#বদ্ধ_হৃদয়ের_অনুভূতি
#পর্বঃ৪২
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
ঘরময় নিরবতা।শুধু ফ্যানের শনশন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।আর আম্বের এর হিংস্র চোখের আহত নিঃশ্বাসের আওয়াজ।মাহাদ এর কোলের উপর রাখা পা টা নামিয়ে নিচে রাখে আম্বের।উৎফুল্ল হয়ে দু পা সামনে ছড়িয়ে দিয়ে পিঠ টা আরো হেলিয়ে দিয়ে কাউচে হেলান দিয়ে বসে মাহাদ।অধর জুড়ে এভারেস্ট বিজয়ের হাসি।
রাগাম্বিত গলায় আম্বের প্রশ্ন ছুঁড়লো–
“খুশি?
মাহাদ হালকা ঘাড় কাত করে বললো–
“অফকোর্স।হোয়াই নট?
মাহাদ এর কথায় ফোঁস করে দম ফেলে আম্বের।এখনো লাল লাল চোখে তাকিয়ে আছে মাহাদ এর দিকে।তার দিকে তাকিয়েই ফিচেল হাসে মাহাদ।
” মেঘ,বৃষ্টি আঁধার জমে,অথৈ নদীর কূল
তোমায় আমি ভালোবাসি,ফোঁটা পদ্মফুল।”
“হুশশশশ,
রেগে আছেন?
মাহাদ এর কথায় চোখের পাল্লা প্রশস্ত করে তাকায় আম্বের।একটু আগে আম্বের কে জোর করে স্যুপ খাওয়াতে গেলে আম্বের মাহাদ এর হাত ধরে টানাটানি শুরু করে।আর তাতে অসাবধানতা বশত আম্বের এর নখের আঁচড় লেগে যায় মাহাদ এর হাতে।আদ্রিতার ঘটনার পর মেয়েদের বড় নখ একদম সহ্য করতে পারে না মাহাদ।তাই জোর করেই আম্বের এর হাত পায়ের নখ কেটে দেয়।এতেই ক্ষুব্ধ আম্বের।
একগাল হেসে উঠে দাঁড়ায় মাহাদ।তাকে পেছন থেকে ডেকে উঠে আম্বের।মাহাদ এর কাছে এসে অনুনয়ের কন্ঠে বললো—-
“আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবেন মাহাদ?
মাহাদ আহত গলায় ধীরগতিতে বললো—
“আপনি তো জানেন এই অবস্থায় আপনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়াটা সেইফ নয়।”
আম্বের অভিমানী গলায় বললো—
“আমার আর ভালো লাগছে না মাহাদ।দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।সারাদিন ঘর বন্দি থেকে মনে হয় যেনো আমি কোনো কবরে আছি।আদৌ কী আমি মুক্তি পাবো!
মাহাদ আলতো হাতে আম্বের কে জড়িয়ে ধরে।অনুযোগের গলায় বললো–
“আই এম রিয়েলী সরি।রাতে নিয়ে যাবো এখন নয়।”
মাহাদ পা বাড়াতেই আম্বের ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করলো—
“কোথায় যাচ্ছেন?
“আপনার জন্য স্যুপ নিয়ে আসি।”
কথা শেষ করে ফিচেল হাসে মাহাদ।আম্বের আঁতকে উঠা গলায় বললো—
“না,,,,
খাবো না আমি।”
মাহাদ নরম গলায় বললো—
“তাহলে কী খাবেন?
“ফুচকা।”
নাক ছিটকে মাহাদ বললো—
“ছিঃ
এইসব কেউ খায়!
“আমি খাবো,খাবো খাবো ব্যস।”
এক শীতল নিঃশ্বাস ফেলে হতাশ গলায় মাহাদ বললো—
“ওকে, নিয়ে আসছি আমি।”
দরজা বাইরে থেকে লক করে যায় মাহাদ।তারা এখন চট্টগ্রামের একটি পার্বত্য অঞ্চলে আছে।রামগড় নাম।পাহাড়ি এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আপন ভুবন।
জানালায় চোখ ফেলে দাঁড়ায় আম্বের।বন্দি জীবন তার।এই টুকুই স্বস্তি।বাইরে কিছু ছোট বাচ্চা দৌড়াদৌড়ি করছে।তাদের দেখেই আমদিত হয় আম্বের।
কয়েকদিন পর তারও একটা বাবু হবে।আপনজন হবে।যার উপর তার একার অধিকার থাকবে।একটা ছোট্ট মাংসপিন্ড।ধীরে ধীরে বড় হবে সে।তার দন্তহীন হাসিতে মেতে উঠবে সারা ঘর।ছোট ছোট হাতে তার আঙুলে মায়ের গাল ছুঁইয়ে দিবে।মা বলে ডাকবে তাকে।দশ ইঞ্চির সেই ছোট্ট পা দিয়ে ঘরময় দৌড়ে বেড়াবে।ভাবতেই একরাশ মুগ্ধতা ছুঁয়ে যায় আম্বের কে।সে তার বাবাই সোনাকে আগলে রাখবে।একদম বুকের মাঝে গুঁজে রাখবে তাকে।সে শুধু তার।তার শরীরের অংশ।তার নাড়ী ছেড়া ধন।
আনমনেই নিজের হাত উঠে আসে তার পেটের উপর।সাত মাস চলছে আম্বের এর।অনেকটা স্ফীত হয়েছে তার উদর।শরীরটাও বেশ ভারি লাগে।তাকে কিছুই করতে হয় না।খাইয়ে পর্যন্ত দেয় মাহাদ।তার সমস্ত কিছুর খেয়াল রাখে।নিজেকে কোনো রাণীর চেয়ে কম মনে হয় না তার।কিন্তু তবুও শূন্যতা তার বুক জুড়ে।
দিনের খানিকটা সময় এই বারান্দায় পায়চারি করে আম্বের।বাইরের খোলা আকাশের স্বাদ এই বন্দিদশা থেকেই নিতে হয় তাকে।
আজ বড্ড মন খারাপ আম্বের এর।সে ততটা জানে না।কিন্তু শুনেছে মেয়েদের প্রথম সন্তান নাকি তার বাবার বাড়িতে হয়।সাত মাসে নাকি অনুষ্ঠানও করা হয়।যেখানে মা আর তার অনাগত সন্তানকে বুক ভরে দোয়া করা হয়।কিন্তু তার তো কেউ নেই।কে করবে এইসব!কে করবে দোয়া তার সন্তানের জন্য।ভাবতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আম্বের।
,
,
,
“কন্যারে রে কন্যারে…
বাঁকা চুলেতে খোঁপা আর বাইন্ধনারে…
ওই চুলেতে জাদু আছে রে..
আমার ঘুম আসে না রাতে
একলা ঘরে রে……
আম্বের তার খোলা চুলে খোঁপা করছিলো।এমনিতেই ভারি শরীর।তার উপর এই চুলের ভার একদম সহ্য হয় না তার।মাহাদ কাছে এসেই আম্বের এর চুলে মুখ ডোবায়।
আম্বের কৌতূহলপ্রদ হয়ে বললো—
“কখন আসলেন আপনি?
“লক খুলে ঘরে ঢুকে পড়লাম আর আপনি টেরও পেলেন না!
কোথায় থাকে মন আপনার?
“চোরের মতো ঢুকেন কেন?
চোর পুরুষ।”
মাহাদ তৃপ্তিকর গলায় বললো—
“মাশাআল্লাহ্।”
খিলখিলিয়ে হাসে আম্বের।একটা লাল শাড়ি নিয়ে এসেছে মাহাদ।আম্বের কে পরিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করায়।একদম পুতুলের মতো লাগছে।মাহাদ আম্বের এর দুই চোখের পাতায় অধর ছোঁয়ায়।
শান্ত ও স্বাভাবিক গলায় বললো—
“একদিন এইভাবে বউ সাজিয়ে আপনার যোগ্য সম্মান দিয়ে আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।”
মিষ্টি হাসে আম্বের।হাঁটু গেড়ে নিচে বসে মাহাদ।আম্বের এর স্ফীত পেটের উপর টপাটপ কয়েকটা চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বললো—
“জলদি আসেন বাবাইসোনা।আপনার মাম্মাই আর বাবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।আপনি এলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান হবে।”
আম্বের মাহাদ এর চুলে হাত রাখে।মাহাদ তার কান চেপে ধরে আম্বের এর উদরের সাথে।কিছু শুনতে চায় সে।আম্বের মৃদু হেসে ঝলমলে গলায় বললো—
“কী করছেন মাহাদ?
মাহাদ আহ্লাদী গলায় বললো—
“আমার বাবাইসোনাকে অনুভব করার চেষ্টা করছি।শুনেছি তারা নাকি রেসপন্স করে।”
“হ্যাঁ।কিন্তু এতো জলদি না।আরো পড়ে।উঠেন আপনি।আর এই শাড়ি কেন এনেছেন আমার জন্য?
মাহাদ দাঁড়াতেই টুপ করে আম্বের কে কোলে তুলে নেয়।চকিতে আম্বের বললো—
“কী,কী করছেন মাহাদ!আপনার লেগে যাবে।”
“কথা সত্য।অনেক ভারি হয়ে গেছেন আপনি।”
“আমি তো আর একা নই।তা মি. ফিল্মস্টার মাথায় চলছে টা কী আপনার?
মাহাদ আম্বের কে বসার রুমে নিয়ে আসে।সেন্টার টেবিলে অনেক ধরনের পিঠা রাখা।সাথে আরো ফলমূল।আম্বের উৎসুক চোখে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বললো—
“এইসব কী মাহাদ!
“আপনার জন্য।সবটা আমি জানি না।তবে এই মুহূর্তে আমাদের সন্তানের জন্য আমি আর আপনি ছাড়া দোয়া করার মতো কেউ নেই।হয়তো তার জন্য আমিই দায়ী।”
আম্বের শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে মাহাদ কে।কাউচে বসাতেই আম্বের টুকটুক করে চেখে দেখে সব পিঠে।মাহাদ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে প্রসন্ন হাসে।নিজের মোবাইলে কয়েকটা ছবিও তুলে।কী মিষ্টি দেখতে লাগে তার শ্যামাঙ্গীনিকে!
,
,
,
বিছানার উপর দু হাতে ভর দিয়ে বসে আছে আম্বের।বছরের মধ্য সময়তে প্রচন্ড গরমে হাঁসফাঁস লাগছে তার।মাথার উপর অনবরত ঘোরা ফ্যানের বাতাস যেনো শরীরে লাগছেই না।আম্বের এর নাক,গলা সব ঘেমে আছে।মুখ দিয়ে বাতাস ছেড়ে সরস গলায় বললো—
“কষ্ট হচ্ছে আমাদ সোনা।একদম না।আপনি এলে আপনার বাবাই কে বলে এসির ব্যবস্থা করে দিবো আপনাকে।গরমের ছুটি তখন।”
আনমনেই হাসে আম্বের।এক হাতে ভর দিয়ে আরেক হাত পেটের উপর রাখে।আদুরে গলায় ফিসফিস করে বললো—
“আপনি একদম আপনার বাবাইর মতো হবেন না।শুধু জ্বালায় আমাকে।আপনাকে আমি আমার পছন্দের হিরো বানাবো।”
মাহাদ এসেই ধুপ করে আম্বের এর পাশে বসে।আনন্দিত গলায় প্রশ্ন করলো–
“কী বানানো হচ্ছে আমার ছেলেকে প্রজাপতি?
এইটা কিন্তু একদম ঠিক হচ্ছে না।আমারও একটা রাইট আছে।”
আম্বের প্রতিবাদ করে বললো—
“একদম না।আমাদ কে আমি একদম আপনার মতো হতে দিবো না।তাকে আমি ফুটবলার বানাবো।”
দুর্বোধ্য হাসে মাহাদ।আম্বের ভ্রু কুঁচকে বললো—
“হাসছেন কেন?
“ফুটবলার!
বাংলাদেশের ফুটবলারদের অবস্থা জানেন?
“তো !তাতে কী!
আমি তাকে ম্যারাডোনা আর পেলের মতো বানাবো।”
মাহাদ সরব গলায় বললো—
“এই জন্য বুঝি তাদের খেলা দেখেন!
“হু।আমাদ শুধু আমার।আপনি মাহিদ আর আম্বিকাকে আপনার ইচ্ছে মতো বানাবেন।”
মৃদু ছন্দে হাসে মাহাদ।হেসে হেসে বললো—
“এরা কারা!
“আমাদের বাবু।এর পরে আমাদের জমজ বাবু হবে।মাহিদ আর আম্বিকা।বুঝলেন ফিল্মস্টার।”
“আপনাকে কে বললো?
আম্বের ঝলমলে গলায় আশ্বস্ত হয়ে বললো—
“স্বপ্নে দেখেছি আমি।”
মাহাদ আম্বের এর গলায় নাক ঘষে বললো—
“আর আমাদ?
“আম্বের আর মাহাদ মিলে আমাদ।”
খলখলিয়ে হাসে আম্বের।বিছানায় দুই হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়ে মাহাদ।সিলিং এ তাকিয়ে ভাবতে থাকে,কতো স্বপ্ন বুনে রেখেছে তার প্রজিপতি।পারবে তো সেই সব স্বপ্ন পূরণ করতে নাকি শুরুতেই সব প্রলীণ হয়ে যাবে হিংস্রতার মায়া খেলায়??
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
আজ লেখা শেষ করেও পোস্ট করতে ইচ্ছে করছিলো না।তাও করলাম।
আপনাদের রেসপন্স ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।তাই ইচ্ছে করে না পোস্ট করতে।)