোর্স দিবে না।বেলীর মধ্যে সে এক অন্যরকম শান্তি খুঁজে পাচ্ছে।মাঝেমধ্যে চেনা,ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে অচেনা মানুষগুলো আপন হয়ে উঠে।বেলী তো তার কাছে অচেনাই।ঠিকমতো তো কথাও হয়নি।শুধুমাত্র বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবব্ধ হয়েছে।
গাড়ি থেকে নেমে আসলো বুরাগ।পকেটে হাত গুজে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।মাঠের প্রান্ত থেকে বেয়ে আসা মৃদু বাতাসটা খুব লাগছে বুরাগের কাছে।চোখ বন্ধ করে,জোরে শ্বাস নিয়ে উপভোগ করছে।ভিতরে তার বিষাক্ত কষ্ট গুলোকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছে।মিনিট দশেক হলো এইভাবে দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ।সে প্রকৃতির স্বাদ নিতে ব্যস্ত।এইরকম একটা শান্ত পরিবেশে হঠাৎ করে একটা ভ্যান গাড়ির আওয়াজ পেয়ে সামনে তাকালো।মধ্যবয়সী একজন লোক ভ্যান গাড়িটা টেনে নিয়ে আসছেন।ভ্যান গাড়িটা ভর্তি বিভিন্ন ফুলের গাঁজরা।বুরাগ ফুলের গাজরা গুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভ্যানওয়ালার উদ্দেশ্য জোরে গলা ছেড়ে “ও মামা” বলে ডাকলো।

ভ্যানওয়ালা কারোর গলার আওয়াজ পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।ভ্যান গাড়িটা টানা থামিয়ে দিলেন।কপালের মৃদু মৃদু ঘামটা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলেন।ততক্ষণে বুরাগও ভ্যানওয়ালার কাছে এগিয়ে আসলো।কিছুটা উদগ্রীব হয়ে বললো,

–“কি কি ফুলের গাঁজরা আছে মামা তোমার এইখানে।”

ভ্যানওয়ালা মুখে হাসি টেনে বললেন,

–“সবই আছে।তোমার কোনটা চাই বলো।”

বুরাগ অনেকটা উত্তেজিত হয়ে বললো,

–“বেলী ফুলের গাঁজরা হবে মামা।”

–“হ্যাঁ হবে।বলো কয়টা দিবো।”

–“যতগুলো আছে আমি ততগুলোই নিতে চাই।”

ভ্যানওয়ালা বেলীফুলের গাঁজরা গুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন।মুখটাকে প্রসারিত করে বললেন,

–“কার জন্য নিবা বাবা!নিজের প্রেয়সীর জন্য?”

বুরাগ কিছুটা চিন্তায় পড়ে যায়।সে তো বেলীর জন্য বেলী ফুলের গাজরা নিচ্ছে।বেলী কি তার প্রেয়সী?মনে মনে এইসব ভাবলেও মুখে কিছু বলে নি বুরাগ।চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ভ্যানওয়ালা ১০ টার মতো বেলীফুলের গাঁজরা বুরাগের হাতে দিয়ে দিলো।উনি আবারও বুরাগের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন,

–“খুব ভালোবাসো তাই না নিজের প্রেয়সীকে।তোমাকে দেখলেই মনে হচ্ছে খুব ভালোবাসো তুমি তোমার প্রেয়সীকে।”

ভালোবাসার কথাটা শুনতেই বুরাগের মনের ক্যানভাসে স্নিগ্ধার হাসি উজ্জ্বল চেহারা টা ভেসে উঠলো।বুরাগের ভিতর কেমন একটা ছ্যাঁত করে উঠলো।চোখ মুখ শক্ত করে বললো,

–“কতো হয়েছে মামা!”

হঠাৎ করে বুরাগের মুখের চেহারার পরিবর্তন টা ভ্যানওয়ালার চোখে পড়লেও মুখে আর কোনো কথা বলেন নি।পুনরায় হাসি মুখেই বললেন,

–“১০ টা গাঁজরা ১০০ টাকা।”

বুরাগ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ৫০০ টাকার একটা ঝকঝকে নোট ধরিয়ে বেলীফুলের গাজরা গুলো নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।একপলকেই গাড়িটাকে দ্রুত বেগে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলো।ভ্যান চালক একবার চেয়ে মনে মনে বলে উঠলেন,”ভালোবাসার আগুনে পুড়লে ভিতর টা একদম কয়লার মতো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।”

বেলী অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে।মনের সুপ্ত কোণে বারবার বুরাগের স্পর্শ গুলো মনে করিয়ে দিচ্ছে।আনমনেই মুখটাতে লজ্জা এসে ভর করলো।আর ঠোঁটের কোণে লজ্জামিশ্রিত হাসি।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।আগের শাড়িটা পালটিয়ে এখন মিষ্টি কালারের একটা শাড়ি পড়ে নিয়েছে।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলার কাছের রক্তজমাট কালসিটে দাগটা চোখে পড়তেই উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলো।মুখে একটা মুচকি হাসি টেনে দুইহাত দিয়ে মুখটা ঢেকে নিলো।

–“বেলী কি করছো?”

শ্বাশুড়ি আফিয়ার কন্ঠ পেয়ে বেলী কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো।নিজেকে ঠিক করে দ্রুত গতিতে পিছনে তাকালো।শাড়ির আঁচল টা টেনে ঠিক করে নিলো।খোলা চুল গুলোকে গলার কাছে এনে রেখে দিলো।স্বামীর ভালোবাসার চিহ্ন শ্বাশুড়ির চোখে পড়লে বেশ খানিকটা ইতস্তত বোধ করবে সে।তাই নিজেকে যতোটা সম্ভব ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে।নরম সুরে বললো,

–“কিছু করছিলাম না মা!আপনি আসুন”

আফিয়া হাসিমুখে রুমে প্রবেশ করলেন।বেলীকে নিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলেন।বাহিরের মৃদু বাতাসে বারান্দায় বিদ্যমান ফুলের গাছগুলো নিজেদের মতো তাল মিলিয়ে হেলছে দুলছে।আফিয়া গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।বেলীকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে একবার দেখে নিলেন।পলকহীন তাকিয়ে আছেন বেলীর দিকে।নিজের কাছে বেলীকে আজকে একটু অন্যরকম লাগছে।
মুখে লজ্জামিশ্রিত হাসি,গাল দুটো লাল হয়ে আছে।এতো গভীরে না গিয়ে আফিয়া আবারও আগের জায়গায় ফিরে আসলেন।বেলীর হাতদুটো নিজের হাতের ভাজে নিয়ে কোমল কন্ঠে বলে উঠলেন,

–“সংসার জিনিস খুব কষ্টকর বেলী।প্রত্যেক টা মেয়ে নিজের সংসারটাকে আগলে রাখার চেষ্টা করে।যতোই তারা কষ্ট পায় না কেন নিজের জীবন দিয়ে হলেও নিজের ছোট সংসার টাকে আগলে রাখার জন্য উঠে পড়ে লাগে।অবশ্য,তুমি এখনো ছোট।আমি তোমাকে সব শিখিয়ে দিবো।”

বেলী আফিয়ার হাত দুটো ভরসা পেয়ে ধরে নিলো।এমন একজন ভালো মনের শ্বাশুড়ি পেয়ে সে অনেক খুশি।আফিয়া বেলীর দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন,

–“আমার ছেলেটা খুবই রগচটা।একবার রাগ উঠলে তাকে সামলানো খুবই কষ্টকর।তবে একটা জিনিস কি জানো ও যখন কোনো কারণে কষ্ট পায় একদম বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।কিন্তু,আমার ছেলেটা এখন নিজের কষ্টটাকে বাহিরে প্রকাশ করে না।ভিতরে ভিতরে রেখে ঠিক প্রপর্ণের মতো ঝরে যাচ্ছে।”

বেলী ভ্রুকুটি কুঁচকে তাকিয়ে আছে।শ্বাশুড়ির কথার কিছুতেই মাথায় বোধগম্য হচ্ছে না।আফিয়া বেলীর হাত দুটো আরেকটু আগলে ধরে নিলেন।কেন জানি এই হাতদুটোতে অনেক কিছু খুঁজে পাচ্ছেন।ছেলেকে সামলিয়ে রাখার জন্য এইহাত দুটোর মালিককে খুবই ভরসা করতে পারছেন।এমনকি নিজের দুঃখ,কষ্ট গুলো বলার মতোও একজনকে পেয়েছেন।আফিয়া বেশ উত্তেজিত হয়ে বললেন,

–“পারবে না আমার ছেলেটা কে আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে।ও ভিতরে ভিতরে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে নিচ্ছে।বৃক্ষের স্খলিত পত্র,গাছের ঝরা পাতার মতোন বুরাগের জীবন থেকে সুন্দর মুহূর্ত গুলো ঝরে গিয়েছে।ভালোবাসার অনুভূতি মরে গিয়েছে।মায়ের সাথে কাটানো মুহূর্তের সময়ও মিহিয়ে গিয়েছে।আমার বিশ্বাস তুমি পারবে বুরাগকে ঝরা পাতার মতো ঝরতে না দিয়ে আবারও তাকে তার জীবনটায় বসন্তের মতো দক্ষিণ দুয়ারে উন্মুক্ত করতে।ঠিক তেমন শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে বসন্ত যখন প্রকৃতিতে আবারও প্রাণ নিয়ে আসে।”

শ্বাশুড়ি আফিয়ার কথায় বেলী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।সবকিছু তার কাছে কেমন ধোঁয়াশা লাগছে।কিছুই তার ব্রেইন পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না।মাথা পর্যন্ত গেলেও ব্রেইন পর্যন্ত যেতে পারছে না।কিন্তু,এতো কিছুর মাঝেও বেলী এইটা বুঝতে পেরেছে তার সামনে অনেক কিছুর দায়িত্ব নিতে হবে।যতো ঝড়েই আসুক না কেন নিজেকে সামলিয়ে নিতে হবে।পরিস্থিতি মোতাবেক তাকে মানিয়ে চলতে হবে।
————-
ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১ টা ছুঁইছুঁই।খয়েরী রঙের একটা নাইটি পড়ে আয়নার সামনের টুলটায় বসে আছে স্নিগ্ধা।বডি লোশন টা হাতের তালুর মাঝ বরাবর নিয়ে দুহাতে মিশ্রণ বানিয়ে হাতে গলায় মেখে যাচ্ছে আর গুনগুন গলায় গান গাইছে।পাশে রাখা ফোনটায় মেসেজের টোন ভেসে আসতেই হাতে থাকা বাকি বডি লোশন টা তাড়াহুড়ো করে গলায় মেখে নিলো।ফোনটা হাতে তোলে নিলো।ফোনের স্ক্রিনে সদ্য আসা মেসেজ টা দেখে মুচকি হেসে চটজলদি করে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।দ্রুত পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শব্দহীন ভাবে দরজা টা খুলে দিলো।দরজার অপাশ দাঁড়িয়ে থাকা লিটন হুমড়ির মতো রুমে ঢুকে দরজা টা লাগিয়ে দিলো।স্নিগ্ধা কিছুটা সরে দাঁড়িয়েছে লিটনের থেকে।মুচকি মুচকি হাসছে সে।লিটন দরজার সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে লালসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে।স্নিগ্ধা একবার চেয়ে বিছানার সামনে এগিয়ে গেলো।বিছানার বালিশ ঠিক করতে করতে বললো,

–“তোমার বউ ঘুমিয়েছে।”

লিটন হালকা চুলওয়ালা মাথাটায় হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধার কাছে এগিয়ে গেলো।স্নিগ্ধার পেটে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিলো।স্নিগ্ধা মুচকি হেসে লিটনের শার্টের গলার দিকের বোতাম টায় হাত রেখে নাড়াচাড়া করছে।

–“বউকে একদম মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছি।আজকে রাত টা আমার আর তোমার হবে।”

–“বুড়োর শখ কতো।”

–“একদম বুড়ো বলবে না।এখনো এক বাচ্চার বাপও হতে পারেনি।”

স্নিগ্ধা মুখে মুচকি হাসি টেনে বললো,

–“হও নি!হয়ে যাবে।তার আর বেশি দেরি নেই।হাতেগনা কয়েকমাস।”

–“বাদ দাও তো বউ বাচ্চার কথা।এখন আমি শুধু তোমায় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।”

স্নিগ্ধা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।অনেকবার খোঁজ নিয়েছিলো বুরাগের বাসায় আছে কিনা।কিন্তু,জানতে পারে বুরাগ বাসায় নেই।মনে মনে বুরাগের আসার জন্য অপেক্ষা করছে।অবশ্য,বুরাগ যখন অতিরিক্ত কষ্টে ভূগে তখন বাসা থেকে অনেক দূরে গিয়ে একা সময় কাটায়।ঠিক এইসময় টাতেই সে বাসায় ফিরে।তা স্নিগ্ধার আগে থেকেই জানা।জানাটা তো স্বাভাবিকই এক সময় তো স্নিগ্ধাই ছিলো বুরাগের জীবন।স্নিগ্ধা জোরপূর্বক লিটনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো।নাইটি টা ঠিক করে লিটন কে বলে উঠলো,

–“তুমি বস।আমি একটু পানি খেয়ে আসছি।গলাটা ভিষণ শুকনো লাগছে।”

লিটন আর কিছু বলে না বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দেয়।আর,স্নিগ্ধা দ্রুত গতিতে দরজা ভেদ করে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।

বেলী খুব ছটফট করছে।বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে।এখনো বুরাগের দেখা মিলে নি।প্রায় ১ টার উপরে বাজে তাও এখনো বুরাগকে আসতে না দেখে একবার রুমের দরজার কাছে যায় তো আরেকবার রুমের বারান্দায়।আর না পেরে নিচে নামার প্রস্তুতি নিলো।

বুরাগ তাড়াহুড়ো করে বাসায় ঢুকলো।দরজা খোলা পেয়েই ঢুকে গেলো।মাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলো আসতে একটু দেরি হবে যেনো দরজার ছিটকিনি না লাগিয়ে রাখে।অবশ্য,বাহিরে দারোয়ান থাকে বলে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই।মূলত নিজে দেরি করে এসে কারোর ঘুম নষ্ট করতে চায় না বুরাগ।কিছুটা দ্রুতই হাটছে।আরেকটু সামনে আগাতে নিলেই হুট করে কেউ একজন এসে বুরাগ কে জড়িয়ে ধরলো।রাত-বিরেতে এমন একটা ঘটনায় বুরাগ চমকে উঠলো।চমকপ্রদ হয়ে সামনে স্নিগ্ধাকে দেখে রাগটা নিমিষেই বাসা বাঁধতে শুরু করলো।বুরাগ স্নিগ্ধার কাঁধ ধরে ছাড়িয়ে নিতে গেলেই স্নিগ্ধা পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।স্নিগ্ধার এই চাহনি বুরাগ কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না।তাই মুখটাকে অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো।স্নিগ্ধা বুরাগের মতিগতি বুঝতে পারে ঠোঁট টাকে একটু প্রসারিত করে নিজের হাত দুটো দিয়ে বুরাগের মুখটা নিজের মুখের দিকে ফিরালো।বুরাগ না পেরে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।স্নিগ্ধার চাহনি টা বুরাগের সবকিছু উলোটপালোট করে দিচ্ছে।করিডোরের মৃদু আলোটা স্নিগ্ধার মুখে এসে পড়ছে।যার কারণে বুরাগের কাছে স্নিগ্ধাকে আরো মোহনীয় লাগছে।স্নিগ্ধা ধীরগতিতে এসে বুরাগের ঠোঁটের ভাজে নিজের লিপস্টিক যুক্ত ঠোঁট গুলো ডুবিয়ে দিলো।এমনটা হতেই বুরাগ সরে আসতে নেয় কিন্তু,স্নিগ্ধা বুরাগকে সরতে না দিয়ে উন্মাদ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।অবশেষে বুরাগও আর না পেরে স্নিগ্ধার সাথে তাল মিলিয়ে উঠলো।

ঠান্ডা,মুগ্ধকর পরিবেশে ফোঁপানোর আওয়াজ পেয়ে বুরাগ আর স্নিগ্ধা দুজনেই চমকে উঠলো।সামনে সিঁড়ির কাছে বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুরাগের ভিতরটা অস্থিরতায় ভরে উঠলো।স্নিগ্ধা দাঁতে দাঁত চেপে বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে।বুরাগ নিজেকে নিজের কাছে এখন অনেক তুচ্ছ মনে করছে।বেলীর ফোঁপানোর শব্দটা বুরাগের অস্থিরতা যেনো আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।মনের ভিতর টায় জ্বলা অনুভব করছে।

নিজের চোখের সামনে নিজের সদ্য বিবাহিত বর আর বাহিরের একটা মেয়েকে এতোটা কাছে দেখে বেলীর মনের ভিতর টা হাহাকার করে উঠলো।মনের কোণে জন্ম নেয়া সুপ্ত অনুভূতিটা যেনো একপলকেই ভেঙে পড়েছে।তার মানে তার নতুন জীবনের সূচনা একফালি রোদের মতো ঝলমলিয়ে আসেনি।আকাশভরা দুঃখ নিয়ে এসেছে।বেলী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না এইখানে।এলোমেলো পায়ে উল্টো ঘুরে উপরে উঠতে নেয়।কয়েক সিঁড়ি আগানোর পরেই শাড়িতে পা ভেজে ধপাস করে লাস্টের দুই সিঁড়ির মাঝখানে পড়ে যায়।এইভাবে পড়ায় বেলী বুকে আর পেটে অনেকটাই ব্যথা পায়।কিন্তু,ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ব্যথা টা সহ্য করে নিচ্ছে।

বেলীর এইভাবে পড়ে যাওয়ায় বুরাগ বেলীর কাছে আসতে নেয়।কিন্তু স্নিগ্ধা তার হাত ধরে আটকে দেয়।বুরাগ গরমচোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো।জোরে ধাক্কামেরে ফেলে দিলো।বুরাগের ধাক্কায় টাল সামলাতে না পেরে স্নিগ্ধা কিছুটা পিছিয়ে যায়।হাতের বাঁধন ছুটতেই বুরাগ বেলীর কাছে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দ্রুত গতিতে পা বাড়ালো।

বেলী পিছনে ফিরে বুরাগকে নিজের কাছে আসতে দেখেই কষ্ট করে উঠে দাঁড়ালো।আস্তে আস্তে সিঁড়ি গুলো পেরিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দৌড়ে চলে গেলো।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here