বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৭

0
6011

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ৭
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

শিহরণ এর ফ্ল্যাট ঢুকতেই লিভিং রুম।ডানদিকে একটা বেড আর সোজা আরেকটা মাস্টার বেড।হাতের বামদিকে ডাইনিং স্পেস আর তার সাথেই লাগোয়া কিচেন রুম।চার বন্ধু লিভিং রুমে বসেই গল্প করছে।

প্রহর কথা বলছে নির্ধার সাথে। ওর কোলে শিহরণ এর দুই বছরের ছেলে নিরণ।নিরণ ওর ছোট ছোট গোলাপি ঠোঁট দিয়ে বারবার প্রহর এর গালে পাপ্পি দিয়ে যাচ্ছে।প্রহর নিরণ এর ছোট ছোট হাত গুলোতে অনবরত চুমু খেয়ে যাচ্ছে।নিরণ কে ওর কাছে মনে হচ্ছে এক খন্ড নরম তুলো।যাতে সে হাতড়িয়ে যাচ্ছে।ওকে সুড়সুড়ি দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠে নিরণ।নির্ধা উঠে গিয়ে ফিডার বানিয়ে আনে।অনেকক্ষন যাবৎ নিরণ কে খাওয়ানো হয়নি।নির্ধা ওকে নিজের কোলে নিয়ে ওকে ফিডিং করাতে থাকে।ধ্যানযোগে তা দেখতে থাকে প্রহর।

মায়েরা কত মমতাময়ী হয়!!!
নিজের চেয়ে সন্তানের কথা বেশি ভাবে।নিরণ ফিডার চুক চুক করে কিছুক্ষন টেনে আবার প্রহর কে দেখে।ছোট ঠোঁট দুটি ছড়িয়ে মিষ্টি করে হাসে।প্রহর এর মন গেথে যায় একদম ওর হাসিতে।
নির্ধা বলল—

“তোমাকে তো বেশ লাগছে প্রহর।”

প্রহর একগাল হেসে বলল–

“হুম।এইটা আমাকে রাহান ভাইয়া গতবার আমার বার্থ ডে তে দিয়েছিলো।”

“আজরাহান তো ভালোই বুঝে তোমাকে কিসে ভালো লাগবে!!

“হুম।”

প্রহর আবার সন্দিহান কন্ঠে বলল—

” আজ তো বাবুর জন্মদিন!!
তাহলে কোনো গেস্ট নেই কেনো??

নির্ধা বিরস কন্ঠে বলল—

“আর জন্মদিন!!!
এইটা তো ওদের প্ল্যান।আমার ছেলের নাম ভাঙিয়ে নিজেদের জলসা ঘর বানানো।কতো করে বললাম এইবার অন্তত কিছু একটা করি।বলল,না।যতদিন না বাবু নিজের হাতে কেক কাটতে পারবে ততদিন শুধু ওর নামে মসজিদ এ মিলাদ পড়ানো হবে আর কিছু দুস্থ মানুষদের খাওয়ানো হবে।কোনো অনুষ্ঠান হবে না।”

নির্ধা এক হতাশার শ্বাস ফেলল।শিহরণ আর ওর বিয়ে হয়েছে চার বছর।শিহরণ ওকে পড়াতো।সেখান থেকেই প্রনয়ের শুরু।আর বিয়েতে এসে শেষ।

প্রহর ঠোঁট গোল গোল করে খানিক ভ্রু কুচকায়।আর বলল–

“এইটা কোনো কথা!!

“আর কী করার।
আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিঙ্গেস করি??

“করো।”

“আজরাহান কে বিয়ে করবে??

প্রহর কোনো ভাবনা ছাড়াই চট জলদি বলল—

“নাহ।”

“কেনো??

“তাকে কেনো আমি বিয়ে করবো!!

“তাহলে জান কে করবে??

প্রহর নিরণ এর তুলোর বলের মতো হাতের ভিতর ওর আঙুল ঢুকিয়ে তা নাড়াচাড়া করে খেলছিলো।মারশিয়াদ এর কথা শুনতেই নিরস নয়নযুগল উর্ধ্বমুখী করে নির্ধার দিকে তাকায়।শান্ত কন্ঠে বলল–

“উহু।”

“তাহলে কাকে বিয়ে করবে!!
কাউকে পছন্দ করো???

প্রহর খলখলিয়ে হেসে উঠে।উচ্ছসিত কন্ঠে বলল—

“কাউকে না।”

“তাহলে কী সারাজীবন কুমারী থাকবে না কী??

“আরে না।আমার বাবা বলেছে আমার জন্য রাজপুত্র আসবে।আমি তাকেই বিয়ে করবো।”

নির্ধা বিস্মিত কন্ঠে বলল—

“তোমার বাবা আছে!!কোথায় আছেন তিনি???

ঝনঝন করে উঠে প্রহর পাঁজরের হাড়।কী বলল সে!!!

“কী হলো বলো,কোথায় তোমার বাবা??

প্রহর ফুপিয়ে উঠে।বর্ষার স্নিগ্ধ জল বইতে থাকে ওর নেত্রযুগল বেয়ে।কম্পিত হতে থাকে ওর শরীর।অনুরনিত হয় ওর ওষ্ঠদ্বয়।গলায় কুন্ডলী পাকিয়ে বসে কষ্টের সমুদ্রে প্রবাহিত ওর অতীতের স্মৃতিকথা।ডুকরে উঠে প্রহর আর বলল—

“কেউ নেই আমার।কেউ নেই।”

প্রহর দৌড়ে বেড়িয়ে আস রুম থেকে।নির্ধা অবলীলায় ডাকতে থাকে ওকে।প্রহর থামে না।তার শ্বাস আটকে যাচ্ছে।এখন তার খোলা হাওয়ার প্রয়োজন।নির্ধার কন্ঠের আওয়াজ এ ওদের কথায় ছেদ পড়ে।আজরাহান ঘাড় ঘুড়িয়ে উঠে দাড়ার।প্রহর ঝপাৎ করে এসে বুকে পড়ে।হেচকি তুলে বলল–

“রারাহাাআন ভভাইইয়াআ,আমিইইইই বাসাআয় যাবো।প্লিজজজ আমমাকেএ নিয়েএএ চললেন।”

আজরাহান দুই হাত দিয়ে ওকে আড়ষ্ট করে নিজের সাথে।উৎসুক কন্ঠে বলল–

“কী হয়েছে তোর??

“প্লিইজজ আমমাকে নিয়েএ চলেনন।”

ওর পিছনেই নির্ধা কে ত্রস্ত পায়ে আসতে দেখে কঠিন গলায় শিহরণ বলল–

“কী বলেছো তুমি ওকে!!
কাঁদছে কেনো ও এভাবে??

“আরে আমিইই,,,

মারশিয়াদ ওর কথার রেশ টেনে বলল–

“থাম শিহরণ।
আজরাহান তুই রেড চিলি কে নিয়ে যা।”

“হুম।আশফিক তুই যাবি??

“আমি পড়ে আসছি।তুই প্রহর কে নিয়ে যা।”

“ওকে।”

প্রহর থেমে থেমে এতো জোড়ে হেচকি তুলছে যে নিজের সাথে সাথে আজরাহান কে ও কাপিয়ে তুলছে।আজরাহান এখনো ওকে বুকের মাঝে লেপ্টে ধরে আছে।হাজারও কষ্টের মাঝে প্রহর এর সুখের পরশ পাথর তার রাহান ভাইয়া।যার ছোয়ায় সে সুখ সাগরে ভাসে।আজরাহান ওকে কোনে মতে সামলে নিয়ে যায়।কেমন যেনো অসাড় হয়ে মিশে ছিলো ওর বুকের সাথে।

ওরা যেতেই আরেক দফা ঝাঝিয়ে উঠে শিহরণ।হাস্যোজ্জ্বল প্রহর এর আলো জ্বলজ্বলে বদনে হঠাৎ কেনো বৈশাখী ঝড়ের আচ্ছাদন পড়লো।নির্ধা কয়েকটা ফাকা ঢোক গিলে।কন্ঠের আড়ষ্টতা ছাড়িয় বলল–

“আমি তেমন কিছু বলিনি।কথায় কথায় ওর বাবার কথা বলল।তাই আমি জিঙ্গেস করলাম সে কোথায় থাকে!!
আর ওমনেই প্রহর,,,,,

বাকি কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করলো না কেউ আর না নির্ধা বলার।বাকিটা সবাই স্বচক্ষে দেখেছে।ওরা একে অপরের দিকে বিস্মিত নজর স্থাপন করে।মারশিয়াদ ম্লান হেসে মনে মনে আওড়ায়—“”””বিষাক্ত অতীত কাউকে ছাড় দেয় না।কাল পরিবর্তণে বিষিয়ে তোলে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।মানুষ বলে–বিষে বিষক্ষয়।সময় কী তাহলে সে বিষের জায়গা নিতে পারবে??
,
,
,
স্থবির,অসাঢ় হয়ে বিবশ পানে চেয়ে আছে আজরাহান কলেজ গেটের পাশে দন্ডায়মান কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে।বসন্ত কালে লাল রঙে সজ্জিত হয় কৃষ্ণচূড়া গাছটি।নামে কৃষ্ণ হলেও সবুজের বুক চিরে ফুড়ে উঠে স্ততবে স্তবকে লাল গুচ্ছমালা।ওপাশে রাধাচূড়া ও আছে।কমলা রঙ এমনিতে ভালো না লাগলেও রাধাচূড়ায় বেশ লাগে।

আজরাহান এর ধ্যান ভাঙে আশফিক এর ধাক্কায়।

“কিরে চুপ করে আছিস কেনো??

“তো কী নাচবো!!

“কী দরকার ছিলো এইসব করার??

“আমি কী জানতাম ও এভাবে রিয়েক্ট করবে!!
আমি তো শুধু ভাবী কে বলেছি বিয়ের কথা বলতে।”

“এখন দেখলি তো কী হলো!!

“হুম।আমার সত্যিই মাথা কাজ করছিলো না তখন।ভাবতেও পারিনি এমন কিছু হবে।”

“ও এসেছে স্কুলে??

“হ্যাঁ।একটু আগে ক্লাসে গেছে।”

আজরাহান এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।বিরস কন্ঠে বলল—

” আমাকে বিয়ে করতে ওর কী সমস্যা আমি বুঝি না।গত ছয় মাস ধরে ওকে বলে যাচ্ছি।কিন্তু একবার ভুলেও হ্যাঁ বলে না।”

“তুই কী পাগলামো শুরু করেছিস!! ওএকটা বাচ্চা মেয়ে।””

“তো!!
তোর কী মনে হয় ওকে আমি মেরে ফেলবো!!
ভালোবাসি ওকে আমি।ওকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়।”

আশফিক ভারী কন্ঠে বলল–

“এখন তো প্রহর এর জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে।তুই আবার উল্টা পাল্ট কিছু না করে বসিছ।”

আজরাহান শক্ত ও স্বাভাবিক কন্ঠে বলল–

“আমি মোটেও ওই রকম ছেলে নই।”

কলেজ ক্যান্টিনে বসে কথা বলছে দুই ভাই।প্রহর এর অবস্থা দেখে সবাই ভীষন ঘাবড়ে যায়।অনেক কষ্ট করে আজরাহান প্রহর কে স্বাভাবিক করে।নাহলে বাড়িতে অনেক প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হতো।
আশফিক এর নজর সামনে যেতেই বাকা হেসে বলল–

“ওই দেখ,তোর মারমেইড আসছে।”

আজরাহান নুরাইসা কে দেখে শান্ত হয়ে বসে।নুরাইসা গুটি পায়ে ওদের সামনে এসে দাড়ায়।আজরাহান দুষ্ট হাসি হেসে বলল–

“কেমন আছেন মারমেইড??
আমার কল কেনো রিসিভ করেন না আপনি??

নুরাইসা বিব্রতবোধ করে।ঠোঁটে মেকি হাসি দিয়ে বলল–

“আমি দেখতে পাই নি।”

“ও তাই না কী!!
দেখি আপনার মোবাইল টা।”

নুরাইসা পাশ ফিরে আশফিক এর দিকে তাকিয়ে বলল–

“সরি স্যার।আসলে আমি একটু অসুস্থ থাকায় আপনার দেওয়া সময়ে অ্যাসাইনমেন্ট টা শেষ করতে পারি নি।তাই আজ নিয়ে এসে ছি।”

“আচ্ছা দাও।”

নুরাইসা আশফিক এর হাতে অ্যাসাইমেন্ট টা দিতে গেলে তা খপ করে ধরে আজরাহান।নুরাইসাও কিছুতে ছাড়বে না।এক পর্যায়ে ওটা ক্যাচ করে ছিড়ে যায়।নুরাইসার চোখে জল ভরে আসে যেনো এখনই কেঁদে দিবে।

“এইটা কী করলেন আপনি??

“ইশশশ!
এইটা কী হলো মারমেইড!!!
এখন তো আপনাকে আবার করতে হবে।কী কষ্ট!!

“করবো না আমি।”

“করতে তো হবেই।সামনে ফাইনাল এক্সেম আসছে।নাম্বার তো খুব প্রয়োজন।”

নুরাইসা কেঁদেই দিলো আর বলল–

“ছিড়লেন কেনো আপনি??কত কষ্ট করে আমি করেছি।”

আশফিক ওর কান্না দেখে তটস্থ হয়ে বলল–

“ওকে আর করা লাগবে না তোমার।আমি নাম্বার এড করে দিবো।”

আজরাহান শয়তানি হাসি হেসে বলল–

“কিসের নাম্বার!!
একদম না।আগে ও অ্যাসাইমেন্ট আবার করবে তারপর নাম্বার।”

নুরাইসার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল–

“যান মারমেইড।কাল অ্যাসাইমেন্ট করে জমা দিবেন।কাল কিন্তু লাস্ট ডেট।অল দ্যা বেস্ট।”

নুরাইসা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।দুইদিন না ঘুমিয়ে অ্যাসাইমেন্ট টা করেছে।আর সেইটা আজরাহান ছিড়ে ফেলল।দমদম করে পা ফেলে চলে যায় নুরাইসা।আজরাহান তৃপ্তির হাসি হাসে।আশফিক চোখ বাকিয়ে বলল–

“ওই,,সমস্যা কী তোর??
কেনো ওর পিছনে লেগে থাকিস??

“আগে তো ওকে চোখের জল আর নাকের জলে ডোবাই তারপর ছাড়বো।”

“তুই পারিসও বটে!!!

“তা আর বলতে!!
,
,
,
রেস্তোরাঁ বসে খেয়ে যাচ্ছে প্রহর।আজরাহান গোল টেবিলের উপরে দু হাত ভাজ করে রেখে তার উপর চিবুক রেখে নিস্পলকভাবে তাকিয়ে আছে।প্রহর বলল–

“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো??
আমার পেট খারাপ করবে।”

আজরাহান চিবুক উঠিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।টাই এর নব হালকা ঢিলা করে বলল–

“আমাকে বিয়ে করতে কী সমস্যা তোর??

“খাওয়ার সময় ডিস্টার্ব করবেন না।”

“একবার আমাকে বিয়ে কর তুই যা খেতে চাইবি আমি তোকে তাই খাওয়াবো।”

প্রহর ভ্রু ক্রুটি করে বলল–

“আপনার কী সমস্যা !!
একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কেনো????

“ওরে আমার বাচ্চা রে!!
আজ বিয়ে দিলে কাল দুই বাচ্চার মা হবে।আর উনি না কী বাচ্চা।”

“হলে হবো।তাতে আপনার কী??

“আমার কী মানে!!
আমারই তো সব।তোর বাচ্চার বাবা তো আমিই হবো।”

“ইশশ!
শখ কতো।আপনাকে আমার পছন্দ না।”

“তাহলে কাকে পছন্দ??

প্রহর রেস্তোরাঁর কার্নিশের একটা টেবিলে বসে ছিলো।থ্রি কোয়ার্টার ছেড়া প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া টি শার্ট,জীর্ণশীর্ণ শরীরে রাস্তার অপর পাশে দেয়ালে ঘেষে বসে আছে একটা ভিক্ষুক।প্রহর তাকে দেখিয়ে বলল–

“ওকে বিয়ে করবো আমি।”

আজরাহান দাঁতে দাঁত নিষ্পেষণ করে বলল—

“আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা ভাবলে একদম মেরে ফেলবো তোকে।”

“এতো মারামারি কিসের??

নুরাইসা কে দেখে প্রহর একগাল হেসে বলল—

“নুরাইসা আপু!!এসো।”

নুরাইসা একটা চেয়ার টেনে ওর পাশেই বসে।

“কেমন আছো প্রহর??

“ভালো।তুমি??

“আমিও।”

“এখানে কী করছো??

“দেখো না খাচ্ছি।আমার খুব খিদে পেয়েছে।”

“তা তো দেখতেই পাচ্ছি।আজকাল তাহলে এইসব চলছে!!!

প্রহর উৎসুক কন্ঠে বলল—

“এইসব কী নুরাইসা আপু!!!

আজরাহান অধরে স্মিত হাসির রেখা একে বলল—

“মারমেইড,একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না???

“ওপস!!!
তাই বুঝি!!!!

চোখ বাকিয়ে প্রহর এর দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসি হেসে বলল—

“জানো তো প্রহর,আজকাল নতুন চোরের আমদানি হয়েছে।এরা ঘরের জিনিস রেখে অন্য কিছু চুরি করতে বেশি পছন্দ করে।”

আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে মেকি হাসি হাসে নুরাইসা।আজরাহান বিব্রতবোধ করে।প্রহর ভ্রু কুচকে তাকায় আজরাহান এর দিকে।আজরাহান দেখে নুরাইসার পাশেই সার্ভিস বয় দাড়িয়ে পাশের টেবিলের অর্ডার সার্ভ করছে।হালকা স্বর উচু করে বলল—

“ভাইয়া,,,আপনাদের কাছে পিংক কালারের বিষ হবে???

রেস্তোরাঁয় বসা কাস্টমারর আড়চোখে তাকায় আজরাহান এর দিকে।আজরাহান আবার ঠোঁটের কোন চেপে নুরাইসার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল—

“তার আবার পিংক কালার খুব পছন্দ।এই যে ধরেন,,,,

নুরাইসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়।টেবিলে থাকা পানির গ্লাস নিয়ে তা ঢেলে দেয় আজরাহান এর মাথায়।আজরাহান হকচকিয়ে উঠে দাড়ায়।আর বলল—-

“মারমেইড!!!!
সাতার কাটতে ইচ্ছে করছিলো বললেই পারতেন।একসাথে গিয়ে সাতার কাটতাম।একা আমাকে ভিজালেন কেনো!!!

নুরাইসা আর দাড়ায় না।এই লোক ঠোঁট কাটা।কখন কী বলে ফেলে!!!
প্রহর নিজ খাওয়ার ব্যস্ত।তার এইসবে মনোযোগ নেই।
,
,
আজরাহান এর বাইক হঠাৎ ই বন্ধ হয়ে যায়।রাস্তার পাশেই ম্যাকানিকাল দোকানে বাইক দিয়ে হাটতে থাকে ওরা দুজন।এখানে সাধারণত রিক্সা পাওয়া যায় না।চিপাগলি।তাই গাড়ির যাতায়াত থাকলেও পার্ক করা বাড়ন।গলির চওড়া মোড়ে অনেক রিক্সা দাড়িয়ে থাকে।আজরাহান আর প্রহর সেখানেই হেঁটে যাচ্ছে।উত্তপ্ত পিচঢালা পথ।সূর্য তার বেগুনী রশ্মি ঢেলে দিচ্ছে।দরদর করে ঝরছে ঘাম।কেমন হাসফাস করছে প্রহর।আজরাহান বলল—

“কোল্ড ড্রিংস খাবি??

প্রহর মাথা নেড়ে বলল–

“হুম,হুম।”

আজরাহান ওকে দাড় করিয়ে একটা দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংস এনে প্রথমেই এক চুমুকে তার অর্ধেক নিজের গলায় ঢেলে নেয়।প্রহর ঠোঁট গোল গোল করে অভিমানি কন্ঠে বলল—

“মুখ লাগালেন কেনো??

আজরাহান সোজাসাপ্টা বলল—

“তোর ঠোঁটে তো লাগাইনি।”

” আপনি আস্ত একটা খবিশ!!

“খেলে খা না খেলে যা।”

প্রহর ওর হাত থেকে বোতল নিয়ে চুক চুক করে গিলে নেয়।মরুভূমির তপ্ত বুকে জলবর্ষন হয়েছে।এক শীতল নিঃশ্বাস ছাড়ে প্রহর।দুইজন আবারো পাশাপাশি গুটি গুটি পায়ে হেটে চলছে।আজরাহান প্রহর এর দিকে তাকিয়ে দেখে ঘেমে নেয়ে একাকার।নাকের ডগায় জমেছে ঘাম।কানের পাশ দিয়ে স্মিত ধারায় গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল।প্রহর এর গলায় আর কপালে লেপ্টে আছে ওর ছোট ছোট অবাধ্য কেশমালা।আজরাহান ঘোর লাগা চোখে দেখতে থাকে।ঘামার্ত মানুষকেও এতো কমনীয় লাগে।প্রহর এর জামার কিছু অংশ ভিজে সেঁটে আছে ওর শরীরের সাথে।আজরাহান এর একদম ভালো লাগছে না।আজরাহান বলল–

“তোকে না কয়েকদিন আগে ছাতা কিনে দিয়েছিলাম।সেইটা কোথায়??

“ব্যাগে।”

আজরাহান পদযুগল স্থির করে বলল–

“গাধী!!!
বের কর ওইটা।”

“ওইটা দিয়ে তো আমি হাটতে পারবো।আপনার হবে না।”

“তো??

“তাই কারোই লাগবে না।দুইজন এভাবেই হাটবো।”

“তুই ঘেমে গেছিস প্রহর।গরমে ঠান্ডা লেগে যাবে তোর।”

“লাগবে না।আপনি চলেন।”

অগত্যা আজরাহান হাটার গতি বৃদ্ধি করে।এভাবে প্রহর কে অন্য কেউ দেখবে তা ওর মোটেও ভালো লাগছে না।পাশাপাশি হাটায় প্রহর এর হাত একটু পর পর ছুয়ে যাচ্ছে আজরাহান এর হাত।আজরাহান মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল–

“ইচ্ছে হলে ধর,আমি কিছু মনে করবো না।”

প্রহর উচ্ছসিত হাসি দিয়ে আজরাহান এর হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে নিজের হাত ঢুকিয়ে তা চেপে ধরে।হেটে চলছে দুজন আপন গতিতে।

কিছুদূর গিয়েই থমকে দাড়ায় আজরাহান তার মোবাইল এর রিংটোন এ।মারশিয়াদ কল করেছে।কিছুক্ষনের মধ্যেই ওদের সামনে এসে থামে ওর গাড়ী।গাড়ী থেকে নেমে ওদের সামনে এসে দাড়ায়।

“এই রোদের মধ্যে এভাবে হাটছিস কেনো??রেড চিলি তো পুরোই রেড চিলি হয়ে গেছে।”

“আরে দেখোনা জান ভাইয়া।রাহান ভাইয়ার ওই খাটারা বাইক টা নষ্ট হয়ে গেছে।তাই তো এই রোদের মধ্যে হাটতে হচ্ছে।”

মারশিয়াদ গা দুলিয়ে হেসে উঠে।ওর হাসিতেই আজরাহান বিরক্ত হয়।”

“আচ্ছা চলেন।আমি পৌছে দিচ্ছি।”

“তুই এখানে কেনো এসেছিস??

আজরাহান কড়া গলায় প্রশ্ন ছুড়ে।

“একটা কাজে এসেছিলাম।”

“চিপাগলিতে তোর কিসের কাজ??

“মাথার ঘিলু কী বেশি গরম না কি!!
উঠে বস গাড়িতে।”

ওরা গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করে।প্রহর জানালার জায়গায় মুখ নিয়ে বাইরে ঠান্ডা পবনের ছোয়া নিচ্ছে।ওর উষ্ণ শরীর ধীরে ধীরে শীতলতায় হারিয়ে যাচ্ছে।
মারশিয়াদ লুকিং গ্লাসে ওকে দেখে বলল—

“বেশি গরম লাগছে রেড চিলি??

“নাহ।কোল্ড ড্রিংস খেয়েছি।ভিতরে এখন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।”

“আপনি ওইটা অফ করে দিন।এসি অন করে দিচ্ছি।”

“না,না,না।এভাবেই ভালো লাগছে।”

“ওকে।”

“জান ভাইয়া!!

“বলেন।”

“আপনি কী সারাদিন গাড়ীতেই থাকেন??

“কেনো??

“এই যে গাড়ীতে আপনি আপনি ঘ্রান পাওয়া যায়।”

প্রহর এর কথা শুনতেই আজরাহান জ্বলে উঠে।চোখ মুখ খিচে বিড়বিড় করে বলল—-“””গাড়ীতে বসেই ওর গায়ের গন্ধ পায় আর আমি সারাদিন যে ওর সাথে লেপ্টে থাকি,কই আমাকে তো কখনো বলে না।”

“তেমন কিছু নয়।গাড়ীতে এয়ার ফ্রেশনার দেওয়া।”

“ও আচ্ছা।”

প্রহর আবার কিছুক্ষন থেমে বলল—-

“জানেন জান ভাইয়া,আমাদের স্কুলের এমাদ স্যার না কী স্কুল ছেড়ে চলে গেছে।একদম ভালো হয়েছে।একটা আস্ত নেংটি ইদুর।জানেন কী করতো,,,,

আজরাহান কঠিন কন্ঠে বলল—

“এই তুই চুপ করবি!!
আর একটা কথা বললে একদম সুপার গ্লু লাগিয়ে দিবো তোর মুখে।”

আজরাহান আক্রোশ ভরা চোখে মারশিয়াদ এর দিকে তাকায়।কর্কশ কন্ঠে বলল—

“এই তুই কী গরুর গাড়ী চালাস!!!স্প্রীড বাড়া।”

“একদম না জান ভাইয়া।ওভার স্প্রীডে গাড়ী চালালে অ্যাকসিডেন্ট হয়।আপনি আপনার মতো চালান।যত্তসব আজাইরা রাহান!!!

মারশিয়াদ ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।বাসার সামনে পৌছাতেই গাড়ীর দরজা খুলেই প্রহর ছুট লাগায় ঘরে।আজরাহান পা বাড়াতেই মারশিয়াদ শান্ত কন্ঠে বলল—

“একটু পানি তো খাওয়া!!!

আজরাহান কাঠ কন্ঠে বলল–

“পানি তোর গাড়িতেই আছে।”

“ঠান্ডা পানি খাওয়া।”

“ওইটা খেয়ে নে পেটে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে যাবে।”

আজরাহান লম্বা লম্বা কদম ফেলে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।মারশিয়াদ বাকা হাসে।সাথে তার চোখ।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here