বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩৩

0
4722

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর
#পর্বঃ৩৩
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

“আমার কাছে তুমি এমন একজন
এতো ভালোবাসি তবু ভরে না তো মন….।।

ভালোবাসার শুরু তুমি শেষ হবে কী জানি না
আমি বলতে তোমায় বুঝি অন্য কিছু বুঝিনা..
এভাবে মিশে থেকো,মায়াতে বেঁধে রেখো
ভালো থাকার তুমি কারণ

আমার কাছে তুমি এমন একজন
এতো ভালোবাসি তবু ভরে না তো মন….।।

—–মাহতিম সাকিব

নিজের অশ্রুঝরা চোখ নিয়ে হাটু গেড়ে দুই হাত জোড় করে তাকিয়ে আছে আজরাহান প্রহর এর দিকে।প্রহর কান্না থামিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে আজরাহান এর দিকে।যেই চোখে একদিন সে ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেছে,যেই চোখে দেখেছে ভয়ার্ত হিংস্রতা আজ সেই চোখ নিষ্প্রাণ,নিষ্প্রভ,শান্ত।
প্রহর নির্বিকার।ঘন ঘন নিঃশ্বাসে আন্দোলিত হচ্ছে ওর শরীর।প্রহর বিছানা থেকে উঠে আজরাহান এর দুই হাত ধরে ওর সামনেই হাটু ভাঁজ করে বসে।আজরাহান এর ললাটে উষ্ণ চুম্বন করে। ম্লান গলায় বলল—

“কেনো এমন পাগলামো করছেন!আপনি কিছু জানেন না আমার সম্পর্কে।আমি আপনাকে কখনো সুখি করতে পারবো না।প্লিজ ভুলে যান আমাকে।ভুলে যান আমাকে।”

আজরাহান প্রহর এর গালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল–

“আমি আমার নিঃশ্বাস কে ভুলে যেতে পারবো কিন্তু তোকে ভুলতে পারবো না।আমায় একা করে দিস না প্রহর।তোকে ছাড়া আমি এক কদম সামনে চলতে পারবো না।”

প্রহর ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে।নরম গলায় স্থির হয়ে বলল—

“আপনি কিছু জানেন না আমার সম্পর্কে।আমি আপনার যোগ্য নই।”

আজরাহান ক্ষুন্ন গলায় বলল–

“কেনো বলছিস এমন!কী জানি না আমি!কী হয়েছে তোর!
বল আমাকে প্রহর।সব খুলে বল আমাকে।”

“আমি কিচ্ছু বলতে পারবো না।আপনি চলে যান।”

আজরাহান গাঢ় গলায় কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলল—

“কোথাও যাবো না আমি।কোথাও না।আজ তোকে সব বলতে হবে আমাকে।কী হয়েছে তোর সাথে?
কীভাবে এলি তুই এখানে?

প্রহর আবারো ঝরঝর করে কেঁদে উঠে।অনুরণিত কন্ঠে বলল–

“আপনি দেখবেন,দেখবেন আপনি!
দেখেন,দেখেন না রাহান ভাইয়া।”

প্রহর ওর কামিজের নিচের অংশ উঠিয়ে সালোয়ার একটু নিচে নামাতেই আজরাহান দেখে ওর নাভির বামপাশে একটু নিচে একটা পোড়া দাগ।আজরাহান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকে।ফর্সা শরীরে ওই পোড়া দাগ যেনো এখনো দগদগ করছে।আজরাহান হাত লাগাতেই কেঁপে উঠে প্রহর।আজরাহান রাগমিশ্রিত গলায় বলল—

“কী করে হলো এইসব!
কে করেছে এইসব!

প্রহর ঝুমঝুম করে অশ্রু ঝরিয়ে যাচ্ছে।আজরাহান ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে।উত্তেজিত গলায় বলল–

“কথা বলছিস না কেনো?
কে করেছে এইসব?বল আমায়,বল প্রহর।বল তোর রাহান ভাইয়া কে।”

প্রহর আজরাহান কে জড়িয়ে ধরে।ধকধক করতে থাকে প্রহর এর বুক।অশ্রুজল ছাপিয়ে যাচ্ছে আজরাহান এর সব প্রশ্নের মায়াজাল।বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর প্রহর শান্ত হয়ে বসে।আজরাহান উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে প্রহর এর দিকে।শান্ত,স্বাভাবিক,ফিকে গলায় প্রহর বলতে শুরু করলো—

“আমার যখন আট বছর তখন মার কী যেনো হয়।তাই বাবা আবার বিয়ে করে।জানেন,বাবা আর মার কাছে আসতো না।আমাকেও ভালোবাসতো না।যখন মা ছিলো তখন নতুন মা আমাকে মারতো না।কিন্তু যখন মা মারা যায় তারপর থেকে কিছু হলেই নতুন মা আমাকে মারতো।”

প্রহর ক্ষনকাল থামে।বুকে জমানো কষ্ট গুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে ওর গলায়।যেনো শ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।শান্ত গলায় আবার বলল—

“জানেন স্কুলে যেতে দিতো চাইতো না আমাকে।সারাদিন কাজ করাতো।আপনিই বলেন আমি কী এতো কাজ করতে পারি!
সারাদিন কাজ করলেও আমাকে খেতে দিতো না।আমার খিদে লাগতো না বুঝি!

আজরাহান দুই হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল দিয়ে প্রহর এর নিরব অশ্রু মুছে দেয়।ওর কপালে স্নিগ্ধ চুমু খায়।
নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে আজরাহান।রাগে ওর শিরা উপশিরা কাঁপছে।
প্রহর আবার বলল–

“জানেন একদিন নতুন মা ভাত বসিয়ে গোসল করতে যায়।আমাকে রান্না দেখতে বলে।ওতোবড় পাতিল আমি কী করে নামাই!
ভাতের পাতিল নামাতে গিয়ে সব নিচে পড়ে যায়।আর এই জন্য নতুন মা আমাকে এইখানে জ্বলন্ত লাকড়ি লাগিয়ে দেয়।”

আজরাহান ওর দুই হাতের মুষ্টি আবদ্ধ করে।দপদপ করছে ওর মস্তিষ্কের স্নায়ু।চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় চোখে তাকিয়ে আছে প্রহর এর দিকে।প্রহর কিছুক্ষন ফুঁপিয়ে আবার বলল–

“জানেন বাবা কে বললে বাবা আমার কথা একটুও বিশ্বাস করে না।উল্টো আমাকেই বকে।
সেদিন রাতে তারাফ ভাইয়া এসেছিলো।আমার জ্বর আসায় তারাফ ভাইয়া সারারাত আমার ঘরে ছিলো।আর তাই…।”

প্রহর বিলাপ করে উঠে।ওর কান্নার আওয়াজে আজরাহান এর প্রতিটা রক্তবিন্দু ফুটন্ত জলের মতো ফুটতে শুরু করে।

“আর তাই নতুন মা আমাকে নোংরা মেয়ে বলেছে।আর বাবাও বিশ্বাস করেনিলো।আর এই জন্যই ওই খারাপ লোকগুলোর কাছে আমাকে বিক্রি করেদিলো।
আমি কী সত্যিই খারাপ রাহান ভাইয়া!
বলেন না রাহান ভাইয়া!

আজরাহান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।পাহাড়সম যন্ত্রণা যে বয়ে বেড়াচ্ছে তাকে কী করে পারলো এতোটা কষ্ট দিতে সে।
আজরাহান নম্র ও গাঢ় গলায় বলল–

“যা হয়েছে ভুলে যা।আমি ওদের কাউকে ছাড়বো না।”

“বাবা বেঁচে নেই রাহান ভাইয়া।নতুন মাও তার শাস্তি পেয়েছে।আমার কোনো অভিযোগ নেই তাদের প্রতি।”

“তাহলে কাঁদছিস কেনো তুই?
ভুলে যা সব।”

প্রহর ক্ষুন্ন গলায় বলল–

“কেনো সবাই আমাকে সন্দেহ করে!কেনো বিশ্বাস করে না কেউ আমায়!আমি কী খুব খারাপ!!

আজরাহান সরস গলায় বলল–

“কে বলল তুই খারাপ!
তুই আমার রেড রোজ।আর আমার রেড রোজ কখনো খারাপ হতে পারে না।”

“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না রাহান ভাইয়া।আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিন।”

আজরাহান এর দৃষ্টি শীতল।কপালে ভাঁজ পড়েছে।গাঢ় গলায় বলল—

“আমি মানছি আমি ভুল করেছি।আমি তোকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারি না প্রহর।কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আর ভুল হবে না আমার।আর কখনো আমি তোকে সন্দেহ করবো না।”

প্রহর কাঁপা গলায় বলল–

“তা হয় না রাহান ভাইয়া।আমি আপনাকে কখনো খুশি রাখতে পারবো না।আপনি দেখলেন না নতুন মা কী করেছে!
এইরকম আরো অনেক দাগ আছে আমার শরীরে।আমি ভালো না রাহান ভাইয়া।ভালো না।”

আজরাহান ব্যস্তভাবে প্রহর চোখে মুখে চুমু খেয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল–

“তুই কী পাগল!
তোর কী মনে হয় আমি তোর শরীর কে ভালোবাসি!আমি তোকে ভালোবাসি প্রহর।শুধু তোকে।
তুই যদি চাস আমি কখনো তোকে স্পর্শ করবো না।শুধু আমার হয়ে থাক তুই।শুধু তোর সৌরভে আমাকে নিঃশ্বাস নিতে দে রেড রোড।আমার আর কিছু চাই না।”

প্রহর এক পশলা অশ্রুজল বিসর্জন দেয়।করুন চোখে তাকিয়ে আহত গলায় বলল—

“রাহান ভাইয়া!

আজরাহান গাঢ় চুম্বন করে প্রহর এর অধরে।প্রহর এর সমস্ত কষ্ট,যন্ত্রণার হিমালয় বিগলিত হতে থাকে আজরাহান এর উষ্ণ অধরের ছোঁয়ায়।জন্ম নেয় এক নতুন প্রহর এর।আজরাহান এর প্রহর।
,
,
,
সকাল নয়টা বেজে গেছে।কিন্তু এখনো আজরাহান নাস্তার জন্য নিচে আসেনি।কুহেলিকা সানায়া কে পাঠায় আজরাহান কে ডাকতে।সিড়ি বেয়ে ক্রমশ বিবশ পায়ে নিচে নামছে সানায়া। ম্লান চোখ মুখ তার।কুহেলিকা ওকে দেখেই শক্ত গলায় বললেন—

“আজরাহান কোথায়?

শুকনো ঢোক গিলে সানায়া।কী বলবে সে!ঘন ঘন কয়েকটা ঢোক গিলে সংকোচযুক্ত গলায় বলল—

“ভাইয়া তো ঘরে নেই।”

কুহেলিকা খেকিয়ে উঠে বললেন—

“কোথায় গেছে ও?

সবার চোখ গিয়ে নিবদ্ধ হলো প্রহর এর ঘরের দরজায়।অন্যদিন তো এইসময় দরজা খোলাই থাকে।অকস্মাৎ এক ভয় চেপে বসে কুহেলিকা শরীরে।প্রহর এর ঘরের দরজায় গিয়ে থাবা মারতে থাকে।ক্ষীপ্ত গলায় বলল—

“প্রহর,প্রহর দরজা খোল।খোল বলছি।”

সানায়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে।কি হবে এখন!যদি সত্যিই আজরাহান ঘরে থাকে।কুহেলিকার বিক্ষিপ্ত আওয়াজে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সানোয়ার আহমেদ।সামান নন্দিতার পাশেই দাঁড়ানো।

সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে প্রহর এর ম্লান মুখে।আজরাহান এর বুকের উপর শুয়ে আছে ও।দরজার আওয়াজ হতেই নিমিঝিমি চোখে উঠে বসে প্রহর।কুহেলিকার তপ্ত গলার আওয়াজ এই সপ্রতিভ হয় প্রহর।এক হাত দিয়ে আজরাহান কে নাড়াতে থাকে।উদগ্রীব হয়ে বলল—

“রাহান ভাইয়া,রাহান ভাইয়া উঠেন।”

আজরাহান চোখ কঁচলে উঠে বসে।ঢুলুঢুলু হয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল–

“কী হয়েছে?
এমন করছিস কেনো?

প্রহর রুদ্ধশ্বাস এ বলল–

“ছোট মা এসেছে।ডাকছে।”

আজরাহান বিগলিত হাসে।নরম গলায় বলল—

“ভয় পাচ্ছিস কেনো?
ভয় পাস না।”

প্রহর করুণ গলায় বলল—

“ছোট মা যদি রেগে যায়!

আজরাহান চোখে হাসে।শান্ত গলায় বলল—

“কী আর করবে!
নাহয় একটা চড়ই মারবে।তোর জন্য তো আমি ফাঁসির দড়িতেও ঝুলতে রাজী।চিন্তা করিস না।হজম করে নিবো আমি।
মাফ কর,শুধু তুই পল্টি মারিস না ডিঙি নৌকা।তাহলে এইবার সত্যিই আমাকে বৃন্দাবনের সন্ন্যাসী হতে হবে।”

প্রহর স্মিত হাসে।আজরাহান বিছানা থেকে উঠে প্রহর কে চোখে টিপ্পনী কাটে।একগাল হেসে দরজা খুলে দাঁড়ায়।আজরাহান কে দেখেই কুহেলিকা ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেয় ওর গালে।আজরাহান কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।অবিচলিতভাবে শান্ত গলায় বলল—

“তুমি যদি আমাকে থাপ্পড় না মেরে প্রশ্ন করতে তাহলে আমি হয়তো উত্তর দিতাম।কিন্তু এখন আমি তোমাকে কোনো কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।”

আজরাহান সানোয়ার আহমেদ এর কাছে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দৃঢ় গলায় বলল—

“আমি আজই প্রহর কে বিয়ে করবো।তুমি ব্যবস্থা করো বাবা।”

আজরাহান এর এহেন কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই।কুহেলিকা ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে প্রহর এর কাছে গিয়ে উদ্বেলিত গলায় বললেন—

“তুই ঠিক আছিস তো!আজরাহান তোর সাথে খারাপ কিছু করে নিতো?

প্রহর শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নম্র গলায় বলল–

“কেনো মারলে তুমি রাহান ভাইয়া কে?

কুহেলিকা কোনো কথা বললেন না।প্রহর এর দিকে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইলেন।প্রহর আবার বলল–

“আমাকে তোমার বাড়ির বউ করবে ছোট মা?

কুহেলিকা মনে হয় এতোক্ষনে নিঃশ্বাস নিলেন।উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললেন–

“তুই করবি আমার আজরাহান কে বিয়ে!

“হুম।”

আচমকায় প্রহর এর মুখমণ্ডল অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো কুহেলিকা।সরস গলায় বললেন—

“আলহামদুলিল্লাহ।
আমায় বাঁচালি তুই মা।তোর এই ঋন আমি কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।”

কুহেলিকা হেড়ে গলায় ডেকে উঠলেন,বললেন—

“এই যে শুনছেন।আমি আমার আজরাহান এর জন্য আমার পুতুল বউকে পেয়েগেছি।এইবার আমার ছেলেটা ঠিক ভালো হয়ে যাবে।
তুই ই পারবি আমার আজাইরা রাহান টাকে ঠিক করতে।”

প্রহর হতভম্ব হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।আর ভাবতে থাকে,তার কপালে এতো সুখ সইবে তো!!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here