বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ২৭

0
3297

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ২৭
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

সময়ে অসময়ে আমরা খুব করে কাছের মানুষের শূন্যতা অনুভব করি।প্রিয় মানুষগুলো যখন কাছে থাকে তখন হয়তো আমরা তাদের প্রয়োজনীয়তা ততটা উপলব্ধি করি না যতটা আসলেই তাদের আমাদের প্রয়োজন।

সামান্তার বাবা একজন স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী।তার পক্ষে বাড়তি একজনের খরচ চালানো একটু কষ্টকরই বটে।কিন্তু তিনি এই নিয়ে কোনো কথা বলেন নি।কিন্তু সামান্তার মা এক সপ্তাহ চুপচাপ থাকলেও পরে এ নিয়ে একটু আকটু টু টা করেই ফেলে।আম্বের সব শুনেও চুপ করে থাকে।পরে বাধ্য হয়েই সামান্তাদের বাড়ির ছুটা কাছের মহিলাকে বাদ দিতে বলে।সামান্তা এই নিয়ে মায়ের সাথে উচ্চবাচ্য করে কিন্তু আম্বের তাকে থামিয়ে দেয়।এখন সামান্তাদের বাড়ির সব ধরনের কাজ আম্বের নিজের হাতেই করে।কলেজে আর যাওয়া হয় না তার।সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই বছর গ্যাপ দিয়ে যদি সামনের বছরের মধ্যে কোনো কাজ জুটাতে পারে তবেই পড়ালেখা কন্টিনিউ করবে নাহলে যা করছে এই ঢের।এতিমদের এতো পড়তে নেই।

সেদিনের পর আরো দুই দিন এসেছিলো রিমেল।আম্বের এর সাথে গিয়ে বাসা খুঁজেছে।কিন্তু ভালো বাসা পাওয়া যায়নি।আবার কোথাও কোথাও ব্যাচেলর ভাড়া দিবে না।হতাশ হয় রিমেল।
তারপর আর আসেনি।অবশ্য এতে হাঁফছেড়ে বাঁচে আম্বের।সে আর কিছুতে জড়াতে চায় না।এখন শুধু একটা ছোট খাটো চাকরি পেলে তার সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়।

আম্বের মাঝে মাঝে এলাকার ছোট্ট বাজারে যায়।একদিন সামান্তার মায়ের সাথে এসেছিলো।এখন একাই আসে।রান্নার জন্য কিছু সবজির প্রয়োজন।সবজি কিনে ফেরার পথে এক পুরুষালী কন্ঠে চকিতে পেছন ফিরে তাকায় আম্বের।একগাল হেসে তাকে হাত নেড়ে সম্ভাষন করে রিমেল।আম্বের এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো—

“কেমন আছেন?

আম্বের বিস্মিত গলায় বললো —

“আপনি!এখানে!

রিমেল স্বাভাবিক গলায় বললো—

“জ্বী আমি।খুশি হলাম ভুলে যান নি।”

আম্বের চোখ সংকীর্ণ করে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় বললো—

“ভুলে যাওয়াটা কী উচিত ছিলো!

রিমেল দুর্বোধ্য হাসলো।ফের বললো–

“বললেন নাতো কেমন আছেন?

আম্বের নিরুদ্বেগ গলায় বললো–

“জ্বী মরিনি এখনো।বেঁচে আছি।জানেন তো মেয়ে মানুষের প্রাণ কই মাছের প্রাণ।”

রিমেল নীরস হাসলো।রিমেল এর দিকে তাকিয়ে আম্বেরও স্মিত হাসলো।সরস গলায় বললো–

“তা এখানে আপনি!

“জ্বী।এই এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছি।”

আম্বের ঈষৎ অবাক গলায় উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো–

“ওমা তাই নাকি!তা বেশ ভালো।”

রিমেল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো–

“হুম।তা বলতে পারেন।
আপনার কী অবস্থা?

“জ্বী ভালোই।”

“আপনার কাছে একটা রিকোয়েস্ট ছিলো।করতে পারি?

আম্বের খানিক চুপ থেকে বললো–

“বলতে পারেন।”

রিমেল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো–

“আপনি কী একটু সময় করে আমার বাসায় যাবেন?

আম্বের ভ্রু কুঁচকে ঝট করে বললো–

“মানে?

রিমেল আশ্বস্ত গলায় বললো—

“রাগ করবেন না।একচুয়েলী আমার বোনটা বাসায় সারাদিন একা থাকে।তাই যদি আপনি একটু ওর সাথে সময় কাটাতেন।”

আম্বের বিরক্ত হয়।আশ্চর্য লোক!না হয় সেদিন একটু সাহায্য করেছে তাই বলে যখন তখন আবদার করবে নাকি!
আম্বের উষ্ণ গলায় বললো—

“আজব মানুষ তো আপনি!এক দেখায় এতো আবদার করার সাহস কোথায় পেলেন!আর আপনি ভাবলেন কী করে আপনি বললেই আমি…।”

“শি ইজ প্যারালাইজ।”

রিমেল এর কথায় থমকে যায় আম্বের।হকচকিয়ে বললো—

“মানে!কী বলছেন আপনি?

রিমেল মৃদু হাসে।সহজ গলায় বললো—

“আমার বোন হাঁটতে পারে না।আসলে একটা অ্যাকসিডেন্টে মা বাবা মারা যায় আর আমার বোন প্যারালাইজড হয়ে যায়।কারো সাথে কথা বলে না ও।এভাবে কী বাঁচা যায় বলেন!আপনাকে দেখে কেনো যেনো মনে হলো আপনিও ওর মতোই দুঃখী।হয়তো আপনিও কিছু হারিয়েছেন।তাই বললাম।সরি।”

কথা বলতে বলতে রিমেল এর গলা বসে আসে।আম্বের অনুতপ্ত হয়।অনুযোগের গলায় বললো—

“আই এম রিয়েলী সরি।ঠিক বুঝতে পারি নি।
আমার কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু..।”

রিমেল জিঙ্গাসু গলায় বললো–

“কিন্তু কী?

“আসলে আমি আপনাকে এক্সেক্ট টাইম দিতে পারবো না।”

“সমস্যা নেই।আমি সারাক্ষন বাসায় ই থাকি।”

“কেন?কিছু করেন না আপনি?

“আউটসোর্সিং।তাই বাইরে যেতে হয় না।আপনার যখন সময় হবে তখন আমাকে কল করবেন।”

রিমেল আম্বের কে একটা নাম্বার দিয়ে চলে যায়।আম্বের কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে,তার কী অপরিচিত কাউকে বিশ্বাস করা উচিত?
,
,
,
কাউচে হেলান দিয়ে বসে আছে মাহাদ।আজ দশদিন পর সে বাসায় এসেছে রাতে থাকবে বলে।সময় এখন যেনো ঘড়ির কাটা।টিক টিক করে এগিয়ে চলে।কাউচ থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই কথা বললো আলতাফ—

“এইসব কী শুরু করেছেন আপনি!
বউমনি কি কেন ফিরিয়ে আনছেন না?

মাহাদ শক্ত গলায় বললো–

“সে আর এই বাড়িতে আসবেনা।”

আলতাফ উত্তপ্ত গলায় বললো—

“কী বলতে চান আপনি?

“কী বলেছি তা নিশ্চয়ই শুনেছেন।একবারের কথা আমি দ্বিতীয় বার বলতে চাই না।”

আলতাফ গরগরে গলায় বললো—

“আপনাকে ইচ্ছে করছে একটা ঠাটিয়ে চড় মারি।কেন বউমনির জীবনটা নষ্ট করলেন আপনি!

মাহাদ ম্লান হাসে।আলতাফ এর সামনে গিয়ে হালকা ঝুঁকে বললো—

“মারেন।একটা চড় মারেন।এতে যদি আপনি একটু শান্তি পান।আপনার বউমনি কে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন আপনি!তাই আজ প্রথম আমাকে আপনার মারতে ইচ্ছে হলো।”

আলতাফ প্রজ্জ্বলিত চোখে তাকিয়ে শাসানো গলায় বললো—

“মনে রাখবেন কাউকে কষ্ট দিয়ে কেউ কখনো সুখ পায় না।”

মাহাদ গা দুলিয়ে হেসে উঠলো।নম্র গলায় বললো–

“জানি চাচা।কে বললো আমি সুখ পেয়েছি!আমি তো অসুখ বাঁধিয়েছি।আর রোজ রাতে তার দাওয়াই নেই।”

মাহাদ তার রুমে ঢুকে দম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।টেবিলের উপরে স্লিপিং পিল ছিলো।সেখান থেকে তিনটা স্লিপিং পিল খেয়ে শুয়ে পড়ে মাহাদ।তবুও তার ঘুম আসে না।মাঝরাতে ভীষন যন্ত্রণা হয় মস্তিষ্কে।এক অবর্ণনীয়,অব্যক্ত,অসহনীয় যন্ত্রণা যা সে একাই বয়ে বেড়ায়।
,
,
,
আম্বের এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে।নিয়তিকে মেনে নিয়েছে সে।হয়তো তার বাবার মৃত্যুর সাথে সাথে তার সমস্ত সুখ চলে গেছে।আর সেখানে কালবৈশাখীর মতো হানা দিয়েছে মাহাদ নামের মানুষটি।

এ কয়েকদিনে আম্বের এর বেশ ভাব হয়েছে রিঝুম এর সাথে।রিঝুম রিমেল এর ছোট বোন।রোজ সময় করে একবার আসে আম্বের।রিমেলই তাকে গিয়ে নিয়ে আসে।দুই একবার সামান্তাও সাথে এসেছিলো।
রিঝুম মেয়েটা ভারি মিষ্টি।কাঁধ পর্যন্ত বব স্টাইলে চুল।দেখলেই কুচ কুচ হোতা হ্যায় মুভির অঞ্জলির মতো মনে হয়।টসটসে দুটো গাল।আম্বের প্রায়ই ওর গাল টেনে দেয়।ঝুমঝুম করে কথা বলে রিঝুম।একবার বলা শুরু করলে আর থামেই না।আম্বেরও অনেক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে রিঝুম এর সাথে কথা বলতে।

ওদের সবার জন্য কফি নিয়ে আসে রিমেল।গরম গরম খেতে ততোটাও মন্দ না।বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
কফিতে চুমুক দিয়ে আম্বের স্বাভাবিক গলায় অনুনয় করে বললো —

“আপনি যে কাজটা ঘরে বসে করেন তা সম্পর্কে আমাকে একটু বলবেন?

রিমেল ধাতস্থ হয়ে বললো—

“হোয়াই নট?
একচুয়েলি এইটা একটা গিভ এন্ড টেক রিলেশন।আই মিন নিজের কাজ টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে করানো।আপনি ইচ্ছে করলেই ঘরে বসেই আরাম সে এই কাজ করতে পারেন।”

আম্বের আগ্রহদীপ্ত হয়ে বললো–

“আমাকে শেখাবেন?

রিমেল আর রিঝুম একে অপরের দিকে তাকায়।রিমেল গাঢ় গলায় বললো–

“তাহলে কিন্তু আপনাকে আমায় অনেক সময় দিতে হবে।
আউটসোর্সিং এর জন্য আপনাকে একজন দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হতে হবে আর এর জন্য সবচেয়ে জরুরী হলো দক্ষতা।আর দক্ষতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই আপনাকে অধিক জানতে হবে আর প্র্যাকটিস করতে হবে।আর এর জন্য মূখ্য হলো সময়।
জানেন,অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট-ওআইআই’র মতে অনলাইন শ্রমিক সরবরাহে বাংলাদেশ এখন বিশ্বেয দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।এ দেশে নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার রয়েছে প্রায় ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার।এর মধ্যে পাঁচ লাখ নিয়মিত কাজ করছে।
বাংলাদেশ আইসিটি ডিভিশন তথ্য অনুযায়ী,তারা বার্ষিক দশ কোটি ডলার আয় করছে।”

আম্বের মুগ্ধ হয়ে সব শুনছিলো।তার মনে আশার আলো ফোটে।যদি ভালো করে এই কাজটা সে আয়ত্ত করতে পারে হয়তো এর মাধ্যমে সে তার জীবন বদলাতে পারে।তাকে আর কারো করুনা নিতে হবে না।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আম্বের।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here