পুনম পর্বঃ৪২ শেষ পর্ব

0
6469

#পুনম (বিশেষ পর্ব)
#আয়েশা_সিদ্দিকা

কিচেন থেকে বাসন নড়াচড়ার বিকট শব্দ হচ্ছে। এটা যে অগ্নিমূর্তির রাগের বহিঃপ্রকাশ তা বুঝতে বাকি রইলো না তানভীরের।ডিনার রেডি হওয়া পর্যন্ত এরকম উচ্চ শব্দ করে প্রতিটা কাজ করবে পুনম।মুখে কিছু না বলেও যে রাগের এমন আগ্নেয় তান্ডব দেখানো যায় তা তানভীর জানতো না।তাই এখন বিরস মুখে সোফায় বসে বউয়ের কার্যকলাপ দেখছে।পুনমের ফর্সা মুখ রাগে থইথই করছে! তানভীর একবার ভাবলো পুনমের কাছে যাবে পরক্ষণেই সেই চিন্তা বাদ দিলো।কেন যেন পুনমের রাগী মুখ দেখতেও তানভীরের ভালো লাগে!টকটকে ফর্সা মুখে টসটসে রাগ!ইশ!কি মারাত্মক সুন্দর!
শায়লা হক সোফায় বসে ছেলের কার্যকলাপ দেখছে।তার ছেলে কতক্ষণ কিচেনে চোখ বুলাচ্ছে আর উসখুস করছে। ছেলের এই করুণ অবস্থা দেখে শায়লা হক আসলেই ভীষণ বিরক্ত! ছেলেটা সাহস করে বউয়ের কাছে যেতেও পারছে না আবার দূরেও থাকতে পারছে না।আহারে বেচারা!
তানভীর করুণ মুখ করে বলে,”রাজু দেখে আসো তো তোমার ভাবির কাজ কতদূর হলো।”
রাজু কপাল কুঁচকে স্যারের দিকে তাকায়। এই নিয়ে তিনবার সে পুনমকে দেখে এসেছে।যতবারই পুনম তাকে দেখেছে ততবারই চোখ গরম করে তাকিয়েছে।এখন আবার গেলে নির্ঘাত তার দিকে ঐসব নিরহ বাসন কোসন ছুড়ে মারবে।রাজু তাই বিরক্ত নিয়া বলে,”পারবো না স্যার।আপনি প্রতিবার অন্যায় করেন তার ভুক্তভোগী কেন আমরা হবো?”
তানভীর চোখ গরম করে তাকায়। সেই দৃষ্টি রাজু উপেক্ষা করে শায়লা হকের সাথে নাটক দেখায় মন দেয়।
তানভীর এবার হতাশ দৃষ্টিতে মা আর রাজুর দিকে তাকায়। কিন্তু তানভীরের প্রতি কারো দয়া হয় না। এই ঘটনা মাসের মধ্যে প্রায় দিনই ঘটে!তাই দয়া দেখানোর কোন মানে নেই!পুনম প্রতিবার রাগ করে আর তানভীর তার রাগের রোষানলে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়।

পুনম চুপচাপ টেবিলে খাবার পরিবেশন করে।তানভীরকে তার দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পুনমের খারাপ লাগে কিন্তু তা চোখে মুখে প্রকাশ করে না।প্রকাশ করলেই তানভীর উৎসাহ পাবে!ভালোবাসাও যে মাঝে মাঝে টর্চার লেবেলে পড়ে তা তানভীরকে না দেখলে পুনম জানতো না।চরম লেবেলের বেহায়া এই পুরুষ! বিয়ের পর থেকে তা বেড়ে একশো গুণ হয়েছে!পুনম উন্মাদ প্রেমিক দেখেছে কিন্তু উন্মাদ বর এই প্রথম দেখা! সবসময়ে তানভীর বাড়াবাড়ি করে!কারো নিষেধ শোনে না। আজকের রাগের কারণ হলো পুনম তার অফিসে গেছে দশটায় আর বেলা বারোটায় গিয়ে তানভীর তার অফিসে হাজির।কারণ তানভীরের হুট করে পুনমকে দেখতে ইচ্ছে হলো। সারারাত, সকাল একটা মানুষকে কাছ থেকে দেখার পরও আবার কি করে দেখতে ইচ্ছে করে পুনম তা জানে না!পুনম তানভীর কে দেখে বিরক্ত হলেও পুনম তা প্রকাশ করেনি।কিন্তু যখন দেখলো বিকেল চারটায় আবার অফিসে এসে হাজির হয়েছে তখন পুনম আর রাগ সামলাতে পারেনি।তানভীর প্রায়ই এমন করে।কোন কিছুর পরোয়া এই পুরুষ করে না।যখন তখন নাকি তার পুনমকে দেখার তৃষ্ণা পায়!এ কেমন তৃষ্ণা? একবার তো পুনম অফিসের কাজে সিলেটো গেলো সকালে, এই মানুষ রাতে গিয়ে হাজির সেখানে।পুনম তানভীরকে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়!পুনম কারণ জনতে চাইলে তানভীর তার গালের ভাঁজ পড়া সুন্দর হাসিটা দিয়ে বলে,”থাকতে পারলাম না পুনমি!তোমাকে ছাড়া একটা মুহুর্ত থাকতে পারলাম না!বুকের কোণে খাঁ খাঁ করতে লাগলো গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুরের মত!এই বুকে একটু বৃষ্টি হয়ে ঝাপিয়ে পড়তো পুনমি! কেমন পুড়ছে দেখো!”
পুনম এরপর আর কিছুই বলতে পারলো না।এই মানুষটার ভালোবাসা যেমন প্রবল তেমন প্রবল কথার তীর! পুনমের অফিসের কলিগ এমনকি আত্মীয় স্বজন সবাই এই বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি করে!তানভীরের কান্ডে তারা বিশ্রী রকমের রসিকতা করে।আজ তো অফিসের মকবুল ভাই বলেই ফেললো,”বরকে কি ঘোল খাইয়েছেন ম্যাডাম?যে আপনাকে ছাড়া সে সব অন্ধকার দেখে!
এরপর থেকেই পুনম রেগে আছে যাকে বলে ভীষণ রাগ।
খাওয়ার পর্বটা চুপচাপ সাড়া হলো সবার কিন্তু তানভীর ঠিকমত খেতে পারলো না।সারাক্ষণ উসখুস করলো!

পুনমকে সব গুছিয়ে রেখে মায়ের ঘরে যেতে দেখেই তারভীরের বুকের রক্ত ছলাৎ করে উঠলো! সর্বনাশ করেছে!পুনম মায়ের ঘুমাবে।তাহলে আজ তানভীরের ঘুম হবে না।তানভীর এবার কিছুটা অভিমান করলো।এ কেমন রাগ?রাগ করেছে তা প্রকাশ করবে তা না উল্টো দূরে রাখার পায়তারা! পুনম কি জানে না তাকে ছাড়া তানভীর ঘুমাতে পারে না?
শায়লা হক ছেলের আর ছেলের বউয়ের কর্মকান্ডে যারপরনাই বিরক্ত! তিনি তার কাথা বালিশ নিয়ে গেষ্ট রুমে চলে গেলেন।যাওয়ার সময় ছেলেকে গাধা বলে গালি দিতে ভুল করলেন না।
পুনম বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলো।মাকে আসতে না দেখে কিছুটা অবাক হলেও গুরুত্ব দিল না।
একটু পরই পুনম অনুভব করলো শক্ত পোক্ত দুটি হাত পুনমকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরেছে।পুনম অন্ধকারেই নিজের কপাল চাপড়ালো!পৌরুষালী শক্তির কাছে নারী চিরকালই কুপকাৎ!
পুনম এক পাশ করে শুয়েছিল।তানভীর পুনমকে ঐ অবস্থায় শক্ত করে বাহুবন্ধনে নিয়ে ফেললো।তানভীরের মুখ পুনমের পিঠের কাছে।তানভীরের উত্তপ্ত গরম নিঃশ্বাস পুনমকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছিলো। পুনম তবুও চুপচাপ!পুনমের সাড়া না পেয়ে তানভীর কতক্ষণ নাক ঘষলো পুনমের পিঠে,ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট চুমু দিলো,খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি দিয়ে সুড়সুড়ি দিলো!এরপর ছোট্ট করে কামড় বসিয়ে দিলো ঘাড়ে! পুনম তবুও নড়লো না।তানভীর এবার যেন আরো শক্ত করে পেচিয়ে ধরলো পুনমকে।পুনমের মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে সে বুঝি মারাই যাবে!ঠিক সেই দমবন্ধ কর মুহূর্তেই পুনম শুনতে পেলো তানভীর তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলছে, “তোমাকে এতটা ভালোবেসে ফেললাম কখন, পুনমি?এ আমার কেমন অসুখ?এ কেমন ব্যাধি পুনমি?হৃদয়ে এ কেমন রক্তক্ষরণ?পিপাসার্ত চোখে তোমায় দেখার এ কেমন তৃষ্ণা?ভালোবাসা কি সত্যি এমন হয়? পুনমি নামের মেয়েটা কখন আমায় এতটা কাবু করে ফেললো?আমি জানতেও পারলাম না!ভালোবাসা কি সত্যিই এতটা সর্বগ্রাসী?”

পুনম হু হু করে কেঁদে ফেললো।এভাবে কেন বলছে মানুষটা?এতটা ভালোবাসা পাবার কি যোগ্য আদৌও সে?তানভীর নামক মানুষটা কেন তাকে এতটা ভালোবাসে? বুকের ভিতর হু হু করে উঠলো পুনমের। উল্টো ঘুরে স্থান নিলো তানভীরের বুকে।তানভীর অন্ধকারেই মৃদু হেসে দিলো।চোখের কোণে জল জমলো তানভীরের।সকল কিছুর বিনিময়ে হলেও মৃত্যুর আগে ও পরেও এই মেয়েটাকে ওর চাই!ভীষণ করে চাই!এতটা কাছে তার পুনমি তবু্ও এ কেমন অস্থিরতা? এই অস্থিরতার কি আদৌও কোন সমাপ্তি আছে?নেই তো। তানভীর ফিসফিস করে বলে উঠে, “ভালোবাসি পুনমি!ভীষণ!”
পুনম আহ্লাদী কন্ঠে বলে উঠলো,”আমি একটুও ভালোবাসি না!”
“নিষ্ঠুর বউ একটা!”
তানভীরের এই উক্তিতে পুনম হেসে উঠলো।সাথে হাসলো তানভীরও।একজোড়া কবুতর যেমন সুখী ওরাও ঠিক ততটা সুখী। দিনশেষে শত কষ্টের পর দুজনের প্রাপ্তি যেন দুজনেই!

ছোট খাটো উপহার দিলাম।কেমন খুশি হলেন সবাই একটু বলে যান তো?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here