#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ২০
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
বিক্ষিপ্তচিত্তে নদীর পাশে দাড়িয়ে আছে সানায়া।প্রহর কে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যে পৌছে যায় এন জিও তে।মেয়েটা কে দেখে ভয় পেয়ে যায় সানায়া।মানুষ কি করে এতো বিবেকহীন হতে পারে!!
একজনের করা ভুলে অন্যকে দোষারোপ করা।অবশ্য আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়।পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যাওয়া নেহাৎ বোকামি।জীবন কোনো ফুলসজ্জা নয়।লড়াই করেই তাকে জিততে হয়।কিন্তু আপন মানুষগুলোও যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন সবকিছুই অসাধ্য মনে হয়।
কতোটা বিতৃষ্ণা হলে একজন মানুষ নিজের হাতে নিজের প্রান নিতে উদ্যত হয়!!!
আত্নহননকারী মরার জন্য আত্মহত্যা করে না বরং বাঁচতে করে।কিন্তু আসলেই একে বাঁচা বলে!!!!
নদীর পাড়ে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সানায়া।নদীর পানির ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনির প্রতিটি শব্দ যেনো তার বুকে আছড়ে পড়ছে।মেয়েটাকে দেখে গা গুলিয়ে উঠে সানায়ার।শরীরের আশি ভাগ পুড়ে গিয়েছে।এক অংশের সাথে অন্য অংশ কী ভয়ংকর ভাবে লেপ্টে আছে।কী নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেছে মেয়েটি।নদীর পাড়ের তীব্র হাওয়ায় সানায়ার অবাধ্য খোলা চুলগুলো ওর মুখের উপর এসে পড়ছে।দু হাত দিয়ে তা কানের পিছনে গুজে বুকে হাত ভাজ করে আবারো ওই শান্ত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।ওর পাশেই এসে দাড়ায় তারাফ।সানায়া নিরস দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তারাফ এর দিকে।স্নিগ্ধ,শান্ত এক অভিব্যক্তি তার।তারাফ এর মনটা যেমন নীল আকাশের মতো স্বচ্ছ ঠিক ওর চোখ দুটোও গভীর মায়ায় ভরা।এই কয়েকদিনে তারাফ কে ও অনেক কাছ থেকে জেনেছে।এ এক অদ্ভুত সুন্দর মনের মানুষ তারাফ।নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছে শৃহীন,রক্তের সম্পর্কবিহীন ওই নিপীড়িত নারীদের কল্যাণে।কখনো ভাই,কখনো বাবা,কখনো একজন সহযোগী হয়ে তাদের পাশে দাড়িয়েছে তারাফ।অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার তারাফ এর।যে কোন মানুষকে প্রথম দর্শনেই সম্মোহন করার ক্ষমতা রাখে।কিন্তু উপরিতলে একদম কঠিন ব্যক্তিত্ব।যে কেউ ইচ্ছে করলেই তার মনের গহীনে প্রবেশ করতে পারবে না।
বাতাসের তীব্রতায় তারাফ এর চুর গুলো উড়ছে।শার্ট যেনো ছিড়ে চলে যাবে শরীর থেকে।বেখেয়ালিভাবে উড়ছে সানায়ার ওড়না।দুহাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে।তারাফ কিছু একটা বলল।বাতাসের তীব্র আওয়াজ শো শো করে বইছে।তাই সানায়া তা শুনতে পায় নি।বাধ্য হয়ে তারাফ ঘুড়ে এসে সানায়ার সামনে দাড়ায়।সানায়া চোখ পিটপিট করে বার কয়েক তাকায়।তারাফ সানায়া অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হালকা উচ্চ স্বরে বলল–
“একটু ওইদিকটায় চলেন।এখানে বাতাসের বেগ বেশি।”
সানায়া যে এন জিও তে এসেছে নদীটা তার পেছনেই।বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই নদী।তারাফ এর কথামতো সানায়া একটু সরে আসে।নদী থেকে কিছুটা দুরে গিয়ে দাড়ায়।বাতাসের গড়পরতা অনেকটা কম এখানে।তারাফ স্মিত হাসে।ধীর গলায় বলল–
“মন খারাপ??
তারাফের কথার কোনো জবাব না দিয়ে সানায়া পাল্টা প্রশ্ন করে।বিরস গলায় বলল—
“আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি??
তারাফ অধর প্রশস্ত করে নরম গলায় বলল–
“অবশ্যই।”
সানায়া একটা নিঃশব্দ নিশ্বাস ছাড়ে আর বলল–
“মানুষ কেনো বাঁচে??
তারাফ চট জলদি সরস গলায় বলল–
“মৃত্যুর জন্য।”
সানায়া গাঢ় চাহনি নিবদ্ধ করে তারাফ এর হাস্যোজ্জ্বল মুখঃচ্ছবিতে।ছোট্ট করে একটা শীতল শ্বাস ফেলল সানায়া।প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বলল–
“এইটা কেমন কথা!!
তারাফ চোখে হাসে।বুকে দু হাত ভাজ করে নদীর ওপারে তাকায়।সূর্য প্রায় ওপ্রান্তে পৌছে গেছে।লালাভ আভায় রাঙিয়েছে পূর্বাদেশ।স্বাভাবিক গলায় বলল–
“পৃথিবীতে মানুষের জন্মই হয় মৃত্যুর জন্য।মানুষ জন্ম নিবে কি না তার গ্যারান্টি নেই।অনেক নবজাতক জন্মের আগেই মায়ের গর্ভে তাদের অন্তিম শ্বাস নেয়।কিন্তু যদি সে একবার এই ধরার বুকে আসে মৃত্যু স্বাধ তাকে একদিন আস্বাদন করতেই হবে।হয়তো আজ,হয়তো কাল বা পরশু।আল্টিমেট মৃত্যুই তার আসল ঠিকানা।”
সানায়া জিঙ্গাসু দৃষ্টি রাখে তারাফ এর দিকে।তারাফ এখনো তার অক্ষিযুগল নিবদ্ধ করে আছে সম্মুখপানে।শান্ত গলায় সানায়া বলল–
“তাহলে কী ধরে নিবো আমাদের জন্ম ব্যর্থ!!বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই!!
“অবশ্যই আছে।
“মাদার তেরেসা” তিনিও তো মারা গিয়েছেন।কিন্তু আমরা আজও তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।নেলসন ম্যান্ডেলা একটি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেও আজ একজন অসাধারন মানুষ।সময় নিষ্ঠার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত তিনি।দীর্ঘ সাতাশ বছর কারাভোগ করেন তিনি শুধুমাত্র বর্ণবাদী মনোভাব থেকে মানুষকে দূরে সরানোর জন্য।আল্লাহর সৃষ্টি সবাই সমান।গায়ের রঙ কখনো কারো মানদন্ডের বিচারক হতে পারে না।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা।তার সবাই মৃত্যুর স্বাধ গ্রহন করেছেন।কিন্তু আজীবন মানুষের হৃদয়ে এক উজ্জল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।মৃত্যু অমোঘ সত্য,নশ্বর শরীরের মুক্তি।কিন্তু কীর্তিমান সত্তা মৃত্যুর পরেও আজীবন বেঁচে থাকে।”
সানায়া ধ্যানের মতো শুনছিলো তারাফ এর কথা।এক অদ্ভুত অভিব্যক্তির মানুষ তারাফ।তার বাচনভঙ্গিও প্রশংসার দাবীদার।সানায়া নদীর দিকে তাকায়।শীতল জলরাশি কুল কুল ধ্বনিতে প্রবাহিত হচ্ছে।সানায়ার কেনো যেনো মনে হলো এই মানুষটাকে সে আরও কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারে।তার মনের অগোছালো প্রশ্নগুলো যা এতোদিন সে কাউকে করতে পারে নি।সানায়া মনের অভ্যন্তরেই হালকা হেসে উঠে।তার মনে জাগ্রত প্রশ্ন গুলো ভেবে।ফিকে গলায় বলল–
“মানুষ কেনো স্বপ্ন দেখে!!জানে তা কখনো পূরন হওয়ার নয় তবুও দেখে।মানুষ সত্যিই কী বোকা??
তারাফ অধর কোনে হালকা হাসে।গাঢ় গলায় বলল–
“স্বপ্নই তো মানুষকে বাঁচতে শেখায়।আমি পাবো না তাই বলে হাতে হাত রেখে বসে থাকলে তো হবে না।আমার স্বপ্ন কে পূরন করার নিম্নতম চেষ্টাও যদি করি তাহলে তার পূর্নতা না আসুক বেঁচে থাকার মানে তো খুজে পাবো।স্বপ্ন না থাকলে বাঁচার ইচ্ছে হারিয়ে যায়।জীবনে কী পাবো তার হিসেব করলে অহেতুক সময় নষ্ট হবে।”
সানায়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মেয়েটির কথা মনে হলো সানায়ার।বলল–
“মানুষ কতো আজব প্রাণী!!!কতো বিচিত্র তার অভিনয়।মানুষ বলে এক করে আরেক।মানুষ চেনা বড় দায়।কেনো করে তারা অভিনয়??
“পৃথিবী এক মঞ্চশালা।আমরা সবাই তার অভিনেতা।কেউ হিরো রোল প্লে করি তো কেউ ভিলেন।আর ওই যে উপরে যিনি আছেন তিনি একমাত্র ডিরেক্টর।আমাদের তার আদেশেই চলতে হয়।এখন কথা হচ্ছে আমরা কোনটা বেছে নিবো।হিরো না কী ভিলেন!!
যার যেইটা পছন্দ।”
সানায়া নিস্প্রভ চোখ রাখে তারাফ এর চোখে।এক অদ্ভুত মায়া এই চোখে।তার কথায়।সানায়ার মন ধীরে ধীরে বিগলিত হয়।মানুষ এতোটা অমায়িক কী করে হতে পারে!!
সানায়া বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি রাখে শান্ত নদীর অববাবিকায়।কেনো যেনো নদীটিকে তার আজ বড্ড আপন মনে হচ্ছে।নদী যেমন তার শান্ত শীতল জলে ধুইয়ে নেয় সকল ঝঞ্জাল ঠিক তারও আজ তাই করতে ইচ্ছে করছে।পৃথিবী আজ ভীষন অসুস্থ।কারণ পৃথিবীতে আজ অসুস্থ মানুষের পরিমান বেড়ে গিয়েছে।সানায়ার ইচ্ছে করছে ওই সকল অসুস্থ মানুষের সকল অসুস্থতা নদীর মতো করে ধুইয়ে দিতে।
তারাফ অভিনিবেশ সহকারে অক্ষি নিপাত করে সানায়ার দিকে।আবার চোখ রাখে নদীর ওপাশটায়।শান্ত,স্নিগ্ধ নদীর মধ্যে ধীরে ধীরে প্রলীণ হচ্ছে অত্যুষ্ণ সূর্য।অস্তাভায় লালিমায় ছেয়েছে আকাশ।সন্ধ্যা নেমেছে পাটে।গৌধুলী তার রঙছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে দিন রাত্রির এই সন্ধিক্ষনে।দূর থেকে ভেসে আসছে আযানের মিষ্টি সুর।আকাশ জুড়ে নীলচে আর লালচে আভার মিলন মেলা।তারাফ আবারো গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায় সানায়ার দিকে।হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে।হিম হিম বাতাসে হালকা কাপন তুলছে শরীরে।সানায়া তার দুইহাত জড়িয়ে নেয়।অবাধ্য চুলগুলো আবারো কপাল জুড়ে এলোমেলো ভাবে খেলছে।সানায়া হাত দিয়ে তা সরায়।প্রগাঢ়ভাবে তারাফ দেখছে তার শ্যামাবতীকে।গৌধুলীর মায়ায় যেনো আরো মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে তারাফ তার শ্যামাবতী এই অদ্ভুত রূপে।
তারাফ ওর হাত দিয়ে সানায় হাত ধরে।চকিতে সানায়া তার শীতল হাতে উষ্ণ ছোয়ায় হাতের দিকে তাকায়।হাত থেকে অক্ষিপল্লব নাড়িয়ে আঁখি আবদ্ধ করে তারাফ এ মুখশ্রী তে।তারাফ কোনো কথা বলল না।চোখে হাসলো সে।সামনে তাকিয়ে পা বাড়ায় নদীর দিকে।সানায়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর পদযুগল অনুসরণ করতে লাগলো।নদীর কাছটায় এসে ঢালু জায়গাটার আরেকটু নিচে নামে তারাফ।ঢালু হওয়ার কিঞ্চিৎ ইতস্তত বোধ করলো সানায়া।তারাফ তার পরিবর্তে এক মিষ্টি হাসি উপহার দিলো সানায়া কে।এই লোকটার অধরে হাসি লেগেই থাকে।অদ্ভুত !!
তারাফ ওর হাতটা বাড়িয়ে দেয় সানায়ার দিকে।তারাফ এর হাত ধরে নিচে নামতে গেলে পড়ে যেতে গেলে ওর হাতটা গভীর করে ধরে সানায়া।নির্বাক হয়ে তারাফ তার অক্ষিযুগল নাড়াচাড়া করতে থাকে।দুই হাত দিয়ে সাবধানে সানায়া কে ঢালু জায়গারটার নিচে আনে।দুজন নিঃশব্দে বসে।
তারাফ নিজের জুতো জোড়া খুলে পাশে রাখে।নদীর শীতল পানিতে ডুবিয়ে দেয় পা দুটো।এক হীম করা অনুভুতি।তারাফ একটু ঝুকে সানায়ার পায়ে হাত দেয়।হকচকিয়ে উঠে সানায়া।শশব্যস্ত গলায় বলল—
“কী করছেন কী!!
তারাফ ঘাড় ঘুড়িয়ে উচু হয়ে বলল–
“ইটস ওকে।যার সর্বত্র সৌন্দর্য ছড়িয়ে তার হাতে ই বা কী আর পায়েই বা কি।”
সানায়া গভীরভাবে তারাফ এর বলা কথাটা ভাবলো।কিন্তু কোনো উত্তর খুজে পেলো না।নদীর পানিতে পা ডুবাতেই শিরশির করে উঠে সানায়ার গাত্রবরণ।দুপাশের মাটিতে শক্তভাবে হাত রেখে পা নাড়াতে থাকে।এক অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে।সানায়ার মনে হলো তার শরীরে সমস্ত রোষ,ক্লেশ,জড়তা,আবদ্ধতা যেনো নদীর পানি ধীরে ধীরে তার গর্ভে শুষে নিচ্ছে।নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছে সানায়ার।হাস্যোজ্জ্বল চোখে ফিরে তাকায় তারাফ এর দিকে।সানায়া দেখে তারাফ গভীর মনোযোগে ওকে দেখে যাচ্ছে।সানায়ার চোখ পড়তেই নিজেকে সংবরন করে তারাফ।মৃদু হেসে পা দুলাতে থাকে পানিতে।সূর্য ডুবে গিয়েছে অনেক আগেই।সন্ধ্যার শেষে রাতের শুরু হতে চলল।
,
,
,
দুইদিন লাগাতার কল করেও আজরাহান,মারশিয়াদ,আশফিক এদের কারো খোঁজ পাওয়া যায় নি।প্রথম দিন নিঃসঙ্কচে গেলেও তার পরের দিন কুহেলিকা উৎকন্ঠার সাথে হাসফাস করতে থাকেন।সারাদিন কল করেও কোনো খোঁজ নেই।হঠাৎ করে শরীর খারাপ করে কুহেলিকার।মায়ের মন তো তাই কু ডাকা শুরু করে।দু রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছে কুহেলিকা।সানোয়ার আহমেদ যে চিন্তিত নয় তা না।কিন্তু তার নিজের ছেলের উপর ভরসা আছে।আজ সকালেই আজরাহান কল করে জানায় সে ফিরবে।স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কুহেলিকা।দুঃচিন্তায় তার নাভিশ্বাস উঠে যায়।
দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ে প্রহর।ঘুমের ঘোরেই গলার নিচটায় উষ্ণ হাওয়ার অস্তিত্ব টের পায় ।সিলিং এর দিকে মুখ করেই শুয়েছিলো প্রহর।হালকা শীত পড়ায় আচমকা অনুভুত হওয়া উষ্ণতায় বেশ লাগছে প্রহর এর।কিন্তু অনেক চেয়েও আঁখিপুট উন্মোচিত করতে পারছে না প্রহর।নিজের পেটের উপর কারো উষ্ণ ছোয়া তীব্র থেকে তীব্র ভাবে অনুভব করছে সে।শিউরে উঠে তার শরীর।ঝট করে অক্ষিপল্লব মেলতেই দেখে আজরাহান ওর গলায় মুখ ডুবিয়ে এক হাত ওর জামার নিচে রেখে উন্মুক্ত পেটের উপর বিচরণ করাচ্ছে।প্রহর বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বিস্মিত গলায় বলল–
“রাহান ভাইয়া, আপনি!!!
আজরাহান প্রহর এর গলা থেকে মাথা উঠিয়ে ওর সোজাসুজি বালিশে রাখে।পেটের দিক থেকে হাত এগিয়ে পিঠের দিকে নিয়ে প্রহর কে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়।একে অন্যের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে প্রগাঢ়ভাবে।বাইরে যাওয়ার সময় পর্দা জানালা আটকে দেওয়ায় ভিতরে কোনো আলো নেই।সন্ধ্যা ছাড়িয়েছে দিন অনেকক্ষন।ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আজরাহান এর বাদামী রঙের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।আজরাহান এর নিঃশ্বাসের এক সুমিষ্ট ঘ্রান প্রহরকে সম্মোহিত করে ফেলেছে।আজরাহান শান্ত কন্ঠে বলল–
“হুম আমি।”
“আপনি এখানে কেনো!!ছোট মা…।”
“মা ঘরে নেই।”
প্রহর পলক ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস টানে।জিঙ্গাসু গলায় বলল–
“কোথায় গিয়েছে??
“ভাবী কে আনতে।”
“আপনি কখন এসেছেন??
“বিকেলে।
তুই চেঞ্জ না করে এই অবেলায় শুয়ে আছিস কেনো??
“ঘুম পাচ্ছিলো খুব তাই।”
আজরাহান দুষ্ট স্বরে বলল–
“রাতে কী করিস তুই!!এই দুদিন তো আমিও ছিলাম না।”
প্রহর মনে মনে আওড়াতে থাকে,,কী করে ঘুমাবে সে!!এই মানুষটার কথা ভাবতে ভাবতেই তো ঘুম উড়ে যায় অচিন পুরে।দুদিন একদম ভালো কাটেনি প্রহর এর।সারাদিন আজরাহান কেই ভেবে চলেছে সে।এখন সে তৃপ্ত।তার প্রানসঞ্চারক ফিরে এসেছে।সে নিঃশ্বাস নিতে পারছে।
আজরাহান ফিচলে গলায় আবার বলল–
“যা ঘুমানোর এখন ঘুমিয়ে নে।বিয়ের পর আর সেই সুযোগ পাবি না।”
প্রহর স্মিত হাসে।তারা একে অন্যের একদম কাছে।আজরাহান এর প্রতিটি হৃদস্পন্দন শুনতে পায় প্রহর।আজরাহান প্রহর এর পিঠে আরেকটু চেপে ওকে একদম নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।প্রহর এর বুকের ডিপডিপ ধ্বনি বাড়তে থাকে।কিন্তু কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সে করে না।প্রহর ওর একহাত রাখে আজরাহান এর গালে।শান্ত গলায় বলল–
“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি??
“শশুরবাড়ি।”
“তাহলে একা এসেছেন কেনো!!আপনার বউ আর বাচ্চাদের সাথে নিয়ে আসতেন।”
“আমায বউ তো তুই।আর বাচ্চা,,,
তার প্রক্রিয়া চলছে।”
প্রহর কিছু বলার আগেই একটু ঝুকে এসে প্রহর এর অধরসুধায় ডুব দেয় আজরাহান।প্রহর ওর দুই হাত দিয়ে আজরাহান এর শার্ট খামছে ধরে।গভীর আশ্লেষে শুষে নিতে থাকে একে অন্যের অধরসুধা।প্রহর এর সমস্ত শরীর অনুরণিত হয়।একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ থাকায় প্রহর এর শরীরের প্রতিটি কম্পন আজরাহান এর শিরা উপশিরায় ঝঙ্কার তোলা শুরু করে।একে অন্যের মাঝে এতটাই মত্ত যে আজরাহান বেসামাল হয়ে পড়ে।প্রহর কে ছেড়েই ঝট করে উঠে বসে আজরাহান।প্রহর নিশ্চল হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।আজরাহান হাতড়িয়ে বেডসাইড সুইচ অন করে।আলোকিত হয় অন্ধকারে ঢাকা রুদ্ধদ্বার এর এই ঘর।প্রহর উঠে আজরাহান এর পাশঘেষে বসে।দুই হাতের আজলায় আজরাহান এর মুখ নিয়ে নিজের দিকে ঘোরায়।নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে জিঙ্গাসু গলায় বলল–
“কী হয়েছে রাহান ভাইয়া???
আজরাহান ওর হাত সরিয়ে ফ্লোরে চোখ আবদ্ধ করে।ম্লান সুরে বলল–
“আর কখনো এই ভর সন্ধেবেলায় শুবি না।যা চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
প্রহর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল–
“আচ্ছা।আপনি বসেন আমি আসছি।”
প্রহর ওয়াশরুমে যেতেই কপাল ভাজ হয়ে আসে আজরাহান এর।বিক্ষিপ্ত গলায় অস্ফুটভাবে বলল–
“কী করতে যাচ্ছিলাম আমি!!এতোবড় ভুল!!
অক্ষিযুগল দৃঢ় করে আজরাহান।ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে আসে প্রহর এর ঘর থেকে।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে এসে দাড়ায় প্রহর।নিজেকে দেখেই একগাল হাসে।কাপা কাপা হাতে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করতেই ওর আছরাহান উষ্ণ ছোয়া অনুভুত হয়।নিজের অজান্তেই পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে নেয় প্রহর।
“কীরে ঘুম এখনো শেষ হয়নি তোর!!
আজকাল কী দাড়িয়েও ঘুমাস না কী??
আজরাহান এর দৃপ্ত কন্ঠে চোখ খুলে তাকায় প্রহর।সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আজরাহান।প্রহর এর আজ কেনো যেনো ভীষন লজ্জা পাচ্ছে।এর আগেও আজরাহান ওকে বহুবার আলিঙ্গন করেছে।কিন্তু এই অদ্ভুত শিউরে উঠা অনুভুতি আগে কখনো হয়নি।তবে আজ কেনো হলো???
এই দুদিন কেনো মনে হলো সে এই মানুষটাকে ছাড়া থাকতে পারবে না!
কেনো মনে হলো নিজের জীবনে এই মানুষটাকেই তার চাই।নিজের করে চাই।একান্ত নিজের।শান্ত পায়ে এগিয়ে আসে আজরাহান প্রহর এর কাছে।ওর গালে চুমু খেতেই সপ্রতিভ হয় প্রহর।ওর চোখ নেমে আসে।ইচ্ছে করছে না আজ আজরাহান এর দিকে তাকাতে।মনে হচ্ছে ওর দিকে তাকাতেই ওর হৃদয়ের তৃষ্ণা বেড়ে যাবে।আর এই তৃষ্ণা এই মুহূর্তে না মিটালে ও মরে যাবে।একদম মরে যাবে।এ যে ভালোবাসার তৃষ্ণা।
তাহলে কী সে সত্যিই তার রাহান ভাইয়া কে ভালোবাসে??
তাকে নিজের করে চায়??
“এই কী ভাবছিস তুই??
প্রহর লজ্জামিশ্রিত গলায় অস্ফুট ভাবে বলল–
“কিছু না।”
আজরাহান শীতল শ্বাস ছেড়ে মিষ্টি গলায় বলল–
“তোর জন্য রসগোল্লা এনেছি ডিঙি নৌকা।
হা কর।”
প্রহর কোনো প্রতিক্রিয়া না করে হা করে।রসগোল্লার আধ অংশ মুখে পুরতেই প্রহর নিজের অক্ষিপুট ধীরে ধীরে প্রশস্ত করতে থাকে।বিস্ফোরিত চোখে তাকায় আজরাহান এর দিকে।ভয় আর দ্বিধান্বিত গলায় বলল–
“আপনি কুহুহপুর গিয়েছিলেন??
আজরাহান ভ্রু যুগল কুঞ্চি করে শান্তভাবে চোখের কোন ক্ষীন করে।মৃদু স্বরে বলল–
“তুই কী করে জানলি আমি কুহুকপুর গিয়েছি??
প্রহর ঝপাস করে আজরাহান এর বুকে পড়ে।আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আজরাহান কে।একদম গভীরভাবে।বাদলের ধারা ঝড়িয়ে হেচকি তুলে বলল–
“আপনি আর কখনো যাবেন না কুহুকপুর।কখনো না।”
আজরাহান বিগলিত গলায় বলল–
“এই কী হয়েছে তোর!!কাঁদছিস কেনো??তাকা আমাদের দিকে রেড রোজ।তাকা।”
আজরাহান এর এক হাতে মিষ্টির বক্স অন্য হাতে প্রহর এর আধ খাওয়া মিষ্টি।তাই নিজের ইচ্ছে থাকলেও প্রহরকে সরাতে পারছে না।প্রহর ওর বুক থেকে মাথা তুলে নাক টানতে টানতে বলল–
“আপনি যান এখান থেকে।যান।”
আজরাহান কিছু বলার সুযোগ পায় না।তার আগেই প্রহর ওকে মৃদু ধাক্কায় রুম থেকে বের করে দরজা লক করে দেয়।আজরাহান হাতের উল্টোপাশ দিয়ে কড়াঘাত করতে থাকে।প্রহর দরজা না খুললেও কুহেলিকা শান্ত পায়ে সেখানে এসে দাড়ায়।স্বতন্ত্র গলায় বলল–
“আজরাহান এখানে কী করছো তুমি??
আজরাহান দুই পাটি দাত একসাথে করে তা কেলিয়ে দেখায় কুহেলিকা কে।ভ্রু কুচকায় কুহেলিকা।আজরাহান ওর হাতের মিষ্টির প্যাকেট টা ডাইনিং টেবিলের উপরে রেখে আধ খাওয়া মিষ্টিটা মুখে পুরে ভজভজ করে বলল—
“দিলাম রসগোল্লা খেতে আর দিলো আমাকে ঘর থেকে বের করে।এই জন্যই লোকে বলে””দুনিয়ায় ভালো মানুষের দাম নাই।”
আজরাহান সিড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে যায়।সানায়াকে ঠোঁট চিপে হাসতে দেখে কুহেলিকা গম্ভীর গলায় বললেন–
“ও কী বলল রে??
“সানায়া একগাল হেসে বলল–
“তোমার আজাইরা রাহান বলেছে তাকে দিয়ে এইসব ছোট খাট কাজ হবে না।তিনি মহৎ কিছু করবেন।”
কুহেলিকা উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকে।যার অর্থ সে কিছুই বুঝে নি।
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ
বলবো না কিছু😒😒)