বৃষ্টিস্নাত ভোর পর্বঃ৩৯

0
5950

#বৃষ্টিস্নাত_ভোর(খন্ডাংশ)
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি

সিড়ি বেয়ে হুড়মুড়িয়ে নামছে নুরাইসা।তৎক্ষণাৎ তার পথ আগলে দাঁড়ায় আজরাহান।আজরাহান কে আজো ঠিক মতো হজম করতে পারে না নুরাইসা।

কিছু কিছু মানুষের জন্মই বোধহয় হয় কিছু মানুষের অগোচরে থাকার জন্য।

আজরাহান কে দেখেই ভ্রু কুঞ্চি করে নুরাইসা।ভ্রু নাচিয়ে স্বাভাবিক গলায় আজরাহান বললো–

“কেমন আছেন মারমেইড?

নুরাইসার মা অসুস্থ হওয়ায় তাকে দেখতে আমেরিকা থেকে এসেছে নুরাইসা আর মারশিয়াদ।আজ আজরাহানদের বাড়িতে ওদের ইনভাইট করা হয়েছে।আশফিক আর ইনশিরাহ তাদের লং ডিসটেন্স ম্যারিড লাইফে তেমন একটা খারাপ নেই।বছরের ছয় মাস ইনশিরাহ বাংলাদেশ তো বাকি ছয় মাস আমেরিকা থাকে।মারশিয়াদ এর সাথে ইনশিরাহ আসেনি সে সেখানেই রয়ে গেছে।

বিরক্তিকর গলায় নুরাইসা বলে উঠলো—

“যেতে দিন আমাকে।”

আজরাহান মিচকি হেসে বললো—

“রাগ করছেন কেন মারমেইড!এতোবড় খুশির খবরে মিষ্টি না হলে চলে!

নুরাইসা মুখ ভার করে বললো—

“কিসের মিষ্টি!কিসের খুশি!

আজরাহান ফিচেল হেসে আফসোস করে বললো—

“হায়!আপনি জানেন না !মারশিয়াদ বাবা হতে চলেছে আর আপনি কিছুই জানেন না!
কী করে পারলো আপনার সাথে এমন করতে!আপনি থাকতেও আরেকটা!

নুরাইসা চোখ টলমল করে উঠে।যেনো এখনই কেঁদে দিবে।ধরা গলায় বললো–

“আপনি মিথ্যে বলছেন।জান এইসব করতেই পারে না।”

“ও আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না!তাহলে দেখেন।”

আজরাহান ওর মোবাইল থেকে একটা ফরওয়ার্ড মেসেজ দেখায় যা মারশিয়াদ এর নাম্বার থেকে সেন্ট করা।আজরাহান আবার ফিকে গলায় বললো–

“দেখলেন তো আপনার জান কি ঘোল খেলে!

নুরাইসা ঝুমঝুম করে কেঁদে ফেলে।দৌঁড়ে আজরাহানদের লিভিং রুমে যায় যেখানে আগে থেকেই সামান,মারশিয়াদ,আশফিক আর তারাফ বসে আছে।চার পুরুষ মিলে রাজনৈতিক,সামাজিক,প্রাগৈতিহাসিক সব আলোচনা চলছে।নুরাইসা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো—

“আপনি,আপনি খুব খারাপ জান।এমন কেন করলেন!

মারশিয়াদ হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ায়।হকচকিয়ে বললো—

“কী হয়েছে !কাঁদছেন কেন আপনি?

“আপনি একটা শয়তান।ছিঃ!লজ্জা করলো না এইসব করতে আপনার!

মারশিয়াদ এর দিকে চোখের পাল্লা প্রশ্বশ্ত করে তাকিয়ে আছে বাকিরা।আর মারশিয়াদ তাকিয়ে আছে সিড়ির নিচে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো আজরাহান এর দিকে।আজরাহান এর অধরের শয়তানি হাসি দেখেই মারশিয়াদ বুঝতে পেরেছে গন্ডগোলটা আজরাহান লাগিয়েছে।মারশিয়াদ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নুরাইসা প্রস্ফুরণ গলায় বললো—

“যান আপনি যান।একদম আমার কাছে আসবেন।গিয়ে আপনার গার্লফ্রেন্ডের বাবুকে সামলান।খাচ্চর লোক কোথাকার!

নুরাইসা সিড়ির দিকে দৌঁড় লাগায়।তার পিছনে মারশিয়াদও।আজরাহান এর দিকে ক্ষীপ্র চোখে তাকিয়ে চোখ দিয়েই ওকে শাসায় মারশিয়াদ।কাউচে এসে আরাম করে বসে আজরাহান।আশফিক সন্দিহান গলায় বললো—

“কাজ টা কী তুই করেছিস!”

আজরাহান শান্ত চোখে তাকায়।হুট করে পন্ডিতের মতো করে বললো–

“আচ্ছা তুই বল এমন গাধি মেয়ে দেখেছিস যে নিজে প্রেগন্যান্ট হওয়ার পরও বুঝে না!
মারশিয়াদ এই গাধি মারমেইড কে সামলায় কী করে!

আশফিক জোরালো গলায় বললো—

“তার মানে এইসব তোর কাজ!

“অবশ্যই।কতোদিন হলো মারমেইড কাঁদতে দেখি না।”

“দুর শালা।তোর এই স্বভাব আর যাবে না!

“তাইতো।আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিনও যাবে না।”
হা হা করে হাসতে থাকে আজরাহান।
,
,
সামানের ঘরে গিয়ে বিলাপ জুড়ে দেয় নুরাইসা।মারশিয়াদ নন্দিতাকে বের করে দিয়ে দরজা লক করে দেয়।নুরাইসার পায়ের কাছে বসে ওর হাত দুটো নিয়ে অনবরত চুমু খেতে থাকে।নুরাইসা ঝট করে হাত টেনে নিয়ে উষ্ণ গলায় বললো—

“একদম চুমু খাবেন না আমাকে।আপনার গার্লফ্রেন্ড এর কাছে যান।যাকে প্রেগন্যান্ট করেছেন তার কাছে যান।”

মারশিয়াদ কোমল গলায় বললো–

“এইসব কী বলছেন মিষ্টি!কিসের গার্লফ্রেন্ড কিসের বাবু!

“আমাকে আজরাহান স্যার বলেছে।আপনি আসলেই খারাপ।”

নুরাইসা কান্নার বেগ বাড়াতে থাকে।মারশিয়াদ ব্যস্ত গলায় বললো–

“প্লিজ থামেন মিষ্টি।আজরাহান ফান করে বলেছে।এই যে দেখেন।”

মারশিয়াদ তার মোবাইল দেখায়।কয়েকদিন ধরেই নুরাইসার স্মেলিং প্রবলেম হচ্ছে আর সেদিন তো গরগর করে বমি করে দেয়।তাই ওকে ডক্টর এর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো।তার রিপোর্ট ইমেল করে পাঠায়।আর সেটাই আজরাহান নিয়ে এই কান্ড ঘটায়।নুরাইসার কান্না থামলেও এখনো হেঁচকি তুলতে থাকে।মারশিয়াদ স্মিত হেসে বললো—

“তো গেলাম আমি গার্লফ্রেন্ড এর কাছে।”

মারশিয়াদ উঠে দাঁড়াতেই ওকে ঝাপটে ওরে নুরাইসা।মারশিয়াদ আলতো হাতে নিজের সাথে নুরাইসাকে মিশিয়ে ধরে।নির্মল গলায় বললো—

“এখন আপনি একা নন মিষ্টি।নিজের সাথে সাথে আমাদের বেবিরও খেয়াল রাখতে হবে।”

“হু।”

,
,
আজরাহান এর ভেজানো দরজা হালকা ধাক্কা মেরে ভেতরে আসে নন্দিতা।হাতে ধোঁয়া উড়ানো গরম কফি।আজরাহান বিসিএস দেওয়ার ট্রাই করছে।অফিস থেকে এসে বাকি সময়টুকু নিজের পড়ায় ব্যয় করে।
নন্দিতা টেবিলে কফির মগ রেখে ফিচেল গলায় বললো–

“কী দেবরজি !সারাবছর কী বইয়েই মুখ গুঁজে রাখবেন নাকি কাজের কাজও কিছু করবেন!

আজরাহান মিচকি হেসে নিচু গলায় বললো—

“ভাইয়ার পাওয়ার কী কমে গেছে নাকি!তা তুমি চাইলে আমার আপত্তি নেই।”

নন্দিতা আজরাহান এর মাথায় একটা চাটা মেরে বললো—

“দুষ্ট ছেলে কোথাকার!পরেরটায় নজর না দিয়ে নিজের চরকায় তেল দাও।”

আজরাহান ছোট্ট করে দম ফেলে বললো—-

“আমার চরকা ঠিক মতোই ঘুরছে এখনই তেল দেওয়ার প্রয়োজন নেই।”

“তাতো জানি।কিন্তু দেবরজি আর কতো ওয়েট করাবেন আমাদের!
দেখো ওদের সবার আগে তোমার আর প্রহর এর বিয়ে হয়েছে।ইনশিরাহ এরও ডেলিভারির টাইম হয়ে এলো,নুরাইসাও কনসিভ করেছে।তো তুমি এখনো বসে আছো কেন!

আজরাহান গম্ভীর গলায় বললো—

“তুমি তো জানো ভাবী,প্রহর মাত্র এইটিন ক্রস করলো।”

“আরে বাবা পনেরো বছরেও অনেকে মা হয়।এইটা কোনো ব্যপার না।আর তুমি নিশ্চয়ই প্রহরকে আরো পড়াবে।এখন ওর এইস.এস.সি শেষ।এখন যদি প্রহর কনসিভ করে তাহলে অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালের আগেই ওর ডেলিভারি হয়ে যাবে।আমি বড় মা হলাম আর তুমি বাবা।আর প্রহর এরও কোনো বছর লস হলো না।
জানো তো মা বাবা কতো আগ্রহ নিয়ে বসে আছে তোমার আর প্রহর এর বেবি দেখার জন্য।”

“জানি।আমি দেখছি।”

“এতো দেখাদেখির কী আছে।তুমি কী যুদ্ধে যাচ্ছো নাকী!

“এটাও তো যুদ্ধের মতোই।”

বিগলিত হাসে আজরাহান।নন্দিতা ওর কান টেনে ধরে।আজরাহান মৃদু আওয়াজ করে বললো—

“আহ!ভাবি ছাড়ো।তুমি আর মা আমার কান টাকে কী পেয়েছো বুঝি না।একদিকে বাবা হতে বলছো আরেকদিকে আমার কান ধরে টানাটানি।কোথাকার ন্যায় এইসব!

“হয়েছে হয়েছে এতো ন্যায় অন্যায় দেখাতে হবে না।সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর তুমি বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছো।”

আজরাহান নরম গলায় বললো—

“তুমি যাও আমি আসছি।”

,
,
নরম পায়ে আড্ডাঘরে ঢোকে আজরাহান।আজরাহান এর শান্ত,নির্মল চোখ দুটি হঠাৎ ই জ্বলে উঠে।প্রহর একদম মারশিয়াদ এর গা ঘেঁষে বসে আছে।সবাই বায়না ধরলো চা খাবে।নন্দিতার কোলে সূর্য্যি।ঘুমে নিভুনিভু করছে ওর চোখ।তাই প্রহর কিচেনে যায় চা বানাতে।

চা বানানো প্রায় শেষ।কাপে ঢালছে প্রহর।আজরাহান শক্ত হয়ে দাঁড়ায় সেখানে।কাপের দিকে নজর রেখেই আজরাহান এর উপস্থিতি বুঝতে পেরে প্রহর স্বাভাবিক গলায় বললো—

“কিছু লাগবে রাহান ভাইয়া?

আজরাহান খপ করে প্রহর এর হাত ধরে।বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো—

“তোকে না মারশিয়াদ থেকে দূরে থাকতে বলেছি?

প্রহর হাত মোচড়া মোচড়ি শুরু করে।চোখ মুখ খিঁচে বললো—

“রাহান ভাইয়া,ছাড়েন লাগছে আমার।”

আজরাহান কঠিন গলায় বললো–

“কেনো শুনিস না তুই আমার কথা!

পরক্ষনেই সেখানে আসে সানায়া।এসে দেখে প্রহর এর হাত থেকে একটা কাপ পড়ে ভেঙে গেছে।ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করলো সানায়া—

“কিরে এইটা ভাঙলো কী করে?

প্রহর অনুযোগের গলায় বলল—

“আমার হাত ফসকে পড়ে গেছে।তুমি চা নিয়ে যাও।আমি এগুলো পরিষ্কার করছি।”

“আচ্ছা জলদি আয়।”

আজরাহান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।প্রহর কাচ গুলো উঠিয়ে একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে জায়গাটা মুছে দেয়।আজরাহান কে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে।

ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে প্রহর।ফিনফিনে হাওয়া বইছে।প্রহর এর কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো চুলগুলো বায়ুর কারণে ঢেউ খেলে যাচ্ছে।চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।তা কিছুক্ষন পরপর হাতের উল্টোপাশ দিয়ে মুছে নিচ্ছে প্রহর।প্রহর এর পাশে এসে দাঁড়ায় মারশিয়াদ।নম্র গলায় বললো—

“এখানে কী করছেন রেড চিলি?

প্রহর শক্ত গলায় বললো—

“কিছু না।”

“আপনি কাঁদছেন?

“আমি কাঁদলে কার কী!

মারশিয়াদ ক্ষীন চোখে তাকিয়ে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো—

“কী হয়েছে আপনার?

প্রহর চটপটে গলায় বললো–

“রাহান ভাইয়া কেন এতো হিংসে করে আপনাকে!এখন তো আমি আর ছোট নই।তার পরও কেন এমন করে আমার সাথে?

“সে আমাকে যতটা হিংসে করে ঠিক তার চেয়ে দ্বিগুন হারে বেশি আপনাকে ভালোবাসে।”

প্রহর জিঙ্গাসু গলায় বললো—

“ভালোবাসলেই হিংসে করতে হয়?

“হয়তো।”

“আপনি কাউকে হিংসে করেন?

“করি।”

“কাকে?

মারশিয়াদ অস্ফুটভাবে বললো—

“আজরাহান কে।”

“আমাকে ভালোবাসেন?

“বাসি।”

“কতোটা?

“যতোটা আপনি আমাকে বাসেন।”

“আর নুরাইসা আপুকে?

“সে আমার প্রাণ।”

মারশিয়াদ স্মিত হাসে।রসালো গলায় বললো—

“এইসব বাদ দিন।আগে বলেন আমাকে চাচ্চু বানাবেন কবে?

প্রহর মুখ ভার করে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বললো—

“কখনো না।”

নিচে নেমে যায় প্রহর।মারশিয়াদ অস্ফুটভাবে বললো—

“আমি চাই পৃথিবীর সব সুখ আপনার চরণে নেমে আসুক।”
,
,
ঘরে ঢুকতেই আজরাহান এর বুকে গিয়ে পড়ে প্রহর।ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।আজরাহান শান্ত গলায় বললো—

“সরি রে।তোকে আমি এক জনমে হারিয়েছি।কিন্তু আগামী সাত জনমেও তোকে আমি আর হারাতে পারবো না।আমি যে আমার ছায়ার সাথেও তোকে ভাগ করে নিতে পারবো নারে প্রহরিনী।কখনো পারবো না।”

আজরাহান সজোরে নিজ বাহুতে আবদ্ধ করে প্রহর কে।এ যেনো চির অটুট বন্ধন।

(বিঃদ্রঃ
আমি আপনাদের বলছিলাম বড় না হোক ছোট করেই কমেন্টস করতে আমার পেজ এর রিচ হঠাৎ ই ডাউন।কিন্তু😔😔।
আচ্ছা যাই হোক ধন্যবাদ।হ্যাপি রিডিং 🙂🙂)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here