পুনম পর্বঃ১৭

0
1775

#পুনম
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৭

রাতের শেষে স্নিগ্ধ একটা ভোর।তানভীরের রুমের জানালার পাশে দুটো পাখি বসে কিচিরমিচির করছে।ঘুম কাটিয়ে চোখমেলে পাখি দুটোর খুনসুটি দেখে তানভীরের খুব ভালো লাগলো।পাখি দুটোর জায়গায় নিজেকে আর পুনমকে ভেবে কল্পনাও করা হলো এক মুহূর্তে! ওদের সকালও হবে এমন খুনসুটিময় কিচিরমিচিরে!
সর্বনাশ করেছে এই মেয়ে! পুনম ছাড়া কিছুই মাথায় আসে না আর! তানভীর বালিশের পাশথেকে মোবাইল নিয়ে টুক করে একটা ছবি তুলে ফেলে পাখিদের।তানভীরের ইচ্ছা জাগে পুনমকে এই ছবি পাঠাতে কিন্তু এই মেয়ে যে একটা ভাঙাচোরা মোবাইল চালায় তাতে যে কথা বলা যায় তাই সৌভাগ্য মনে হয় তানভীরের।
চট করেই মাথায় আসে পুনমকে একটা মোবাইল কিনে দিলে কেমন হয়?পরমুহূর্তেই মুখ ভার হয়ে আসে তানভীরের,যে কঠিন রাগী মেয়ে.. মোবাইল দিয়েই মুখে না মেরে দেয় শেষে! এর দ্বারা সবই সম্ভব। কেবল ভালোবাসা ছাড়া!
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই তানভীর শুনতে পায় মায়ের রুম থেকে গানের আওয়াজ আসছে…. অনেকদিন পর মায়ের কন্ঠে গান শুনে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো তানভীরের।মায়ের গানের গলা খুব সুন্দর। তানভীর শব্দহীন পায়ে হেঁটে রুমে প্রবেশ করে।দেখতে পায় খাটের উপর আয়েশ করে বসে চোখ বুজে একমনে নজরুল সংগীত গাইছে মা।পড়নে একটা ধূসর সুতি শাড়ি।শরীরের কোন স্থানই গহনা নেই।চোখের নিচে কালো দাগ। রুক্ষ ঠোঁট মৃদু হাসির রেখা।মাকে তারপরও খুব সুন্দর দেখায় তানভীরের কাছে। চুপচাপ মায়ের পাশে গিয়ে খাটে বসে তানভীর। মার কন্ঠে তখন নজরুল সংগীতের সুর….

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি।
কেউ দুখ লয়ে কাঁদে কেউ ভুলিতে গায় গীতি।।

কেউ শীতল জলদে হেরে অশনির জ্বালা,
কেউ মুঞ্জুরিয়া তোলে তার শুষ্ক কুঞ্জ – বিথী।।

কেউ কমল – মৃণালে হেরে কাঁটা কেহ কমল।
কেউ ফুল দলি’ চলে, কেউ মালা গাঁথে নিতি।।

কেউ জ্বালে না আর আলো তার চির – দুখের রাতে,
কেউ দ্বার খুলি’ জাগে চায় নব, চাঁদের তিথি।।

গজল সঙ্গীত – ( মান্দ – কাহারবা )

সংগীত থেমে গেছে অনেকক্ষণ। শায়লা হক চোখ বন্ধ করে একই ভাবে বসে থাকে।তানভীর মায়ের কোলে মাথা রাখে।মায়ের হাতটি টেনে এনে হাতের পিঠে আলতো করে চুমু খায়।শায়লা হক ছেলের দিকে মমতাভরা দৃষ্টিতে তাকান, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।তানভীর আর সহ্য করতে পারে না।মায়ের কোলে মুখ গুজে শক্ত করে কোমর জরিয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠে বলে,
—-মা কেন তোমাকে বাবা পাগল বলে? কেন সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয় মানসিক ভারসাম্যহীন রোগী হিসেবে? বলো মা?কেন তুমি প্রতিবাদ করনা মা?কেন তুমি নিজেকে আড়ালে রাখো মা? আমার মা তো পাগল নয়।তবে কেন মা আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তুমি থামিয়ে দিতে?কেন তুমি এত ভীতু মা?কেন তোমার মত ভীতু বানালে মা আমায়? বল মা?…
——কারণ তোর মা বড় ভীতুরে খোকা!
—-আমি তোমায় এখান থেকে নিয়ে যাবো মা।আর কিছুদিন…তারপর আর কোন কষ্ট তোমায় পেতে দেবো না।
শায়লা হক হাসে ছেলের কথায়।ছেলেটা এতদিন রাগ করে তার রুমেও আসতো না।কত অভিযোগ তার মায়ের প্রতি? কিন্তু ও কি জানে কতটা বদ্ধ কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছে ওর মা!
—-তোর বাবা তো আজকে দেশে ফিরছে।এত অবাধ্যতার কি কৈফিয়ত দিবি খোকা?
—-কিচ্ছু দিব না।
—রুমে বদ্ধ করে রাখবে।
—রাখুক।
—-তারুণ আমার কাছে একটুও আসে না।ও ওর পাগল মাকে ভয় পায়, তাই নারে খোকা?
তানভীর একথার উত্তর দেয় না।তারুণ নিজেও জানে মা পাগল নয় তবে ও বেশি একটা মিশে না মার সাথে।খাবার টেবিলে দেখা হয় সবার।এছাড়া মায়ের রুমে সচারাচর কেউ আসে না।
—-খোকা এবার তোর বাবার ভ্রমণ সঙ্গী কে রে?
—– আর আই কোম্পানি গ্রুপের মালিকের দ্বিতীয় স্ত্রী পলি আক্তার।
শায়লা হকের সমস্ত শরীর ঘৃণায় রী রী করে ওঠে।আগে এসব দেখে কষ্ট পেতো কান্না করতো।প্রতিবাদ করে বেধর মার খেতো। কিন্তু সব হারানোর পর এখন আর কিছুই আসে যায় না শায়লার।হায়দার হোসেন নামক ব্যক্তিটিকে সে অসম্ভব ঘৃণা করে।মৃত্যু ছাড়া তার রেহাই নেই তা সে জানে তাই প্রতিটি মুহুর্তে মৃত্যুর দিন গুনে।নিজের মেয়ের বয়সী মেয়েদের সঙ্গে যে পুরুষ রাত কাটাতে পারে তাকে ঘৃনা ছাড়া আর কি করা যায়?টাকা, নারী, মদ এই তিন নিয়ে যার জীবন সে সব কিছু করতে পারে,সব! তাই এত ভীতু শায়লা।তানভীর, তারিন হায়দার হোসেনের এই দিক জেনে এত ঘৃণা করে যেদিন বাকিটুকু জানবে সেদিন কি করবে?আর তার তারুণ সে তো বাবাকে আইডল মানে।সে এর এক অংশও জানে না।তারুণ যেদিন জানবে কি বলবে তার আইডল বাবা সম্পর্কে?
—-মা বুবুর কাছে যাবে?বুবুর তোমার জন্য খুব কাঁদে মা।
শায়লার যেতে মনে চায় কতবছর দেখে না মেয়েটাকে কিন্তু আজ যে হায়দার বাড়ি ফিরছে তাকে দেখতে না পেলে তো… ভেবে শিউরে ওঠে শায়লা!
—না থাক খোকা।
আগের তানভীর হলে বলতো,ঠিকাছে।কিন্তু এই তানভীর পুনমের জন্য বদলে যা-ওয়া তানভীর। যে ভয় পায় না কাউকে।
—-মা তুমি যাবে,কেউ তোমার শরীরে আর হাত তুলতে পারবেনা।এই তোমার ছেলে তোমায় ছুঁয়ে বলছে।তোমার খোকা দায়িত্ব কিভাবে নিতে হয় শিখে গেছে…
—–তুই প্রেমে পড়েছিস খোকা…
তানভীর ঠোঁট কামড়ে লাজুক ভাবে হাসে।মায়ের হাত ধরে বলে,—–তুমি কিভাবে বুঝলে?
—-অনেকের জীবনে প্রেম হলো পায়ে শিকলের বেড়ির মতন।আর অনেকের জীবনে প্রেম আশির্বাদ হয়ে আসে।যেন সম্পর্কের আকাশে উড়ন্ত পাখিদের মুক্তির গান! বাধভাঙা, নিয়মভাঙা বেপড়োয়া প্রেম সবার জীবনে আসেনা, যার ক্ষেত্রে আসে সে সকল নিয়মভেঙে প্রেমে পড়ে!
তোর জীবনে এসেছে।তোর চোখেমুখে সেই প্রেমের বিদ্যুৎ বিচ্ছুরণ আমি দেখতে পাই খোকা।সেই মেয়ে তোকে বদলে দিয়েছে।
—-মা খুব নিষ্ঠুর তোমার বউমা।আমার হতে সে চায় না।
—-তাতে কি হয়েছে তুই তো নিয়ম ভাঙা,বেপরোয়া প্রেমিক। ডাইরেক্ট তুলে নিয়ে এসে তোর ঘরে বন্দি করে রাখবি।তোর না হয়ে যাবে কোথায়…বলে হেসে ওঠে মা।
তানভীর সঙ্কিত চোখ বলে,
—-যদি রাগ করে, যদি অভিমান করে বসে। আমার ঘরে যদি থাকতে না চায়…..
—-তবে খুব ভালোবাসবি।ভালোবেসে রাগ অভিমান সব মুছে দিবি।পারবি না?
—-পারবো খুব পারবো।
—–মাকে দেখাবিনা সেই সাহসী মেয়েটিকে।
—–দেখাবো যেদিন আমার সকল কেনর উত্তর তুমি দিবে।
—-তবে তাই সই। তবে তার নাম কি?
—-পুনম…….
*******************
মায়ের ডাকে পুনমের ঘুম ছুটে যায়।কি সুন্দর শান্তিতে একটু ঘুমাচ্ছিল তাও পারবে না।আর তিনদিন পর ঈদ।সব টিউশন বন্ধ তাই একটু ঘুমাচ্ছিল তাও যদি পারে।
মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে পুনম,
—-কি হয়েছে মা? এত ডাকছ কেন?
মায়ের চোখে মুখে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। পুনম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ওঠে, —এত কাচুমাচু কেন করছো?কেন এত ভোরে ডাকলে সেটা বল না?
—তোর মেজ মামা এসেছে,জানিসই তো তার আলসারের সমস্যা রোজা রাখতে পারে নি….তাই
পুনম বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। মায়ের কথা ফিতা কাটার মত মাঝখান থেকে কেটে দিয়ে বলে,
—–তোমার ভাইয়ের আলসারের সমস্যা থাকুক আর পা…….র সমস্যা থাকুক। আমার জানার দরকার নেই।এখন কি লাগবে সেটা বলো?
—-দু হালি ডিম আনবি আর নুডলস এর প্যাকেট।
—-কেন ঘরে বিস্কুট চানাচুর নেই? চা- দাও তাদের।এত আইটেম দেয়া লাগবে কেন?
—-তুই আর তোর বাবা আমার বাপের বাড়ির আত্মীয় দেখলে গায়ে ফোঁসকা পড়ে।তোর বাবা নাক মুখ কুঁচকে তাদের সামনে বসে আছে আর তুই এমন কথা বলতেছিস।
পুনমের মেজাজ সহসা চড়ে না।যখন চড়ে তখন হুশ থাকে না।ও রাগের সাথে বলে ওঠে,
—-কেন বলবো না এমন কথা? তোমার এই বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন গুলো কোথায় থাকে সারা বছর? যখন রোগে পড়ে কাতরাও তখন আসে তারা?কোন খোঁজ খবর রাখে তোমাদের?আমার নানা তোমার নামে জমি দিয়ে গেলো তাও জোচ্ছুরি করে নিয়ে গেছে তোমার ভাইরা।বছরের এই দুই ঈদে আসে বোনের প্রতি দায়িত্ব দেখাতে।তোমার জন্য একটা কাপড় আর বাবার জন্য পাঞ্জাবি নিয়ে। তাদের বলে দিও এসব ফেতরা তোমাদের চাই না।তোমাকে কাপড় দেয় না বাবা?তাদের গুলো কেন লাগবে? এই কাপড় দেয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব শেষ। সবগুলো স্বার্থপর!আমার বাবার অধিক টাকা নেই বলে যে তারা সবসময় নিচু চোখে দেখে তা তুমি দেখ না।মা তোমায় বলে দিচ্ছি আমি সব সহ্য করবো কিন্তুর বাবার অসম্মান সহ্য করবো না।

মা ঝরঝর করে কেঁদে দিয়ে বলে,—আমার ছেলে বেঁচে থাকলে তোর এত ঝামটা আমার সহ্য করতে হতো না।লাগবে না তোর বাজার।
—না লাগলেই ভালো। আর সব কিছুতে কেন আমাকে লাগবে তোমার।যখন দুই জামাইকে আদর করে খাওয়াও তখন তারা ছেলের মতন আর কাজের বেলা তারা জামাই হয়ে যায়, তাই না?বাসায় এতগুলা মানুষ থাকতে সবকিছুতে কেন এই পুনমকেই করতে হবে? বলতে পারো?
আর শুনো মা তারা দুটাকার জিনিস নিয়ে আসে আর বাবা যে তাদের হাতে টাকা দিয়ে দেয় কিছু কেনার জন্য তা তোমার চোখে বাজে না?শুধু শুধু চোখের সামনে কাঁদবা না।

এরই মধ্যে রুমে ঝুমা প্রবেশ করে।তল পেটে হাত দিয়ে বলে ওঠে পুনমকে,—হ্যা রে পুনু আমার কি হলো বলতো? কাল থেকে পেটে চিনচিন ব্যাথা করছে।তোর দুলাভাই তো বাবুর চিন্তায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিছে।আমায় একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি পুনু?

একেতো পুনমের মেজাজ খারাপ তার উপর মেজ আপার এই কথা তার আরো মেজাজ খারাপ করে দেয়। কি আশ্চর্য সে কি টাকার গাছ লাগিয়েছে।যে নাড়া দিলেই টাকা পড়বে?
—মেজ আপা তোর জামাইর যখন এত চিন্তা তখন তাকেই বল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে,আমাকে বলছিস কেন?
না হলে বাপের বাড়ি এসেছিস তোর বাবা, মা কে বল।
ঝুমার চোখ ছলছল করে ওঠে। একদম মায়ের মত স্বভাব।….তোর দুলাভাইর চাকরি নাই দেখেই তো তোকে বলছি না হলে কি বলতাম।
—-শোন মেজ আপা, মন দিয়ে খুঁজলে বাঘের চক্ষুও পাওয়া যায় তারপর তো চাকরি।চাকরি না পেলে ঠেলাগাড়ি ঠেলতে বল তোর জামাই কে…..বলে পুনম ওড়না মাথায় পেচিয়ে হাতে পার্স ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয় যায়।ওর রাগ লাগে,এত দায়িত্ব আর ভালো লাগে না।যেন সবই ওর ঠেকা।
সবার এত প্রয়োজন! অভাব গুলো বাক্স বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে করে পুনমের।সবাই ওর কাছে বলতে পারে, ওর প্রয়োজন গুলো বলবে কার কাছে?কে আছে?
পাবনী ওয়াশরুমে বসে এতক্ষন সবই শুনতে পেয়েছে।সে বের হয়ে মাকে আর মেঝ আপাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
—রাগ করো না তোমরা।ওর মেজাজ ঠিক নেই। সারাদিন টিউশন করেছে আবার সারা রাত পড়ে সেহরি খেয়ে শুয়েছে তাই ঘুম হয় নি মা।তুমি কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়েছো তাই রাগ করেছে।আর ঠিকই তো বলেছে ও। ও একা কত দিক সামলাবে? এই যে বের হয়েছে দেখ মা তোমার বাজার নিয়েও আসবে আর আপা তোমার ডাক্তারের সিরিয়াল দিয়েও আসবে। ও মুখে যাই বলুক ওতো সবই করছে আমাদের জন্য।

বাসায় ডিম নুডলস আর কিছু সবজি পাঠিয়ে দিয়ে ও এক্সিম ব্যাংকের দিকে হাঁটা শুরু করে।একটা স্টুডেন্ট ডিপি এস করেছিল।যখন যা পারতো টাকা রাখতো। এখন দেখতে হবে সেই একাউন্টে কত টাকা হয়েছে? ও চেয়েছিল কিছু টাকা উঠিয়ে একটা ভালো টাচ ফোন কিনবে। তা আর হলো কথোয়?এত অভাবের ভিতর আবার শখ! ও ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ক্লিনিকের রিসিপশনে ফোন দিয়ে একটা গাইনী বিভাগে আর একটা অর্থোপেডিক্সের ডক্টরের সিরিয়াল নেয়।কাল রাতে সেজ আপাকে পায়ে ওড়না বেঁধে ঘুমাতে দেখেছে।হয়তো পায়ের ব্যাথা বেড়েছে কিন্তু আপা তো মুখ ফুটে কখনোই তা বলবে না।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here