বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ১১

0
3657

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ১১
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

“তব পাই তোমার দেখা,যদি না থাকে আশা
ঊষা লগ্নে কেন তবে এই দুরাশা?

প্রভাতের শুরু রাতের আঁধার কাটিয়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে।ঘন কুয়াশা আচ্ছাদিত চারপাশ।পুবের সূর্য সবেই উঁকি মারতে শুরু করেছে।

রাতে ঘরের দুয়ারে বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে সেখানেই চোখ বুজে নেয় আম্বের।বুকের ভেতর জমানো ভয় যেনো তার শরীর কে অবশ করে দিয়েছে।তাই তো শীতের হিমেল বাতাসও যেনো তার শরীরে কোনো প্রকার আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলো না।

আচমকা আম্বের এর কানে ভেসে আসে সাইরেন এর আওয়াজ।ভীতসন্ত্রস্ত আম্বের ঝট করে চোখ খুলে।কোনো কিছু না ভেবেই দৌড়ে আসে মেইন গেইটের সামনে।আম্বের ভীত চোখে তাকিয়ে রইলো।সে দেখলো একটা সাদা রঙের অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে আসছে।দম দম করে উঠে আম্বের এর হৃৎপিন্ড।মস্তিষ্কের কোনায় কোনায় বইতে থাকে ঝড়।ধীরে ধীরে বিবশ হয়ে আসছে আম্বের এর শরীর।কী হতে চলেছে!

সাইরেন এর ট্যাও ট্যাও আওয়াজে স্বপ্নমহলের বাকি সদস্যরাও গেইটে এসে দাঁড়ায়।ভয়ার্ত চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
অ্যাম্বুলেন্স থামে।তার পিছন থেকেই সাদা পোশাকে বেড়িয়ে আসে দু’জন লোক।স্ট্রেচার টেনে নামায় সেখানে।আম্বের নির্নিমষ তাকিয়ে আছে।অক্ষিযুগল ভরে উঠেছে শ্রাবণের স্নিগ্ধ ধারায়।যেনো এখনি নামবে বৃষ্টি।লোক দুজন স্ট্রেচার টা এনে রাখে গেইটের ভেতর।সবাই তটস্থ হয়ে চেয়ে আছে।অ্যাম্বুলেন্সের পিছনেই নিঃশব্দে থামে মাহাদ এর গাড়ি।আম্বের সেদিকে তাকাতেই দেখে ধীরগতিতে গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে মাহাদ।নরম পায়ে স্ট্রেচারের সামনে এসে দাঁড়ায়।আম্বের এর চোখের বান ছুটেছে।তবুও সে নড়লো না।অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মাহাদ এর দিকে।মাহাদ একবার গভীর চোখে তাকালো আম্বের এর দিকে।তারপর আর দাঁড়ালো না।লম্বা লম্বা পা ফেলে স্বপ্নমহল এ চলে যায়।আম্বের এর হুশ ফিরে আলতাফ এর করুন আর্তনাদ এ।স্ট্রেচারে থাকা লাশটার দিকে তাকাতেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায় আম্বের এর।থরথর করে কাঁপতে থাকে আম্বের এর শরীর।আটকে আটকে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে।হৃৎপিন্ড যেনো কম্পন নিতে ভুলে গেছে।কান্নার তোড়ে কথা আটকে গেছে আম্বের এর।সকল বাঁধা ভেঙে আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে আম্বের।

“বাবা!!!!!

মুহূর্তেই ভারী হতে থাকে শীতের কুয়াশায় আচ্ছাদিত বায়ু।স্বপ্নমহল এর প্রতিটি দেয়াল ভেদ করে তার কাঠামো নাড়িয়ে দিচ্ছে আম্বের গগনবিদারী কান্না।ছুটে এসে আহমেদ এর বুকে পড়ে আম্বের।জমাট বাঁধা গলায় বললো–

“বাবা,ও বাবা কী হয়েছে তোমার!কথা বলো বাবা,কথা বলো।”

আহমেদ শুয়ে আছে।নিরব,নিথর।কথা বললো না আহমেদ।কী করে বলবে!সে যে আজ চির সমাহিত।
আম্বের আবারো চিৎকার করে উঠে।আম্বের এর কান্নার আওয়াজ যেনো মাটি ফেড়ে উঠে পড়া গাছের শিঁকড় পর্যন্ত উপড়ে দিচ্ছে।চায় না সে এ মর্ত্যলোকে থাকতে।কান্না জড়ানো গলায় ক্ষুব্ধ হয়ে আম্বের বললো–

“কথা বলছো না কেন তুমি!ও বাবা কথা বলো।তোমার পরীর সাথে কথা বলো।ও বাবা তুমি চুপ করে আছো কেন!বাবা,বাবা।”

আম্বের উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ শুরু করে।দু হাতের ধাক্কায় ঝাঁকিয়ে তুলে বাবা কে।কিন্তু আহমেদ শান্ত,স্থির,নিশ্চল।সে কথা বললো না।আলতাফ পাশে বসে আম্বের এর।নম্র গলায় বললেন–

“শান্ত হোন বউমনি।”

আম্বের শান্ত হলো।গলা নামিয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো আধো বোলে বললো–

“চাচা,দেখেন না বাবা কথা বলছে না।আপনি বলেন না বাবাকে কথা বলতে।বলেন না তার পরী তাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।বলেন না চাচা।”

আলতাফ বার কয়েক ঢোক গিলে।

“রক্তের সম্পর্কে যখন টান লাগে অমৃতও তখন বিষ মনে হয়।”

নরম গলায় আলতাফ বললো–

“শান্ত হোন বউমনি।সামলান নিজেকে।মৃত্যু সে তো চির সত্য।আজ আর কাল তার আস্বাদন তো করতেই হবে।”

আম্বের শুনলো না।উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করে।বাড়ির সবাইর চোখ দিয়ে ঝড়তে থাকে নিরবধি জলের ধারা।আম্বের কে কেউ আর কিছু বললো না।

“জমাট বাঁধা কষ্টের হিমালয় গলাতে চোখের উষ্ণ জল ই ঝড়াতে হয়।”
,
,
খাটিয়ায় শুয়ে আছে আহমেদ এর প্রানহীন দেহ।সাদা শুভ্রতায় জড়ানো একটি নিথর দেহ।তার সামনেই বসে আছে আম্বের।কাঁদছে সে।কিন্তু নিঃশব্দে।কোনো ছন্দপতন নেই।নিরবে চোখের কোণ বেয়ে ঝড়ছে নোনতা জলের প্রস্ররণ।নির্বিকার চেয়ে আছে আম্বের।যেনো তার দেহে প্রাণ নেই।
আগরবাতির মৃদু গন্ধ যেনো ভয়ংকর করে তুলেছে পরিবেশ।
হঠাৎ আম্বের এর মনে হলো কেউ তাকে দেখছে।আম্বের দ্বিধান্বিত হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।স্বপ্নমহল এর সামনের খোলা যায়গায় আহমেদ এর লাশ রাখা হয়েছে।আর তার বরাবরই স্বপ্নমহল এর বিশাল খোলা বারান্দা।
মাহাদ স্থিরচিত্তে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে।আম্বের এর কাতর চোখ আবদ্ধ মাহাদ এর সমাহিত চোখে।
আহমেদ কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার শেষ ঠিকানায়।আম্বের তাকিয়ে দেখেই হকচকিয় উঠে।ব্যস্ত গলায় বললো—

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমার বাবা কে!কেনো নিয়ে যাচ্ছেন!আমার বাবা কে নিবেন না।”

আলতাফ ধরে রেখেছে আম্বের কে।স্বপ্নমহল এ কোনো মহিলা নেই।আলতাফ নিজ হাতে ধরে রেখেছে আম্বের কে।আম্বের কে সামলানো যাচ্ছে না।বিলাপ করে কাঁদছে আম্বের।
মাহাদ এলো না।পাথরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো।নিয়ে যাচ্ছে আহমেদ কে।আম্বের এর মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে।ভারী হয়ে উঠছে আম্বের এর বুকের বা’পাশ।সবকিছু ধীরে ধীরে শান্ত হতে লাগলো।ঢলে পড়ে আম্বের আহমেদ এর কোলে।
,
,
,
বিছানায় বসে আছে আম্বের।আহমেদ এর মৃত্যুর আজ সাতদিন হয়েছে।তিনদিনের দিন ছোট খাটো মিলাদ পড়ানো হয়।পুরো স্বপ্নমহল এক জলজ্যান্ত কবরস্থান এ পরিণত হয়েছে।
মানুষ তো আছে কিন্তু জীবন্ত লাশের মতো।কারো মুখে কোনো কথা নেই।সবাই নিশ্চুপ।
এই সাতদিনে একবারো মাহাদ আম্বের এর কাছে আসেনি।ছিলোই না বাসায়।ব্যস্ত সময় পার করে তার শুটিং এ।কিন্তু এই কয়েকটা দিন মায়ের মতো করে আম্বের কে আগলে রেখেছে আলতাফ।মাহাদ বাসায় না থাকার কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় আম্বের সাথেই কাটায় আলতাফ।একদম মিইয়ে পড়েছে আম্বের।এই কদিনে চেহারা হয়েগেছে বিবর্ণ,বেরঙ।ইমুও আসেনি একবারের জন্যও আম্বের এর কাছে।দুই একবার যাও এসেছে দরজা থেকে আম্বের কে দেখেই চলে গিয়েছে।স্কুলেও যায় না ইমু।সারাদিন ঘরে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকে।

হঠাৎ চোখের পানি ব্যস্ত হাতে মুছে নেয় আম্বের।বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ছোট্ট একটা শোকেস থেকে একজোড়া চাবির গুচ্ছ এনে হাতে দেয় আলতাফ এর।আলতাফ এক পলক দেখে নির্বিকার ভাবে বললেন—

“কী হয়েছে বউমনি?

আম্বের ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো।শক্ত গলায় বললো–

“বাবা তো নেই।আপনারা নতুন লোক রেখে নিবেন।”

আলতাফ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।আম্বের ব্যতিব্যস্ত হয়ে একটা কালো রঙের স্যুটকেস নিয়ে বিছানায় রাখে।নিজের জামা কাপড় ভাঁজ করে তাতে ভরতে থাকে।আলতাফ বিস্ময়কর চোখে তা অবলোকন করে।গভীর স্বরে জিঙ্গাসু গলায় বললেন—

“এইসব কী করছেন বউমনি!

হালকা হাসে আম্বের।সমস্ত জরাজীর্ণতা দুর করে সরস গলায় বললো–

“আমি চলে যাবো চাচা।বাবা যখন নেই তখন আর এখানে আর কেন থাকবো!

আলতাফ দ্রুতপায়ে আম্বের এর কাছে এসে দাঁড়ায়।শঙ্কিত গলায় বললেন–

“এইসব কী বলছেন!কোথায় যাবেন আপনি?

আম্বের বিগলিত হেসে স্বাভাবিক গলায় বললো–

“পৃথিবীটা মস্ত বড় চাচা।কোথাও না কোথাও জায়গা হয়ে যাবে।কিন্তু এই বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়।”

আলতাফ চিন্তিত গলায় বললেন–

“কেন?

আম্বের চুপ করে রইলো।কাপড় গুছিয়ে স্যুটকেস আটকে বললো—

“সোনার খাঁচায় আবদ্ধ পাখি আমি নই চাচা।মাটির পিঞ্জিরা থেকে পালিয়ে এসে আরেক পিঞ্জিরায় বন্দি হতে আমি চাই না।তাই আমি চলে যাবো।”

“কোথায় যাবেন আপনি?

ভারী পুরুষ কন্ঠে ফিরে তাকায় আম্বের।মাহাদ ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে।কিন্তু তাতে আম্বের কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।অধর কোণে তাচ্ছিল্যের হাসে হেসে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
মাহাদ বিরক্তিকর গলায় বললো—

“কোথায় যাবেন আপনি?

আম্বের অগ্নি চোখে তাকায়।তার শিরা উপশিরা দপদপ করছে।এই মানুষটাকে জীবনে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।মাহাদ স্পষ্ট দেখতেপায় যে চোখে সে তার জন্য স্বার্থহীন ভালোবাসা দেখেছে আজ সে চোখে ক্ষোভ,রাগ,ক্রোধ আর একরাশ অভিমান এসে জড়ো হয়েছে।মাহাদ বিচলিত হলো না।এখন তাকে শান্ত থাকতে হবে।আম্বের নাক ফুলিয়ে কঠোর গলায় বললো–

“সেই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দিতে আমি বাধ্য নই মি.মাহাদ আবইয়াজ।”

মাহাদ অবিচলিত গলায় শান্তভাবে বললো—

“শান্ত হোন।আর প্লিজ আমাকে একবার বলার সুযোগ দিন।”

আম্বের দৃঢ় গলায় ক্রোধিত হয়ে বললো—

“নাহ।কিচ্ছু শুনতে চাই না আমি।এক নিষ্ঠুর,পাষান,হৃদয়হীন পুরুষের কাছ থেকে কিছু শুনতে চাই না আমি।”

আম্বের মাহাদ শার্ট খামচে ধরে তাকে ঝাঁকাতে লাগলো।শক্ত গলায় আবার বললো—

“আমি ভুল করেছি আপনার মতো একজন মানুষকে ভালোবেসে।আপনি এমন একজন মানুষ যে আমার বাবার কবরে এক মুঠো মাটি পর্যন্ত দিতে যান নি।পৃথিবীতে আমি যদি আমার বাবাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবেসে থাকি তা ছিলেন আপনি।আর পৃথিবীতে প্রথম যদি আমি কোনো মানুষ কে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি সেটাও আপনি।চলে যান আপনি একান থেকে।আমি আর কখনো আপনাকে দেখতে চাই না।”

মাহাদ আম্বের কে কিছু বললো না।আলতাফ কে হালকা গলায় বললো—

“আপনি যান চাচা।”

আম্বের ফুঁসলে উঠে।ক্ষুব্ধ গলায় বললো–

“কেন যাবে চাচা!আপনি কী ভেবেছেন আমি আপনাকে ভয় পাই।নো মি.মাহাদ আবইয়াজ।নো।আই জাস্ট হেট ইউ।হেট ইউ।”

মাহাদ হিসহিস করতে থাকে।দাঁতে দাঁত চেপে অধর ছড়িয়ে শ্বাস নেয়।নিজেকে যথাসম্ভব সংবরণ করে গাঢ় গলায় বললো—

“আপনার রাগ জায়েজ।আমি মানছি প্রজাপতি।বাট আমাকেও বলার সুযোগ দিন।”

আম্বের মুখ তুলে বিদ্রুপপূর্ণভাবে হাসে।আর তাচ্ছিল্যের সুরে বললো—

“প্রজাপতি!কে প্রজাপতি!আর কখনো এই নামে ডাকবেন না আমাকে।কেউ নই আমি আপনার,কেউ নই।আর কিসের সুযোগ এর কথা বলছেন!কোনো কৈফিয়ত চাই না আমার।”

আম্বের স্যুটকেস নিয়ে দু কদম আগাতেই মাহাদ শক্ত করে আম্বের এর হাত চেপে ধরে।ভারী গলায় প্রশ্ন করলো–

“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

“হাত ছাড়েন আমার।ছাড়েন।কোন অধিকারে আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন!

মাহাদ গভীর দৃষ্টিতে আম্বের এর দিকে তাকায়।আজ এই চোখ সত্যিই ওকে খুন করে দিবে।মনে মনে হাসে মাহাদ।আনমনেই বললো, আপনি সত্যিই আমার ভালোবাসার সুগন্ধি প্রজাপতি।আপনার ওই অরুনলোচন চোখেও এক অকৃত্রিম মোহনীয় নেশা।আপনাকে আমি ছাড়তে পারবো না মিস সুগন্ধি।আমার এই স্পন্দনহীন হৃদয়ে যে আপনাকে প্রয়োজন প্রজাপতি।
নিজের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে মৃদু হাসে মাহাদ।ধীরে ধীরে অধর প্রশস্ত করে হাসতে থাকে মাহাদ।আর ক্ষনকাল ব্যয়েই উন্মাদগ্রস্তের মতো অগোছালো হাসিতে ফেটে পড়ে সে।আম্বের নিশ্চুপ,নিথর হয়ে উদ্বাসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।হাসি বন্ধ করে মাহাদ।ঘর জুড়ে সুনসান নিরবতা।শোঁ শোঁ করে মৃদু বায়ু বইছে।মাহাদ বাঁকা হেসে বললো–

“অধিকার!অধিকারের কথা বলছেন! আপনার আদ্যোপান্ততে এখন শুধু আমার অধিকার।আমার নির্দেশ ছাড়া আপনি শ্বাস ও নিতে পারবেন না মিস আম্বের।”

ভারী হয়ে আসে আম্বের এর দেহপিঞ্জর।ঘন হয়ে আসে তার নিঃশ্বাস।মাহাদ ওকে আম্বের তখনই বলে যখন সে তাকে নিয়ে ভাবে না।কী ছিলো মাহাদ এর কথায়!আম্বের ভীত গলায় বললো–

“কী বলতে চান আপনি!

“দেখাতে চাই।”

মাহাদ আম্বের কে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নমহল এর দোতালায় ঠিক মাহাদ এর পাশের বেড রুমে।আম্বের এখনো থম মেরে আছে।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।মাহাদ জোরালো পায়ে নিজের ঘরে যায়।কিছু সময় পর একটা ফাইল নিয়ে ফিরে আসে।আর তা তুলে দেয় আম্বের এর হাতে।আম্বের ফাইলটা দেখতেই ওর চোখের টলটলে অশ্রুবাণ গড়িয়ে পড়তে থাকে।চোখ,মুখ বিকৃত করে ছিড়ে ফেলে দেয় ফাইল।মাহাদ মৃদু হাসে।শয়তানি গলায় বললো—

“ওটা তো ফটোকপি।মেইন কপি আমার কাছে।
তো এখন বলেন আমার কি অধিকার!

আম্বের স্তব্ধ হয়ে যায়।এ কোন মাহাদ কে দেখছে সে!মানুষ এতোটা নিচে কী করে নামতে পারে।আম্বের চিৎকার করে বললো—

“আমি বিশ্বাস করি না।এইসব মিথ্যে।”

মাহাদ অদ্ভুত শব্দ করে মুখ দিয়ে।আফসোসের গলায় বললো–

“আই উইশ !
এইসব মিথ্যে হতো।বাট ইটস ট্রু মিস আম্বের।পুরো তিন কোটি টাকায় আপনার বাবা আপনাকে আমার কাছে বিক্রি করেছে।তিন কোটিতে কয়টা শূন্য হয় জানেন তো!

আম্বের ধীর গলায় বললো–

“আমার বাবা এমন কাজ করতেই পারে না।”

মাহাদ বিছানার কাছে গিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়ে।হালকা গলায় বললো–

“আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি।কিন্তু এইটা সত্যি প্রজাপতি।আপনার বিশ্বাস না হলে তার সিগনেচার দেখতে পারেন।তবে আপনার বাবা বেশ বুদ্ধিমান।আপনাকে কোনো ব্রোথেলে বিক্রি করলে কতো পেতো!দু লাখ,পাঁচ লাখ কিংবা বড় জোড় দশ!কিন্তু আমি পুরো তিনকোটি দিয়েছি।এই টাকা দিয়ে তো তিনি সারাজীবন আরামে খেয়ে যেতে পারতো।কিন্তু আফসোস!

আম্বের চুপ করে রইলো।সত্যিই কী তার বাবা তাকে বিক্রি করে দিয়েছে!আর যদি দিয়েই থাকে তাহলে এতো টাকা সে কী করেছে!আর মাহাদ ই বা তাকে এতো টাকা দিয়ে কেনো কিনে নিবে!
আম্বের শান্ত গলায় বললো–

“আমি কোনো পন্য নই।”

মাহাদ দু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসে।স্বাভাবিক গলায় বললো–

“আপনি আমার ভালোবাসা।”

“আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

“আমি ভালোবাসলে যে আপনাকেও বাসতে হবে তার কোনো প্রয়োজন নেই।”

“যেতে দিন আমাকে।কী ক্ষতি করেছি আমি আপনার !কেনো করছেন আপনি এইসব!

মাহাদ ঝট করে উঠে দাঁড়ায়।আম্বের এর কাছাকাছি গিয়ে বললো—

“ক্লস গুলো ঠিক মতো দেখেছেন তো প্রজাপতি।আপনার উপর এখন শুধু আমার অধিকার।চুপচাপ আমি যা বলি তা শুনবেন।তাতে আপনারও ভালো আমারো ভালো।”

আম্বের কঠিন গলায় বললো—

“ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে!

মাহাদ হাসে।ঝরা গলায় বললো–

“মাহাদ আবইয়াজ ভয় দেখায় না,ভয় জয় করে।
আপনার বাবাকে তো অনেক ভালোবাসেন তাই না।এখন যদি আপনি এই বাড়ি থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে আমি আপনার বাবার নামে কেস করবো।আপনার মৃত বাবাকে এক মুহূর্তও শান্তিতে থাকতে দিবো না আমি।”

আম্বের ফিচেল হাসে,বললো–

“মৃত মানুষের নামে কেস!
হাউ ফানি মাহাদ আবইয়াজ!

“ইয়েস মিস সুগন্ধি।টাকা সব পারে।আপনার জন্য নতুন বাবা নিয়ে আসবো।”

হাসতে থাকে মাহাদ।মাহাদ এর হাসিতে ঝনঝনিয়ে উঠে আম্বের এর শরীর।সে এই মাহাদ কে কখনো দেখেনি।কখনো না।
দরজা আটকে বের হয় মাহাদ।আলতাফ ব্যস্ত গলায় বললেন—

“কী শুরু করেছেন আপনি!কেনো এতো কষ্টা দিচ্ছেন বউমনি কে?

মাহাদ কিচেন এ যায়।একটা কোল্ড ড্রিংস এর ক্যান নিয়ে নিয়ে তাতে চুমুক লাগায়।তীব্র শীতেও তার শরীর দিয়ে তপ্ত আভা নির্গত হচ্ছে।একটু আগে যা সে করেছে তা অবিশ্বাস্য।করিডোরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় মাহাদ।আলতাফ তার থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে।সে তার প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষমান।মাহাদ দুর আকাশে তাকিয়ে আছে।রৌদ্রোজ্জ্বল দিন।সূর্যের মিষ্টি আলো।ফিকে নীলাভ আকাশ।

স্মিত গলায় মাহাদ বললো—

“সবে তো শুরু চাচা।এখনো অনেক বাকি।”

আলতাফ রাগাম্বিত গলায় বললেন–

“এইসব করলে কী সে আপনাকে ভালোবাসবে!

মাহাদ বিগলিত গলায় বললো–

“ঘৃণা করবে।ভালোবাসা আর ঘৃনা পাশাপাশি থাকতে পারে না।হয় ভালোবাসবে না হয় ঘৃণা করবে।”

আলতাফ জোর দিয়ে বললেন–

“আপনি যা করছেন তাতে সে আপনাকে ঘৃণাই করবে।”

মাহাদ দুর্বোধ্য হাসলো।তপ্ত গলায় বললো—

“বিনা অপরাধে সবাই আমাকে ঘৃণা করেছে।আপনার বউমনি না হয় আমার অপরাধের কারনেই আমাকে ঘৃণা করবে।ভালোবাসার অপরাধে।”

আলতাফ কন্ঠে নমনীয়তা এনে ব্যস্ত ভাবে বললেন–

“আপনি তাকে সব সত্য বলে দিন।”

মাহাদ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

“যখন পুরো সত্য আমি নিজেই জানি না তাকে কী করে বলবো!

মাহাদ কাউচে বসলো।গম্ভীর গলায় আলতাফ কে বললো—

“আপনি মি.রহিম কে বলে ইমু কে কোনো বোর্ডিং স্কুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।কারণ এরপর এই বাড়িতে যা হবে আমি চাই না তার বিরূপ প্রভাব পড়ুক ইমুর উপর।আমি চাই না আরেকজন মাহাদ আবইয়াজ এর জন্ম হোক।”

আলতাফ নিঃশব্দে চলে গেলেন।মাহাদ হেলান দিয়ে বসে কাউচে।তার কানে আম্বের এর মৃদু চিৎকার এর আওয়াজ ভেসে আসছে।মাহাদ তার চক্ষু মুদিত করে ভাবনার জগতে ডুব দেয়।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here