বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ৫

0
4615

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৫
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

ইমু কে এভাবে কাঠের মতো দাঁড়ানো দেখে বেশ অবাক হয় আম্বের।স্মিত গলায় বললো—

“দাঁড়িয়ে আছিস কেন!ভেতরে আয়।”

ইমু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এদিকে ওদিক তাকায়।ভেতর ভেতর একটা চাপা রাগ হিরহির করছে ইমুর শরীরে।আম্বের বিগলিত হেসে সরস গলায় বললো–

“আয়।বস।”

আম্বের ইমুর হাত ধরে এনে বিছানার উপর বসায়।থমথমে মুখ ইমুর।আম্বের উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো—

“কী হয়েছে তোর?

ইমুর ভেতরের চাপা রাগ আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বোগলাতে থাকলো।ইমু নিজেকে ধাতস্ত করে।নিচু গলায় বললো—

“কিছু না।”

আম্বের ঝুমঝুমিয়ে বললো—

“তাহলে মুখ এমন সারস পাখির মতো করে রেখেছিস কেন!
একদম ভালো লাগছে না।”

ইমু নিষ্প্রভ চোখে তাকায় আম্বের এর দিকে।ইমুর চোখ মুখ শক্ত।চোয়াল কাঁপছে।কাট কাট গলায় বললো—

“তুমি মাহাদ স্যার কে পছন্দ করো?

আম্বের ইমুর কথায় একদম দুপ করে মিইয়ে যায়।কী বললো ইমু!
ম্লান গলায় বললো—

“কী বলছিস এইসব!তোকে এইসব কে বললো??

ইমু মিইয়ে গলায় আবার বললো–

“কেশবালা,তুমি সত্যিই মাহাদ স্যারকে পছন্দ করো !

আম্বের বিরক্ত নিয়ে বললো–

“দুর ছাতার মাথা!
আমি কেন ওই ফিল্মস্টার কে পছন্দ করতে যাবো!
ওই ব্যাটা আস্ত এক বজ্জাতের হাঁট।”

আম্বের এর কথায় সপ্রতিভ হয় ইমু।তার গোধূলির মায়ায় জড়ানো মলিন চেহারা হঠাৎই উজ্জ্বল ও প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠে।ওর অমায়িক হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে ছোট্ট শ্বাস ফেললো আম্বের।সন্দিহান গলায় মুখ গুঁজ করে বললো–

“তুই পছন্দ করিস নাকী?

ইমুর কী হলো সে জানে না।তার মনে অনাকাঙ্ক্ষিত এক অনুভূতির আভাস হতে লাগলো।আম্বের এর সাথে কাটানো সময় গুলো সে সারারাত ভাবে।তাই ইদানিং তার ঘুম হয় না।
সহজ ও স্বাভাবিক ভঙিতে মাথা নেড়ে না সম্মতি দিলো ইমু।

উচ্ছ্বাসিত হয়ে আম্বের ওর এক হাত হাই ফাইব করার জন্য তুলে বললো—

“দে তালি।”

ঝলমলিয়ে হেসে উঠে ইমু।তার মনে একশো প্রজাপতি রঙ ছড়াতে লাগলো।আম্বের এর মায়াভরা চেহারায় নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো।
আম্বের উপহাসের সুরে বললো—

“ওই হনুমানটাকে কোনো মেয়ে পছন্দ করবে নারে।আর আমি তো পরী,বাবা বলে।তাহলে আমি কেন করবো!

খিলখিলিয়ে হাসির ফোয়ারা বইয়ে দেয় আম্বের।তার ওই হাসিতেই সম্মোহিত হয়ে নির্বিকার চেয়ে আছে ইমু।
আম্বের গাঢ় গলায় প্রশ্ন করলো—

“নাড়ু খাবি?

ইমু শান্ত ভঙিতে ছোট্ট আওয়াজ তুললো।বললো–

“হুম।”

“তুই বস আমি আনছি।”

আম্বের একটা বয়াম থেকে ইমু কে কয়েকটা নাড়ু এনে দেয়।একগাল হেসে তাতে কামড় বসায় ইমু।
আহমেদ গোসল করে বেরিয়ে ইমু কে দেখে হালকা হেসে হেড়ে গলায় বললেন—

“কিরে ইমু!
আজকাল শুধু গল্পগুজব ই চলে নাকি পড়ালেখাও!

ইমু নিজের হাতের নাড়ু প্লেটের উপর রেখে ধীরগতিতে আহমেদ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।উদাস গলায় বললো–

“কাকু,তুমি নাকি কেশবালা কে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিবে?

ইমুর কথায় মৃদু হাসলেন আহমেদ।স্বাভাবিক গলায় বললেন–

“হ্যাঁ।ও কী সারা জীবন এভাবে থাকবে নাকি!পড়তে হবে না!

ইমু ঠোঁট উল্টে গাঢ় গলায় বললো—

“করবে।তাতে হোস্টেলে যেতে হবে কেন?

আহমেদ চোখে হাসলেন।ছেলেটা বড্ড মায়া করে আম্বের কে।আহমেদ আলতো করে এক হাতে ইমু কে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলেন।সে এক পরম আনন্দ অনুভূতি।ইমুকে নিয়ে বিছানায় বসালেন।একটা বেতের মোড়া টেনে তাতে বসলেন আহমেদ।আম্বের কে বললেন এক গ্লাস পানি দিতে।আম্বের বাবার আদেশে তাকে এক এক গ্লাস কিঞ্চিৎ উষ্ণ পানি এনে দিলেন।ঠান্ডায় কয়েকদিন ধরে আহমেদ এর গলাটা ভীষন ব্যাথা করছে।তাই আম্বের বাবাকে কুসুম গরম পানি খেতে দেয়।পানি খেয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেলে আহমেদ।শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় ইমু কে বললেন—

“দেখ,এখান থেকে রোজ তোকে কত সময় পায়ে হেটে স্কুলে যেতে হয়।তাতে অনেক সময় ব্যয় হয়।কিন্তু আম্বের তো আর এতো ছোট ক্লাসে না যে রোজ এতোটা সময় পায়ে সেটে যাওয়া আসা করে আবার ঘরের সব কাজ সামলে নিজের পড়ালেখা চালাতে পারবে।এতো ওর বড্ড কষ্ট হবে রে।”

ইমু নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো।কিন্তু কথা বললো না।সে কিছুক্ষন ভাবলো।তারপর দূর্বল গলায় বললো–

“যদি কেশবালা রিক্সা করে যাওয়া আসা করে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই!

আহমেদ চমৎকার হাসলেন।আনন্দিত গলায় বললেন–

“উরি বাবা!
এতো টাকা আমাদের আছে নাকি!
রোজ যাওয়া আসা করবে?

“হোস্টেলেরও খরচ আছে!

আহমেদ অধর ছড়িয়ে প্রসন্ন হাসলেন।ছেলেটা আঁটসাঁট বেঁধেই এসেছে।কিছুতেই আম্বের কে যেতে দিবে না।কয়েকদিন আগেও যে ছেলে কে মেরে কথা বলাতে পারতো না সে এখন দিব্যি যুক্তিপূর্ণ কথা বলে।এ তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
আহমেদ স্বাভাবিক গলায় বললেন—

“হ্যাঁ।সেটাও ঠিক।কিন্তু এমন তো আগেও হয়েছে।অর্থের সাথে সাথে এখানে সময়েরও একটা ব্যাপার আছে।”

ইমু চট করে আহমেদ এর হাত নিজের মুঠোয় বন্ধি করলো।উদ্বেলিত গলায় বিনম্র ভাবে বললো—

“তুমি কেশবালা কে হোস্টেলে দিও না প্লিজ।আমি রোজ কেশবালা কে রিক্সা করে তার কলেজে দিয়ে আসবো।”

আহমেদ অবাক গলায় বললেন—

“তুই এতো টাকা কোথায় পাবি?

“বাবা তো রোজ আমাকে টিফিনের টাকা দেয়।সেই টাকা দিয়ে আমি কেশবালা কে কলেজে দিয়ে আসবো।একটুও দেরি হবে না তুমি দেখো।”

ফিকে হাসলেন আহমেদ।একটু নিচু গলায় বললেন—

“দুর বোকা !তা কী হয় নাকি!

ছলছল করে উঠে ইমু নেত্রনীর।তার বুকে চিনচিনে ব্যথা উঠে।এমনটা হয়েছিলো আরো একবার।আজ আবার হচ্ছে।ইমুর কথার ঝুড়ির কথামালা গুলো দলা পাকিয় আসে।ঘোলা চোখে তাকিয়ে ধরা গলায় ব্যস্ত হয়ে ইমু বললো—

“চলে যাও।তোমরা সবাই চলে যাও।আর কখনো এসোনা।যাও তোমরা।”

লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে আসে ইমু।সে চায় না তার চোখের জল কেউ দেখুক।সে চায় না তার শূন্য বুকের এই হাহাকার কেউ দেখুক।ইমুদের কাঁদতে নেই।ভাগ্যের কাছে তারা নিরুপায়।

আম্বের কে বুকের এক পাশে গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরে আহমেদ।আবেগ আপ্লুত হয়ে নরম গলায় আম্বের বললো–

“বাবা,
হোস্টেলে যাওয়াটা কী বেশ জরুরী!

আহমেদ নিরুদ্বেগ গলায় শান্তভাবে বললেন—

“হয়তো।”

“ইমুটা যে কাঁদবে!

“ছেলেটা বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে তোকে।”

“হুম।”

অজানা কারনে আম্বের এর চোখ দুটোও ভরে এলো।এ কয়েকদিনে ইমুও এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছে আম্বের এর মনে।এক অজানা নামহীন অনুভূতি।

ঘর থেকে বের হতেই ইমু দেখে মাহাদ গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে।মাহাদ এর নিজের গাড়ি আছে।যা ও নিজেই ড্রাইভ করে।বাড়িতে এছাড়াও আরো দুটো গাড়ি পড়ে আছে।যা মাঝে মাঝে ইউজ হয়।আর সেই গাড়ি গুলোর জন্যই রহিম শেখ কে রাখা।সে হিসেবে তিনি বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন।কারণ নিজের একান্ত প্রয়োজনে মাহাদ কোথাও গেলে নিজেই ড্রাইভ করে।

মাহাদ কে দেখেই ইমুর বুকে জলোচ্ছাসের মতো উথাল পাথাল শুরু হলো।দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিজের বাবাকে।হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ইমু।

ইমুর এই বাঁধ ভাঙা জোয়ারে একটুও বিচলিত হলেন না রহিম।বরং তিনি খুশি হলেন।ছেলেটা অনেকদিন প্রানভরে কাঁদে না।মায়ের মৃত্যুতেও ইমু একটুও কাঁদে নি।
যেদিন ইমুর মা মারা যায় সেই রাতে একটা মৃত মানুষের সাথে সারারাত ঘুমিয়েও ইমু টের পায়নি তার মা রাতের প্রথম প্রহরেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে।ভোরের আলো ফুটতেই সেই মৃত মায়ের ঠান্ডা স্পর্শেই ঘুম ভাঙে ইমুর।ছোট্ট ইমু কিছুই বুঝতে পারেনি।বার কয়েক মাকে মৃদু গলায় ডাকলো।কিন্তু মা উঠলেন না।ইমু গলার স্বর তীক্ষ্ম করলো।আরো ডাকলো মাকে।কিন্তু তবুও মা উঠলেন না।মা একদম শান্ত,শীতল,সমাহিত।ইমু এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে সেই যে চুপ হলো আর কথা বললো না।
ইমুর মাকে যখন খাটিয়া করে নিয়ে যাওয়া হলো তখনো ইমু চুপচাপ বসে রইলো।কিছু বললো না।কোনো প্রতিক্রিয়াও করলো না।সারাদিন দৌড়ে বেড়ানো ইমু কথা বলতেই ভুলে গেলো।
এই বাড়িতে আসার পর মাহাদ কে দেখে আরো কুঁকড়ে গেলো ইমু।তার গলার স্বর প্রায় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম।কিন্তু সেই খরা হৃদয়ে কথার বৃষ্টি হয়ে নামলো আম্বের।

ক্রন্দনরত গলায় ইমু হেঁচকি তুলে বললো—-

“বাবা,তুমি কাকু কে বলোনা কেশবালা কে হোস্টেলে না দিতে।ও বাবা বলোনা।
তুমি বললে কাকু শুনবে।সবাই কেন আমাকে ছেড়ে চলে যায় বাবা!কেন চলে যায়!

ইমু আর কিছু বলতে পারে না।তার গলা ধরে আসে।ঘোলাটে চোখে সে শুধু তার মায়ের সেই সাদা কাপড়ে মোড়া চেহারা দেখতে পায়।ইমুর মা তাকে ডেকে বলছে—

“ইমু আমি চলে যাচ্ছি।আয় একবার মায়ের কোলে।একবার আয়।তোকে জড়িয়ে ধরে এ যাবৎ কালের সব মায়া,মমতা পুষিয়ে দেই।আমাকে যে যেতে হবে।আয় বাবা আমার বুকে আয়।”

ইমু আরো দেখে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আম্বের।শক্ত করে ইমুর হাত ধরে রেখেছে।সে কিছুতেই ইমুকে যেতে দিবে না।তাহলে আজ কেন সে তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছে??
,
,
,
ড.তন্ময় আকন একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট।স্বল্প সময়েই বেশ নাম কামিয়েছে তার কাজে।ফ্যানের মৃদু হাওয়ায় বসে বেশ মনোযোগ সহকারে শুনছে মাহাদ এর কথা।অনেক উৎসাহ আর অবিশ্বাস্য গলায় বললো–

“আর ইউ সিরিয়াস?

মাহাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। গাঢ় গলায় বললো–

“আই এম নট জোকিং!

“ইয়েস।ইউ আর রাইট।আই থিংক দিস ইজ ইউর ডেসটিনি।”

মাহাদ চিন্তিত গলায় জোরালো ভাবে বললো—

“বাট হোয়াই?

তন্ময় ফিকে হাসলো।হালকা গলায় বললো—

“ভাগ্যের উপর আমাদের কারো হাত নেই।ভাগ্য পূর্ব নির্ধারিত।যা হওয়ার তা হবেই।”

মাহাদ দুর্বোধ্য হাসলো।থমথমে গলায় বললো–

“যাকে আমি চিনি না,কখনো দেখিনি সে কেন আসবে আমার স্বপ্নে?

মাহাদ আরেকটু উৎসাহ নিয়ে হেয়ালি গলায় আবার বললো—

“আম্বের!
কী অদ্ভুত নাম!কিন্তু এই নাম ছাড়া আর কিছু নেই তার মাঝে দেখার মতো।না গ্ল্যাসি লুক,না এট্রাকটিভ ফিগার,না কোনো স্পেশাল কোয়ালিটি!
তবুও সে মাহাদ আবইয়াজ এর স্বপ্নে এসেছে।হাউ রিডিকুলাস!

তন্ময় হো হো করে হেসে উঠে।তার দেখাদেখি মাহাদও ম্নান হাসে।তন্ময় হাসি বন্ধ করে সরস গলায় বললো–

“নাম শুনে আপনি একটুও অবাক হন নি?

মাহাদ অধর বাঁকিয়ে হাসলো।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“একদম ই যে হইনি তা কিন্তু নয়।কিন্তু…।”

“কিন্তু কী?

“মেয়েটার তো আমি চেহারা দেখিনি।কিন্তু আম্বের কে দেখেছি।
একদম সাধারণ এর চেয়েও সাধারণ।কিন্তু তার মাঝেও অসাধারন।”

তন্ময় ভ্রু কুঞ্চি করলো।চোখের কোন ক্ষীন করে গমগমে গলায় বললো–

“মানে!ঠিক বুঝলাম না।”

মাহাদ বিগলিত হেসে উদাস গলায় বললো–

“জানি না।
মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা আছে।হয়তো আমার সব প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকেই আমি পাবো।”

তন্ময় গম্ভীরভাবে কিছুক্ষন চুপ করে রইলো।পুরো ঘরজুড়ে এক বাতাসের হিসহিস শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।তন্ময় গাঢ় গলায় বললো—

“ডেসটিনি বিশ্বাস করেন?

মাহাদ সোজা প্রত্যুত্তর করলো —

“নাহ।”

তন্ময় আবেগী গলায় বললো–

“আমি করি।”

মাহাদ গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো।তার চেহারা জুড়ে উৎসুক দুই চোখের ভাষা তন্ময় বুঝলো।তাই নিজ থেকেই আবার বললো—

“এই যে আমাকে দেখছেন,একজন কৃষকের ছেলে হয়ে আজ আমি একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট।
ইটস মাই ডেসটিনি।যা আমি কখনো কল্পনা করতে পারি নি।”

মাহাদ স্বাভাবিক ভঙিতে চেয়ে রইলো।কেনো যেনো তার কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।তন্ময় আবার হাসলো।সে দেখতে পেলো মাহাদ এর চোখে একরাশ ভয়ার্ত নিস্তব্ধতা।তন্ময় হালকা হেসে বলতে শুরু করলো–

“আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন আমি একজন কে পছন্দ করতাম।ভালোবাসি বলবো না।কেন বলেন তো!আসলে ভালোবাসা কী তখন তা আমার বোধগম্য ছিলো না।সে ছিলো আমার চোখের নেশা,হৃদয়ের পিপাসা।
ক্লাস টেন পর্যন্ত চোখে চোখ রাখা,হাতে হাত রাখা,পাশাপাশি চলা এর মাধ্যমেই আমাদের সম্পর্কটা আরো গভীর হলো।
কিন্তু বিপত্তি হলো আমার এস.এস.সি এক্সাম এর পর।বাবার পক্ষে আমাকে আর পড়ানো সম্ভব না।তাই আমাকে মামার বাড়ি পাঠানো হলো।আমিও চলে গেলাম।নিজের হৃদয় ছেড়ে শূন্য বুক নিয়ে।এর মাঝে আর আসা হলো না নিজ গ্রামে।সেও এক মহা ঘটনা।
ইন্টার এক্সাম এর পর যখন এলাম আমার সব আশা নিরাশায় পরিণত হলো।সে হারিয়ে গেলো।কোথায় গেলো জানি না।
মামা কে না বলে এসেছিলাম।আমার মামাতো ভাই মামার পকেট থেকে টাকা চুরি করে নিজের বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলো।কিন্তু দোষ এসে পড়লো আমার ঘাড়ে।আমার কাছে নিজের রেফারেন্সে কিছুই ছিলো না।বাবা জানতে পারলেন আমি তাকে খুঁজতে এসেছি।তাই ভাবলেন সত্যিই আমি চুরি করেছি।বেধড়ক মারলেন সেদিন আমাকে।আর সেই রাতেই আমার জীবনে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটলো।বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।মা সমস্ত দোষ আমার উপর চাপিয়ে দিলেন।সবাই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন।
তার কিছুদিন পর মা মারা গেলেন।আমার ঠিকানা হলো আবার আমার মামার বাড়ি।এইবার সবকিছু বদলে গেলো।মামার মাইর,মামির কাঠখোট্টা কথা,মামাতো ভাইবোনদের তিরস্কার আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।
দীর্ঘ আটবছর এক অন্য দুনিয়ার মানুষ ছিলাম আমি।আর আজ তার পরিণতি আজকের তন্ময় আকন।”

তন্ময়ের বুক চিড়ে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।মাহাদ থম মেরে বসে থাকলো।নিজের কথা ভাবলো সে।সে ভাবতো তার জীবন বুঝি নাটকীয় কিন্তু সবার জীবনই নাটকে ভরপুর।অন্তিম পর্বের আগে কিছুই বোঝা যায় না।তন্ময় মুচকি হেসে শান্ত গলায় আবার বললো–

“জানেন আরেকটা বিষয় কী!
সেদিন আমার বাবার মৃত্যুই আজকের আমার ডেসটিনি।
আরেকটা কথা,এই যে যার জন্য আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো সে আজ আমার সাথে।”

মাহাদ বিস্মিত গলায় বললো–

“মানে!তাকে খুঁজে পেয়েছেন?

“নাহ।পাইনি।ডেসটিনি পাইয়ে দিয়েছে।”

মাহাদ বিরক্তি গলায় বললো–

“প্লিজ,এক্সপ্লেইন ইন ডিটেইলস।”

তন্ময় ঝলমলে গলায় বললো–

“মামা আমার বিয়ে ঠিক করে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে।যেহেতু নাম আছে তাই আর আমার বংশ পরিচয় তাদের কাছে তেমন আক্ষেপের বিষয় হলো না।
কিন্তু ওই যে ডেসটিনি!
বিয়ের দিন মেয়ে উধাও।তাই বাধ্য হয়ে মেয়ের কাজিন এর সাথে আমার বিয়ে হয়।কিন্তু দুঃখের বিষয় কী জানেন!
মেয়েটার লাশ পাওয়া যায় তারই বাড়ির পিছনে একটা পুকুরে।আর যার সাথে আমার বিয়ে হয় সে আর অন্য কেউ নয় সে যাকে আমার কিশোর হৃদয় চেয়েছিলো।”

মাহাদ উদ্ভাসিত চোখে সবকিছু শুনছে।সত্যিই ডেসটিনি বলে কিছু আছে!
ভাগ্য সত্যিই নির্মম,নিষ্ঠুর,প্রতারক।

তন্ময় আবারো একগাল হেসে বললো–

“এই যে আপনারা ফিল্ম করেন তা কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত।শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফিল্মে ঘটে যাওয়া প্রতিটি দৃশ্য,প্রতিটি মানুষ একে অন্যের সাথে জড়িত।ঘটনাবিহীন কোনো চরিত্র নেই।”

মাহাদ একরাশ বিস্ময় আর জিঙ্গাসু দৃষ্টি নিয়ে বললো—

“তাহলে আপনি বলতে চান সেই স্বপ্ন আর আম্বের কানেক্টেড?

তন্ময় স্বাভাবিক গলায় বললো-

“আই ডোন্ট নো।
কিন্তু আমার মনে হয় কোথাও সে আপনার অস্তিত্বে জড়িয়ে আছে।
জানেন তো ডক্টর আর লয়্যার এর কাছে কোনো কিছু গোপন করতে নেই।
আপনি কিন্তু করেছেন।তাই এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো মতামত আমি দিতে পারলাম না।”

মাহাদ রহসময়ী হাসলো।তন্ময় ঠিক বলছে।সে তার আস্ত জীবন কাহিনি দিয়েও একটা ফিল্ম করতে পারে।যাতে থাকবে অসংখ্য থ্রিল।ক্ষমতার লোভ,অর্থের লোভ,অর্থের বিনিময়ে ভালোবাসার পরাজয়,ট্র্যাজেডি।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাহাদ।আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হলো না তার।ভাগ্যের উপর তার বিশ্বাস নেই।
মাহাদ উঠে দাঁড়ায়।মিষ্টি হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো—

“আজ তাহলে আসি।দেখি আমার ডেসটিনি কোথায় নেয় আমাকে।”

তন্ময় ব্যস্ত গলায় বললো—

“ওয়েট মি.মাহাদ।”

মাহাদ কপাল ভাঁজ করলো।তন্ময় কাউকে ডাকলো।

“আগ্নেত্রী!

একটা মেয়ে এলো।তন্ময় বললো–

“শী ইজ মাই ওয়াইফ।শী ইজ ইউর বিগেস্ট ফ্যান।”

মাহাদ বিগলিত হেসে শান্ত গলায় বললো—

“হাই।”

আগ্নেত্রী ঝুমঝুম করে হেসে উঠলো।উচ্ছ্বসিত গলায় বললো–

“আই এম ইউর ডাইহার্ট ফ্যান।অটোগ্রাফ প্লিজ।”

মাহাদ স্মিত হেসে বললো–

“শিউর।হোয়াই নট!

সব কাজ শেষ করে একটা ফাইল হাতে তন্ময় এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো মাহাদ।ফাইল টা খুলে দেখলো সব রিপোর্ট নর্মাল।মাহাদ হাসলো।আসলেই তো তার কিছু হয়নি।মাহাদ গাড়িতে বসলো।দুর্বোধ্য হাসলো মাহাদ।গাড়ির স্টেয়ারিং হাত দিয়ে বললো—

“আই এম সরি মিস আম্বের।আপনাকে অনেক সহ্য করতে হবে।আমার সব প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই দিতে হবে।তার আগে তো আপনাকে আমি ছাড়ছি না।আফটার অল ইউ আর মাই ডেসটিনি।”

মাহাদ বাঁকা হাসলো।বললো—

“আপনাকে আমার প্রয়োজন মিস সুগন্ধি।হায়,,,
আমার প্রজাপতি।আফসোস!
আপনার আরো আগে আসা উচিত ছিলো।পাঁচ বছর!এই পাঁচ বছর যে লম্বা সময়।আপনাকে তার হিসেব দিতে হবে প্রজাপতি।দিতে হবে।”

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here