বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ২৬

0
4413

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ২৬
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

দুই দিনে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সানায়া।চোখের ফোলা ভাব সাথে দূর্বলতা,ফ্যাকাশে চেহারা।একদম বিশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিল যেনো।
পাঁচ বছরের সুপ্ত ভালোবাসা সানায়ার।অকস্মাৎ এতোটা শকড নিতে পারে নি।মারশিয়াদ কে সানায়া সেই প্রথম দেখা থেকে ভালোবাসে।মারশিয়াদ এর ব্যক্তিত্ব ,বাচনভঙ্গি, ওর গভীর চোখের চাহনি,অধরে লেগে থাকা স্মিত হাসি ওর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা সবকিছুই প্রথম দেখায় সানায় কে বিমুগ্ধ করে।একটু একটু করে ওর মনে ফোটা ভালোবাসার পদ্ম আজ তার সম্পূর্ণ পরিস্ফুটন ঘটিয়েছে।কিন্তু দমকা হাওয়া যেনো তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অকুলপাথারে।
রাতের স্বপ্ন না কি মায়া থাকে।কিন্তু সে তো দিনের স্বচ্ছ আলোয় তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাতে চেয়েছে।যা মিথ্যে হবার নয়।তবে আজ কেনো সব ধূ ধূ মরুভূমি !!
কেনো তার মনে হচ্ছে এইসব ভালোবাসা ছিল না,ছিল মরিচিকা।
বুকের কোথাও জমে থাকা পাহাড়সম কষ্ট সানায়ার বুকে ভীষন চাপ সৃষ্টি করছে।বুক ভারী হয়ে আসছে তার।
উপর ওয়ালার কাছে তার একটাই প্রার্থনা সে যা ভাবছে তা যেনো মিথ্যে হয়।তার জান যেনো তাকেই ভালোবাসে।অন্য কাউকে নয়।

সানোয়ার আহমেদ শুয়ে শুয়ে সানায়ার কথা ভাবছেন।ছোট বেলা থেকেই সানায়া চটপটা।কোনো কিছু গোপন রাখে না।কিন্তু আজ এমন কী হলো যে তার মেয়ে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না।তাহলে কী সে তার মেয়েকে কখনো বুঝতে পারে নি!!না কী বুঝার চেষ্টা করে নি!!

ডোর বেল বাজতেই লম্বা লম্বা পা ফেলে দরজায় এসে দাড়ায় নন্দিতা।সে ছাড়া যারা আছে সবাই নিজের ঘরে।দরজা খুলতেই লম্বা চওড়া এক সুদর্শন ব্যক্তিকে দেখতে পায় নন্দিতা।অধর ছড়িয়ে ছন্দবিহীন হাসির রেখা টানে।ধীর গলায় বলল–

“আসসালামু আলাইকুম।”

নন্দিতা বিস্মিত গলায় বলল–

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।
কাকে চাই??

নন্দিতা এর আগে ছেলেটিকে কখনো দেখেনি।মৃদু স্বরে ছেলেটি বলল–

“আমি তারাফ।মিস সানায়া বাসায় আছে??

সানায়া স্বস্তিকর নিঃশ্বাস ফেলে সহজ গলায় বলল–

“ও আপনি সেই এন জিও ওয়ালা!!
আসেন,আসেন।ভিতরে আসেন।”

তারাফ অধর প্রস্ফুটিত করে বলল–

“আমাকে এন জিও ওয়ালা মনে হয়!!

লজ্জামিশ্রিত হাসে নন্দিতা।ইতস্তত হয়ে বলল–

“না মানে ওই আসলে…

“ইটস ওকে ভাবি।”

নন্দিতা বিস্মিত চোখে কম্পনরত কন্ঠে বলল–

“আআপনি জজানলেন কী করে আমি সানায়ার ভাবি!!

তারাফ হালকা হাসে।হাসিতে যেনো মুক্ত ঝড়ে।নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে নন্দিতা।স্বাভাবিক গলায় তারাফ বলল–

“আপনাদের কথা অনেক শুনেছি মিস সানায়ার কাছে।আর এতোটা গাধা নই অবশ্য।”

নন্দিতার বেশ লাগলো তারাফ কে।কি মিষ্টি আর আপনজনের মতো কথা বলে!!নন্দিতা নরম গলায় বলল–

“আপনি বসেন।দাড়িয়ে আছেন কেনো??

তারাফ সরল গলায় বলল–

“বসতে পারি যদি আপনি আমাকে তুমি করে বলেন।বয়সে হয়তো বড় হবো কিন্তু সম্পর্কে ছোট।”

নন্দিতা ছোট্ট করে হেসে বলল–

“আচ্ছা ঠিক আছে।বস।আমি সানায়া কে ডেকে দিচ্ছি।”

নন্দিতা সানায়া কে ডাকতে গেলে পুরো ঘরময় চক্ষু বিচরণ করে তারাফ।একদম শান্ত শিষ্ট পরিবেশ।কোনো হৈ হুল্লোড় নেই।সে অবশ্য এইসব এ অভ্যস্ত নয়।এন জিও তে সারাক্ষন চিৎকার চেচামেচি চলতেই থাকে।তারাফ নিঃশব্দ নিঃশ্বাস ফেলে।ভালোই লাগছে তার।

কুহেলিকা কারো কথার আওয়াজ শুনে বাইরে বেরিয়ে আসে।তারাফ কে দেখে চিন্তিত এবং বিরস হাসে।তাকে দেখেই তারাফ উঠে দাড়িয়ে সালাম প্রদর্শন করে।নিজের পরিচয় দিলে কুহেলিহা মুচকি হেসে ওকে বসতে বলে।বেশ কিছুক্ষন পর আসে সানায়া।কুহেলিকা এন জি ও সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করে।তারাফ এর নম্র ব্যবহার,মিষ্টি হাসি আর সুঠাম দেহ সব মিলিয়ে দারুণ পছন্দ হয় কুহেলিকার।সানোয়ার আহমেদ এসেও আপাদমস্তক দেখে তারাফ কে।তারাফ সম্পর্কে সানায়া আগেই অনেক কিছু বলেছে।কিন্তু যা বলেছে তার চেয়েও বেশি অমায়িক তারাফ।কথার সৌন্দর্যে যে কাউকে প্রথম দেখায় বিমোহিত করে ফেলবে।

সানায়া কে দেখে একরাশ হতাশা ভর করে তারাফ কে।দেখেই কেমন বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে।এমন কী হয়েছে এই দুই দিনে তার শ্যামাবতীর সাথে!!

অতি স্বাভাবিক গলায় বলল–

“কেমন আছেন আপনি??

সবার নজর পড়ে সানায়ার দিকে।এখনো পুরো ধকলটা সামলে উঠতে পারে নি।বিমর্ষ চেহারায় বিষাদের ছায়া যা ওর মুখে স্পষ্ট।
সানায় ধরা গলায় বলল–

“ভালো।আপনি??

“আপনাকে দেখে ভালো লাগছে।”

তারাফ এর কথায় উদ্দীপ্ত চোখে তাকায় সানায়া।জোরপূর্বক মৃদু হাসির কম্পন তোলে।শান্ত গলায় বলল–

“বসেন।”

তারাফ স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে।সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু ছন্দে বলল–

“আজ আর বসবো না।আসি।”

সানায়া ব্যস্ত গলায় বলল–

“এখনই চলে যাবেন??

“জ্বী।ওরা সবাই একা।”

সানায়া ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়ে।বিগলিত হেসে বলল–

“চলেন আপনাকে এগিয়ে দেই।”

তারাফ স্মিত হেসে কুহেলিকা আর সানোয়ার আহমেদ থেকে বিদায় নিয়ে ঘুড়ে দাড়াতে তটস্থ পায়ে সেখানে এসে স্থির হয় নন্দিতা।হাতে হালকা নাস্তা।অধর চড়িয়ে মোহনীয় হেসে তারাফ বলল–

“আজ না ভাবি।অন্যদিন।আসি।”

নন্দিতা নিরস গলায় বলল–

“আচ্ছা আবার এসো।”

,
,
সানায়াদের বাড়ির রাস্তাটা বেশি প্রশস্ত নয়।এলাকার মানুষের পার্সোনাল গাড়ি ছাড়া তেমন কোনো যানবাহন এর আনাগোনা নেই।পাশাপাশি হেটে চলছে তারাফ আর সানায়া।একে অপরের পদযুগল একসাথেই এগিয়ে চলছে।তারাফ আড়চোখে বারবার দেখে চলছে সানায়া কে।কেমন যেনো দম বন্ধ লাগছে তার।বুকের কোথাও একটা টুকরো মাংসপিন্ড যেনো দপ দপ করছে।ভীষন রকম কাঁপছে তা।শ্বাসরুদ্ধ করে দিচ্ছে মনে হচ্ছে।সানায়ার এই নিরব অভিব্যক্তি তারাফ এর ভিতরটা কে দগ্ধ করে দিচ্ছে।আর হচ্ছে না।কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।কিন্ত একপ্রান্তে দাড়ানো দুটো মানুষ দুজন ভিন্ন মানুষকে ভেবে চলছে। থম মেরে দাড়ায় তারাফ।তার সাথেই দাড়ায় সানায়া।
নির্লিপ্ত তাকিয়ে নরম গলায় তারাফ বলল–

“একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করতে পারি আপনাকে??

ভ্রু কুচকায় সানায়া।চোখে মুখে উত্তাপ জড়ো হয়।উদ্বিগ্ন গলায় বলল–

“বলেন।”

” আপনাদের বাড়িটা কী আপনাদের নিজের??

ঝুমঝুম করে হেসে উঠে সানায়া।দীর্ঘসময় ধরে হাসতে থাকা সানায়ার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে তারাফ।আনমনেই হেসে উঠে।সানায়াদের বাড়িটা যে ওদের নিজের তা তারাফ ভালো করেই জানে।তারপরও প্রেয়সীর মুখের ঝর্ণার মতো ওই শীতল হৃদয় জুড়ানো হাসি টাকে দেখার জন্য অদ্ভুত চেষ্টা করলো সে।সে পেরেছে।
গাঢ় গলায় বলল–

“হাসলে কিন্তু আপনাকে একদম মোনালিসার মতো লাগে।”

তারাফ এর কথায় ধুম করে হাসি বন্ধ করে দেয় সানায়া।নিরস লোক!!শেষ পর্যন্ত একটা মরা মানুষের হাসির সাথে তুলনা করলো!!
মুহুর্তেই হালকা তেতে উঠে তপ্ত গলায় বলল—

“ধ্যাত দিলেন তো আমার হাসির বারোটা বাজিয়ে!!আর কাউকে পেলেন না!!

তারাফ শক্ত হয়ে সিনা চওড়া করে দাড়ালো।সরস গলায় বলল–

“মোনালিসার হাসির রহস্য কিন্তু আজও কেউ উদঘাটন করতে পারিনি।কোটি টাকা দাম তার হাসির।আমার কাছে অবশ্য এতো টাকা নেই।তবে আপনার হাসি আমার কাছে তারে চেয়েও অমূল্য।”

সানায়া স্মিত হাসে।লোকটার কথার মায়া থেকে কোনোভাবেই নিজেকে ছাড়াতে পারে না।কিন্তু তা ভালোলাগা ভালোবাসা নয়।শান্ত গলায় সানায়া বলল–

” একটা প্রশ্ন করতে পারি??

তারাফ অস্ফুট শব্দ করে মাথা নাড়িয়ে বলল–

“উহু।”

সানায়া চোখ মুখ কুচকায়।চোখের কোন ক্ষীন করে তাকায় তারাফের দিকে।তারাফ উচ্ছ্বাসিত হেসে বলল–

“হাজারখানেক প্রশ্ন করেন।”

সানায়া মৃদু হাসে।লোকটা আসলেই অদ্ভুত !!
সানায়া বলল–

“আপনার মতো এতো ট্যালেন্টেড ছেলে ইচ্ছে করলেই কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করতে পারেন।কিন্তু তা না করে একটা সাধারণ এন জিও তে।”

তারাফ অধর ছড়িয়ে হাসে।স্বাভাবিক গলায় বলল–

“এই দুনিয়াতে কেউ নিজের স্বার্থ ছাড়া কোনো কিছুই করে না।”

হকচকিয়ে উঠে সানায়া।তারাফ এর মুখে স্বার্থের কথা শুনে বিষম খায়।এই মানুষটার মুখে স্বার্থের কথা মানায় না।সানায়া আস্তব্যস্ত গলায় বলল–

“মানে??

তারাফ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সানায়া খেয়াল করলো হাস্যোজ্জ্বল চেহারার অধিকারী এই সুদর্শন পুরুষের চেহারায় মুহুর্তেই একরাশ হতাশা ফুটে উঠে।চোখ গুলো টলমল করে উঠে।গাঢ় গলায় তারাফ বলল–

“আমি একজন কে খুজতে এসেছি।এখনো খুজে চলছি।জানি না সে বেঁচে আছে কি না!!জানি না তাকে আর কখনো খুজে পাবো কি না!!তবুও আমৃত্যু তাকে আমি খুজবো।”

সানায়া প্রগাঢ় দৃষ্টিতে দেখে তারাফ কে।শূন্যে তাকিয়ে আছে তারাফ।একরাশ অস্থিরতা তার চোখে মুখে।এই স্বল্প কিন্তু গাঢ় সম্পর্ক তৈরির ব্যপ্তিকালে তারাফ কে সানায়া এতোটা উদাসীন কখনো দেখে নি।প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে সানায়া বলল–

“কে সে??

তারাফ দৃঢ় গলায় বলল–

“আমার সুখতারা।যে আমার জীবনে সুখপাখি হয়ে এসে সুখতারা হয়ে ওই দূর আকাশে মিলিয়ে গিয়েছে।”

উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে সানায়া।তার মনের তৃষ্ণা মেটেনি।সে জানতে চায়।সবটা জানে চায়।আর তা এখনই।তারাফ সানায়ার অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে নিজেই বলল—

“আমার মা খুব তাড়াতাড়ি মারা যান।বাবা আবার বিয়ে করেন।আর আমি আমার নানু বাড়িতে মানুষ হই।আমার চেয়ে বছর ছয়েক বড় আমার এক খালা ছিলো।উপযুক্ত বয়সে তারও বিয়ে হয়।আমি তখন এডমিশন টেস্ট নিয়ে ব্যস্ত।তাই খালার শশুড় বাড়ি যাওয়া হয়নি।ভালো পরীক্ষার ফলাফল হিসেবে একটা পাবলিক ভার্সিটিতে চান্সও পেলাম।প্রায় একবছর পর খালার শশুড় বাড়ি যাই।খালা এমন একটা মানুষকে বিয়ে করেছেন যার প্রথম পক্ষের স্ত্রী তার বিয়ের একবছর পর মারা যান।সেই ঘরের একটা মেয়েও ছিলো।বয়স নয় কী দশ!!

তারাফ একটু থামলো।নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সানায়া।হাওয়া বইছে মৃদু ছন্দে।তার আলোড়নে সানায়ার ছোট ছোট চুল গুলো এলোমেলো উড়ছে।কিন্তু সানায়ার উৎসুক চাহনি ফেরে নি তারাফ থেকে।তারাফ আবার বলল–

“মেয়েটাকে কেনো যেনো একদম সহ্য হতো না আমার।দুধে আলতা গায়ের রঙ।আবক্ষ ঘন কালো চুল।একটা হাটু সমান ফ্রক পড়ে সারা উঠান দৌড়ে বেড়াতো।বেশ কয়েকবার খালার বাড়িতে যাই।ধীরে ধীরে মেয়েটার প্রতি এক অকৃত্তিম মায়া বসে পড়ে।বেশ চঞ্চল ছিলো।”

ক্ষনকাল চুপ থেকে উচ্ছলিত গলায় বলল–

“আমাকে কী ডাকতো জানেন!তারা মিয়া।আমার কিন্তু বেশ মজা লাগত।একবার ওকে বলেছিলাম ওকে আমি বিয়ে করবো তাই আমার মাথার চুল টেনে ছিড়ে ফেলেছে।”

গা দুলিয়ে হেসে উঠে তারাফ।স্বল্প সময় বাদে নম্র গলায় বলল–

“তারপর বলল তারা ভাইয়া।আর আমি তাকে সুখতারা।আমার সুখতারা।”

তারাফ এর বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো এক শীতল দীর্ঘশ্বাস।কাতর নয়নে তাকালো সানায়ার দিকে।সানায়ার কপালে চিন্তার ভাজ।উজ্জ্বল তার চোখের মনি।নরম আর উৎসুক গলায় সানায়া বলল–

“তারপর কী হলো!!সে হারিয়ে গেলো কী করে!!

“একবার খালার বাসায় গিয়ে দেখি সুখতারার ভীষণ জ্বর।কোনো একটা কারনে খালা ওকে মেরেছে।আসলে কী বলেন তো যতই হোক সৎ মা তো সৎ মা ই হয়।সে রাতে আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারি নি।সারারাত জলপট্টি দেই সুখতারার মাথায়।সকালে আমাকে ওর ঘরে দেখে এলাহিকান্ড বাধিয়ে দেয় সুখতারার বাবা।কোনোমতেই তাদের আমি বোঝাতে পারছিলাম না।সুখতারা কে আমি বোনের চোখে দেখি।কলেজের একটা ঝামেলার কারণে কোনো মিমাংসা ছাড়াই আমাকে বাধ্য হয়ে সেদিন ফিরতে হয়।আমার জীবনের চরম ভুল ছিলো তা।”

সানায়া তপ্ত গলায় বলল–

“কেনো,,কী হয়েছিলো??

“সুখতারা হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে।সেইবার যখন খালার বাড়ি গেলাম সুখতারা কে পাইনি।খালা কে অনেক জিঙ্গেস করি।বলল বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়ে আর ফেরেনি।পুরো গ্রামে তাকে আমি খুজে পাইনি।
শুনেছি পাশের গ্রামের একটা মেয়ে কে না কী পাচারকারীরা নিয়ে যায়।আর হয়তো আমার সুখতারাও ছিলো।”

“আর এইজন্যই আপনি ওইসব মেয়েদের মধ্যে তাকে খুজে চলছেন!!

“হ্যাঁ।”

সানায়ার চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে শীতল অশ্রুজল।তারাফ নির্নিমেষ তাকিয়ে বলল–

“কাঁদবেন না।আপনার চোখের জল আমার হৃদয় পুড়ে।”

শান্ত,স্নিগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে সানায়া।তারাফ শান্ত গলায় বলল–

“দোয়া করবেন যেনো আমি আমার সুখতারা কে খুজে পাই।সে ক্ষমা না করলে তো আমি কখনো মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে পারবো না।
আসি।ভালো থাকবেন।”

তারাফের বাড়ন্ত পদযুগল এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে।সানায়া নিস্পলকভাবে তাকিয়ে ভাবছে কতোটা কষ্টে থেকেও একজন মানুষ হাসতে পারে!!
কতোটা ভালোবাসলে কাউকে আমৃত্যু খোঁজার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়!!
কতোটা বিশাল মনের মানুষ হলে একজন মানুষকে এতোটা আপন করে নিতে পারে!
ধীরে ধীরে তারাফ এর অবয়ব সানায়ার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে।সানায়া নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে এখনো।
,
,
,
স্কুল থেকে ফিরেই চট জলদি চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে প্রহর।আজ একটু দেরি হয়েছে আসতে। শীতের বেলা।ঘূর্ণিঝড়ের বেগে ঘড়ির কাটা চলতে থাকে।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যেনো ঘোড়দৌড় শুরু করে সূর্য।আসর এর আযান শেষ হয়েছে।অনেকটা আন্দোলিত প্রহর।আজ থেকে স্কুল ছুটি।
ওর পাশেই ব্যস্ত ভঙিতে এসে বসে আজরাহান।নন্দিতা স্মিত হেসে ওদের দুজনকে খাবার বেড়ে দেয়।খাবার মুখে দিয়েই প্রহর সরস গলায় বলল–

“সানায়া আপু কোথায় ভাবী??

“ওর এক বন্ধু এসেছে।তাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছে।”

প্রহর উচ্ছ্বসিত গলায় বলল–

“ওই এন জি ও ওয়ালা ভাইয়া এসেছে!!ইশ!!আরেকটু আগে আসলে দেখতে পারতাম।”

আজরাহান চোখ কুচকে তপ্ত গলায় বলল–

“এতো পরপুরুষ কে দেখার স্বাধ কেনো তোর!!আমাকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলের দিকে তাকাবি একদম চোখ গেলে দিব তোর।”

“ইশ!!
আপনাকে দেখার কী আছে!!সরেন।আজাইরা রাহান।”

প্রহর ওর প্লেট হাতে দম দম পায়ে এগিয়ে যায় কুহেলিকার ঘরের দিকে।মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে নন্দিতা।ফিচেল গলায় বলল–

“সামলাতে পারবে তো!!শি ইজ ভেরি ডেঞ্জারাস।”

আজরাহান ঠোঁট বাকিয়ে হেসে উচ্ছল গলায় বলল–

“অর্ধেক সামলিয়েছি। বাকি টাও সামলে নিবো।”

দম দম পায়ে কুহেলিকার ঘরে ঢুকে আলগোছে বিছানায় বসে প্রহর।খাওয়ার প্লেট হাতে নিয়ে তা কোলের উপর রাখে।ম্লান মুখ তার।কুহেলিকা আছর ওয়াক্তের নামায শেষ করে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছেন।প্রহর কে দেখে বললেন–

“কী হয়েছে!!চাঁদ মুখে অমাবস্যা কেনো??

প্রহর আহ্লাদী গলায় বলল—

“তোমার ওই আজাইরা রাহান কে কিছু বলবে!!শুধু জ্বালায় আমাকে।”

কুহেলিকা স্মিত হেসে বলল–

“আচ্ছা বলব।
আগে বল আজরাহান ঠিক মতো তোকে পড়ায় তো!!না কী সারাদিন ওর মোবাইলে গেমস খেলিস!!

প্রহর ঠোঁট বাকায়।ইশ!! এসেছেন পড়ায়!সুযোগ পেলেই তো চুমু খায় আমাকে।আস্ত শয়তান।

কুহেলিকার ফের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙে প্রহর এর।স্বাভাবিক গলায় কুহেলিকা বলল–

“কথা বলছিস না কেনো??

“আরে আমাকে রাহান ভাইয়া মোবাইল দেয় না কী!
আগে যাও ও দিতো এখন তো তাও দেয় না।সারাদিন ফুসুরফাসুর করতে থাকে মোবাইলে।”

“কুহেলিকা সরস গলায় বললেন–

“চিন্তার কারণ নেই।যদি ভালো রেজাল্ট করিস তাহলে তোর সামান ভাইয়া কে বলেছি তোকে মোবাইল কিনে দিতে।”

চকচক করে উঠে প্রহর এর চোখ মুখ।উচ্ছলিত গলায় বলল–

“সত্যি !!

“হুম।”

প্রহর দীপ্ত হাসে।খিলখিল শব্দ হয় তাতে।কুহেলিকা গাঢ় গলায় প্রশ্ন করলেন–

“নামায পড়েছিস??

খাওয়া বন্ধ করে আহত চোখে তাকায় কুহেলিকার দিকে। কুহেলিকার এই চাহনির মানে বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না।শান্ত গলায় বললেন–

“মান্থলি শেষ হলে পবিত্র হয়ে ঠিক মতো নামায আদায় করবি।এক ওয়াক্তও যেনো কাযা না হয়।তাহলে এক টা মাইরও মাটিতে পড়বে না।”

প্রহর একগাল হেসে গদগদ গলায় বলল–

“আচ্ছা।”

প্রহর খাওয়ায় অভিনিবেশ করে।কুহেলিকা সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে প্রহর কে।একদম ছোট্ট পাখির ছানা।ফর্সা চেহারায় দীঘল কালো ভ্রু।একদম যেনো জীবন্ত পুতুল।আর এই পুতুলটাকেই কুহেলিকা তার পাগল ছেলেটার বউ করে সারাজীবন এই ঘরে রাখতে চায়।তাতে যদি তার পাগল ছেলেটার পাগলামি একটু কমে।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here