#বৃষ্টিস্নাত_ভোর(খন্ডাংশ)
লিখাঃতাজরিয়ান খান তানভি
উপচে পড়া গরমে হাঁসফাস জনজীবন।সূর্য যেনো তার রশ্মি দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে সবাইকে।বাতাসে ধূলোর এক বিভ্রান্তিকর ঘ্রাণ।হকারদের গলা ছাড়া ডাক।রিক্সার টুংটাং শব্দে পরিবেশ যেনো অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে।
বিকাল দিকে রাস্তায় প্রচন্ড ভীড় লেগে থাকে।অফিস,গার্মেন্টস ছুটি হওয়ায় ব্যস্ত সড়ক পথ যেনো আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সূর্য তার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে প্রলীন করছে গোধূলির মায়ায়।
রাস্তায় এধার ওধার পরিপূর্ণ মানুষে।সংকীর্ণ রাস্তায় ঠিকমতো দাঁড়ানো যায় না।তাও অনেক কষ্টে জনমানব ঠেলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজরাহান।
আজ প্রহর এর অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল এক্সামের শেষ বিষয় ছিলো।অনেক কষ্টে কলেজের গেইট দিয়ে বের হয় প্রহর।বের হতেই দেখে আজরাহান গেইট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।প্রহর এর হাত ধরে টেনে ভীড় থেকে বের করে।ঘামে ভিজে চুপচুপ প্রহর।ওকে কোণে নিয়ে দাঁড় করায় আজরাহান।পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে প্রহর এর কপাল,গাল মুছে দেয়।প্রহর হেসে হেসে বললো—
“আপনি এলেন যে!ছোট আব্বু কোথায়?
আজরাহান এইবার টিস্যু দিয়ে প্রহর এর গলা মুছতে থাকে।গম্ভীর গলায় বললো—
“আজ তোর সনোগ্রাফি করাবো।তাই ছুটি নিয়ে এলাম।”
প্রহর সহজ গলায় বললো–
“আচ্ছা,তাই বলেন।বাবুর জন্য এসেছেন।আজকাল তো আমার জন্য আপনার সময়ই হয় না।”
আজরাহান বিগলিত গলায় বললো–
“তুই জানিস আমাকে অফিসে ব্যস্ত থাকতে হয়।এখন কথা বাড়াস না চল।এমনিতেও রাত হয়ে আসছে।এই অবস্থায় বাইরে থাকা ভালো নয়।”
প্রহর খলখলিয়ে হেসে উঠে।ফিকে গলায় বললো—
“আপনি আবার এইসব কবে থেকে মানেন!
“যেদিন থেকে তুই মা হতে চলেছিস সেদিন থেকে।চল এখন।”
প্রহর আবার হাসে।খিলখিলিয়ে হাসে।
,
,
,
বেডে শুয়ে আছে প্রহর।সনোগ্রাফি মেশিনে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে প্রহর এর অভ্যন্তরে বেড়ে উঠা অস্তিত্ব।উচ্ছ্বসিত গলায় প্রহর প্রশ্ন করলো—
“কেমন আছে বাবু আনটি?
গাইনোকোলজিস্ট মেহের নন্দিতার মায়ের বান্ধবী।তাই প্রহর তাকে আনটি বলেই ডাকে।মেহের স্মিত হেসে বললেন—
“বাবু নয় বাবুরা বলো প্রহর।”
প্রহর উৎসুক গলায় বললো–
“মানে!
“তুমি টুইন্স কনসিভ করেছো।”
প্রহর এর প্রাণ ভরে আসে।ঝুমঝুমিয়ে বললো—
“সত্যি!
“হুম।”
ধুম করে উঠে বসে প্রহর।মেহের বিতৃষ্ণা গলায় বললেন—
” আরে আরে মেয়ে করছো কী!
প্রহর ব্যস্ত গলায় অনুনয় করে বললো—
“আপনি রাহান ভাইয়া কে ডাকেন প্লিজ।প্লিজ আনটি প্লিজ।”
মেহের অবাক হয় না।প্রহর এর উচ্ছলিত স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত।সেই প্রথম যেদিন চেকাপ করতে আসে সেদিন থেকেই প্রহর এর বাচ্চাপনায় রিতীমতো মুগ্ধ মেহের।সবকিছুতেই সাবলীল সে।বাধ্য হয়ে আজরাহান কে ভেতরে আসতে বলে মেহের।আজরাহান কে দেখেই চোখ দিয়ে ইশারা করে প্রহর।আজরাহান স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।তার দৃষ্টি দেখছে এক অবিশ্বাস্য রচনা।যা ছিলো তার স্বপ্ন আজ তা সত্যি।সনোগ্রাফী মেশিনের স্ক্রিনে ভেসে উঠছে দুটো ফেটারস এর অস্তিত্ব।আজরাহান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
বেড থেকেই দৌঁড়ে গিয়ে আজরাহান কে জড়িয়ে ধরে প্রহর।আজরাহান সলজ্জ চোখে তাকায় মেহের এর দিকে।তিনি মৃদু হেসে প্রশ্রয়ের ইশারা করলেন।আজরাহান আলতো হাতে প্রহর কে নিজের সাথে চেপে ধরে।হালকা গলায় বললো—
“তোকে আমি কথা দিয়েছিলাম লিটেল হার্ট।দেখলি উপর ওয়ালা আমার কথা শুনেছে।”
প্রহর আজরাহান এর বুকে মুখ গুঁজেই অস্পষ্ট গলায় বললো–
“হু।”
মেহের এর কথায় আজরাহান এর বুক থেকে মাথা তোলে প্রহর।
“এখন কিন্তু আর দৌঁড় ঝাঁপ করা যাবে না প্রহর।এখন তোমাকে সাবধানে চলতে হবে।একা নও তুমি।তোমার সাথে আরো দুজন আছে।”
প্রহর মিষ্টি করে হেসে মাথা হেলায়।এক হাতে ওকে ধরে রেখেছে আজরাহান।মাথা উঁচু করে আজরাহান এর দিকে তাকিয়ে নরম গলায় প্রহর বললো—
“আমার খেয়াল রাখবেন না রাহান ভাইয়া?
আজরাহান আলতো করে প্রহর এর কপালে চুমু খেলো।আশ্বস্ত গলায় বললো—
“আমি তোকে আমার জীবন দিয়ে আগলে রাখবো।”
“দেখলে আনটি রাহান ভাইয়া আমাকে কতো ভালোবাসে!তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না আমাকে নিয়ে।বাবুরা আসলে মিষ্টি নিয়ে যেও বুঝলে।”
ঝুমঝুমিয়ে হাসে প্রহর।প্রহর এর স্নিগ্ধ হাসির ধ্বনি বার বার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে আজরাহান কর্ণগহ্বরে।
,
,
,
বাসায় ঢুকেই কুহেলিকা কে জোরসে জড়িয়ে ধরে প্রহর।একগাল হেসে বললো—
“ছোটমা ডক্টর আনটি বলেছে আমার দুটো বাবু হবে।একটা তোমার একটা আমার।”
নন্দিতা ভ্রু কুঁচকে রুষ্ট গলায় বললো—
“এইসব কী ধরনের কথা!
দুটো মানে!তাহলে আমার আর সানায়ার কী হবে!আমরা কাকে কোলে নিবো!
প্রহর ঠোঁট উল্টে বললো–
“তোমরাও নিবে।”
নন্দিতা ঘোর আপত্তি করে বললো—-
“না না।এটাতো না ইনসাফি হলো।দুটো কেন?
চারটা লাগবে।এই নিয়ম মানা যাবে না।কী হলো সানায়া তুমি কিছু বলছো না কেন!
নন্দিতার সাথে তাল মিলিয়ে সানায়াও বললো—
“ঠিক ঠিক।দুটো দিয়ে হবে না।”
প্রহর অনুযোগের গলায় বললো—
“আমি কী জানি।রাহান ভাইয়াকে বলো।”
নন্দিতা গাঢ় হাসলো।ফিচেল গলায় বললো–
” এইটা কী হলো আজরাহান!
একে তো এতো দেরি করে খুশির খবর শোনালে।তার উপর অর্ধেক!এইটা কোথাকার ন্যায়!চারটা নাহলে তো আমি একদম ই মানবো না।হাজার হোক বড় মা হিসেবে আমারও একটা খোয়াইশ আছে।
কী হলো মা আপনি কিছু বলছেন না কেন!
আজরাহান লজ্জায় মাথা নিচু করে।লজ্জামিশ্রিত গলায় বললো–
“ভাবি তুমিও না।”
নন্দিতা বিস্মিত গলায় চোখ বড় বড় করে বললো—
“এ বাবা,
আমাদের আজরাহান কারীম আবার লজ্জাও পায়!আল্লাহ কাল সূর্য ঠিক জায়গায় উঠবে তো নাকি ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে খুঁজতে হবে!
আজরাহান আর দাঁড়ায় না।দমদম করে সিড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।
নন্দিতা একগাল হেসে প্রহর কে জড়িয়ে ধরে।আর বললো—
“সব সময় এমন হাসি খুশি থাক।”
সবার মুখে এক অদ্ভুত সুখের ঝলকানি।
,
,
ঘরে এসে কাউচে বসে আছে আজরাহান।মনে হচ্ছে সব কিছু যেনো স্বপ্ন।এই কদিন আগেই ওদের বিয়ে হলো এখন সে বাবা হতে চলেছে।
নয় বছর আগে যখন প্রথম বার আজরাহান প্রহর কে দেখে তখন সে ঋতুমতি হয়েছিলো।এই বাড়িতে আসার পর ধীরে ধীরে বাড়ন্ত বয়সের সাথে প্রহর এর প্রাণোচ্ছল স্বভাবের প্রেমে পড়ে আজরাহান।হয়ে যায় প্রহরিনী তার প্রেয়সী।এরপর অনেক বাঁধা ডিঙিয়ে তার স্ত্রী।এখন সে তার সন্তানের মা হতে চলেছে।আজরাহান এর মনের কোণে বয়ে চলে এক উত্তাল ভালোবাসার ঢেউ।
আগের আজরাহান আর নেই।একজন কর্তব্যনিষ্ঠ ছেলেতে পরিণত হয়েছে সে সাথে একজন দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন স্বামী।আজরাহান প্রথম যেদিন জানতে পারে প্রহর মা হবে সেদিন সারারাত ও ঘুমায়নি।প্রহর এর বুকে মাথা রেখে ওর পেটের উপর হাত দিয়ে শুয়েছিলো।আজরাহান এর মনে হচ্ছিলো সে যেনো তার সন্তানকেই ছুঁয়ে আছে।
আজরাহান এর পাশে এসে বসে প্রহর।আজরাহান এর কাঁধে মাথা রেখে ওর বুকের উপর হাত রাখে প্রহর।আজরাহান স্থির গলায় বললো–
“তোকে না এতো দ্রুত উঠানামা করতে বাড়ন করেছি!
“সরি।”
“আর যেনো না দেখি।
আর এখন থেকে এতো উঠানামা করতে হবে না তোর।কিছু লাগলে ভাবি অথবা সানায়াকে ডেকে বলবি।”
“আচ্ছা।”
প্রহর কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে রইলো আজরাহান এর কাঁধের উপর।ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো–
“রাহান ভাইয়া যদি আমাদের দুটো মেয়ে হয় আপনি তাদের ভালোবাসবেন?
আজরাহান গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো—
“তোকে আমি আগেও বলেছি এই ধরনের লেইম কথা বলতে না।ছেলে মেয়ের মধ্যে তফাৎ করা আমার বাবা মা আমাদের শিক্ষা দেয়নি।আমাদের দুই ভাইয়ের চেয়ে মা বাবা সানায়াকে বেশি ভালোবাসে।সূর্যির জন্মের পর বাবা পুরো এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করেছে।আর তোকে কী কম ভালোবেসেছে তারা!
জরুরি না তোর সাথে যা হয়েছে সবার সাথে তা হবে।আর আমার মেয়েদের সাথে তো একদম ই নয়।”
“বাব্বাহ!
এতো লেকচার দিতে বলিনি আপনাকে।”
প্রহর টুপ করে আজরাহান এর ঠোঁটে চুমু খেয়ে নিলো।আজরাহান চকিতে জিঙ্গেস করলো–
“এইটা কী হলো?
এমনিতে তো আমাকেই জোর করতে হয়।আজ রেড রোজ নিজেই চুমু খেলেন?
“আমার বর কে আমি চুমু খেয়েছি তাতে আপনার কী?
“ম্যাডাম,
বরটা আপনার হলেও ঠোঁট টা আমার।ওইটা সরকারি নয়।”
আজরাহান প্রহর কে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শোয়ায়।ওর গলায় চুমু খেতেই প্রহর বললো–
“এই এই কী করছেন!
এখন এইসব চলবে না বুঝলেন।ডেলিভারির আগ পর্যন্ত নো ইটিশ পিটিশ।”
“মিসেস প্রহরিনী আপনি হয়তো জানেন না চুমু খাওয়ার জন্য ডেলিভারির প্রয়োজন হয় না।ওইটা অন্য কাজে।”
আজরাহান তার অধরপল্লব ডুবায় তার ডিঙি নৌকার অধর সায়রে।