বদ্ধ হৃদয়ের অনুভুতি পর্বঃ২৮

0
3406

#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ২৮
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

নৈঃশব্দ চারপাশ।এসির ভোঁতা শব্দে থমথম করছে ঘর।পাশে খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসছে ফুলের ঘ্রাণ।বাতাসের বেগে উড়ে যাওয়া পর্দার ফাঁকে দেখা মিলছে নীলাভ আসমানের।মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি।কোথাও কোথাও তা আবার জটলা বেঁধে রয়েছে।

বিক্ষিপ্তচিত্তে সোফায় বসে আছে মাহাদ।আম্বের যাওয়ার প্রায় পনেরো দিন হতে চললো।ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহাদ।
একটু পরই বের হবে সে।তার হাতে এখন প্রচুর কাজ।হাতে থাকা রিমোট দিয়ে টিভি অন করে চ্যানেল পাল্টাতে থাকে।একটা চ্যানেলে এসে তার চোখ আটকে যায়।বিখ্যাত ওয়েব সিরিজ প্রযোজক এনাম মাহমুদের দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার তারই ফার্ম হাউজ থেকে।ব্রেকিং নিউজ পড়তেই চোখ কপালে উঠে মাহাদ এর।হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।পর মুহুর্তেই মোবাইলের রিং বেজে উঠে তার।রিসিভ করতেই শীতল কন্ঠ বলে উঠে–

“কেমন আছো মাহাদ।”

মাহাদ অবাক গলায় বললো—

“আপনি!এই নাম্বার কোথায় পেলেন?

“তোমাকে তো আমি পাতাল থেকেও খুঁজে বের করবো।এইটা তো একটা নাম্বার।
নিউজ দেখেছো?

মাহাদ অবিচলিত গলায় বললো–

“কেন মারলেন তাকে?

মাহতাব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন যেনো তিনি মজার কিছু শুনলেন।ঝলমলে গলায় বললেন–

“এনামের সাহস কী করে হয় তোমাকে ব্ল্যাকমেল করার!আমার মেয়ের নাম ভাঙিয়ে।আমি তো অবাক হচ্ছি।বেশি কষ্ট দেইনি তো।জাস্ট ওর গলায় ছুরিটা বসাতে বলেছি।তারপর দু টুকরো।”

মাহাদ এর মস্তিষ্ক ঝিমুনি দিয়ে উঠে।কী বিভৎষ!

মাহাদ শক্ত গলায় বললো—

“এইসব এর কোনো প্রয়োজন ছিলো না।”

মাহতাব জোর গলায় বললেন–

“আলবৎ ছিলো।ওর শাস্তি ও পেয়েছে।এইবার তোমার পালা।”

মাহাদ দৃঢ় গলায় বললো—

“কী বলতে চান আপনি!

“মেয়েটা কোথায় মাহাদ?

মাহাদ ছোট করে শ্বাস ফেললো।শান্ত ও নম্র গলায় বললো—-

“আপনি ভুল করছেন।সে এখানে নেই।কোথায় আছে আমি জানি না।”

মাহতাব তার কন্ঠ আরো নমনীয় করে বললেন—

“তা আমি জেনে নেবো।তোমাকে আমি শান্তিতে থাকতে দিবো না।”

মাহাদ রুষ্ট গলায় বললো–

“কেন পাগলামি করছেন আপনি?আপনি ভালো করেই জানেন এতে আমার কোনো দোষ নেই।আপনার মেয়ের মৃত্যুর জন্য সে নিজেই দায়ী।”

মাহতাব দাম্ভিক গলায় বললেন—

“একদম চুপ।কী করিনি আমি তোমার জন্য!আজকের এই যশ,খ্যাতি,সুনাম সব পেয়েছো তুমি আমার জন্য।তার বিনিময়ে কী করেছো তুমি!কেড়ে নিয়েছো আমার মেয়ে কে।তোমাকে আমি কখনই শান্তিতে থাকতে দিবো না।”

“আপনার মেয়ে কখনো আমাকে ভালোবাসেনি।শুধু ব্যবহার করতে চেয়েছিলো।”

“সেদিন সে সত্যিই তোমার কাছে ভালোবাসা নিয়ে গেছিলো।কিন্তু তুমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছো।যদি তুমি সেদিন তাকে ফিরিয়ে না দিতে তাহলে সে আজ আমার কাছেই থাকতো।”

“ইট ওয়াজ এন অ্যাকসিডেন্ট।তাতে আমার কোনো হাত ছিলো না।
আর কতোদিন আমার উপর দোষ চাপিয়ে এইসব খুনের খেলা খেলতে থাকবেন!

“যতদিন আমি বেঁচে থাকবো।”

লাইন কেটে যেতেই তটস্থ হয়ে কল ব্যাক করে মাহাদ।কিন্তু নাম্বার সুইচ অফ।মাহাদ ব্যস্ত হয়ে কল করে তার বন্ধু কে।

গমগমে গলায় মাহাদ বললো–

“মাহতাব খান ফিরে এসেছে।শুরু করেছে আবারো সেই খেলা।টিভি অন কর।”

“হোয়াট দ্যা হেল?
পাগল হয়ে গেলো নাকি!
কী করবি এখন তুই?

মাহাদ শক্ত গলায় বললো—

“তোকে আমি দেড় মাস সময় দিলাম।এর মধ্যে তুই ওই লোকটাকে খুঁজে বের করবি।”

মাহাদ এর বন্ধু ব্যস্ত গলায় বললো–

“মাথা খারাপ তোর!যাকে এ কয়েকমাসেও খুঁজে পাইনি তাকে দেড় মাসে কোথায় পাবো আমি?

“কোথায় পাবি জানি না।তাকে আমার চাই।আর এইবার আর আমি হারবোনা।গত পাঁচটা বছরে বিষিয়ে তুলেছে আমার জীবন ওই মাহতাব খান।এইবার আমার টার্ন।রোজা কে মেরে অনেক বড় ভুল করেছে সে।”

ওপাশের ব্যক্তি সন্দিহান গলায় বললো–

“কী করবি তুই?

মাহাদ কল কেটে দেয়।বাঁকা হাসে মাহাদ।অস্ফুটভাবে বললো–

“সরি প্রজাপতি।আপনাকে যে আবারো আমার প্রয়োজন।ওই মাহতাব কে হারাতে আমাকে তো এই খেল খেলতেই হবে।আর আপনি আমার দাবার গুটি।”
,
,
,

বৈকালের ঠান্ডা বাতাস হু হু করে বইছে।গরম পুরোপুরি না পড়লেও তার আঁচ বুঝা যাচ্ছে।রাস্তা দিয়ে চলছে সি এন জি,রিক্সা।পাড়ার সরু রাস্তা হওয়ায় তেমন বড় কোনো গাড়ি এখানে ঢোকে না।
একটা ছোট ফাস্টফুড এর দোকানে দাঁড়িয়ে আছে আম্বের আর সামান্তা।রিঝুম পেস্ট্রি খেতে খুব পছন্দ করে।তাই আজ আম্বের রিঝুম এর জন্য পেস্ট্রি নিয়ে যাবে।আজ রিমেল কে না জানিয়েই বেরিয়েছে।সামান্তার কিছু সাজেশন্স বই লাগবে তা নিতেই লাইব্রেরি তে এসেছিলো।কিন্ত এখন আর ফিরে না গিয়ে একবারে রিঝুম এর সাথে দেখা করেই বাসায় যাবে।

ডোর বেল বাজতেই দরজা খুলে রিমেল।আম্বের কে দেখেই স্তব্ধ হয়ে যায়।রিমেল এর পায়ে কম্পন শুরু হয়।প্রস্ফুরনিত গলায় বললো–

“আআপপপনিই!

আম্বের একগাল হেসে বললো–

“আমি হয়েছি তো কী হয়েছে!সরেন।”

রিমেল কে পাশ কাটিয়ে ভেতরে এসেই শ্বাসরুদ্ধ করে চেয়ে থাকে আম্বের।স্থির,নিশ্চল দৃষ্টি তার।রিঝুম তার হুইল চেয়ার ছাড়াই দিব্যি সুস্থ মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আম্বের এর চোখের পাতা প্রশ্বস্ত হয়।ভীত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জল জমে আসে।আম্বের নিঃশব্দে শ্বাস ফেলছে।ঝিমঝিম করে উঠে তার মস্তিষ্ক।হালকা হেলে পড়তেই রিমেল সামলায় তাকে।আম্বের তড়িৎ বেগে সরে এসে তপ্ত গলায় বললো—

“একদম ছোঁবেন না আমাকে।কারা আপনারা!কেনো ধোঁকা দিলেন আমাকে!
ধোঁকা দেওয়ার জন্য বারবার আমাকেই বেছে নিতে হয় আপনাদের।”

রিমেল ব্যস্ত গলায় বললো—

“প্লিজ কথা শুনেন আমার।”

আম্বের চিৎকার করে বললো–

“একদম না।আমি কারো কথা শুনতে চাই না।যেতে দিন আমাকে।”

আম্বের ঘুরে দাঁড়াতেই তার কানে আসে সে অতি পরিচিত কন্ঠ।

“দাঁড়ান মিস আম্বের।”

আম্বের পেছন ফিরে তাকায়।মাহাদ কে দেখেই বিস্ফোরিত চোখ দুটো যেনো পলক ফেলতেই ভুলে গেছে।প্রদৃপ্ত গলায় আম্বের বললো–

“আপনি!
ও তাহলে এইসব আপনার কাজ!

রিমেল অনুযোগের গলায় বললো—

“সরি ভাবি।এ ছাড়া যে কোনো পথ খোলা ছিলো না।আপনারা কথা বলেন আমরা আসছি।”

রিমেল রিঝুম কে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।আম্বের বের হতে চাইলে মাহাদ দরজা লক করে তার চাবি নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।রাগে টগবগ করছে আম্বের এর মাথা।ফুঁসে উঠে বললো–

“এইসব কী শুরু করেছেন আপনি!যেতে দিন আমাকে।”

মাহাদ শান্ত হয়ে কাউচে বসে।কাউচে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ধীরস্থির গলায় বললো—

“আমার খিদে পেয়েছে মিস সুগন্ধি।”

আম্বের তেঁতে উঠা গলায় বললো–

“তো আমি কী করবো!আমাকে যেতে দিন মাহাদ।”

মাহাদ আবারো তার স্নিগ্ধ পুরুষালী গলায় অনুরক্তি সুরে বললো—

“বললাম তো খিদে পেয়েছে আমার।”

মাহাদ এখনো চোখ বুজে আছে।তার চোখের ডার্ক সার্কেল বলে দিচ্ছি কত রাত সে ঘুমায়নি।আম্বের গভীর দৃষ্টিতে তাকায় মাহাদ এর ঠোঁটের দিকে।কেমন কালষেটে পড়ে গেছে।মাহাদ এর ঠোঁট তো এমন ছিলো না।সিগারেট খাওয়া ধরেছে নাকি!আম্বের প্রশ্ন করে না।মাহাদ এর কথায় এতোটুকু বুঝতে পেরেছে হয়তো অনেকক্ষন যাবত কিছু খায় নি।আম্বের কিচেনে যায়।ফ্রীজ খুলে দেখে সেখানে কিছু ফ্রজেন সমুচা আর চিকেন নাগেট রাখা।আম্বের সেগুলোই আপাতত তেলে ভেজে মাহাদ এর সামনে এনে দেয়।মাহাদ কোনো কথা বললো না।এক নাগাড়ে খেয়ে চললো।আম্বের কোমল গলায় প্রশ্ন করলো —

“রিমেল আপনার কী হয়?

মাহাদ শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো–

“আমার বন্ধু।”

“তাকে আপনিই আমার পেছনে লাগিয়েছেন?

মাহাদ নিরুদ্বেগ গলায় বললো—

“হ্যাঁ।”

“কেন?

“আপনি ভাবলেন কী করে আমি আপনাকে একা ছাড়বো!

আম্বের ঈষৎ উষ্ণ গলায় বললো—

“কেন!আমি তো খারাপ মেয়েমানুষ।এতো কিসের চিন্তা আপনার আমাকে নিয়ে।”

মাহাদ প্রত্যুত্তর করলো না।সে খাওয়া শেষ করলো।গ্লাসে রাখা পানি খেয়ে আবারো কাউচে হেলান দিয়ে বাঁকা চোখে তাকায় আম্বের এর দিকে।আম্বের এর দু চোখ লাল হয়ে আছে।রাগে তার শরীরের সাথে সাথে ঠোঁটের কম্পনও বেশ বুঝতে পারে মাহাদ।স্মিত হাসে মাহাদ।নির্মল গলায় বললো—

“রেগে আছেন?

আম্বের শক্ত গলায় বললো—

“সিগারেট কেন খেয়েছেন আপনি?

মাহাদ ম্লান হাসলো।ঝরা গলায় বললো—

“ঘুম আসছিলো না তাই।”

“ঘুম এসেছে?

“উঁহু।ভেবেছিলাম আসবে।সময় কাটলো।”

আম্বের ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় গলায় বললো—

“এখন যেতে দিন আমাকে।”

মাহাদ সোজা বললো–

“নাহ।আপনি এখানেই থাকবেন।”

আম্বের ঝট করেই বলে উঠে—

“কখনই না।”

মাহাদ উঠে দাঁড়ায়।ধীর পায়ে আম্বের এর কাছে এসে ঝুঁকে তার গলার কাছে গিয়ে বললো—

“আপনি আসার পর আমি একটা রাতও ঘুমাতে পারিনি।”

আম্বের কড়া গলায় বললো—

“সরে দাঁড়ান মাহাদ।”

“ভালোবাসি আপনাকে আমি।”

আম্বের ফোঁস ফোঁস করছে।বিতৃষ্ণা গলায় বললো—

“আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

মাহাদ চোখে হাসে।সহজ গলায় বললো–

“মিথ্যে বলছেন আপনি।”

“বললাম তো আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

মাহাদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলতো হাতে আম্বের এর ডান হাত নিজের হৃদযন্ত্রের উপর রেখে বললো—

“আপনি আরেকবার বলেন যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন না,তাহলে আপনার এক মিথ্যেই আমার হৃদকম্পন থেমে যাক।”

গলা ধরে আসে আম্বের এর।তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে এক উদ্ভট প্রশ্ন করলো মাহাদ কে।বললো—

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।আপনি শুধু আমার শরীর কে ভালোবাসেন।কিসের এতো লোভ আপনার আমার শরীরের প্রতি?

মাহাদ আম্বের গলায় নাক ঘষে ঘোর লাগা কন্ঠে বললো—

“আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন।কেনো আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারি না!কেনো একটা রাতও আপনার চিন্তায় শান্তিতে ঘুমাতে পারি ন!

“এইসব মিথ্যে।কোনো প্রয়োজন নেই আপনার জীবনে আমার।”

মাহাদ আম্বের কে একটানে নিজের বুকে নিয়ে নেয়।কাতর গলায় বললো—

“শুনতে পাচ্ছেন আমার স্পন্দন !এ স্পন্দন শুধু আপনার জন্যই।আপনার শূন্যতায় আমার কোনোদিন পূর্নতা আসবে না প্রজাপতি।”

“আপনি আমাকে শুধু ব্যবহার করেছেন।”

“ভালোবেসেছি আপনাকে আমি।আর ভালোবেসেই মরেছি আমি।”

জল ভরে আসে আম্বের এর চোখে।নিজেকে সংবরণ করার আপ্রাণ চেষ্টায় সে ব্যর্থ হয়।দু হাতে উপর্যুপরি কিল ঘুষি মারতে থাকে মাহাদ এর বুকে।তার কান্নায় মাহাদ এর শ্বাস আটকে আসে।আম্বের এর মাথাটা শক্ত হাতে চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে।

অসহায় গলায় বললো—

“”কেনো এলেন আপনি আমার জীবনে!না নিজেকে আপনার কাছে আসা থেকে আটকাতে পারছি না আপনাকে ছেড়ে বাঁচতে পারছি।”

আম্বের হাউমাউ করে কেঁদে বললো—

“কেন এমন করেন আপনি!কেন এতো কষ্ট দেন আমাকে!নিজেও কষ্ট পান আর আমাকেও মরণ যন্ত্রণা দেন।কেন?কেন?কেন?

“ক্ষমা করবেন আমাকে।আর একটু সময় দিন আমাকে।প্লিজ মিস সুগন্ধি।আরকটু সময় দিন।”

“মাহাদ!

মাহাদ নিজের অঞ্জলিতে করে আম্বের মুখ টা উঁচু করে।তার ঠোঁটে গভীর চুমু খায়।আম্বের এর গাল,গলা কপালে অসংখ্য চুমুতে ভরে দেয়।শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে আম্বের কে।এক মিষ্টি সময় কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজন।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here