পুনম পর্বঃ০৪

0
1971

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ০৪

তারুণ কলেজ থেকে বের হয়ে দেখলো, একটা মেয়ে ছাতা দিয়ে একটা ছেলেকে মারছে।কি আশ্চর্য ঘটনা! ছেলেটাও পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে।একটা ছেলে হয়ে এই দৃশ্যটা দেখে ওর কেমন যেন লাগলো। দেখলো অনেকে দাঁড়িয়ে দেখছে আর মজা নিচ্ছে। তারুণ এগিয়ে গিয়ে দেখলো সাদা কলেজ ড্রেস পড়া একটি মেয়ে। চুলে দুটো বেণি করা তাও অগোছালো। কাঁধে কলেজ ব্যাগ আর হাতে ছাতা নিয়ে মেয়েটি ছেলেটাকে মারছে আর সমান তালে বকে যাচ্ছে। তারুণ ভিরের লোক দূর করে মেয়েটাকে থামিয়ে বললো,
——এই মেয়ে তুমি ওকে মারছো কেন? আর তুমিও বা পড়ে পড়ে মার খাচ্ছো কেন?
সাদা কলেজ ড্রেস পড়া মেয়েটা আর কেও নয় লাবণ্য। লাবণ্য চিল্লিয়ে বললো,
—–মারবো না কেন? শালার কত বড় সাহস!আমার মেকাপ নিয়ে কথা বলে, এই লাবণ্যের মেকাপ নিয়ে কথা!
ও তো মার খাবে সাথে ওর চৌদ্দ গুষ্ঠি মার খাবে।চামচিকার নানা কোথাকার? বলে আবার একটা লাথি দিল লাবণ্য।
তারুণ আঁতকে উঠলো।কি সাংঘাতিক মেয়ে! নিজের বিস্ময় চেপে বললো,
—–মেকাপ নিয়ে কথা বলায় তুমি এভাবে মারবে?
—-লাবণ্যের কাছে লাবণ্যের মেকাপ হলো লাকি চার্ম। আর শুধু মেকাপের জন্য মারিনি এই চামচিকাকে।আমাকে বলে কিনা।আমি ফেল করা ছাত্রী, আমি মেকাপ ছাড়া আর কিছু পারি না।মেকাপ ছাড়া আমায় শয়তানের মত দেখায়। এরজন্য নাকি কেউ আমার সাথে রিলেশন করবে না তাই ওর সাথে রিলেশন করতে বলছে। শালা আমি কি তোর মত নকল টুকে পাস করি। আপনিই বলুন,মাত্র তিন সাবজেক্টে আমি নম্বর কম পেয়েছি তাই পাস করিনি তাই বলে আমি ফেল্টুস মার্কা মেয়ে? আর ও নড়বে কি একেবারে মেইন পয়েন্টে আগে মেরে কাবু করে ফেলেছি না।…..

তারুণের মুখ হা হয়ে গেছে এই সাংঘাতিক মেয়ের কথা শুনে, বলে কি এই মেয়ে? ওদের কথার মাঝখানে মার খাওয়া ছেলেটা উঠে চলে গেছে। লাবণ্য ছাতাটা মেলে ধরে তারুণকে প্রশ্ন করলো,
—-আচ্ছা আপনিই বলুন, আমি দেখতে কি অসুন্দর? আমাকে মেকাপে কি পেত্নির মত লাগে?

তারুণ ভারি দ্বিধায় পড়লো। সরাসরি কোন অচেনা মানুষকে এভাবে কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে তা ওর ধারনার বাহিরে।তাছাড়া একটু আগে ছেলেটাকে যে মাইর মারলো তা ওর খাবার ইচ্ছে নেই কোন মন্তব্য করে।
লাবণ্য অবশ্য উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বললো,
—-আমার নয়াপু কি বলেন জানেন? বলে মেকাপ করাও একটা আর্ট।আর এটা সবাই পারে না।আর আমার নয়াপু কখনো ভুল বলে না। নয়াপু বলে, আমি হলাম মায়াবতী।আমি যখন মেকাপ করি তখন নাকি আমাকে দেবীদের রাণীর মত লাগে।

তারুণ খেয়াল করলো মেয়েটা দেখতে শ্যামলা। সকালে মেকাপ করছিল তা এখন ফেটে ফেটে গেছে একটু আগে রোদে মারামারি করার জন্য। তার মায়াবতী মনে হলো না কিন্তু ভালো লাগলো বিশেষ করে মেয়েটির চিবুক আর চিকন ঠোঁট দুটির কারণে। তারুণ প্রশ্ন করলো,
—নয়াপু কে?

—–আরে আপনি নয়াপু কে চিনেন না,কি আজব! সে আমার চতুর্থ বোন।তার নাম পুনম। কিন্তু আমার দাদু বলতো সে হলো নয়া।আরে মুখের হা বন্ধ করুন। আমরা পাঁচ বোন।তো দাদু বলতো, বড় মেজো সেজো নয়া ছোট। তো সেখান থেকেই আমি ডাকি নয়াপু।জানেন? আমার নয়াপু একদম বোম্বে নায়িকাদের মত।হেব্বি দেখতে!

তারুণের মনে হলো লাবণ্যের নয়াপুকে চিনতে না পারা মহা অপরাধের কাজ।তারুণের মাথায় চক্কর দিতে শুরু করেছে, এই মেয়ে বেশি কথা বলা মেয়ে।অচেনা একটি ছেলের সাথে এভাবে বলছে যেন কতদিনের চেনা!
তারুণ এবার বললো,
—-লাবণ্য তুমি কি আমাকে চিনো?

এতক্ষণে লাবণ্যের খেয়াল হলো এবং বললো।, চিনিনা তবে চিনবো,
—আমি লাবণ্য। আপনি?
—আমি তারুণ।এই কলেজে পড়ি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার।সায়েন্স গ্রুপ।
—-আরে ব্রো আমিও তো সেইম তবে আর্টস। তো কাল দেখা হবে ভালো থেকো। আমি দেরি করে ফিরলে আমার খারুস বাপ টেনশন করবে তারপর আবার আজ ক্লাস টেষ্টের রেজাল্ট দিছে,ফেল মারছি।আমার যে কি হবে? বেঁচে থাকলে কাল তোমায় ট্রিট দিবো। আসি…. বলে দুলতে দুলতে ছাতা মাথায় দিয়ে চলে গেলো।তারুণ বুঝতে পারলো না এই মেয়ে আদোও টেনসড কি না!
*************************
সালেহা বেগম খাটের উপর বসে পান বানাচ্ছেন আর ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছেন।স্বামীর হাতে পানের খিলি ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—-আপনি একজন দয়া মায়াহীন পিতা।আমার মেজো মেয়েটা যাওয়ার সময় বললো, বাবা আসি।আপনি একবারও থাকতে বললেন না।

নিয়াজ উদ্দিন পান মুখে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
তার মাঝে মাঝে মনে হয় মৃত শাশুড়ী মাকে কবর থেকে উঠিয়ে এনে জিজ্ঞেস করি,
— আপনি আমার সাথে এই অন্যায়টা কেন করলেন?আপনার এই বোকা মেয়েকে কেন আমার গলায় ঝুলালেন।
নিয়াজ উদ্দিনের এখনো মনে আছে তার বাসর রাতের কথা।বিয়ের আগে একবার নাম মাত্র দেখেছিলেন সালেহাকে।বাসর ঘরেই তাদের প্রথম কথা।নিয়াজ উদ্দিন যখন বাসর ঘরে ঢুকে, এই মহিলা না কোন সালাম না কোন কুশল প্রথম যে কথা বলেছিল তা হলো,
—চুমু দিলে সাবধানে দিবেন আপনার গোঁফে যেন আমি ব্যাথা না পাই!হনুমানের পশমের মত আপনার গোঁফ!

নিজেই মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয় এই বোকা মহিলার সাথে সে এতগুলো দিন কাটিয়ে দিলো।

তার মেজো মেয়ে ঝুমা শশুড় বাড়ি থাকে মাসের মধ্যে দশদিন আর বাপের বাড়ি বিশ দিন।দুদিন পর পর এই মেয়ে জামাই নিয়ে হাজির।ভালো কোম্পানির চাকরি দেখে বিয়ে দিয়েছিল মেজো মেয়েটার। আর তার জামাই দুদিন পর পর চাকরি ছেড়ে দিবে আর বউ নিয়ে ঘরে বসে থাকবে।তার নাকি চাকরি করতে ভালো লাগে না। সারাদিন মেয়েটার আঁচলে ঘুরবে আর মেয়েও পতিভক্ত কিছু বলে না জামাইকে চাকরি নিয়ে।তার মেয়েটা যেমন বোকা তেমন জামাইটা গাধা!বোকা আর গাধার সংসার!হুহ। শবে বরাতের আগে তারা এলো পাঁচদিন পর আজ গেলো।তাদের নাকি থাকতে বলবে।সে তো জানে দুদিন বাদেই তারা হাজির হলো বলে।
*************************

রাজু ড্রাইভিং করছে আর তানভীর স্যার তার পাশের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছে।তার স্যার একটু আগে বললো,
—–রাজু এখন তুমি সোজা পুনমের কাছে গিয়ে গাড়ি থামাবে।তার আগে গাড়ি থামালেই কঠিন শাস্তি!পুনমের দেখা পেলেই তবে আমায় ডাকবে। আন্ডারস্ট্যান্ড?

রাজু বুঝতে পারছে না কি করবে?তার স্যার আজ পাঁচদিন পর বের হলো রুম থেকে।মূলত বলা যায় তাকে বের হতে দেয়া হয় নি।রাজু আজ ছয় বছর ধরে নামমাত্র তানভীর স্যারের পি এ।বড় স্যার মানে তানভীর স্যারের বাবা রাজুকে রেখেছে তানভীর স্যারের সকল খবর তাকে দেওয়ার জন্য।সারাদিন স্যার যা করে তা রাতে ঘুমানোর আগে বড় স্যারকে আপডেট দিতে হয়।রাজুর ভালো লাগে না।আগে তানভীর স্যার কখনো শাস্তি পায়নি,এই পুনমের জন্য একবছর যাবত শাস্তি পাচ্ছে। রাজুর বার বার মনে হয় মেয়ে মানে ঝামেলা।তার স্যার আগে কত নিয়ম মাফিক চলতো আজকাল তার স্যারের জীবনে সব উলোট পালোট। সেদিন পুনমকে ফুল দেওয়ার কারণে তানভীর শাস্তি হিসেবে পাঁচদিন ঘরবন্দী থেকেছে। তানভীর যখন ঘুমাচ্ছিলো তখন তার বাবা এসে ফোন নিয়ে যায় আর রুমের দরজা বাহির থেকে তালা দিয়ে রাখে।

রাজুর ভেবে অবাক লাগে তার স্যার এই পাঁচদিন কোন টু শব্দ করেনি।একবারও বলেনি দরজা খুলে দিতে। রাজু বার বার দরজার সামনে দিয়ে ঘুরে যেতো আর মনে মনে পুনমকে একশত ভাষায় একশত গালি দিত!

গাড়ি থেমেছে অনেকক্ষণ, তানভীর গাড়ীতে বসে পার্কে বসা পুনমকে দেখছে।হালকা গোলাপি রঙের কু্র্তি সাদা ওড়না আর জিন্স পড়নে পুনমের।কোন সাজ নেই মুখে তারপরও কি অনিন্দ্য সুন্দর মুখশ্রী।তানভীর জানে না এই মেয়েটাকে সে ভালোবাসে কিনা?তাদের মধ্যে কোন প্রেমও নেই।বরং পুনম সবসময় ওকে দেখলে কপাল কুঁচকে কথা বলে।বিরক্তির ভাব ধরে থাকে। তবুও তানভীরের অহেতুক ভালো লাগে পুনমকে।এই যে পুনম নামের মেয়েটির জন্য সে শাস্তি পাচ্ছে তাতেও তানভীর আনন্দ খুঁজে পায়।যেখানে পুনম নামটি জড়িত থাকে সেখানে তানভীরের বিরাজ করতে ভাল লাগে।পুনম যখন মাথা নত করে ঠোঁট চেপে হাসে ঠিক সে সময় তানভীরের মনে হয়,এই মাত্র গ্রীষ্মের খরা প্রান্তরে এক পশলা শান্তির বৃষ্টি নেমেছে!
পুনমের কপালে জন্ম টিপ পড়ানো।বিধাতা পরম যত্নে পুনমের দুধে আলতা মুখে দুই ভুরুর ঠিক মাঝখানে একটা কালো কুচকুচে তিল বসিয়ে দিয়েছে।দেখলেই মনে হয় টিপ পড়েছে।

রাজু চরম বিরক্ত, তার স্যার বিগত দশমিনিট যাবত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। না নামছে গাড়ি থেকে না কথা বলছে।শেষে না পেরে বলেই উঠলো,
—–স্যার নামবেন না?
তানভীর পুনমের দিকে তাকিয়েই বললো,
—–বুঝলে রাজু, তোমার পুনম ম্যাম হচ্ছে টোটাল কারেন্ট বক্স।তার কাছে গেলেই শকড লাগে।শরীর ঝিমঝিম করে।আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।তাই নিজেকে প্রস্তুত করছি।
রাজু বোকার মত হা করে করে তাকিয়ে রইলো স্যারের দিকে।তানভীর আবার বললো,
—–শোনো রাজু, সৃষ্টিকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে আপনি যখন পুনমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন কি আপনার মুড ভালো ছিলো? না হলে এই মেয়েটা এত নিখুঁত হলো কেন?হোয়াই? হোয়াই?

রাজু কেঁদে দিলো এবার, তার স্যার এই পাঁচদিন বন্দি থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে তারউপর আবার ঠিকমত খাওয়া দাওয়াও করেনি এতদিন।সে কি করবে ভেবে পেল না?
—-স্যার আপনার কি ক্ষুদা পেয়েছে?
তানভীরের মনে চাইলো পুনমকে সামনে বসিয়ে খাবার খেতে তাহলে যদি তার রুচি ফিরে আসে।এখন তা সম্ভব না। পুনম একটু আগে টিউশনিতে যাওয়ার জন্য চলে গেছে।পুনম কোচিং এর পর আধাঘন্টা সময় পায় পরের টিউশনিতে যাওয়ার জন্য।পথের মাঝেই এই পার্কটা পড়ে, তাই সে এখানে কিছুক্ষণ বসে রেষ্ট নিয়ে পড়াতে যায়।
তানভীর আবার সিটে মাথা এলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
—-রাজু তুমি এত সহজে কিভাবে কাঁদো? আমি তো পারি না। রাজু আজ তো আমি পুনমির সঙ্গে কথা বলিনি তবে তোমার বড় স্যারকে কি বলবে? সে কি এখন পুনমিকে দেখার জন্য আমার চোখও বন্দি করবে?

রাজু মাথা নত করে আছে, তার স্যারের বিরুদ্ধে বলতে মনে চায় না কিন্তু সে অসহায় যার নুন খায় তার সাথে গাদ্দারি কি করে করবে?
তানভীর আবার বলে,
—- রাজু মন খারাপ করো না।এটা তোমার কাজ। তবে আমি তোমাকে ভীষন পছন্দ করি।এখন গাড়িটা বুবুর বাসার দিকে নিয়ে যাও। অনেকদিন তাকে দেখিনা!

রাজু গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো,কিন্তু তার প্রেসার লো হতে শুরু করেছে। বড় স্যার যখন জানতে পারবে তানভীর স্যার তার বোনের বাসায় গেছে তখন তার স্যারের আবার কি শাস্তি হবে?রাজু বিড় বিড় করে বলে, মেয়ে মানেই ঝামেলা!

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here